• ফিফা বিশ্বকাপ ২০২২
  • " />

     

    তবু অনন্ত জাগে...

    তবু অনন্ত জাগে...    

    কলোনির মাঠে বিকেলে ফুটবল নিয়ে মাঠে নামা না গেলে জীবনের আর অর্থ কী? ফলে, আবেগী দর্শক আর আনাড়ি ফেসবুকার হিসেবে নয়, তখন তুমি নিজেই টেড লাসো সিরিয়ালের ‘দানি রোহা’, যার কাছে Football is life।

    ১৯৯৮ এর রহস্যময় ফাইনালে রোনালদোকে চেনাই গেলো না, কিন্তু- ব্রাজিল ফ্যান নয়- ফুটবলের ফ্যান হিসেবেই চোখে লেগে থাকলো বার্গক্যাম্পের তিন টাচের যাদুতে আর্জেন্টিনার বিদায়। সিআইএ তখনো অপেক্ষা করে যাচ্ছে, অচিরেই ফিদেল ক্যাস্ট্রোর পতন ঘটবে। তোমার অপেক্ষা তখনো শুরুই হয়নি।

    ২০০২। রোনালদো, রিভালদোর কথা বাদ; দিন-দুপুরের বিশ্বকাপে তখন রোনালদিনিয়ো ছিলেন। ফলে আংটিতে চুমু খাওয়া লর্ড অফ দা রিংস দক্ষিণ কোরিয়ার আন জুং হোয়ান বাদ, চোখে থাকে ওই ঝাঁকড়া চুলে ঢেকে যাওয়া ফ্রি-কিক। তুমি ব্রাজিল ফ্যান, তখনো তোমাকে অপেক্ষা করতে হয় না। কিন্তু, যেমন জানে গ্যালিয়ানো, সিআইএ তখনো অপেক্ষা করে যাচ্ছে, অচিরেই ফিদেল ক্যাস্ট্রোর পতন ঘটবে কিউবায়, এই তো- আর মাত্র কয়েক ঘন্টার মামলা।

    কিন্তু ফুটবল ওদের চাইতে উদার। রোনালদিনিয়োর পথ ধরে তুমি ব্রাজিল ফ্যান তাই ক্লাব ফুটবলে চলে এলে বার্সেলোনায়- খোঁজ খবর রাখার শুরু। এখানেই আসছে চিরশত্রু আর্জেন্টিনার নতুন ম্যারাডোনা? মেসি যার নাম? হতে পারে। সেই মেসি বেঞ্চ থেকে নামলো বিশ্বকাপের মাঠে। আর্জেন্টিনা দেখালো সার্বিয়া-মন্তেনিগ্রোর সাথে সুন্দরতম ফুটবল, আর ব্রাজিল বাদ গেলো জিদানের একার যাদুতে। তোমার অপেক্ষার শুরু তাই, বলতে পারো ২০০৬ থেকে। আর সিআইএ তখনো অপেক্ষা করে যাচ্ছে, অচিরেই ফিদেল ক্যাস্ট্রোর পতন ঘটবে কিউবায়, এই তো- আর মাত্র কয়েক ঘন্টার মামলা।

    কিন্তু রাজনীতি যা পারে না, শিল্প আর গল্প, করতে পারে সেটাই। আর ফুটবলের চেয়ে বড় গল্প কোথায় পাওয়া যাবে?

    রাত জাগা ফুটবল তোমাকে জানায়, সেরা খেলাটা কেবল একটা দলের থাকে না কখনো। ব্রাজিলের রোনালদিনিয়ো বাদেও তাই, মেসি সত্যিই ভালো খেলে। তুমি জানো যে ইনিয়েস্তা একটা জিনিস আর ক্রিশ্চিয়ানো একটা মাল, তোমার জানা হয় যে এমনকি শোয়েনস্টাইগারের হাতে গেলেও বিশ্বকাপ তোমার খারাপ লাগবে না। ব্রাজিল হারার মতোই মন খারাপ হয় মেসি হেরে গেলে। আর এতো জানার ভীড়ে আবিষ্কার করা যায়- উন্মাদ ম্যারাডোনাকে ডাগয়াউটে রেখে জার্মানরা যে একটা স্টিম রোলার চালিয়ে গেলো ২০১০ এর মেসির ওপর, তাতে তোমার ভালোই মন খারাপ হয়। ব্রাজিল হারার মতোই যেন। অথচ রাতের পর রাত ছোটোখাটো ওই মানুষটাকে বল নিয়ে যা করতে দেখেছো, তাতে করে ওকে কিছু একটা জিততে দেখাটা খুব দরকার। দুনিয়ার সবচেয়ে বিখ্যাত স্বর্ণখণ্ডটা মেসির হাতে উঠুক, এই ইচ্ছার জন্ম তাই তখন থেকেই। ব্রাজিলের জন্য অপেক্ষা আরেকটু বাড়ে অবশ্য। আর ওদিকে প্রিন্স চার্লস অপেক্ষা করছে, এবার হয়তো সিংহাসনে বসা হবে তার।

    অথচ ২০১৪ এমনভাবে সিংহাসনে তোলে জার্মানদের, গোটা লাতিন আমেরিকা সেটা ভুলতে চাইবে চিরদিনের মতো। ফুটবল কতটা হৃদয় ভাঙে, সেই সত্য তার চাইতে স্পষ্ট করে জানেনি কেউ আগে। গ্যালারির সেই গোঁফওয়ালা বুড়োর জন্য চোখের জল যদি বা গোপন করা যায়, বিশ্বকাপের হাত ছোঁয়া দূরত্ব থেকে মেসির ছবিটা মানা যায় না কিছুতেই। ম্যারাডোনাকে ছাপিয়ে গিয়ে সর্বকালের সেরা হবার সবকিছুই মেসি করে ফেলেছে, তা তুমি জানো ততদিনে। কিন্তু তবুও, তবুও কোথাও যেন অবিরাম কামড়ায় হিগুয়েন আর পালাসিওর ওই মিস। Football is life, and football is death too। ব্রাজিল সমর্থনের ওপরে গিয়ে এই প্রথম তোমার মনে হয়, আমরা মরিনি আজও, কিন্তু মরে গেছে লাতিন আমেরিকার ফুটবল। এমনকি মেসির পায়েও তাই বিশ্বকাপ আর কখনো আসবে না আমাজন অববাহিকায়। তোমার অপেক্ষা আরো বাড়বে, যেমন প্রিন্স চার্লস ওদিকে অপেক্ষা করছে, এবার সত্যিই সিংহাসনে বসা হবে তার, আর অল্প কয়েকটা মাস।

    কিন্তু প্রিন্স চার্লসের চেয়েও দীর্ঘতর হয়ে ওঠে মেসির অপেক্ষা। গোল স্কোরিং-এর যাবতীয় রেকর্ডকে হেলায় উড়িয়ে তার সকল আশা গিয়ে মাথা কুটে মরে আর্জেন্টিনার জন্য একটিমাত্র শিরোপা চেয়ে। আর কোপা আমেরিকার মাঠে, সেই আশাকে সে নিজেই ছুঁড়ে ফেলে দেয় রুপকথার সেই চরিত্রের মতো- মৃত মায়ের ডাক শুনে যার পেছনে তাকানো নিষেধ ছিলো। মেসি তাই অবসর নিলো। তোমাদের অপেক্ষা ফুরোলো না।

    মেসি ফিরেও এলো আবার, ধুঁকতে থাকা আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ বাছাই পার করাতে। সাথে এলো ২০১৮। রাশিয়া তখন দু’হাত ভরে দিলো ফুটবলকে, কিন্তু তোমাকে নয়। তিতের ব্রাজিল দারুণ খেলেছে, কিন্তু তাদের হারায় ততটা খারাপ একদম লাগে না যতটা লাগে মেসি একটা দুর্বল দল নিয়ে হেরে গেলে। এই খারাপ লাগার কারণ ততদিনে তোমার জানা। তুমি জেনে গেছো তৃতীয় বিশ্বের একটা দেশের মানুষ হিসেবে কতটা অপাংক্তেয় তুমি, ফকিরনির বাচ্চা হিসেবে পৃথিবীতে তোমার আর কিছু নেই, গল্প ছাড়া। আর মেসির চাইতে ভালো গল্প তোমার প্রজন্মের কাছে নেই। মেসি সেই গল্পটা, যেটার উত্তরসুরী তুমি রেখে দিতে চাও। কিন্তু জীবন সিনেমা নয় যেহেতু, মেসিকে তাই তুমি ধরে নাও আধুনিক ফুটবলের আরেকটা ট্রাজিক ঘটনা হিসেবেই। Everybody knows the war is over; Everybody knows, the good guys lost.

    তারপর সূর্যের নিচে চলে আসে মহামারি। আফগানিস্তান ছেড়ে যায় মার্কিনরা। মেসি চলে যায় পিএসজিতে। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোকেও ছোবল মারে বয়স। মৃত্যু হয় ফুটবল ঈশ্বরের। প্রিন্স চার্লস বসে পৃথিবীর সিংহাসনে। যা যা তোমরা পাওনি জীবনে, তোমাদের যেখানে যেখানে অপমান- তার জবাব দিতে টিভিসেটের সামনে তোমরাও আর নায়ক খোঁজো না। তোমরা জানো অলৌকিকের কোনো জায়গা নেই এই দুনিয়ায়, পৃথিবীতে সব কিছুই অংক কষেই ঘটে।

    তবুও, খেলার আফিমে চারপাশের সমস্ত ফাউল আর স্থানীয় ফিফার দুর্নীতি ভুলে যায় এদেশের মানুষ- সেই অমোঘ সত্য জেনেও, তুমি আরেকবার বসে যাও টিভির সামনে। তুমি টিভির সামনে বসে যাও, কারণ টেড লাসো বলেছে ‘Believe’.

    আর টিভির সামনে বসে তুমি বুঝতে পারো, এখন আর দল নেই কোনো, আছে শুধু অনেক স্মৃতির জার্সি পরা একটা ছোট্ট মানুষ। কার্বন আর সিলিকনের দ্বি-মৌল যৌগের ভেতরের ব্যাখাতীত কোনো আবেগে, তুমি সেই মানুষটার মাঝ দিয়ে দেখতে চাও কোনো ইচ্ছাপূরণের সিনেমা। তুমি অপেক্ষা করো। ১৬ বছরের অপেক্ষা। কারো কাছে ৩৬ বছরের।

    তারপর লেওয়ানডস্কি পেনাল্টি মিস করে, তুমি শ্বাস চেপে ধরো ঢাকায়, কারণ গাধার বাচ্চারা প্রথম ম্যাচেই হেরে বসেছে। তুমি অপেক্ষা করো তবু, আর একটা পুরোনো ঝলক উড়িয়ে দেয় মেক্সিকোর প্রাচীর ওকোচাকে। তারপর ম্যাকএলিস্টার আর ডি পল আসে, তুমি অপেক্ষা করো। তারপর ঝোড়ো হাওয়ার মাঝেও অস্ট্রেলিয়ায় মিলে যায় সাময়িক সুখ। তারপর নেদারল্যান্ডস আসে, আর preposterous in Imagination, perfect in Execution মার্কা এক থ্রু-বল আর এমি মার্টিনেজের হাতে সেটাকেও টপকে যাওয়া যায়। তারপর আলভারেজে ভর করে থামানো যায় ক্রোয়াশিয়াকেও, তুমি ফিরে পাও সেই ছোট্ট গুটিগুটি পায়ের ছোট্ট দৌড়টাকে, যা দেখতে গত ১৬ বছর বহু একাকী রাত জাগা। আর তারপর?

    তারপর ১২০ মিনিট শেষে অর্ধেক মানবজাতি নিবিড় করে চায় একটাই ফলাফল। আর সেই মানুষটা- মেসির জন্য জীবন দিতে পারে বলে যে দাবি করেছিলো, সেই মার্টিনেজের হাতের তালু হয়ে ওঠে চওড়া। লুসাইল সবাইকে জানিয়ে দেয়, প্রাচীন এই পৃথিবীতে এখনো কাজ করে প্রার্থনা। আইসিস, রাশিয়া যুদ্ধ আর মোদিজী ভরপুর এই দুনিয়াটা তখন হয়ে যায় লিওনেল মেসির।

    ... লিখতে লিখতে ভাবি, এই লেখা কি মেসির জন্য? নাকি কেবল নিজের কথাই বলে গেলাম ডোপামিন আসক্ত কন্টেন্ট-নির্ভর এই প্রজন্মের হয়ে? হয়তো তাই।

    তবু, Fever pitch সিনেমার সেই আর্সেনাল ফ্যানের মতোই অনুভব করি, লিওনেল মেসি তো উপলক্ষ শুধু, আসলে ফুটবলের সাথে জীবনের একটা চক্র পূরণ হলো আজ। আমাদের সঙ্গী আজ প্রেশারের ওষুধ, আমাদের দিন বন্দী এক্সেল শিটের সংখ্যায়, রাতজাগা এখন আমাদের কাছে আর রহস্যময় হয়ে ওঠে না প্রথম প্রেমে। তবু আমরা কাল রাতে জেনেছি যে ফুটবলের মতোই জীবনেরও সেকেন্ড হাফ আছে। প্রথমার্ধে সব হারিয়েও সেকেন্ড হাফে তা বহুগুণে ফিরে পাওয়া যায় বহুগুণে।

    আমরা, যারা দীর্ঘ শীতরাত্রিতেও ফুটবলরে বেসেছি ভালো; তারা জানি, টাইব্রেকার নিতে এগিয়ে যাওয়া একাকী কোনো ফুটবলারের মতোই, পৃথিবীর সব ধ্বনি-সব রঙ এখন আর স্পর্শ করছে না আমাদের। ঝোড়ো হাওয়া আর পোড়ো বাড়িটার দরজা কে যেন মিলিয়ে দিয়েছে, সত্য হয়ে আছে শুধু সবুজ ঘাসের মতো একটা প্রশান্তি। Football is life, আর নব্বই মিনিটের সেই অনন্ত জীবনকে মুছে ফেলার সাধ্য মৃত্যু ছাড়া আর কিছুর নাই।