• ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ
  • " />

     

    দুই মাসেই স্পার্সের চেহারা বদলে দেওয়া এই অজি কোচ আসলে কে?

    দুই মাসেই স্পার্সের চেহারা বদলে দেওয়া এই অজি কোচ আসলে কে?    

    ২০২১-২২ ছিল স্মরণকালের মধ্যে স্পার্সের সবচেয়ে দুর্দশার মৌসুম। তিনজন ভিন্ন ম্যানেজারের অধীনে মৌসুমটা কোনোভাবে শেষ করে গ্রীষ্মে আবার দলের সবচেয়ে বড় তারকা হ্যারি কেইনকে হারিয়েছে তারা। এরপরও চলতি মৌসুমে দারুণ শুরু করেছে লন্ডনের ক্লাবটি।

    টটেনহাম হটস্পার স্টেডিয়ামের এই নতুন অধ্যায়ের কেন্দ্রে রয়েছেন একজন অস্ট্রেলিয়ান। অ্যাঞ্জ পস্তেকগলু। স্পার্স ভক্তদের মতো আপনিও হয়তো কয়েকমাস আগেও জানতেন না এই ম্যানেজারের নাম। এই প্রতিবেদনে আমরা জানার চেষ্টা করব কে এই অ্যাঞ্জ পস্তেকগলু, এবং মেলবোর্নের মাঠ থেকে তিনি কীভাবে প্রিমিয়ার লিগে এসেছেন? 

    মরিসিও পচেত্তিনো, লুইস এনরিকে, জুলিয়ান নাগেলসম্যানের মতো বড় ম্যানেজারদের সবাই মুখ ফিরিয়ে নিলে গ্রীষ্মে সেল্টিক কোচকে নিয়োগ দিয়েছিলেন স্পার্স চেয়ারম্যান ড্যানিয়েল লেভি। তবে এখন মনে হচ্ছে, বেশ কিছু বাজে সিদ্ধান্তের পর এবার একজন জ্যাকপট ম্যানেজার নিয়োগ দিয়ে ফেলেছেন লেভি। 

    জুনে স্পার্সে যোগ দেওয়ার আগে কোচিং পেশায় মোট ২৭ বছর কাটিয়েছেন অ্যাঞ্জ। গ্রিস, স্কটল্যান্ড, জাপানের মতো দেশে দায়িত্ব পালন করেছেন। বহিরাগত হিসেবে এরকম প্রতিটি ম্যানেজারিয়াল পজিশনেই প্রথমে মানুষের ভ্রুকুটির মুখে পড়তে হয়েছে তার। এবং শেষে প্রতিটি ক্লাবেই ভক্ত থেকে শুরু করে সাংবাদিক, সমালোচক সবার মন জয় করতে সক্ষম হয়েছেন এই অজি। 

    অ্যাথেন্স থেকে মেলবোর্ন 

    পস্তেকগলুর জন্ম কিন্তু অস্ট্রেলিয়ায় নয়। অস্ট্রেলিয়া থেকে বহু দূরে, গ্রীসের অ্যাথেন্সে জন্মেছেন তিনি, ১৯৬৫ সালে। তার নামও গ্রীক। জন্মের কয়েক বছর পরই এক ভয়াবহ সামরিক অভ্যুত্থান হয় গ্রীসে। চাকরি হারান পস্তেকগলুর বাবা। যে কারণে জন্মের চার বছরের মাথায় তাকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি দেন তার গ্রীক বাবা-মা। 

    বাবার অনুপ্রেরণাতেই ছোটবেলায় ফুটবল খেলা শুরু করেন অ্যাঞ্জ। নয় বছর বয়সে যোগ দেন সাউথ মেলবোর্নের ইয়ুথ একাডেমিতে। সেখানে থেকে একসময় তার জায়গা হয় সিনিয়র দলে। পুরো খেলোয়াড়ি জীবন এই এক ক্লাবেই কাটান তিনি। লেফটব্যাক হিসেবে খেলা অ্যাঞ্জ শেষের দিকে দলের অধিনায়কত্বও পেয়েছিলেন। 

    পস্তেকগলু যখন তার ক্যারিয়ারের শীর্ষে, তখন তার দলে ম্যানেজার হিসেবে আসেন হাঙ্গেরিয়ান কিংবদন্তি ফেরেঞ্চ পুসকাস। ইংলিশের চেয়ে পুসকাস গ্রিকে বেশি পারদর্শী ছিলেন। যে কারণে, ড্রেসিংরুমে তার অনুবাদক হয়ে উঠেন ২৪ বছর বয়সী পস্তেকগলু। 

    ১৯৯৩ সালে, মাত্র ২৭ বছর বয়সে হাঁটুর এক ইনজুরির জন্য পেশাদার ফুটবলকে বিদায় জানাতে হয় পস্তেকগলুর। এর আগে নয় বছরের সিনিয়র ক্যারিয়ারে দুইবার লিগ শিরোপা ও একবার লিগ কাপ জিতেছেন তিনি। 

    ২০০০ সালে সাউথ মেলবোর্নের ভক্ত-সমালোচকদের ভোটে নির্বাচিত টিম অব দা সেঞ্চুরিতে জায়গা হয়েছিল পস্তেকগলুর। অস্ট্রেলিয়া জাতীয় দলের হয়েও চারবার মাঠে নেমেছেন তিনি। 

    কোচিং ক্যারিয়ার: অস্ট্রেলিয়ান ফুটবলে রাজত্ব 

    খেলা থেকে অবসর নিলেও 'ওয়ান ক্লাব ম্যান' পস্তেকগলু সাউথ মেলবোর্নেই থেকে যান। তাকে দেওয়া হয় সহকারী কোচের দায়িত্ব। তিন বছর পর, ১৯৯৬ সালে প্রধান কোচের দায়িত্ব পান অ্যাঞ্জ। 

    প্রধান কোচের দায়িত্ব পাওয়ার পর প্রায় সাথে সাথেই ক্লাবের আবহাওয়া বদলে দেন পস্তেকগলু। সাত বছর লিগবিহীন থাকার পর টানা দুই বছর (১৯৯৭-৯৮, ৯৮-৯৯) লিগ শিরোপা জেতে তার দল। 

    তার উত্থান নজরে আসে অস্ট্রেলিয়া ফেডারেশনের। ২০০০ সালে ৩৫ বছর বয়সী পস্তেকগলু দায়িত্ব পান অস্ট্রেলিয়ার বয়সভিত্তিক দলের। দীর্ঘ সাত বছর অস্ট্রেলিয়া অনূর্ধ্ব ১৭ ও অনূর্ধ্ব ১৯ ও ২০ দলের কোচ ছিলেন তিনি। অনুমান করা যায়, তাকে একসময় জাতীয় দলের কোচ করার দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছিল অজি ফেডারেশন। কিন্তু ২০০৭  সালে দল অনূর্ধ্ব ২০ বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করলে ব্যর্থ হলে সাবেক সকারু ও ফুটবল পণ্ডিত ক্রেইগ ফস্টারের সঙ্গে লাইভ টেলিভিশনে বাগ-বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন পস্তেকগলু। এই ঘটনার জন্য বরখাস্ত হন তিনি। 

    সাথে সাথে অস্ট্রেলীয় ফুটবলে ব্রাত্য হয়ে উঠেন। তাকে দায়িত্ব দিতে অস্বীকৃতি জানায় সব অস্ট্রেলীয় পেশাদার দল। পরের দুবছর গ্রিসের তৃতীয় ডিভিশনের এক দল ও মেলবোর্নের আধা-পেশাদার এক দলের সঙ্গে কাটান তিনি। ২০০৯ সালে অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ডিভিশন, অ্যা লিগের তলানিতে থাকা দল ব্রিসবেন রোর একরকম অপারগ হয়েই তাকে কোচ হিসেবে আনে। 

    তার হাতে দেওয়া হয় ধুঁকতে থাকা এক দলের রিবিল্ডিংয়ের দায়িত্ব। বছরের মধ্যে দল গুছিয়ে ২০১০-১১ মৌসুমে অ্যা-লিগ চ্যাম্পিয়নশিপ জেতেন পস্তেকগলু। জেতেন পরের মৌসুমেও।  চ্যাম্পিয়নশিপের ইতিহাসে প্রথম দল হিসেবে টানা দুবার শিরোপা জেতে ব্রিসবেন। এই দুই মৌসুমের মাঝখানে টানা ৩৬ ম্যাচ অপরাজিত ছিল ব্রিসবেন, যা এখনো অস্ট্রেলীয় রেকর্ড। 

    এরপর আরেক ক্লাব, মেলবোর্ন ভিক্টরিতে গেলেও এক মৌসুমের মধ্যে তার ডাক পড়ে অস্ট্রেলিয়া জাতীয় দলে। ২০১৪ বিশ্বকাপকে সামনে রেখে তাকে কোচ হিসেবে নিয়োগ দেয় অজি বোর্ড। 

    বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার জায়গা হয়েছিল গ্রুপ অব ডেথে। আগেরবারের দুই ফাইনালিস্ট, স্পেন ও নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে এই গ্রুপে ছিল ল্যাটিন পরাশক্তি চিলি। স্বাভাবিকভাবেই কোনো ম্যাচ না জিতেই বাড়ি ফিরতে হয়েছে পস্তেকগলুর শিষ্যদের। তবে পরের বছর ঘরের মাটিতে এশিয়ান কাপ শিরোপা জেতে তারা। নিজেদের ইতিহাসে এই একবারই মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পড়েছে অজিরা। 

    বোর্ডের সঙ্গে টানাপড়েনের রেশ ধরে ২০১৮ বিশ্বকাপের আগে আগে জাতীয় দলের দায়িত্ব ছেড়ে দেন পস্তেকগলু।

    দেশের বাইরে: জাপান, স্কটল্যান্ড, ইংল্যান্ড ... 

    অস্ট্রেলিয়ান ফুটবল কম্পলিট করে এরপর দেশের বাইরে পা দেন অ্যাঞ্জ। দায়িত্ব নেন জাপানিজ দল ইকোহোমা এফ মেরিনোজের। ১৫ বছর পর তাদের জেতান লিগ শিরোপা। জে-লিগে এটিই কোনো অস্ট্রেলিয়ানের জেতা প্রথম শিরোপা। 

    জাপানে পস্তেকগলুর সাফল্য নজরে আসে অনেক ইউরোপিয়ান ক্লাবেরও। প্রথম ক্লাব হিসেবে এই অজির সঙ্গে আলোচনা চালায় স্কটিশ দল সেল্টিক। ২০২১ সালে যখন সেল্টিকের দায়িত্ব নিয়েছেন, তখন মাত্রই রেঞ্জার্সের ২৫ পয়েন্ট পিছনে থেকে লিগ হাতছাড়া করেছে সেল্টিক, দশ বছরে প্রথমবারের মতো। 

    এখানে বলে রাখা ভালো, পস্তেকগলুই প্রথম অস্ট্রেলিয়ান ম্যানেজার যিনি ইউরোপের কোনো বড় ক্লাবের দায়িত্ব নিয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই, জাপানের মতো স্কটল্যান্ডেও তার আগমন নিয়ে শুরুতে অনেক হাসাহাসি হয়েছে। এখানেও কিছুদিনের মধ্যেই সব নিন্দুকের মন জয় করেন অ্যাঞ্জ। সেল্টিককে ফিরিয়ে আনেন তাদের পরিচিত রূপে। মৌসুমে শেষে ডমিস্টিক ট্রেবল জেতে স্কটিশ জায়ান্টরা- লিগ, লিগ কাপ ও স্কটিশ কাপ ঘরে তুলে। 

    স্পার্সেও প্রায় একইরকম চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন পস্তেকগলু। লাইন-বিচ্যুত এক ক্লাবকে আবার পরিচিত রূপে ফিরিয়ে আনছেন তিনি। মৌসুমের প্রথম সাত ম্যাচে ১৭ পয়েন্ট জোগাড় করেছে স্পার্স। ইতোমধ্যে ম্যান ইউনাইটেড, লিভারপুলের মতো দলকে হারিয়েছে, এমিরেটসে নগর-প্রতিদ্বন্দ্বী আর্সেনালের বিপক্ষে করেছে ড্র। 

    তবে পস্তেকগলুর জন্য এটি দল গুছানোর মৌসুম। বড় সাফল্যের কোনো চাপ এবার থাকছে না। থাকছে না ইউরোপীয় ফুটবলও। চাপমুক্ত ফুটবল খেলে এখন পর্যন্ত স্বাচ্ছন্দ্যেই এগুচ্ছে স্পার্স। এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকলে এবার ম্যাডিসনদের জন্য শীর্ষ চার ভালোভাবেই সম্ভব। মৌসুমের শুরুতে যা কল্পনাও করেনি কেউ।