• আইপিএল ২০২৩
  • " />

     

    স্টোকস-নাওয়াজ, শেষ ওভারের সেই ভুল দায়ালের বেলায়ও?

    স্টোকস-নাওয়াজ, শেষ ওভারের সেই ভুল দায়ালের বেলায়ও?    

    আন্দ্রে রাসেলের বড় বড় ছয় দেখেছেন টিভিতে। কীভাবে মারেন সেসব, সরাসরি দেখার ইচ্ছে ছিল রিংকুর। ৪ ওভারে প্রয়োজন ৫০ রান, এমন পরিস্থিতিতে 'রাসেল শো' নিশ্চয়ই টিভির সামনে বসে দেখা হয়েছে রিংকুর। আহমেদাবাদে এদিন এমনই অবস্থায় সেই রাসেলের সঙ্গী রিংকু সিং। রিংকু রাসেল শো দেখতে পেলেন না, এরপর নিজে যা দেখালেন, তা রাসেল কেন, কেউই তো করে দেখাতে পারেননি! 

    টি-টোয়েন্টির ইতিহাসে শেষ ওভারে সর্বোচ্চ ২৩ রানের প্রয়োজন মেটানোর রেকর্ড আছে। বিগ ব্যাশে সিডনি সিক্সার্স আর সিডনি থান্ডারের মধ্যে ঘটেছে এমন ঘটনা, ২০১৫ সালে সিডনি থান্ডারের জস লেলরের বলে জর্দান সিল্ক ও স্টিভ ও’কিফি মিলে এনেছিলেন তা। আইপিএলেও তো আছে, ২০১৬ সালে পাঞ্জাবের আক্সার প্যাটেলের শেষ ওভার থেকে এমএস ধোনি এনেছিলেন ২৩ রান। কিন্ত ২৯! মুখে মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে একই কথা, এমন কিছু দেখিনি তো আগে! 

    রিংকু তা দেখিয়ে কলকাতার অবিশ্বাসের আলোড়ন তোলা উল্লাসের মধ্যমণি। ওদিকে সেসবেরই ফাঁকে ক্যামেরায় ধরা পড়লেন ইয়াশ দায়াল। চোখ দুটো ঘুরে রেখেছেন তোয়ালে দিয়ে। চারপাশের কিছুই যেন দেখতে চান না। কিন্ত দুর্ভাগ্য তার, এর আগে যা ঘটে গেছে, তা নিয়ে কথা তাকে শুনে যেতে হবে বাকি জীবন। কোথায় ভুল করলেন, কখনো কী ফিরে যেতে চাইবেন সেই ওভারে?

    রিংকুর টানা পাঁচ ছয়ে ম্যাচ ফিনিশ নিশ্চয়ই আপনাকে মনে করিয়ে দিয়েছে ব্র‍্যাথওয়েটের ওই চার ছয়। এইতো গেল টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সময়ে ওই ম্যাচের প্রসঙ্গে স্কাই ক্রিকেটে এউইন মরগান বলেছিলেন, 'যখন আমি ওই ফাইনালের দিকে ফিরে তাকাই, অধিনায়ক হিসেবে আমার জন্য অন্যতম বড় শিক্ষা ছিল, আসলে আমি সেদিন দৌড়ে স্টোকসের কাছে যাচ্ছিলাম, বল দিয়ে কথা বলছিলাম, কিন্ত কথোপোকথনটা দুই দিক দিয়ে হয়নি, কথা বলেই আবার দৌড়ে ফিরে আসছিলাম। শিক্ষাটা হচ্ছে, এখন হলে আমি আস্তে ধীরে তার কাছে যেতাম, বলটা যতক্ষণ পারা যায় হাতে রেখে নিশ্চিত করতাম কথোপকথনটা যেন দ্বিমুখী হয়, এবং তাতে যে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চাই সেটির জন্য পরিস্কার বার্তা থাকত, এরপর বল দিয়ে ফিরে আসতাম।'

    ২০১৬ সালের সেই ফাইনালের প্রসঙ্গ এসেছিল যে কারণে মরগানদের আলোচনায়, তা হচ্ছে ২০২২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে নাওয়াজের করা সেই শেষ ওভার। স্নায়ুর পরীক্ষা নেওয়া ওই ম্যাচে সেদিন নাওয়াজের আশেপাশে দেখা গিয়েছিল কয়েক ফিল্ডারকে, অধিনায়ক বাবরের পাশাপাশি শাদাব খানকেও দেখা গিয়েছিল কথা বলতে। এইন মরগান পরে এমন পরিস্থিতি মোকাবিলার ক্ষেত্রে বলেছিলেন, 'বোলারের কানে একজনের থেকেই পরিস্কার বার্তা যাওয়া উচিত। যাতে বোলার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য যথেষ্ট শান্ত থাকতে পারে।'

    দায়ালের ওই ওভারে আরেকবার ফিরে যাওয়া যাক তাহলে। ২ বলে ১০ রান যখন প্রয়োজন, দায়ালের আশেপাশে রশিদ-মিলারের সাথে জায়ান্ত যাদবকেও দাঁড়িয়ে কিছু বলতে দেখা যায়। শেষ বলের আগে রশিদ-মিলারের সাথে যোগ দেন শুভমান গিলও। এতজনের উপস্থিতিতে বোলারের ঘাবড়ানোর সম্ভাবনা কি থাকে না?

    ইএসপিনক্রিকইনফোর ম্যাচ পরবর্তী অনুষ্টানে এসে অস্ট্রেলিয়ার সাবেক ক্রিকেটার ও আইপিএলের শিরোপাজয়ী কোচ টম মুডির কথা, সেসময় একজনেরই শুধু উচিত ছিল কোনও বার্তা দেওয়া। একেকজনের একেক মত, কিংবা একই মত থাকলেও তাতে উদ্বেগের সৃষ্টি হতে পারে। অভিজ্ঞ হোন  কিংবা না, সেসময় বোলারের শান্ত থাকার প্রয়োজন, আর সেজন্যই আশেপাশে এতজনের থাকা ভালো কিছু নয়। ওই সময় প্রয়োজন হলে একজনই শুধু কোনও বার্তা দিতে পারেন, সেটা অধিনায়ক কিংবা সিনিয়র কোনও বোলার হতে পারেন। বোলারকে শান্ত থাকার সুযোগ দিতে হবে, তার সেরা ডিফেন্সিভ বল কী জিজ্ঞেস করতে হবে, সেটির উপরই আস্থা রেখে ফিল্ড সাজিয়ে রাখতে হবে। অনেকজনের আনাগোনা অবশ্যই বোলারের মাঝে সেসময় দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করতে পারে। 

    দিনটাই খারাপ যাচ্ছিল দায়ালের। শেষ ওভারে আসার আগে যে তিন ওভার করেছেন, তাতেই দিয়ে ফেলেছিলেন ৩৮ রান। সেই পাঁচ ছয়ের প্রথম তিন বলে একই ফিল্ড সাজিয়ে গিয়েছিলেন বোলিংয়ে। ডিপ ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্ট, ডিপ কাভার রেখে লং অফে আরেকজন, স্কোয়ার লেগ উপরে তুলে মিড উইকেট আর মিড অন বাইরে। সেই তিন বলের দুটিতে ওয়াইড ইয়র্কারের যে চেষ্টা ছিল তার মাঝে, সে অনুযায়ীই ফিল্ড সাজিয়ে রেখেছিলেন। 

    প্রথম বলটা করে ফেললেন ফুলটস, দ্বিতীয়টায় লাইন বদলে স্টাম্প তাঁক করলেন, সেটির পরে আবার ওয়াইড লাইনে গেলেন, তিনটিই ফুলটস। পরিকল্পনা মোতাবেক কাজ হলো না। বদলালেন ফিল্ডিংয়ের চেহারা, অফ সাইডের বাইরের এক ফিল্ডার, ডিপ ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্ট ভেতরে এনে এবার স্কোয়ার লেগ নিলেন বাইরে। স্লোয়ার করলেন, প্রায় একই লাইনের দুটি বল, এবারও রিংকুর ওই ব্যাটটা ফাঁকি দিতে পারলেন না। তাহলে কেন লাইন পাল্টালেন না? এক ডটের ব্যাপারই তো ছিল, কেন ঝুঁকি নিয়ে অন্য কিছু করতে গেলেন না? স্টাম্প বরাবর ইয়র্কার, বাউন্সার, জোরের উপর লেংথে? কতকিছুই তো এখন মনে হতে পারে, সেসবই আদতে বৃথা কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়! কতকিছুই কী ওই সময় দায়ালের কানে এসেছিল, তাতেই কী হলো গন্ডগোল?

    কে জানে! রিংকু আর দায়ালের বন্ধুত্ব কতটা গাঢ়, সে ব্যাপারেও জানা নেই। এইতো কদিন আগেই দুজনে খেলছিলেন একই দলে। সৈয়দ মুশতাক আলী ট্রফিতে উত্তর প্রদেশের হয়ে। সেদিনের কথা, রিংকুর এক ইনস্টাগ্রাম পোষ্টে দায়ালের ফিরতি পোষ্ট, ‘বিগ প্লেয়ার ভাই’! রিংকুও উত্তর দিয়েছিলেন, ভালোবাসার কয়েকটি ইমোজির সাথে ভাই লিখে। উত্তর প্রদেশের সেই দুই ক্রিকেটারের ব্যাটে-বলেই জন্ম নিল এক ইতিহাস। যে ইতিহাসে রিংকুর সাথে দায়াল থাকবেন, সেটি কি চাইতেন স্বয়ং রিংকুও!

    পেস বোলারদের নাকি পাথর হৃদয়ের হতে হয়, এদিন ম্যাচ শেষে দায়ালের ভেঙ্গে পড়া ছাড়া আর কী-ই বা করার ছিল! অবিশ্বাস্যের দোলায় হারিয়ে গিয়ে রিংকুও হয়তো ভুলে গিয়েছিলেন দায়ালের কথা। ম্যাচ শেষে অবশ্য দায়ালকে মনে করেছেন, গেলবার ভালো করার কথা মনে করিয়ে দিয়ে আরও কিছু উৎসাহমূলক কথাবার্তা নাকি ছিল দায়ালকে পাঠানো রিংকুর মেসেজে। মেসেজে জানাতে ভুলেননি বাস্তবতার সুগন্ধি ছড়ানো ওই সত্যিটাও, ‘ক্রিকেটে এমন হয়!’ 

    ক্রিকেটে এমন হয়। তিন শব্দের এই লাইন, একেকজনের কাছে যার অর্থ একেকরকম।