• ২০২২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ
  • " />

     

    হেলসের দ্বিতীয় জীবন: নির্বাসনের দুঃস্বপ্ন থেকে অ্যাডিলেইড রূপকথা

    হেলসের দ্বিতীয় জীবন: নির্বাসনের দুঃস্বপ্ন থেকে অ্যাডিলেইড রূপকথা    

    জস বাটলারের কাছে একটা মেসেজ এলো- আমি কেন দলে নেই, এ ব্যাপারে আমাদের কিছু আলাপ হতে পারে? ২০২২ বিশ্বকাপের স্কোয়াড নির্বাচন শেষ। বাটলার দেখতে পেলেন অ্যালেক্স হেলসের পাঠানো ওই মেসেজ। তাদের আলাপ হলো, হেলসকে বুঝালেন বাটলার, কেন তিনি দলে নেই!

    বাটলারের আগে হেলসের কথা হয়েছিল নির্বাচকের সঙ্গে। ডিরেক্টর অব ক্রিকেট, রব কি, নির্বাচকের ফাঁকা পদের দায়িত্বে। তার কাছে হেলস সরাসরি ফোন দিয়েই জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেন আমি দলে নেই?’ জানতে চাইলেন সেটির কারণ, ক্রিকেটীয় নাকি অন্য কিছু? হেলসের নির্বাচনের ব্যাপারে তার অতীতের কোন ভূমিকা থাকবে না, মিডিয়ায় শোনা কথার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা ছিল হেলসের।

    ২০১৯ বিশ্বকাপের স্কোয়াডে ছিলেন। বিশ্বকাপের মঞ্চে নামার কয়েকদিন আগেই একটা পরীক্ষা দিলেন। সে পরীক্ষায় দ্বিতীয়বারের মতো তার ফল এলো নেতিবাচক। বিনোদনমূলক ড্রাগ নেওয়ার অপরাধের দরুণ, বিশ্বকাপের স্কোয়াড থেকে ছেঁটে ফেলা হলো তার নাম। ইংল্যান্ড জাতীয় দলের দরজা যেন চিরতরেই বন্ধ হয়ে গেল হেলসের জন্য!

    ফ্র‍্যাঞ্চাইজির দুয়ার খুলল একের পর একটা। ফ্র‍্যাঞ্চাইজির আঙ্গিনায় দাপিয়ে বেড়াতে থাকলেন হেলস। রশিদ খান বাদে এই সময়ে তার চেয়ে বেশি টি-টোয়েন্টি খেলতে পারেননি আর কেউই। বিগ ব্যাশ, পিএসএল, সিপিএল, হান্ড্রেড, ভাইটালিটি ব্লাস্ট- সবমিলিয়ে সাড়ে চার হাজারের মতো রান! সেটিও এসেছে ৩২ গড়ে, স্ট্রাইক রেটও ছিল স্বাস্থ্যকর, ১৫৪! মাঝের এই সময়ে ইংল্যান্ডের প্রথম কোন ব্যাটার হলেন, যার টি-টোয়েন্টিতে দশ হাজার রান আছে। 

    লাল বলের ক্রিকেট ছেড়ে দিয়েছিলেন একেবারেই, টি-টোয়েন্টির ব্যাটিং শাণিত করার উদ্দেশ্যে। সেটির ফলও পাচ্ছিলেন, এই সময়টাকেই তিনি টি-টোয়েন্টি ব্যাটার হিসেবে তার 'সেরা' মানেন। কিন্ত জাতীয় দল যে তার থেকে মুখ ফিরিয়েই নিয়েছিল। আবার ফিরতে পারবেন তো? সেই প্রশ্নটারও উত্তর ধীরে ধীরে খুঁজে নিচ্ছিলেন হেলস। মেনে নিয়েছিলেন, জাতীয় দলে আর সুযোগ পাওয়া হচ্ছে না তার। জীবনের 'সেরা' সময় যখন পার করছেন, তখন কিনা তিনি খেলে যাচ্ছেন ইংল্যান্ডের জার্সি ছাড়া অন্য কোন জার্সিতে! এ ব্যাপারটাই তার হতাশা বাড়িয়ে দিত আরও।

    জাতীয় দলে যেন অলিখিতভাবে নির্বাসিতই হয়ে গিয়েছিলেন হেলস। সেসময় জস বাটলার ও জেসন রয়ের জুটি সফলতার সাথে খেলতে থাকে। ইংল্যান্ডের প্রতিভার ছড়াছড়িতে তাই রানের ফোয়ারা ছোটালেও, হেলসের ফেরার ব্যাপারে তা কোন আলোচনার জন্ম দিতে পারেনি। কিন্ত ২০২২ বিশ্বকাপের আগে আগে জেসন রয়ের কাটে দুর্বিষহ সময়, ঘরের মাঠে দুই সিরিজে ৬ ম্যাচে করেন ৭৬ রান। পরে হান্ড্রেডেও তার দুর্দিন কাটেনি।

    এদিকে হেলসের ফর্মের স্রোত সমানতালে এগিয়ে চলছিল। হান্ড্রেডে ২৫৯ রান করেন দেড়শোর বেশি স্ট্রাইক রেটে। ইংল্যান্ড স্কোয়াডে তবু জায়গা না পেয়ে হতাশই হতে হয়েছিল হেলসকে। হতাশ হয়েছিলেন, কারণ তখন হয়তো তার মনের কোণে ফেরার আশার যে বীজ, তা চারা রুপ নিতে চলেছিল। ততদিনে অইন মরগান জাতীয় দলকে শেষ বলে দিয়েছেন। মরগানের সময়েই ওই ড্রাগ টেস্টে ফেল করে বাইরে যেতে হয়েছিল, মরগান আর তাকে ভেতরে আনার কথা ভাবেননি। 

    মরগানের নেতৃত্বে ইংলিশদের সাদা বলের বিপ্লবে অন্যতম সারথি ছিলেন হেলস। ক্যারিয়ারে যে ৭০ ওয়ানডে খেলেছেন, তার মধ্যে ৬১টিই মরগানের অধীনে। ২০১৫ বিশ্বকাপের ভরাডুবির পর ইংলিশ ক্রিকেট যে বিপ্লবের পথে পা দেয়, সেখানে ইংল্যান্ড দলের নিয়মিত সদস্য ছিলেন হেলস। একটি বিশ্বকাপের লক্ষ্যে তাদের এগিয়ে চলায় সাথী ছিলেন হেলসও। কিন্ত বিশ্বকাপের আগেই মাঠের বাইরের এক ঘটনা তাকে সেই ইতিহাসের অংশ হতে দিল না। ইংল্যান্ড বিশ্বকাপ জিতেছে, টিভিতে বসে দেখছেন হেলস, পড়ে গিয়েছিলেন মহা এক দোলাচলে- বিশ্বকাপ জয়ের আনন্দ, ওদিকে সেই আনন্দের অংশীদার হতে না পারার বেদনা। আমারও তো থাকার কথা ছিল বিশ্বজয়ের ওই উৎসবে, হেলসকে ভেতরে ভেতরে পুড়িয়ে মারে এই আক্ষেপ।  

    ক্যারিয়ারে অনেকবারই নেতিবাচক খবরের শিরোনাম হয়েছেন। ২০১৭ সালে তো একবার ব্রিস্টলের এক পানশালার বাইরে মারামারিতে জড়িয়ে গিয়েছিলেন, পেয়েছিলেন নিষেধাজ্ঞা। বর্ণবাদের অভিযোগও উঠেছিল তার বিরুদ্ধে। ইংলিশদের মধ্যে সবার আগে টি-টোয়েন্টিতে সেঞ্চুরি করেছিলেন সেই হেলসই! ২০১১ সালে টি-টোয়েন্টিতে অভিষেকের পর তিনটি বিশ্বকাপে খেলেছেন। জীবনের সেরা ফর্মে থেকেও আরেকটিতে খেলতে পারবেন কিনা, জানা ছিল না তার! ক্যারিয়ার শেষের অধ্যায়ে তাহলে লেখা থাকবে একটি নেতিবাচক খবরেরই গল্প? 

    অস্ট্রেলিয়া বিশ্বকাপের প্রস্ততির যাত্রায় অনেকটুকু পাড়ি দেওয়ার পর হুট করে অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেন মরগান। এবছরের জুনে নতুন অধিনায়ক হন জস বাটলার। বিশ্বকাপে জেসন রয়কে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতে হয় ইংল্যান্ড টিম ম্যানেজমেন্টকে। কিন্ত তার জায়গায় যাকে টপ অর্ডারের সেরা বিকল্প মনে হলো তাদের, তিনি হেলস নন। ওপেনিং নিয়ে ইংল্যান্ডের ভাবনা ছিল অন্যরকম- জস বাটলারের সঙ্গী হবেন জনি বেইরস্টো, টি-টোয়েন্টিতে যার সেরা পজিশন ওপেনিং। হতাশ হেলস এরপরই আসলে জানতে চেয়েছিলেন নির্বাচক রব কি, অধিনায়ক জস বাটলারের কাছে- আমি কেন দলে নেই?

    ছুটি কাটানোর বন্দোবস্ত করে ফেলেছিলেন হেলস। দক্ষিণ আফ্রিকায় ছুটি কাটাতে চলে যান, ওমন সময়ে একটা খবর এলো। জনি বেইরস্টো গলফ খেলতে গিয়ে ইনজুরিতে পড়ে গেছেন, বিশ্বকাপ থেকেই ছিটকে গেছেন তিনি। বিধির কি খেল, এবার হেলসকেই ডেকে নিল ইংল্যান্ড। সেই ডাকটা এত সহজ-সরল ছিল না! হেলসের টি-টোয়েন্টি ফর্মে কারো তার নির্বাচন নিয়ে আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্ত ক্রিকেটারের সাথে নির্বাচনটা যে ‘মানুষ’ হেলসেরও! রব কি নাকি প্রত্যেক সদস্যের কাছ থেকেই জেনে নিয়েছিলেন, দলে হেলসকে আনলে তাদের কোন সমস্যা আছে কি না। বাটলারও সিনিয়র সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হলেন, কারো কোন আপত্তি আছে কি না! 

    হেলস ফিরলেন জাতীয় দলে, তিন বছরের নির্বাসন কাটিয়ে। বিরক্তিকর, বেদনাদায়ক সময়, দুঃস্বপ্ন পেরিয়ে। যেন দ্বিতীয় জীবন পেলেন। বিশ্বকাপের আগে আগে পাকিস্তান সফরে সুযোগ পেলেন। সেখানে খুব ভালো কিছু করেননি, ছয় ম্যাচে ২১ গড়ে ১৩০ রান। কিন্ত তার জন্য স্বস্তির বিষয়- তখন দলের আস্থা, বিশ্বাস ছিল তার উপর। প্রথমে ডাকা স্কোয়াডে ছিলেন ফিল সল্ট, ব্যাকআপ ওপেনার হিসেবে থাকা সল্টকে বেইরস্টোর জায়গায় ভাবতে পারত ইংল্যান্ড। কিন্ত টি-টোয়েন্টিতে রানের বন্যা ছুটিয়ে, এরপর বিশ্বকাপ যেখানে, সেই অস্ট্রেলিয়ায় অভিজ্ঞতার সাথে রানের ঝুলি সমৃদ্ধ বলে এগিয়ে থাকেন হেলস। 

    'নির্বাসিত' সময়ে বিগ ব্যাশে খেলেছিলেন তিন মৌসুম। ওই সময়ে অস্ট্রেলিয়ার লিগে তার চেয়ে বেশি রান করেননি আর কেউই। ৪৫ ম্যাচে ৩৬ গড়ে করেছেন ১৫০২ রান, সেটিও আবার ১৫২ স্ট্রাইক রেটে! হেলসের উপরই তাই পূর্ণ বিশ্বাস রাখে ইংল্যান্ড। অস্ট্রেলিয়ায় সফল হবেন, সেই আশা জোরদার করলেন অস্ট্রেলিয়া সফরে গিয়েই। অজিদের বিপক্ষে সিরিজে ৮৪ রানের এক ইনিংস খেলেন। কিন্ত বিশ্বকাপে প্রথম দুই ম্যাচে নিরাশই হতে হয় ইংল্যান্ডকে। 

    আফগানিস্তানের বিপক্ষে ১৯ রানের পর আয়ারল্যান্ডের সাথে ৫ বলে ৭। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে পরের ম্যাচ বৃষ্টিতে ভেসে যায়, ইংল্যান্ডের জন্য বাকি ম্যাচগুলো তাই 'জিততেই হবে' রুপ নিয়েছিল। আর ওসব ম্যাচেই হেলস তার হিটিং পাওয়ার দেখিয়ে বুঝালেন, তিনি যেমন কতকিছু মিস করেছেন, সেই সাথে কত কি মিস করেছে ইংল্যান্ডও!

    নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৫২ রানের ইনিংস খেলার পর শ্রীলংকার সাথে ৪৭। এরপর সেমি-ফাইনালের বড়মঞ্চে এসেই উপহার দিলেন বড় ইনিংস। ৪৭ বলে ৮৬ রানের ইনিংসে ভারতকে হতভম্ব করে দেওয়ার পর ম্যান অব দ্যা ম্যাচ নিতে এলেন। প্রথম কথাটাই ছিল, কখনো ভাবিনি আবার বিশ্বকাপ খেলতে পারব! 

    হেলস, আপনি এখন বিশ্বকাপ জেতাতেও পারেন!