• সিরি আ
  • " />

     

    ক্লাব কিংবদন্তিদের বিক্রি, মালিকের দূরদর্শিতা: যেভাবে প্রায় দেউলিয়া থেকে ঘুরে দাঁড়াল নাপোলি

    ক্লাব কিংবদন্তিদের বিক্রি, মালিকের দূরদর্শিতা: যেভাবে প্রায় দেউলিয়া থেকে ঘুরে দাঁড়াল নাপোলি    

    এই মুহূর্তে ইউরোপের শীর্ষ পাঁচ লিগে সবচেয়ে ইনফর্ম দল কোনটি? নাপোলির নামটা শুনে অবাক হবেন না। সিরি আ তে এই লেখা পর্যন্ত তারা এগিয়ে ১৫ পয়েন্টে। সব ঠিকঠাক থাকলে ৩৩ বছর আবার স্কুডেটো (লিগ শিরোপা) জিতবে নাপোলি। ২৩ ম্যাচে ২০ জয়, ৬২ পয়েন্ট। এই ধারায় এগুতে থাকলে মৌসুম শেষে তাদের সংগ্রহ দাঁড়াবে ১০০ পয়েন্টের উপরে। চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ছয় ম্যাচে পাঁচটিতে জেতা নাপোলি স্বপ্ন দেখছে প্রথমবারের মতো শেষ ১৬ পেরোনোর। লুসিয়ানো স্পালেত্তির দলের এই খুনে ফর্মের রহস্য কী? হঠাৎ করে কীভাবে ইতালিয়ান ফুটবলে রাজত্ব শুরু করল এই দল? 

    আসলে এই উত্থান হঠাৎ করে হয়নি। নাপোলির উত্থান বুঝতে হলে আমাদের কিছুটা পিছনে তাকাতে হবে। 

    ইতালির ফুটবল-পাগল শহর নেপলসের ক্লাব নাপোলি। যথেষ্ট সম্ভ্রান্ত ক্লাব হয়েও নাপোলি তাদের ইতিহাসে লিগ শিরোপা জিতেছে মাত্র দুবার, যার সর্বশেষটি এসেছে ১৯৯০ সালে। এবং হ্যাঁ, দুটি শিরোপাই এসেছিল ফুটবল-ঈশ্বর ডিয়েগো ম্যারাডোনার হাত ধরে। ম্যারাডোনা-পরবর্তী সময়ে শীর্ষ স্তরে প্রতিদ্বন্দ্বিতা চালিয়ে গেলেও ২০০৪ সালে এসে দেউলিয়া হয়ে যায় ক্লাবটি। 

    সেখান থেকে ক্লাবকে উদ্ধার করেন প্রখ্যাত ইতালিয়ান ফিল্ম প্রডিউসার, অরেলিও ডি লরেন্টিস। এখনো ক্লাবের মালিকানা তার হাতেই। ডি লরেন্টিস শুধু ক্লাবকে দেউলিয়াপনা থেকেই উদ্ধার করেননি, ক্লাবে যথেষ্ট বিনিয়োগ করে দাঁড় করিয়েছেন টেকসই একটি কাঠামোও। 

    ২০০৪ সালে দেউলিয়া হওয়ার পর তৃতীয় ডিভিশনে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল নাপোলিকে। সেখান থেকে শীর্ষ স্তরে লড়াই ফিরতে ২০১০ নাগাদ লেগে যায় ক্লাবটির। এরপর গত দশকে শিরোপার দিকে চোখ রাখে ন্যাপলসের ক্লাবটি। পর পর দায়িত্বে আসেন চারজন বাঘা ইতালিয়ান কোচ। 

    প্রথমে ওয়াল্টার মাজ্জারি। তার অধীনে ১১-১২ মৌসুমে কোপা ইতালিয়া জেতে নাপোলি। কাভানি-লাভেজ্জি-হামসিকে গড়া আগ্রাসী ফ্রন্টলাইন নিয়ে পরের মৌসুমে লিগ শিরোপার জন্য লড়ে তারা, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরাস্ত হয় জুভেন্টাসের কাছে। 

    জুভেন্টাসের সঙ্গে নাপোলির এই লড়াই চালিয়ে যান পরের ম্যানেজাররাও। রাফা বেনিতেজ তার দুই বছরে একবার কোপা ইতালিয়া জিতিয়েছেন, একবার করেছেন স্কুডেটোর জন্য লড়াই। 

    ২০১৫ সালে ক্লাবের দায়িত্ব নেন মারিজ্জিও সারি। এই বর্ষীয়ানের তিন বছরের দায়িত্বকালে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ফুটবল খেলে নাপোলি। বলের দখল রেখে পাসিং-নির্ভর ‘সারিবল’ সাড়া ফেলে দেয় পুরো ইউরোপজুড়ে। সারির তিন মৌসুমেই স্কুডেটোর  জন্য লড়ে নাপোলি। কুলিবালি-জর্জিনহো-মার্টিনসরা তিনটি মৌসুম শেষ করে যথাক্রমে ৮২, ৮৬ ও ৯১ পয়েন্ট নিয়ে। কিন্তু প্রতিবারই জুভেন্টাসের কাছে হার মানতে বাধ্য হয় তারা। 

    এরপর কার্লো আনচেলত্তি সারির ডিএনএ ধরে রেখে দল গোছালেও তিনিও দলকে দ্বিতীয় স্থানের বেশি উপহার দিতে পারেননি। লুসিয়ানো স্পালেত্তি ক্লাবের দায়িত্ব নেন ২০২১ সালে। তিনি মাজ্জেরি বা সারির মতো একটি নির্দিষ্ট সিস্টেম বা দর্শন বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করেননি। সিংহভাগ ইতালিয়ান কোচের মতোই তার দর্শন হচ্ছে সময়ের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া। তবে সেটা মেথডের বাইরে না। 

    “ফুটবলে এখন সিস্টেম বলতে কিছু নেই। প্রতিপক্ষ কোথায় জায়গা ফাঁকা রাখছে, তার উপরই সব। আপনাকে দ্রুত ফাঁকা জায়গা খুঁজে বের করতে হবে, এবং কখন আক্রমণ করতে হবে তা বুঝতে হবে। আক্রমণ শুরু করার সাহস রাখতে হবে, এমনকি প্রেসিং-এর মুখেও,” নিজের দর্শন নিয়ে লুসিয়ানো স্পালেত্তি। 

    নাপোলির খেলা দেখলে বুঝতে পারবেন, এই দর্শনই প্রয়োগ করছে তারা। তবে স্পালেত্তি একা দলকে এই জায়গায় নিয়ে আসেননি। তার সাথে ছিল একটি দুর্দান্ত সাপোর্ট সিস্টেম। নাপোলির সাম্প্রতিক সাফল্যের পিছনে স্পোর্টিং ডিরেক্টর ক্রিশ্চিয়ানো জিউনতলিকে কৃতিত্ব দিয়েছেন ফাব্রিজিও রোমানো। 

    “ডি লরেন্তিসকে সঙ্গে নিয়ে তিনি অনেক বিখ্যাত খেলোয়াড়কে বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যেটা একটা বড় ঝুঁকি ছিল। কিন্তু এখন এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ দিতেই হয়। স্পালেত্তিকে সঙ্গে নিয়ে কম দামে অনেক ভালো খেলোয়াড় কিনতেও সক্ষম হয়েছে। এই নতুন খেলোয়াড়দের আরও তিনগুণ দামে বিক্রি করা যাবে।” 

     

    রোমানোর এই বক্তব্যেই নাপোলির বর্তমান সাফল্যের মূল চিত্র উঠে এসেছে। ‘বিখ্যাত’ খেলোয়াড় বলতে রোমানো বুঝিয়েছেন কালিদু কুলিবালি, ড্রিস মার্টিনস, লরেঞ্জো ইনসিনিয়ে, ফাবিয়ান রুইজকে। ক্লাবের চার কিংবদন্তিকে এক মৌসুমে বিদায় করেছে নাপোলি। 

    এখন বলে রাখা ভালো, ক্লাব হিসেবে নাপোলি বেশ কয়েক বছর জড়িয়ে ছিল সারি-হ্যাঙওভারে। কার্লো আনচেলত্তি ও গাত্তুসু, পরবর্তী দুই ম্যানেজারই সারির দলকে অক্ষত রেখে পরিকল্পনা সাজিয়েছেন। সারি-যুগের প্রায় সব খেলোয়াড়ই ভক্তদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়। হবেনই বা কেন, ইনসিনিয়ে ও মার্টিনস ক্লাবের ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতা। কুলিবালি তর্কসাপেক্ষে ক্লাব ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ ডিফেন্ডার। 

    কিন্তু এই কিংবদন্তিদের সবাই-ই যে ৩০-র কোটা পেড়িয়ে গেছেন। এবং সবার বেতনও আকাশচুম্বী হয়ে উঠেছিল। ক্লাবের অর্থনৈতিক অবস্থা স্থিতিশীল রাখতে জিউনতলি ও ডি লরেন্তিস এই কিংবদন্তিদের ছাটাই করার সিদ্ধান্ত নেন। গত গ্রীষ্মে ক্লাব ছাড়েন কুলিবালি, ইনসিনিয়ে, মার্টিনস, মিলিক, রুইজ। এক কথায় সারির দলের যারা বাকি ছিল, সবাই। 

    এই কিংবদন্তিদের জায়গা নেন তরুণদের এক বিগ্রেড। কুলিবালির জায়গা নিয়েছেন ফেনেরবাচ থেকে আসা কিম মিন জাই। এই দক্ষিণ কোরিয়ান এসেই একাদশে তার জায়গা পাকা করেছেন। শুধু সিরি আ নয়, বিশ্বকাপেও তার রক্ষণ নজর কেড়েছে ফুটবল বিশ্বের। গেটাফে থেকে আসা উরুগুইয়ান সেন্টার-ব্যাক ম্যাথিয়াস অলিভেরাও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন একজন মূল্যবান স্কোয়াড প্লেয়ার হিসেবে।   

    দীর্ঘদিন ধরে ক্লাবে থাকা পিওতর জিলেনস্কি এবার নিজের খেলাকে নিয়ে গেছেন পরের ধাপে। বর্তমানে ক্লাবের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অ্যাসিস্ট তার। সর্বোচ্চ অ্যাসিস্ট আর কারো না, এই মৌসুম সেনসেশন খিচকা কাভারস্কেলিয়ার। 

    ইউক্রেনে যুদ্ধের জন্য তার ক্লাব রুবিন কাজান ছাড়তে বাধ্য হওয়া এই জর্জিয়ান এই মৌসুমে নাপোলিতে যোগ দেন মাত্র ১০ মিলিয়ন ইউরোয়। অভিষেক ম্যাচেই গোল ও অ্যাসিস্ট দিয়ে ভক্তদের মন জয় করে নেন তিনি। এখন পর্যন্ত লিগে ১০ গোল ও সর্বোচ্চ ৯ অ্যাসিস্ট করা এই ২২ বছর বয়সীকে নাপোলি ভক্তরা ডাকতে শুরু করেছে ‘কারাডোনা’ নামে। 

    কারাডোনা অবশ্য একা আক্রমণভাগ সামলান না। তার সঙ্গে আছেন হার্ভিং লোজানো, যাকে স্বয়ং ম্যারাডোনার সুপারিশেই দলে ভিড়িয়েছিল নাপোলি। এবং ভিক্টর ওসিমহেন। নাপোলির আরেক সেনসেশন। ইতোমধ্যে এই নাইজেরিয়ান স্ট্রাইকারকে দিদিয়ের দ্রগবার সঙ্গে তুলনা করেছেন জোসে মরিনহো। এরই মধ্যে লিগে ১৮ গোল করা ওসিমহেন (অন্য যেকোনো খেলোয়াড়ের চেয়ে ৫ গোল বেশি) প্রথম আফ্রিকান ফুটবলার হিসেবে সিরি আ’র শীর্ষ গোলদাতা হতে চলেছেন। 

    কাভারস্কেলিয়ার সঙ্গে তার বোঝাপড়া যেকোনো রক্ষণের জন্যই একটি দুঃস্বপ্নের নাম। শুধু এই দুজনই যে গোল করছেন তা নয়। একাদশের প্রায় সব জায়গা থেকেই আসছে গোল-অ্যাসিস্ট। স্পালেত্তির বক্তব্যও পরিস্কার, দলের সবার কন্ট্রিবিউট করতে হবে। কাভারস্কেলিয়া-ওসিমহেন-লজানোর বাইরেও আক্রমণে গভীরতা দেওয়ার জন্য রয়েছেন মাতেও পলিতানো ও জিওভানি সিমিওনে, ইতালিয়ান ফুটবলে দুজনেরই রাজ্যের অভিজ্ঞতা। 

    বদলি নেমে ত্রাস সৃষ্টি করার জন্য রয়েছেন এলজিফ ইলমাসও। মিডফিল্ডার হয়েও এই ২৩ বছর বয়সী এখন পর্যন্ত গোল করেছেন ছয়টি। লেফটব্যাক মারিও রুই অ্যাসিস্ট করেছেন জিলেনস্কির সমান। 

    ৩৩ বছর পর শিরোপার এতো কাছে এসে নাপোলির মূল লক্ষ্য একটিই, বাইরের সব গুঞ্জনকে নিভিয়ে দিয়ে প্রতিটি ম্যাচ জেতার চেষ্টা করা। হ্যাঁ, প্রতি ম্যাচ। 

    ক্লাবের বর্তমান অগ্রগতিতে যেন বাধা না আসে, সেজন্য জানুয়ারিতে তেমন কোনো দলবদলই করেনি নাপোলি। কাভারস্কেলিয়া, ওসিমহেন, জিলেনস্কিদের নিয়ে আগ্রহের কমতি নেই প্রিমিয়ার লিগে। বিশেষ করে গ্রীষ্মে এদেরকে পাওয়ার জন্য কিছু ক্লাব যে উঠেপড়ে লাগবে, সেই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে এখনই। কিন্তু জানুয়ারিতে কোনো ক্লাবের ফোনই ধরেনি নাপোলি। জানিয়েছেন রোমানো নিজে। 

    আর খেলোয়াড়রাও যেন কোনো উটকো সাক্ষাৎকার দিয়ে গুঞ্জন তৈরি না করে, সেটিও নিশ্চিত করেছে ক্লাব কর্তৃপক্ষ। আপাতত মনোযোগ প্রতিটি ম্যাচে জয় আদায় করার দিকেই। সেই লক্ষ্যে ভালোভাবেই এগুচ্ছে স্পালেত্তির শিষ্যরা। 

    এবং সবশেষে, নাপোলির ভক্তদের কথা না বললেই নয়। ২০০৪ সালে যখন তৃতীয় ডিভিশনে নেমে গিয়েছিল ক্লাব, তখনও পূর্ণ থাকতো তাদের স্টেডিয়াম। এই লিগের গড় উপস্থিতি মাত্র দুই থেকে তিন হাজার। অথচ নাপোলির মাঠে ৫০ হাজারের বেশি ভক্তও দেখেছে কোনো কোনো ম্যাচ। 

    সুখে-দুঃখে সবসময় ক্লাবের সঙ্গে থাকা এই ভক্তদের সম্বন্ধে রোমানো বলেন, “শহরের অবস্থা অবিশ্বাস্য। ভক্তরা এই দলের জন্য পাগল। তারা বিশাল বড় এক পার্টির প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে সেটা কখনোই ঘোষণা দেবে না তারা। তারা মুখ বন্ধ রাখছে, এটাই নাপোলির স্টাইল। তবে ঐতিহাসিক এক উদযাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা। প্রস্তুত হোন, নাপোলিতে এবার এমন কিছু দেখবেন যা পূর্বে কখনো দেখেননি।”