• লা লিগা
  • " />

     

    রেকর্ডগড়া রক্ষণ, দলে শৃঙ্খলা, লেভারের বাজিমাত: যেভাবে লা লিগা জিতল জাভির বার্সা

    রেকর্ডগড়া রক্ষণ, দলে শৃঙ্খলা, লেভারের বাজিমাত: যেভাবে লা লিগা জিতল জাভির বার্সা    

    ২০২১ সালে জাভি যখন বার্সার দায়িত্ব নিয়েছিলেন, বলতে গেলে একরকম মাঝসমুদ্রে দুলছিল বার্সার নৌকা। আগের দুই বছরে কোনো লা লিগা ট্রফি নেই, ক্লাবের অর্থনৈতিক অবস্থা টালমাটাল- সবকিছুর মিলে জাভির ভাগ্য ছিল অনিশ্চিত। সেই অবস্থা থেকে দায়িত্ব নিয়ে জাভি বার্সাকে চার বছর এনে দিয়েছেন লিগ। কীভাবে সেটা সম্ভব হলো? 

    স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন একটা কথা বলেছিলেন, অ্যাটাক আপনাকে ম্যাচ জেতাবে, কিন্তু লিগ জেতাবে ডিফেন্স। এবারের বার্সার জন্য এর চেয়ে যুতসই কথা বোধ হয় আর নেই। বার্সার এবারের লিগে পুরো মৌসুমে মাত্র ১৩টি গোল হজম করেছে,। এর মধ্যেই লিগে এক মৌসুমে সবচেয়ে কম গোল খাওয়ার রেকর্ড ১৮টি, সেটাও তারা ভেঙে দিতে যাচ্ছে। এই মৌসুমে তারা ১১টি ম্যাচে মাত্র ১-০ গোলে জিতেছে, যেটা বলে দিচ্ছে ডিফেন্সে তারা কতটা ভালো করেছে। পুরো মৌসুমে মাত্র প্রতি ম্যাচে .৩৫ গোল হজম করেছে, ইউরোপের শীর্ষ লিগেই যা অনন্য।

    সেজন্য সবার আগে জাভি ধন্যবাদ দিতে পারেন তার ব্যাকলাইনকে। আন্দ্রেস ক্রিশ্চিয়েনসেন এই মৌসুমেই বার্সায় এসেছেন, প্রথম মৌসুমেই দেখিয়েছেন কেন ক্লাবের বড় ভরসা হতে পারেন। রোনাল্ড আরাউহো চোটের জন্য মধ্যে বেশ কিছুটা সময় খেলতে পারেননি। কিন্তু ফিট হওয়ার পর এখন বার্সা রক্ষণের বড় স্তম্ভ তিনি। অ্যালেক্স বালদে মাত্র ১৯ বছর বয়সে দেখিয়েছেন, লেফটব্যাকে তিনি বার্সার ভবিষ্যত। তার জন্য দলে এখন অনিয়মিত নিয়মিত লেফটব্যাক জর্দি আলবা। মেকশিফট রাইটব্যাক জুলস কুন্দেও প্রথম মৌসুমে তার ইউজুয়াল পজিশন থেকে সরে নিজের কাজটা ঠিকমতোই করেছেন। 

    তবে ডিফেন্সে আসল কাজটা হয়েছে পুরনোদের বিদায় জানিয়ে। জেরার্ড পিকে এই মৌসুমে যখন দলে ছিলেন, জাভি তাকে অনুরোধ করেছিলেন নিজের বার্সা ভবিষ্যত নিতে আরেকবার বাহবতে। পিকে তখন দলে জায়গা করে নেওয়ার লড়াই চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেছিলেন। কিন্তু চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ইন্টারের বিপক্ষে বার্সার ৩-৩ গোলে ড্রয়ের পর নিশ্চিত হয়ে যায় পিকের এই দলে কোনো ভবিষ্যত নেই। পিকেও সেটা বুঝতে পেরে নভেম্বরেই ফুটবল থেকে বিদায় নিয়ে নেন। আরাউহো চোট থেকে ফেরায় বার্সার রক্ষণ শক্ত হয়। আলবাকে সরিয়ে বালদেকে খেলানোয় প্রশ্ন উঠেছিল, তবে জাভি প্রমাণ করেছেন তার সিদ্ধান্তই ঠিক। 

    তবে রক্ষণ মানে শুধু ব্যাকলাইন নয়, তার সাথে পুরো দলের ভারসাম্য জড়িত। জাভি নিজে সবসময় বার্সার পজেশন ভিত্তিক পাসিং ফুটবলেই দলকে সাজিয়েছেন, তবে এবার সেই ধারণা কিছুটা স্যাক্রিফাইস করতে হয়েছে কখনো কখনো।  মৌসুমের শুরুতে জাভি দুই উইংয়ে দুইজন স্পিডি উইঙ্গারকে খেলিয়েছেন। সেজন্য দেম্বেলে, ফাতি, ফেরান তোরেস থাকার পরেও নিয়ে এসেছেন রাফিনহাকে। মাঝে টার্গেটম্যান লেভানডফস্কি। কিন্তু দুই উইঙ্গার ট্র্যাক ব্যাক না করায় ইন্টারের সাথে তিন গোলে ড্রয়ের পর জাভি নতুন করে ভেবেছেন। বিশ্বকাপের পর বদল এসেছে বার্সার ফর্মেশনে। জাভি চার মিডফিল্ডার নিয়ে বক্স শেপে দল সানিয়েছেন। বুসকেটস ও ডি ইয়ং ডাবল পিভটে খেলেছেন। গাভি খেলেছেন ফলস উইঙ্গার ও মিডফিল্ডারের মাঝামাঝি রোলে। আর ক্রিয়েটিভ মিডফিল্ডার হিসেবে ছিলেন পেদ্রি। সেজন্য অ্যাটাকে সমস্যা হলেও রক্ষণ শক্ত হয়েছে বার্সার। 

    বিশেষ করে এই শেপে প্রতিপক্ষকে বল রাখতে দেয়নি বার্সা। এই মৌসুমে একমাত্র রিয়াল সোসিয়েদাদই বার্সার চেয়ে বেশি কাউন্টার প্রেস করেছে। লেভানডফস্কিকে আনাও এই মৌসুমে জাভির আরেকটু সাফল্য। মৌসুমের প্রথমার্ধে দারুণ উজ্জ্বল ছিলেন লেভা। ৩৫ বছর বয়সে লা লিগার সবচেয়ে বেশি গোল তার। শেষ দিকে একটু গোল খরায় পড়লেও মাঠে ও মাঠের বাইরে এখন উজ্জ্বল তিনি। 

    তবে জাভি সবচেয়ে বড় যে কাজটি করেছেন, সেটা ক্লাবের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। যখন জাভি খেলোয়াড় ছিলেন, ক্লাবে কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম ছিল। অনুশীলনে দেরি করে আসার জন্য বা টিম মিটিংয়ে ঠিকমতো না এলে জরিমানার বিধান ছিল। কিন্তু জাভি অবসর নেওয়ার পর ছয় বছরে তার অনেক কিছুই আর ছিল না। কোচ হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর বুসকেটসের সাথে পরামর্শ করে জাভি সেই  শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন অনেকটাই। দলের সবার সাথে সকালের নাস্তা ও দুপুরের লাঞ্চ করার নিয়ম চালু করেন আবার। ড্রেসিংরুমে বুসকেটস আলবারা ছিলেন, লেভার মতো সিনিয়র ফিগার আসে। যার জন্য দলের ভারসাম্য হয় ভালো। 

    বার্সার সামনে আরেকটা বড় ঝুঁকি ছিল ফিন্যান্সিয়াল লেভার। আগের সভাপতি বার্তোমেউ ক্লাবকে যে অবস্থায় রেখে গিয়েছিলেন, তাতে ক্লাবের কিছু সম্পদ বিক্রি করে ইকোনমিক লেভারটা বাস্তবায়ন করা ছিল মস্ত ঝুঁকি। লাপোর্তা জানেন, টাকায় টাকা আনে। দলকে শিরোপা জেতানোর জন্য এই অবস্থায়ও ক্লাবে বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেন। সেকারণেই মেসিকে ধরে রাখতে না পারার পরেও ক্লাবের বেতন বাড়ে, নতুন আরও খেলোয়াড় আসে। লা লিগা জিতে সেই আস্থার প্রতিদান দিয়েছেন জাভি।

    তবে জাভির কাজ এখনো শেষ হয়নি। বলা যায় অর্ধেক হয়েছে,। এই মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগে গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নিয়েছে বার্সা, পরে বিদায় নিয়েছে ইউনাইটেডের কাছে ইউরোপা লিগ থেকেও। ইউরোপে গত কয়েক মৌসুমের রেকর্ড একদমই ভালো নয়।  বুসকেটস চলে যাচ্ছেন। ডাবল পিভোটে তার জায়গায় একজন খেলোয়াড়কে তাই দরকার বার্সার। সেখানে বিকল্প কে হবেন, সেটা বড় প্রশ্ন। আবার ফেরান তোরেস, আনসু ফাতিরাও ভালো করতে পারছেন না। তাদেরও বিক্রি করে দিতে চাইতে পারে বার্সা। কুন্ডে রাইটব্যাক হিসেবে খেললেও সেটা তার প্রেফারড পজিশন নয়। সেখানে নতুন করে কাউকে দেখতে চাইতে পারে তারা। তার চেয়েও বড় প্রশ্ন লিওনেল মেসি ফিরবেন কি না। লাপোর্তা বলেছেন, যে কোনো মূল্যে মেসিকে ফেরাতে চান,। কিন্তু এ ব্যাপারটা পছন্দ হয়নি বলে ক্লাবের ফুটবল ডিরেক্টর ম্যাথু আলেমানি ক্লাব ছেড়ে চলে যাচ্ছেন বলে জানা যাচ্ছে। আলামেনির ওপর অনেকভাবেই নির্ভর করতেন লাপোর্তা, তার চলে যাওয়া হতে পারে ক্লাবের জন্য বড় আঘাত।