কিক অফের আগেঃ মহারণের আগে খণ্ডযুদ্ধের গল্প
মিলানের মাদ্রিদ ডার্বি
ইনজুরি সময়ে রামোসের হেডে সমতায় ফেরার পর অতিরিক্ত সময়ে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদকে এক অর্থে গুঁড়িয়ে দিয়েই চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতে নিয়েছিল রিয়াল মাদ্রিদ। তীরে এসে তরী ডুবেছিল অ্যাটলেটিকোর, চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের স্বাদটা থেকে গিয়েছিল অধরাই; মাত্র দু’বছর আগের ঘটনা।
মাঝখানে শুধু বার্সেলোনার এক মৌসুমের আধিপত্য। মাদ্রিদের একসময়ের একপেশে সেই ডার্বিই এখন বাকি অনেক ম্যাচের চেয়ে বেশি উত্তেজনা ছড়ায়! লিসবনের পর মিলানেও সেই দু’দলই চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে। কিন্তু এই মিলানে এর আগে চ্যাম্পিয়নস লিগের ১১টি ম্যাচের একটিতেও জিততে পারেনি রিয়াল।
এক-এগারো!
চমকে উঠতে পারেন এই শিরোনাম পড়ে। নাহ, খেলার সাথে রাজনীতি টানা হয়েছে ভেবে ভুল করে বসবেন না। চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালের সমীকরণটা যা দাঁড়িয়েছে, তার এক অনুষঙ্গেই ওই সংখ্যার মাহাত্ম্য নিহিত!
চ্যাম্পিয়নস লিগের সবচেয়ে সফল দল রিয়াল মাদ্রিদ আজ জিতলেই তাদের ইউরোপিয়ান শিরোপা সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াবে এগারোতে। অন্যদিকে এই নিয়ে তৃতীয়বারের মতো চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে ওঠা অ্যাটলেটিকো ব্যর্থ হয়েছে আগের দু’বারই। সিমিওনের অধীনে সবগুলো প্রতিযোগিতার শিরোপা জিতলেও, এই একটি ট্রফিই অধরা রয়ে গেছে অ্যাটলেটিকোর। সান সিরোর ফাইনালে দুঃখ ঘুচবে অ্যাটলেটিকোর? নাকি ‘উনডেসিমা’ জিতে বাকি সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে ইউরোপের সবচেয়ে সফল দল রিয়াল মাদ্রিদ?
চলো, জিজু, ফিলোসফি...
খেলোয়াড় হিসেবে রিয়াল মাদ্রিদের হয়েই জিতেছিলেন চ্যাম্পিয়নস লিগ। মাত্র ৫ মাস আগে দায়িত্ব নিয়ে বদলে দিয়েছেন রিয়ালকে। এই মৌসুমও শিরোপাশূন্য কাটাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন যে রিয়াল সমর্থকেরা তাদের জন্য যেন দেবতা রূপেই আবির্ভাব ঘটেছিল জিজুর। লিগে টানা ১২ ম্যাচ জিতে রিয়ালকে দ্বিতীয় বানালেন; নিয়ে এলেন চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালেও। জিদানের হাতে চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপা দেখাটাই রিয়াল সমর্থকদের সবচেয়ে বেশি আরাধ্য।
খেলোয়াড়ি জীবনে সিমিওনে আর জিদান মুখোমুখি হয়েছেন একাধিকবার। খেলোয়াড় হিসেবে দু’জনের মাঝের ফারাকটা লক্ষনীয় তাদের কোচিং দর্শনেও। সহজ বাংলায় ‘দুই মেরুর দুই জন’। একজন গোল করতেন, পায়ের কারুকাজে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতেন গোটা দুনিয়া। অন্যজনের কাজ ছিল সেই মন্ত্রমুগ্ধ দর্শককে ধরায় নামিয়ে এনে বুঝিয়ে দেয়া এ খেলাটা শুধুই গোলের নয়। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে ধারণা করাই যায় আজকের খেলায় দু’দলের কৌশলটাও এমনই হবে। জিদানের আক্রমণাত্মক কৌশলের বিপক্ষে কাউন্টার অ্যাটাকিং ফুটবল দর্শনটাই বেছে নেবার কথা সিমিওনের!
বার্সেলোনা-বায়ার্ন মিউনিখের মতো দলকে টপকে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে জায়গা করে নিয়েছে অ্যাটলেটিকো। আর তাতে সবচেয়ে বড় অবদান ‘চলো’ সিমিওনেরই। প্রতিশোধে বিশ্বাসী নন তিনি- জানিয়েছিলেন আগেই। কিন্তু প্রতিপক্ষ তো শুধু নগর প্রতিদ্বন্দ্বীই নয়; লিসবনের সেই ফাইনালে এই দলের কাছে হারটাই এখনও তাড়া করে ফেরে সিমওনেকে। প্রতিশোধের এমন মোক্ষম সুযোগ তো কমই আসে!
অন্যদিকে জিদানের রিয়াল মাদ্রিদ তুলনামুলক সহজ প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধেই জিতে উঠে এসেছে ফাইনালে। পুরো মৌসুমের ফল বিচার করলেও এগিয়ে রাখতে হচ্ছে রিয়ালের বিপক্ষে শেষ দশ ম্যাচে মাত্র একটিতে হারা অ্যাটলেটিকোকেই।
দু’দলের কৌশল যতোই বিপরীত হোক, সাম্প্রতিক ফর্মের বিচারে যতোই মাদ্রিদের দুই দলকে সমান ধরে হিসেব কষা যাক- একটা দিক দিয়ে রিয়ালের ছায়ায় ঢাকাই থাকতে হচ্ছে অ্যাটলেটিকোকে। মনস্তাস্ত্বিক দিক থেকে রিয়ালের চেয়ে ঢের পিছিয়ে মাদ্রিদের লাল-সাদা স্ট্রাইপের দলটি। ফাইনালের মতো মহা-গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে মাঠের খেলার পাশাপাশি রোনালদো-বেল-রামোসদের সাথে স্নায়ুযুদ্ধে লড়াই করবার ক্ষমতাটা কাগজে কলমে অ্যাটলেটিকোর কমই। আর এসব ম্যাচে ব্যবধান গড়ে দিতে এই একটা কারনই যথেষ্ট। উদাহরণ হিসেবে ইউরোপা কাপের ফাইনালে সেভিয়ার কাছে লিভারপুলের হারটাই টানা যেতে পারে।
রোনালদো-গ্রিজম্যান, মদ্রিচ-গাবি
"আমার মনে হয় না অ্যাটলেটিকোর কোনো খেলোয়াড় এই রিয়ালে সুযোগ পাবে। সব দিক দিয়েই রিয়াল দল হিসেবে অনেক ভালো।"
গ্যারেথ বেলের এমন কথায় অবাক হয়েছিলেন অনেক রিয়াল সমর্থকও। ওয়েলশম্যানের ওই যুক্তির বিপক্ষে সবার আগে উঠে এসেছিল গ্রিজম্যানের নামটাই। তোরেস যতই নতুন করে নিজেকে খুঁজে পান না কেন, ফাইনালে অ্যাটলেটিকোর সবচেয়ে বড় ভরসা ফ্রেঞ্চ এই ফরোয়ার্ড। অন্যদিকে বরাবরই মতো রোনালদোই রিয়ালের ভরসা। টানা ছয় বার পুরো মৌসুমে ৫০ গোলের রেকর্ড তো গড়েছেন আগেই। চ্যাম্পিয়নস লিগেও করেছেন ১৬ গোল। সামনে শুধু নিজের গড়া ১৭ গোলের রেকর্ডটাই। নিজের পুরনো রেকর্ডটা আরেকবার ছুঁয়ে দিয়ে রিয়ালের উনডেসিমা জয়েও ভূমিকা রাখতে চাইবেন রোনালদো। পর্তুগীজ এই তারকার মতো অতো না হলেও, গ্রিজম্যান নিজেও এই মৌসুমে করেছেন ৩২ গোল।
এই দুই ফরোয়ার্ডের লড়াইটা নির্ধারন করতে পারে ম্যাচের ফল। কিন্তু ওই লড়ায়ের ফলটা নির্ধারণ করে দিতে পারেন দুই মিডফিল্ডার। জিদানের অধীনে মদ্রিচ যেন আরও সপ্রতিভ। মাঝমাঠ নিয়ন্ত্রণ করে রিয়ালের বেশিরভাগ আক্রমণেও সাহায্য করেছেন এই ক্রোয়েট। তবে ফাইনালে তার জন্য কঠিন এক পরীক্ষাই অপেক্ষা করছে। অ্যাটলেটিকোর মাঝমাঠের সেনাপতি গাবিও যে কম যান না। গোল বন্যা হবার সম্ভাবনা যেহেতু কম সেক্ষেত্রে মাঝমাঠের লড়াইটাই বরং হয়ে উঠতে পারে আরও আকর্ষনীয়।
লড়াইয়ের ভেতর ছোট ছোট আরও কতোগুলো লড়াই। টান-টান উত্তেজনা, একটু ভুলেই সর্বনাশ। মোটা দাগে ফাইনালের বৈশিষ্ট্যগুলো তো এমনই।
জরিপঃ