হাথুরুর বাংলাদেশের 'পাত্র-পাত্রী দেখাদেখি' কেমন হচ্ছে?
পাত্র চাই। পাত্রী চাই। এমন শিরোনামে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখেছেন কখনো? আজকাল আর সে চল নেই। পাত্র-পাত্রী মেলানো একটা কঠিন কাজই হয়তো ছিল এক সময়। বাংলাদেশ দলেরও অবস্থা এখন বলা যায় সেরকম।
দ্বিতীয় মেয়াদে হেডকোচ হয়ে এসে হাথুরুসিংহে তার প্রথম ওয়ানডে সিরিজের আগে বলেছিলেন, শুরুর দুই ম্যাচে দেখবেন ক্রিকেটারদের, এরপর সেখান থেকেই করণীয় ঠিক করবেন। সেই ইংল্যান্ড সিরিজসহ চার সিরিজ, এরপরও ওয়ানডেতে এখনও যেন তিনি আর বাংলাদেশ দেখেই যাচ্ছে! শেষ কয়েক বছরে যে ফরম্যাটে সবচেয়ে সফল বাংলাদেশ, সেখানেই স্থিরতা ভর করছে খুব সামান্যই। এ পর্যন্ত হাথুরুর অধীনে ২৪ জন ক্রিকেটার কোনও না কোনও স্কোয়াডের সদস্য হয়েছেন। হাথুরু ম্যানেজমেন্টের নেতৃত্বে বাংলাদেশ যে ১২ ওয়ানডে খেলেছে, তাতে এক জাকির হাসান বাদে ২১ জনের মধ্যে ২০ জনই ম্যাচ খেলেছেন।
***
বাংলাদেশ দেখে যাচ্ছে আসলে মূলত তিন জায়গায়, ধরে নিতে পারেন তিন পাত্রী খুঁজতে বেরিয়েছে। অতিরিক্ত স্পিনারের বেলায় তো যেন হয়েছে চেয়ার-বদলের খেলা। সেই খেলায় প্রতিযোগী দুজনের বেশি ছিলেন না অবশ্য এতদিন। ইংল্যান্ড সিরিজে সুযোগ ডাক দিয়েছিল তাইজুলের ঘরে। তিন ম্যাচের প্রত্যেকটিতেই উইকেটের ঘরে দাগ কেটেছেন তাইজুল, সব ম্যাচেই রান যদিও দিয়েছিলেন পঞ্চাশের বেশি করে। তিন ম্যাচে ছয় উইকেটে নেওয়া তাইজুলের নাম পরের সিরিজের স্কোয়াডে যখন অনুপস্থিত, তখন হাথুরুর কথায় আরেকজনকে প্রস্তত করার দিকটাই উঠে এসেছিল।
ঘরের মাঠে আয়ারল্যান্ড সিরিজের আগে নাসুম আহমেদকে নেওয়া সম্পর্কে হাথুরুসিংহে বলেছিলেন, 'আমাদের বোলিং ইউনিট আরও বড় করার চেষ্টা করছি। তাইজুল টেস্টে আমাদের প্রধান বোলার। সে ওয়ানডেতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খুব ভালো বোলিং করেছে। আমরা জানি সে প্রস্তত৷ আমরা চেয়েছি, নাসুমকেও একটা সুযোগ দিতে, সে কী করতে পারে দেখতে। যদি সেও ভালো করে, বিশ্বকাপের আগে আগে আমাদের দুজন প্রস্তত থাকবে।'
আইরিশদের বিপক্ষে সে সিরিজের তিনটা ম্যাচেই খেলেছিলেন নাসুম। প্রথম ম্যাচে ৩ উইকেট নিয়েছিলেন ৮ ওভারে ৪৩ রান দিয়ে, পরের ম্যাচে বাংলাদেশের বোলিং ইনিংস শুরুর আগেই ম্যাচ পরিত্যাক্ত হয়ে যায়। শেষ ম্যাচে আইরিশদের দেড় শর কম রানে অলআউট করার পথে নাসুমের হাতে আসে মাত্র ৩ ওভার। ওয়ানডের নাসুমকে ওই সিরিজেই কেবল দেখতে পারেন হাথুরু। পরের দুই সিরিজেই যে তৃতীয় স্পিনারের জায়গা হয়ে যায় তাইজুলের নামে।
আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে অ্যাওয়ে সিরিজে প্রথম ম্যাচ পরিত্যাক্ত হওয়ার আগে তাইজুল ২ ওভার হাত ঘুরিয়ে এক উইকেট পেয়েছিলেন। পরের ম্যাচে ওই একটি উইকেট পেতেই খরচ করতে হয়েছিল ৭ ওভারে ৫৯ রান। সিরিজের শেষ ম্যাচে বাংলাদেশ নেমেছিল তৃতীয় স্পিনার ছাড়াই। আফগানিস্তানের বিপক্ষে পরের সিরিজের প্রথম দুটি ম্যাচেও তাই। তৃতীয় ম্যাচে আবার বাংলাদেশ একাদশে রেখেছিল অতিরিক্ত স্পিনার, তাইজুল সেদিন ৯ ওভারে ৩৩ রান দিয়ে উইকেট পেয়েছিলেন দুইটি।
হাথুরুর অধীনে চার সিরিজের তিনটিতেই ছিলেন তাইজুল, জায়গা তারই পাকাপোক্ত মনে হচ্ছিল তাই, কিন্ত তিনিই পরে বাদ পড়ে গেলেন এশিয়া কাপ থেকে। এই নির্বাচন নিয়ে প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদিন নান্নু সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, 'তাইজুল অনেকটা অ্যাটাকিং স্পিনার, নাসুম একটু ডিফেন্সিভ। টিম ম্যানেজমেন্ট যে প্ল্যান দিয়েছে, আমরা চিন্তা করে নাসুমের দিকে গিয়েছি কারণ শ্রীলঙ্কাতে এশিয়া কাপে ফ্ল্যাট উইকেটেও খেলতে পারে, লাহোরেও ফ্ল্যাট উইকেটে খেলা হতে পারে, যেখানে ডিফেন্সটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সে চিন্তা করেই নাসুমকে নেওয়া’।
হাথুরুর বাংলাদেশে তাইজুলের ৬ ম্যাচে ১০ উইকেট শিকার ২৬.২১ গড়ে। নাসুম মাত্র দুই ম্যাচেই বোলিং করেছেন, তাইজুলের ৫.৪৪ ইকোনমির সাথে নাসুমের ৪.৯১ ইকোনমির তুলনা জুতসই হবে না মোটেও। নাসুমের অ্যাকুরেসির বেলায় ঘাটতি আছে কিছুটা, আর তাইজুলের কন্ট্রোল থাকলেও সেই টেস্ট মাইন্ডসেটই অনেক সময় তাকে অনুমেয় বানিয়ে ফেলে।
আচ্ছা, তিনজন মূল স্পিনার নিয়ে যখন খেলবে কোন দল, তখন নিশ্চয়ই পিচ যথেষ্ট স্পিন-সহায়কই হবে। তাহলে তো আক্রমণাত্মক এক স্পিনারকে নিয়েই খেলতে চাইবে যেকোন দল। স্পিন-সহায়ক উইকেটের ফায়দা তুলে নিতে তৃতীয় স্পিনারের কাজ রক্ষণের হওয়ার কথা তো না। তাহলে যে প্রধান নির্বাচক জানালেন, ডিফেন্সিভ বোলারের চাহিদার জন্যই নাসুমকে নেওয়া। ফ্ল্যাট উইকেটে তো তিনজন স্পিনারকে নিয়ে নামারই সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ!
তিন স্পিনারের একাদশে থাকা মানেই পিচের সহায়তা পুরোপুরি নেওয়া, সেটা আক্রমণের মাধ্যমেই নিশ্চয়ই, আর সেজন্য দরকার এক আক্রমণাত্মক বোলারেরই। বাংলাদেশ তো উল্টো পথেই হাটলো মনে হচ্ছে। অবশ্য কে জানে! এ দেখাই হয়তো শেষ দেখা নয়, এশিয়া কাপের পরই হয়তো তৃতীয় স্পিনারের জায়গা হবে অন্য কারও।
***
সাত কার হবে, তা যেন অনিশ্চিয়তার চাদরে ঢাকা পড়ে থাকাটাই হয়ে গেছে নিয়তি। দীর্ঘদিন সাতে থাকা আফিফে ঠিক কাজের কাজ হয়নি। সাতের চাহিদা মেটাতে একপ্রকার ব্যর্থ আফিফ বাদ পড়ে যান হাথুরুর প্রথম ওয়ানডে সিরিজ শেষেই। পরের সিরিজে আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে নতুন আরেকজনকে দেখতে চায় বাংলাদেশ। ইয়াসির আলী ম্যাচের সুযোগ পেয়েছিলেন ঠিক, কিন্ত দুই ম্যাচের একটিতে ১০ বলে ১৭ রান করে হয়ে যান রানআউট, আরেকটিতে ৪৭তম ওভারে নেমে ৭ রান করেন।
আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে অ্যাওয়ে সিরিজে স্কোয়াডে থাকেন ইয়াসির৷ কিন্ত বাংলাদেশ ভিন্ন কৌশলমুখী হয়ে পড়ে। বাড়তি বোলার খেলিয়ে এতদিন আটে থাকা মিরাজকেই সাতে নামায়। তিন ম্যাচে ৯৭.৬৫ স্ট্রাইক রেটে মিরাজ করেন ৮৩ রান। ওই সিরিজে স্কোয়াডে বাংলাদেশ রাখেনি আফিফকে। আফগানিস্তান সিরিজ যখন এল, আগের দুই সিরিজেই স্কোয়াডে থাকা ইয়াসির বাদ পড়ে গেলেন, আফিফকে ফেরালো বাংলাদেশ। আবার আফিফ, আফগানিস্তানের বিপক্ষে দুই ইনিংসে ৯ বলে ১ রান।
২০২১ সাল থেকে হিসেব করলে নাম্বার সাতে যা পেয়েছে বাংলাদেশ, তা অতি সামান্যই। সেসময়ে সাত নাম্বার পজিশনে বাংলাদেশের ব্যাটিং গড় ২১.৭৩। যা টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলোর মধ্যে তৃতীয় সর্বনিম্ন। ২০২৩ বিশ্বকাপের দলগুলোর মধ্যে নাম্বার সাতের স্ট্রাইক রেটের তালিকায়ও বাংলাদেশ তলানিতে, টাইগারদের ৮৫.৬০ স্ট্রাইক রেট চতুর্থ সর্বনিম্ন।
২০২১ থেকে বাংলাদেশ সাতে খেলিয়েছে ছয়জনকে। কোনও ব্যাটারেরই একই সাথে বিশের উপর গড় ও এক শর অধিক স্ট্রাইক রেট থাকেনি। সর্বোচ্চ ২০ ম্যাচ খেলা আফিফ হোসেন ১৭ ইনিংসেই ব্যাট করতে নেমেছেন, তাতে ৩৭৬ রান করেছেন ২৬.৮৫ গড় ও ৮৪.৬৮ স্ট্রাইক রেটে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১০ ম্যাচ খেলা মিরাজের ৮ ইনিংসে সম্বল ১১৯ রান, যাতে স্ট্রাইক রেট ছিল ওই ৮০ এর আশেপাশে। আরও খেলেছেন নুরুল হাসান, ইয়াসির আলী, শেখ মেহেদী, সৌম্য সরকার- তিন ম্যাচের বেশি জুটেনি অবশ্য কারও কপালেই। তাতে নুরুলের ৩৮ বলে নটআউট ৩২ রানের একমাত্র ইনিংস বাদে কারো গড়ই ১২ এর উপরে যায়নি।
এশিয়া কাপেও বাংলাদেশ দেখতে চাইল, সাতের সুরাহা করা যায় কি না। ডাক পেলেন শামীম পাটওয়ারী, শেখ মেহেদী। এই সাত নিয়ে হয়তো এশিয়া কাপের পরও চলবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। এই পজিশনটাই বাংলাদেশের বাস্তবতায় এখন হয়ে গেছে পরীক্ষা-নিরীক্ষার। সেই পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফাঁকেই যদি কিছু পাওয়া যায়!
***
ব্যাকআপ ওপেনারের বেলায় 'দেখাদেখি'র তেজি হাওয়া আসলে বইছে বর্তমান পরিস্থিতিতে। তামিম ইকবালের অবসর-কান্ডের পর ইনজুরিতে এশিয়া কাপ থেকে ছিটকে পড়া, ব্যাকআপ ওপেনার খুঁজতে জোরদার হয়েছে বাংলাদেশ। ইংল্যান্ড সিরিজে কোন বিকল্প ওপেনার ছিলেন না স্কোয়াডেই। সুযোগ বিলাসী আয়ারল্যান্ড সিরিজে ডাক পেয়েছিলেন শুরুতে জাকির হাসান, পরে ইনজুরিতে তিনি ছিটকে গেলে সুযোগ আসে রনি তালুকদারের। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে পরের সিরিজেও রনিই থাকেন বিকল্প ওপেনার হিসেবে, সাকিবের অনুপস্থিতির দরুণ তৃতীয় ওয়ানডেতে দলের নকশায় যে পরিবর্তন আসে, তাতে লিটনকে চারে দিয়ে তামিমের সঙ্গে ওপেনিংয়ে নামানো হয় রনিকেই।
ওই ম্যাচে ৪ রান করার পরে আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজে তামিমের অবসর-নাটকে সুযোগ ডানা মেলেছিল, কিন্ত সেটি রনির না হয়ে নাঈম শেখের জন্যই। নাঈম দুই ম্যাচ খেলে ৯ রান করতে পারেন মাত্র। এশিয়া কাপের স্কোয়াডে থাকেন নাঈম, বাদ পড়ে যান রনি। তবে আরেক ওপেনারের অন্তর্ভুক্তি বলে দেয়, নাঈমে স্থির হওয়ার সাহস করতে পারছে না বাংলাদেশ। এশিয়া কাপে তানজিদ হাসান তামিম পাবেন নিজেকে দেখানোর সুযোগ!
এশিয়া কাপ যাক, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ঘরের মাঠে সিরিজ আছে। এশিয়া কাপের দলটাকেই বিশ্বকাপে রাখতে পারাটাই আদর্শ হত বলা যায়। কিন্ত বাংলাদেশ 'দেখাদেখি'র পর্ব শেষ করতেই পারছে না যেন!
আমরাও সে পর্ব দেখতে থাকি তাহলে! অবশ্যই শেষের অপেক্ষায় থেকে।