• অন্যান্য
  • " />

     

    অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার: পাদপ্রদীপের আলো যাদের খুঁজে পায় না

    অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার: পাদপ্রদীপের আলো যাদের খুঁজে পায় না    

    একটা ফুটবল ম্যাচ জেতানোর সবচেয়ে বড় কৃতিত্বটা কে পান? যিনি গোল করেছেন সেই ফরোয়ার্ডই তো? অথবা দুর্দান্তভাবে রক্ষণ সামলানো ডিফেন্ডাররা, বা দারুণ কিছু সেভ করা গোলরক্ষক, অথবা আরেকটু বড় পরিসরে ভাবলে ডাগআউটে দাঁড়িয়ে থাকা কোচ বা ম্যানেজার। এর বাইরে আর কাউকে কৃতিত্ব দেওয়ার কথাটা সচরাচর মনেই আসে না কারোর। তবে  ডাগআউটে দাঁড়িয়ে থাকা ওই উত্তেজিত ম্যানেজারকে সামলানোর জন্য, তাঁকে ট্যাকটিক্যাল সাহায্য করার জন্য, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে মতামত দেওয়ার জন্য আরো একজন মানুষ থাকেন। তিনিই অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার, কৃতিত্বের ভাগ না পেলেও নিজের কাজটা যাকে করে যেতেই হয়।

    অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারদের মধ্যেও রকমফের আছে। সব ক্ষেত্রে অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের কর্মপরিধি বা কাজের ধরণ একই থাকে না। কোন কোন ক্ষেত্রে কাজের বিস্তারে ম্যানেজারকেও ছাড়িয়ে যান তিনি, ম্যানেজারের মতো অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারও জায়গা করে নেন ফুটবল ইতিহাসে। নটিংহ্যাম ফরেস্টের কিংবদন্তিতুল্য ম্যানেজার ব্রায়ান ক্লফের সহকারী পিটার টেইলর, লিভারপুলের বিল শ্যাঙ্কলির অ্যাসিস্ট্যান্ট বব পেইসলি (যিনি পরবর্তীতে নিজেও ম্যানেজার হিসেবে বেশ ভালো করেছিলেন), রিয়াল মাদ্রিদে কার্লো আনচেলত্তির সহকারী জিনেদিন জিদান, প্রত্যেকেই নিজেদের অন্যান্য পরিচয়ের পাশাপাশি অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার হিসেবেও বিখ্যাত। অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারদের গল্পের আদ্যোপান্ত বলেছে দ্যা কোচেস ভয়েস

    অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার কারা?

    পদের নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে, ম্যানেজারের সহকারী ব্যক্তিই অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার। অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের ওপর সাধারণত ম্যানেজারের পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস থাকে। দুজনের চিন্তার ধরণ প্রায় একই হয়, তাই দলের গঠন, ফরমেশন, খেলার ধরণ প্রভৃতি বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেন।

    বিল শ্যাঙ্কলি ও বব পেইসলি; Image Source: Getty Images

    অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজাররা সাধারণত পাদপ্রদীপের আলোতে খুব বেশি আসেন না, কিন্তু কোচিং স্টাফ ও খেলোয়াড়দের সাথে তাঁর কাজ ও সমন্বয় চলতেই থাকে। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তের ভারটা মূল ম্যানেজারের হাতে থাকলেও, অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারদের কাজকে ছোট করে দেখার কোন সুযোগ নেই। আর আধুনিক ফুটবলে তো অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারদের গুরুত্ব বাড়ছে প্রতিনিয়ত।

    অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারদের কী ট্রেনিং থাকা প্রয়োজন?

    বিবর্তনের সাথে সাথে ফুটবল প্রতিনিয়ত এগিয়ে চলেছে। তাই কোচ বা ম্যানেজারদেরও এর সাথে পাল্লা দিয়ে নিজেদের পরিবর্তন করতে হয়। ম্যানেজার, অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারদেরও এখন কিছু ট্রেনিং থাকা প্রয়োজন। চ্যাম্পিয়নস লিগ বা ইউরোপা লিগে ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করতে যেমন উয়েফা প্রো লাইসেন্সের দরকার হয়, তেমনি কোন পেশাদার ক্লাবের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের দায়িত্ব পালনের জন্য প্রয়োজন হয় উয়েফা বি লাইসেন্স।

    পেপ গার্দিওলা ও তাঁর সহকারী হুয়ানমা লিলো; Image Source: Getty Images

    এর পাশাপাশি, ফুটবলের ট্যাকটিক্যাল ব্যাপারগুলো নখদর্পণে রাখা চাই। গ্রুপ ম্যানেজমেন্ট, দলের মধ্যকার সমন্বয়, খেলোয়াড় ও কোচিং স্টাফের সাইকোলজি, খেলোয়াড়দের থেকে সেরাটা বের করে আনার ক্ষমতা, এগুলোও একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের ঝুলিতে থাকা প্রয়োজন।

    হেড কোচের সাথে কাজের সমন্বয়

    হেড কোচ এবং অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের প্রতিদিনের কাজে যেমন সম্ন্বয়ের প্রয়োজন, একই সমন্বয় থাকার প্রয়োজন দুজনের বিশ্বাস এবং মানসিকতায়। হেড কোচের দর্শন ও কাজের পরিপূরক হিসেবে ভূমিকা পালন করেন অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার।

    দলের ট্রেনিংয়ের ধরণ ও প্রয়োজনীয় অগ্রগতি হচ্ছে কিনা, সেই ব্যাপারে দুজনেই নজরদারি করেন। মৌসুম শুরু হয়ে গেলে ম্যাচ আর ট্রেনিংয়ের বাইরে আলাদা করে তেমন সময় পাওয়া যায় না, তবুও দলের অগ্রগতির খেয়ালটা রাখতেই হয়।

    টটেনহ্যামের খেলোয়াড়দের কিছু একটা বুঝিয়ে দিচ্ছেন অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার হেসুস পেরেজ; Image Source: Getty Images

    খেলোয়াড়দের কাছ থেকে দরকারি তথ্য জোগাড় করে তার মূল বিষয়গুলো হেড কোচের কাছে পৌঁছে দেওয়াটাও অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এর ফলে হেড কোচ অল্প সময়েই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন, দলের সেরাটা বের করে আনতে বেশি সময় দিতে পারেন। এজন্য খেলোয়াড়দের ভালো এবং কার্যকরী সম্পর্ক রাখাটা অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। খেলোয়াড়রা যেন মন খুলে কথা বলতে পারে, নিজেদের পর্যবেক্ষণ, সমস্যা ও সমাধানগুলো জানাতে পারে, সেই পরিবেশটাও নিশ্চিত করতে অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার কাজ করেন।

    সময়ে সময়ে ম্যানেজার এবং অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের মধ্যে তর্ক-বিতর্কও হতে পারে। তবে অবশ্যই সেটা দলের মঙ্গলের স্বার্থে। সব ক্ষেত্রে যে তাঁদেরকে ঐক্যমত্যে পৌঁছাতেই হবে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, কিন্তু নিজেদের মতভেদ ভুলে দলের জন্য সেরা সিদ্ধান্তটা নিতে জানতে হবে দুজনকেই।

    অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের দায়িত্ব

    অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের কর্মপরিধি নির্ভর করে মূল ম্যানেজারের ওপর। স্বাভাবিকভাবেই সব অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের দায়িত্ব একই নয়। সাধারণভাবে দলের পরিকল্পনা, ভিডিও বিশ্লেষণ, দলের অভ্যন্তরীণ মিটিং ডাকা ও পরিচালনা করা, এবং পরিকল্পনার বাস্তবায়নে সাহায্য করাই অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।

    হুয়ান কার্লোস উনজুয়ে এবং লুইস এনরিকে; Image Source: Getty Images

    আগে যেমনটা বলা হয়েছে, খেলোয়াড়দের সাথে অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের ভালো সম্পর্ক থাকা চাই। একই কথা প্রযোজ্য কোচিং স্টাফের অন্যান্য সদস্যদের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও। দলের ট্রেনিংয়ের ক্ষেত্রে সমন্বয়, কন্ডিশনিং কোচের সাথে সেশন, অ্যানালাইসিস সেশন, মিডিয়া টিমের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা, এগুলোও অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের দায়িত্ব। সহজ কথা, ম্যানেজারের জন্য যেসব কাজগুলো সময় ও শ্রমসাপেক্ষ, সেগুলোই করবেন অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার, চেষ্টা করবেন যেন ম্যানেজারের মনোযোগের কেন্দ্রে থাকে দল এবং দলের খেলোয়াড়রাই।

    ট্রেনিং গ্রাউন্ডেও অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের কিছু সেশন থাকতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়তো ম্যানেজার মনোযোগ দেবেন ম্যান-ম্যানেজমেন্টে, সেক্ষেত্রে অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের ওপর দায়িত্ব থাকবে ট্রেনিং পরিচালনা করার। সাধারণত সেট-পিস ট্রেনিং, সেট-পিসে গোল করা ও গোল ঠেকানোর জন্য দলের সদস্যদের আলাদা আলাদা ভূমিকা প্রদান, প্রতিপক্ষকে বিশ্লেষণ, ম্যাচের আগে পরিকল্পনা, এসব কাজের দায়িত্ব থাকে অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের ওপর।

    ম্যাচ চলাকালীন অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের ভূমিকা

    ট্রেনিংয়ের ক্ষেত্রে সাধারণত ম্যানেজারের চিন্তাভাবনা ও দর্শনকেই খেলোয়াড়দের মাঝে প্রয়োগ করার কাজটা করেন অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার। ম্যাচের আগেও পরিকল্পনায় কোন বদল এলে সেটা খেলোয়াড়দের বুঝিয়ে দেন তিনি। ম্যাচের মধ্যকার কোন বিশেষ পরিস্থিতি, যেমন দল যদি ১-০ ব্যবধানে পিছিয়ে পড়ে, প্রতিপক্ষের কোন খেলোয়াড় যদি লাল কার্ড দেখেন, বা নিজের দলের কোন গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় যদি চোটে পড়েন, সেক্ষেত্রে করণীয় কী হবে, প্রস্তুতির সময়ে এই ব্যাপারগুলোও মাথায় রাখার চেষ্টা করেন অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার। ম্যাচের ঠিক আগে খেলোয়াড়দের গা গরমের পর্বটাও পরিচালনা করেন তিনি, পাশাপাশি হেড কোচের কানে পৌঁছে দেওয়ার মতো খবরের সন্ধানে চোখ রাখেন প্রতিপক্ষের শিবিরেও।

    পেপ লিন্ডার্সের সাথে ইয়ুর্গেন ক্লপ; Image Source: Getty Images

    ম্যাচ চলাকালীনও হেড কোচকে নানাভাবে সাহায্য করেন অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার। খেলাটা কীভাবে চলছে, কীভাবে চলা উচিত, সেই ব্যাপারে হেড কোচের সাথে নিজের মতামত আদানপ্রদান করেন। সাবস্টিটিউট হিসেবে যারা নামেন, তাদেরকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও নির্দেশনা দেন, পাশাপাশি ম্যাচের গুরুত্বপূর্ণ কোন মুহূর্ত, ক্লিপ বা তথ্যও হেড কোচকে জানিয়ে রাখেন অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার।

    ম্যাচ শেষেও হেড কোচের সাথে মিটিংয়ে বসেন অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার, কথা বলেন ম্যাচের সার্বিক অবস্থা নিয়ে। ম্যাচ-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে কী কী বলা হবে, সে ব্যাপারেও আলোচনা করেন তাঁরা।

    অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের প্রকারভেদ

    অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার অনেক ধরণেরই হতে পারেন। সাধারণভাবে মূল কোচরাই ঠিক করেন যে তাঁরা ঠিক কোন ধরণের সহকারী বেছে নেবেন। অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারদের ক্ষেত্রে খুব বেশি যে ব্যাপারটা লক্ষ্যণীয়, তাঁরা প্রায় সকলেই সাবেক খেলোয়াড় এবং খেলাটার প্রতি ভালোবাসা থেকেই চলে আসেন কোচিং পেশায় এবং ধীরে ধীরে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে চান। এই ধরণের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজাররা ড্রেসিংরুমের অবস্থাটা খুব ভালো বোঝেন। আর ক্লাবে যদি তাঁর নিজের খেলার অভিজ্ঞতা থাকে, তাহলে তো কথাই নেই। হেড কোচের জন্যও সেক্ষেত্রে কাজটা সহজ হয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় আইতর কারাঙ্কার কথা, রিয়াল মাদ্রিদে হোসে মরিনহোর সহকারী ছিলেন যিনি। এছাড়া বার্সেলোনায় লুইস এনরিকের অধীনে কাজ করা হুয়ান কার্লোস উনজুয়েও একই ধরণের উদাহরণ। রিয়াল মাদ্রিদ কোচ কার্লো আনচেলত্তির অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার জিনেদিন জিদানকেও রাখতে হবে একই বন্ধনীতে।

    কার্লো আনচেলত্তি ও তাঁর তৎকালীন সহকারী জিনেদিন জিদান; Image Source: Getty Images

    আরেক ধরণের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার রয়েছেন, যারা পেশাদার পর্যায়ে ফুটবল খেলেননি বললেই চলে, বা খেললেও অভিজ্ঞতা খুব বেশি নেই। কিন্তু খেলাটার ব্যাপারে পর্যাপ্ত একাডেমিক জ্ঞান রয়েছে তাঁদের। খেলাটা নিজেরা সরাসরি না খেললেও খুব বেশি সমস্যা হয় না তাঁদের, তাত্ত্বিক জ্ঞানের সাথে আধুনিকতার সংযুক্তিতে তাঁরাও নিজেদের প্রমাণ করেণ সম্ভাবনাময় রূপে। ম্যানচেস্টার সিটিতে পেপ গার্দিওলার সহকারী হুয়ানমা লিলো, টটেনহ্যাম ও পিএসজিতে মরিসিও পচেত্তিনোর সহকারী হেসুস পেরেজ এবং লিভারপুলে ইয়ুর্গেন ক্লপের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার পেপ লিন্ডার্সের নাম নেওয়া যায় উদাহরণ হিসেবে।

    অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারদের একটা বড় অংশের স্বপ্ন থাকে হেড কোচ হওয়ার। অনেকেই স্বপ্নের সেই সিঁড়িতে পা রাখার সৌভাগ্য অর্জন করতে পারেন, অনেকেই পারেন না। তবে তাতে তাঁদের চেষ্টা থেমে থাকে না নিশ্চয়ই, তা পাদপ্রদীপের আলো তাঁদের স্পর্শ করুক বা না করুক!