রুদ্ধশ্বাস লড়াইয়ে মেন্ডিসের ফিফটির পর আসালাঙ্কার ‘আইস কুল’ ইনিংসে ফাইনালে শ্রীলঙ্কা
এশিয়া কাপ ২০২৩, সুপার ফোর, কলম্বো (টস-পাকিস্তান/ব্যাটিং)
পাকিস্তান - ২৫২/৭, ৪২(৪২) ওভার (রিজওয়ান ৮৬*,শফিক ৫২, ইফতিখার ৪৭ পাথিরানা ৩/৬৫, মাদুশান ২/, ওয়েলালাগে ১/৪০ )
শ্রীলঙ্কা - ২৫২/৮, ৪২(৪২) ওভার (মেন্ডিস ৯১, আসালাঙ্কা ৪৯*, সামারাবিক্রমা ৪৮, ইফতিখার ৩/৫০, আফ্রিদি ২/৫২, শাদাব ১/৫৫
ফলাফল: শ্রীলঙ্কা ২ উইকেটে জয়ী (ডিএলএস মেথডে)
অলিখিত সেমিফাইনাল হল ম্যাচের ভারের সাথে মানানসই। বৃষ্টি বাধ সেধেছে বহুবার; তবে দুই দল উপহার দিল বহুদিন মনে রাখার মত এক ওয়ানডে। রুদ্ধশ্বাস এক ম্যাচে সহজ জয়ের দিকেই যেখানে এগিয়ে যাচ্ছিল শ্রীলঙ্কা, সেখানে ইফতিখার আহমেদের মুহুর্মুহু উইকেট নেওয়ার পর দারুণ এক ওভারে শ্রীলঙ্কাকে প্রায় এশিয়া কাপ থেকে বিদায়ের রাস্তা দেখিয়ে দিয়েছিলেন শাহীন শাহ আফ্রিদি। কিন্তু স্নায়ু ধরে রেখে শেষ বলে গড়ানো ম্যাচে ঠিকই বর্তমান চ্যাম্পিয়নদের ১১-তম বারের মত ফাইনালে তুলেছেন চারিথ আসালাঙ্কা।
২৫২ রানের লক্ষ্যে শ্রীলঙ্কার শুরুটা হয়েছিল দারুণ। এদিন একাদশে ফিরে শুরু থেকেি আক্রমণাত্মক হওয়ার চেষ্টা করেন কুশল পেরেরা। তবে শাদাব খানের দারুণ সরাসরি থ্রোতে ৮ বলে ১৭ রানেই থামতে হয় তাকে। মেন্ডিসকে নিয়ে অবশ্য এরপর দলকে শক্ত অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য খেলতে থাকেন পাথুম নিসাঙ্কা। উইকেটে এসে মেন্ডিস আপন ছন্দে খেলতে থাকলে খেই হারিয়ে বসেন নিসাঙ্কা। ক্রমান্বয়ে চাপ তাকে পেয়ে বসলে সেটা থেকে মুক্তি পেতেই শাদাবকে খেলতে গিয়েছিলেন বেরিয়ে এসে, ৪৪ বলে ২৯ রান শেষে সেই শটেই ফিরতি ক্যাচ দিয়ে তিনি ফিরলে ভাঙে ৫৭ রানের জুটি। সেখান থেকে অবশ্য শ্রীলঙ্কার রাস্তাটা যেন আরও মসৃণ হয়েছে সময়ের সাথে।
সাদিরা সামারাবিক্রমা উইকেটে যোগ দিয়ে রান বের করতে থাকেন অনায়াসেই। দুজনেই নিয়মিত প্রান্ত বদলের পাশাপাশি বাউন্ডারি বের করে পাকিস্তানের বোলিং আক্রমণ প্রায় নিষ্ক্রিয় করে ফেলেন। পেসাররা যেন উইকেটের কোনও কূলকিনারাই বুঝে উঠতে পারছিলেন না। তবে দুজনর কিছু বেশ কিছু সময় ধরে প্রশ্ন তোলা ইফতিখার হয়ে দাঁড়ান বাঁধা। ফিফটির দ্বারপ্রান্তে এসে ইফতিখারের করার ৩০-তম ওভারে বেরিয়ে খেলতে গিয়ে স্টাম্পিংয়ের শিকার হয়ে থামেন ৫১ বলে ৪৮ রান করা সামারাবিক্রমা। ১০০ রানের সেই জুটি ভাঙলে পাকিস্তানকে চেপে বসার কোনও সুযোগ দিতে চাননি মেন্ডিসের সাথে যোগ দেওয়া চারিথ আসালাঙ্কা। ওই ইফতিখারকে দুজনেই মিইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন; দারুণ এক স্লগ সুইপে মেন্ডিস তো ছয় মেরে নব্বইয়ের ঘরেও ঢুকে যান। তবে পরের ওভারে সেই ইফতিখারই থামান তাকে। ব্যাটের কানায় লেগে বল হালকা ভেসে গেলে সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে দারুণ এক ক্যাচ নেন মোহাম্মদ হারিস; সেই সাথে ৮৭ বলে ৯১ রান শেষে আসরে দ্বিতীয়বারের মত ‘নার্ভাস নাইন্টিজ’-এর শিকার হন মেন্ডিস।
শ্রীলঙ্কা শিবিরের হৃৎকম্পন বাড়িয়ে দিয়ে নিজের পরের ওভারেই শ্রীলঙ্কা অধিনায়ক দাসুন শানাকাকেও ফেরান ইফতিখার। চাপ যেন লঙ্কানদের পেয়ে বসছিল দ্রুতই। তবে শাহীন আফ্রিদির করা ৩৯-তম ওভারে ৩৬ বল পর বাউন্ডারি মেরে সেই চাপ লাঘবের চেষ্টা করেন আসালাঙ্কা। তবে ৪১-তম ওভারে এসে যেন এবারও বিধিবাম! আফ্রিদি এতক্ষণ নিষ্ফলা থাকলেও হুট করেই জানান দিলেন নিজের উপস্থিতির কথা। টানা দুই বলে ধনঞ্জয়া ও দুনিথ ওয়েলালাগেকে তো ফেরালেন বটেই, দিলেন মোটে ৪ রান। শেষ ওভারে ৮ রান দরকার হলে জামান খানের দারুণ বোলিংয়ে প্রথম তিন বলে মাত্র ২ রান আসার পর ৪র্থ বলে রান আউট হয়ে ফিরেন মাদুশান। তবে ওই রান আউটের সময় পিচের অর্ধেক পেরিয়ে স্ট্রাইক পেয়ে যান আসালাঙ্কা। পঞ্চম বলে ব্যাটের কানায় লেগে বল স্লিপ অঞ্চল দিয়ে বাউন্ডারির দড়ি ছুঁলে শেষ বলে ঠান্ডা মাথায় ডিপ স্কয়্যার লেগের ফাঁকা অঞ্চলে বল ঠেলে প্রয়োজনীয় দুই রান নিয়ে নেন আসালাঙ্কা। ৪৭ বলের ৪৯* রানের দারুণ ইনিংসে শ্রীলঙ্কাকে আবারও নিয়ে যান ফাইনালে।
এর আগে গতকাল একাদশ ঘোষণা দিলেও আজ ম্যাচের আগে পাকিস্তানকে অতর্কিতে আনতে হয়েছে দুই পরিবর্তন। ইমাম-উল-হকের জায়গায় একাদশে ঢুকে অবশ্য ৪ রানের বেশি করতে পারেননি ফাখার জামান; প্রমোদ মাদুশানের বলে স্টাম্প খুইয়ে তিনি ফিরলে উইকেটে এসে বিপদ সামলানোর চেষ্টা করেন বাবর আজম। ওপেনিংয়ে নামা শফিক কিছুটা সময় নিলেও বাবর প্রান্ত বদল করতে থাকেন নিয়মিত। অবশ্য আগের ম্যাচে দুর্দান্ত অল-রাউন্ড পারফর্ম্যান্সের পসরা সাজিয়ে বসা দুনিথ ওয়েলালাগে আবারও নিজেকে মেলে ধরলে থামতে হয় বাবরকে। দারুণ এক অফ স্পিনে বাবরকে সামনে টেনে এনে স্টাম্পিংয়ের ফাঁদে ফেলে তাকে ৩৫ বলে ২৯ রান শেষে ফেরান ওয়েলালাগে। থিকশানা-ওয়েলালাগের স্পিন জুটি সেখান থেকে পাকিস্তানকে প্রায় নিশ্চুপ করে ফেললে ২১-তম ওভারে ধনঞ্জয়া ডি সিলভাকে দারুণ ছয় মেরে তার পরের বলে ৬৫ বলে ফিফটি পূর্ণ করেন শফিক। সেখান থেকে হাত খুলতে গেলে পরের ওভারেই কিছুটা খাটো লেংথের বলের ফাঁদে ফেলে ৬৯ বলে ৫২ রান করা শফিককে ফেরান মাথিশা পাথিরানা। উইকেটে এসেই ধুঁকতে থাকা মোহাম্মদ হারিসকে এরপর ফিরতি ক্যাচে শিকার বানিয়ে পাথিরানা শ্রীলঙ্কাকে ম্যাচে ফেরান শক্তভাবেই। মোহাম্মদ নাওয়াজ এসে এরপর প্রতি-আক্রমণে যেতে চাইলে বলপ্রতি ১২ রানের পর তাকে দারুণ এক ভেতরে ঢোকা বলে স্টাম্প উপড়ে ফেলেন থিকশানা। সাথে সাথেই বৃষ্টি আবার বাগড়া দিলে এরপর আর ম্যাচে থাকতে পারেনি শ্রীলঙ্কা।
বৃষ্টি থামলে খেলার সীমা আরও একবার কমে আসলে উইকেটে থাকা রিজওয়ান-ইফতিখার ম্যাচের ধারা বুঝে খেলতে থাকেন। দুজনেই কিছুটা সময় নিলেও ৪৮ বলে ফিফটি পেয়ে যান রিজওয়ান। ৩০ ওভারে যেখানে পাকিস্তানের রান ছিল ১৩৮, আর দশ ওভার পরে কোনও উইকেট না হারিয়ে তারা পৌঁছে যায় ২৩৫ রানে! রানের চাকা সচল রাখতে গিয়ে অবশ্য ফিফটির দ্বারপ্রান্তে এসে থামতে হয় ইফতিখারকে; আক্রমণে স্লোয়ারে বিভ্রান্ত করে পাথিরানা তাকে থামান ৪০ বলে ৪৭ রান শেষে। শেষ ওভারে শাদাব খানকেও মাদুশান ফেরালেও ৭৩ বলে ৮৬* রানে অপরাজিত থাকেন রিজওয়ান। ১৬-তম ওভারে পাকিস্তান অধিনায়ক ফেরার পর যখন উইকেটে এসেছিলেন তখন ম্যাচ ঘুরে যেতে পারত যেকোনো দিকেই; এমনকি শ্রীলঙ্কা ফিরেছিলেন দারুণভাবেই। মাটি কামড়ে পড়ে থেকে শেষদিকে আক্রমণ করে ঠিকই রিজওয়ান তবুও নিজের নামের প্রতি সুবিচার করে পাকিস্তানকে এনে দিয়েছেন পর্যাপ্ত রসদ। দর্শকদের নাভিশ্বাস ছুটিয়ে সেই লক্ষ্য শেষ বলে তাড়া করে টানা দ্বিতীয় ফাইনালে গিয়েছে শেষমেশ লঙ্কানরাই।