• ফিফা বিশ্বকাপ ২০২২
  • " />

     

    যেসব জায়গায় বাজিমাত করে বিশ্বজয়ের হাসি হাসল আর্জেন্টিনা

    যেসব জায়গায় বাজিমাত করে বিশ্বজয়ের হাসি হাসল আর্জেন্টিনা    

    ঘুম থেকে উঠলেও আপনার মাথায় নিশ্চয় ঘুরঘুর করছে গতকালের ফাইনালের কথা। লিওনেল মেসি তার সতীর্থদের সাথে এখনও আনন্দে নিশ্চয়ই উত্তাল, এই দূর দুরান্তে বসে আপনিও তার ভক্ত হয়ে থাকলে তার সাথে আনন্দে শামিল হতে পারেন। সেই আনন্দে শামিল হওয়ার পাশপাশি গতকাল আবেগের বসে যার অনেক কিছুই ভাবতে পারেননি সেটাও ভাবতে পারেন নতুন করে। স্কোরলাইন বলছে ফ্রান্স, আর্জেন্টিনা লড়েছে শেয়ানে শেয়ানে। সত্যিই তাই, তবে ম্যাচের বড় একটা অংশ ধরেই ফ্রান্স পাত্তাও পায়নি আর্জেন্টিনার কাছে। প্রথমার্ধের সেই দাপট, টাইব্রেকারের জন্য সুদূরপ্রসারী বিকল্প পরিকল্পনা, সমতায় ভড়কিয়ে না গিয়ে শুটআউট বিশেষজ্ঞদের নামানোর জন্য শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করা - আর্জেন্টিনার পরিকল্পনায় জয়ের ছাপটাও ছিল স্পষ্ট। কোন কোন জায়গায় আর্জেন্টিনা ফ্রান্সকে কাবু করে হেসেছে শেষ হাসি সেটাই পেছন ফিরে দেখা যাক।


    ম্যাজিকম্যানের জাদুর বাক্স

    আর্জেন্টিনার অপেক্ষার অবসানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে আর্জেন্টাইন ফুটবলের পথ প্রদর্শক - এই কথাটা তো আপনাদের মজ্জাগত ছিল অনেক আগে থেকেই। ফুটবলকে তো জাদুকর হতাশ করবেন না। পুরো আসরের মতই ফাইনালেও মেসি জ্বলে উঠলেন। দলকে এগিয়ে দিলেন পেনাল্টি গোলে। দলের দ্বিতীয় গোলটা যে এল দুর্দান্ত এক প্রতি-আক্রমণ থেকে সেই প্রতি-আক্রমণের মধ্যমণি ওই মেসি। পিছে আঠার মত লেগে থাকা ডিফেন্ডারের চাপ সামলে ডানে যেই পাস ছাড়লেন মলিনার উদ্দেশ্যে সেখান থেকেই ফাঁক হয়ে গেল ফ্রান্সের রক্ষণ। মেসিকে মাঝমাঠে আটকানোর চেষ্টা করেও তার পদাচারণায় যারপরনাই পথভ্রষ্ট ফ্রেঞ্চ মিডফিল্ড। ফ্রান্সের সমতাসূচক গোলের পর মেসি দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিতে চাইলে সেটা আঁচ করতে পেরে মাঠে নামা কামাভিঙ্গা তার ক্লাব সতীর্থ চুয়ামেনির সাথে জুটি বেঁধে সাময়িকভাবে নিশ্চুপ রেখেছিলেন মেসিকে। তবে অতিরিক্ত সময়ে ফ্রান্সের রক্ষণে চিড় ধরতে আবারও ঠিকই সুযোগ বুঝে নিয়েছিলেন মেসি। লতারোর শট লরিস প্রতিহত করলেও সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় থেকে মেসি ঠিকই দলের তৃতীয় ও নিজের দ্বিতীয় গোল পেয়েছিলেন। টাইব্রেকারেও প্রথম পেনাল্টি নিতে এসে কোনও ধরনের চাপের তোয়াক্কা না করে যেভাবে লরিসকে ধোঁকা দিয়ে বল জালে জড়িয়েছিলেন সেটাই যেন আর্জেন্টাইনদের বলে দিয়েছিল, আজ তাদেরই দিন।

    মাঝমাঠের ত্রয়ীর দুর্গ

    আর্জেন্টিনা প্রথমার্ধে যে রীতিমত খাবি খাইয়েছিল ফ্রান্সকে সেটার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব এনজো ফার্নান্দেজ, রদ্রিগো ডি পল ও অ্যালেক্সিস ম্যাক অ্যালিস্টারের সমন্বয়ে গড়া মিডফিল্ড ত্রয়ীতে। এদিন ৪-৪-২ ফর্মেশনে খেলায় সাথে আনহেল ডি মারিয়া থাকলেও রক্ষণের সময়ে মুলত ৫-৩-২ আকারে বল জেতার চেষ্টা করেছে আর্জেন্টিনা যেটার কেন্দ্রতে ছিল এই তিনজন। তিন জনের এই ত্রিভুজ ভেদ করে পাসিং লাইন খুঁজে পেতে খাবি খেয়েছেন গ্রিজমান, চুয়ামেনি। সেই সাথে এমবাপেকে তারা যেভাবে মলিনার সাথে জুটি বেঁধে আটকিয়ে রেখেছিলেন সেখানেই ফ্রান্স আরও ভড়কে গিয়েছিল। এমবাপের পায়ে বল যাওয়ার আগে তার পেছনে এই দুই মিডফিল্ডারের দুজন ও সামনে মলিনা অঞ্চল ভিত্তিক মার্কিংয়ে ছিলেন সদা প্রস্তুত। এমবাপেকে বল ছাড়ার আগেই বারবার তাই ফ্রান্সকে অন্য উইংয়ে বল ছাড়ার সুযোগ খুঁজতে হয়েছে অথবা পেছনে পাস ছাড়তে হয়েছে, যেটার সুযোগ নিয়ে তাদের কাছ থেকে বেশ কয়েকবার বল কেড়ে নিয়েছে আর্জেন্টিনার মিডফিল্ড। আর যদিও বা এমবাপের পায়ে বল এসেছিল তাকে এই ত্রিভুজের মাঝে বেঁধে তার গতিময়তা নিষ্ক্রিয় করে ফেলা হয়েছিল। তবে এমবাপেকে আর কতক্ষণ বা আটকিয়ে রাখা যায়! খুনের ঘ্রাণ পেয়ে শিকারি বাঘের মত এমবাপে ঠিকই শিকার করেছেন। সেটার পরেও আক্রমণে নিজেদের আকার ধরে রেখেছিল আর্জেন্টিনার মিডফিল্ড, যেখানে আলাদা করে ম্যাক অ্যালিস্টারের কথা বলতেই হয়। রক্ষণ, আক্রমণ দুই জায়গায়ই তিনি এদিন ছিলেন দুর্দান্ত।

    আকাশী নীল বাজপাখি

    এমবাপের প্রথম দুই গোল খাওয়া নিয়ে এমি নিজেই ছিলেন চরম বিরক্ত। সেখান থেকেই যেন নিজেকে দুঘা কষিয়ে নিজেকে জাগিয়ে তুলেছেন এমি। অতিরিক্ত সময়ে  এমবাপের সমতা সূচক গোলের পর একদম শেষ মিনিটে বক্সের ডান প্রান্তে ফাঁকায় বল পেয়ে গিয়েছিলেন রন্ডাল কোলো মুয়ানি। আগুয়ান এমি শরীর বাড়িয়ে তখনই তার মাথার ওপর দিয়ে বল তুলে দেওয়ার সুযোগ বানচাল করে দেন। তবে কোলো মুয়ানি মাথা ঠাণ্ডা রেখে যথাসম্ভব সেরা পথেই হেঁটেছিলেন, কাছের পোস্টে মাটি কামড়ানো শটে বল জালে জড়াতে চেয়েছিলেন। সেখান থেকেই এমি যা করলেন তা হয়তো বিশ্বকাপ ফাইনালের ইতিহাসের অন্যতম সেরা মুহূর্ত হিসেবে অনেকের মনে দাগ কেটে গিয়েছে। পুরো পা প্রশস্ত করে যেভাবে শটটা ঠেকালেন সেটার আত্মবিশ্বাস থেকেই যেন অপ্রতিরোধ্য হয়ে গেলেন। এরপর তো কোমানের পেনাল্টি আটকিয়ে, চুয়ামেনিকে ভড়কে দিয়ে আর্জেন্টিনার রূপকথার অন্যতম নায়ক বনেই গেলেন এমি।

    স্কালোনির ৪-৪-২ বাজি

    দেশম তার প্রতিটা বদলি খেলোয়াড় দিয়ে আর্জেন্টিনার স্বপ্ন প্রায় নস্যাৎ করেই ফেলেছিলেন। তবে দেশমকে যে বিকল্প পথে হাঁটতে হয়েছিল তড়িঘড়ি সেটার জন্য স্কালোনির ধূর্ত পরিকল্পনাকে সাধুবাদ জানাতেই হবে। ফ্রান্সের দুই উইং ফরওয়ার্ডের গতিকে নিষ্ক্রিয় করার বিকল্প ছিল না। সেটার জন্য অনেকেই ভেবেছিলেন আর্জেন্টিনা তিন সেন্টার ব্যাক খেলাবে, ভাবেননি স্কালোনি। কেন ভাবেননি সেটাও তার শিষ্যরা মাঠে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। প্রথমার্ধে আর ম্যাচের অধিকাংশ সময় ধরে দুই উইংয়ে গতির কোনও ব্যবহার করতেই পারেনি ফ্রান্স। তার কারণ দুই ফুল ব্যাকের খুব একটা উপরে না উঠে মাঝমাঠে প্রেস করানোর পরিকল্পনা। সেই সাথে ৪ জনের মিডফিল্ড নামানোয় দুই প্রান্তে দুই মিডফিল্ডার ও এক ফুল ব্যাকের সমন্বয়ে ত্রিভুজ তৈরি করায় একেবারেই গতির সুবিধা নিতে পারেনি ফ্রান্স, এমনকি উইংয়ে পাস খেলাতেও দুই বার করে ভাবতে হয়েছে তাদের।