• কোপা আমেরিকা
  • " />

     

    সিজার লুইস মেনোত্তি : ফুটবলেই যার জীবনপাঠ

    সিজার লুইস মেনোত্তি : ফুটবলেই যার জীবনপাঠ    

    জুবায়ের তানিন 
     


    ১৯৭৮।  মারিও কেম্পেস; ‘এল ম্যাটাডোর। করডোবার আরেক গোল্ডেন বয় ড্যানিয়েল বারতোনি। রেফারি সার্জিও গোনেল্লার লম্বা বাঁশি। ৩-১ ব্যবধানে ডাচদের থেমে যাওয়া টোটাল ফুটবলের ছন্দ। জেগে ওঠা এল মনুমেন্টাল স্টেডিয়াম। কেম্পেস-বারতোনি-পাসারেলাদের ভিক্টোরি ল্যাপ। 

     

    বুয়েনোস আইরেসের এই স্টেডিয়ামের আশেপাশেই ছিল অসংখ্য টর্চার সেল। নেপথ্যে স্টেডিয়ামের ভিআইপি স্ট্যান্ডে বসে থাকা কার্লোস ভিদেলা আর তার স্বৈরশাসন। ফলাফল; ৩০ হাজার আর্জেন্টাইনের রীতিমতো হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়া। পুরো দেশটার হয়ে ওঠা জীবন্ত নরক, টর্চার সেল।  

     

    টানটান উত্তেজনার ঠিক ১২০ মিনিটের মাথায় বাঁশিতে লম্বা ফুঁ দিলেন রেফারি সার্জিও গোনেল্লা। আর্জেন্টিনার ডি-বক্সে তখন বল নিয়ে আরও একবার আক্রমণে উঠেছিল হল্যান্ড। বাঁশির শব্দে ডাচদের টোটাল ফুটবলের ছন্দ থেমে গেল। জেগে উঠলো বুয়েনোস এইরেস। ১৯৭৮ বিশ্বকাপ ফাইনালের স্কোরলাইন তখন, আর্জেন্টিনা ৩-১ হল্যান্ড। 

    আলিবসেলেস্তে সমর্থকদের ফেটে পড়া উল্লাসে কান পাতা দায় এল মনুমেন্টাল স্টেডিয়ামে। আর্জেন্টিনা জিতেছে তাদের প্রথম বিশ্বকাপ, তাও ঘরের মাঠে। সেই বিশ্বকাপ কেবলই একটা অর্জন নয়, আর্জেন্টাইনদের কাছে ছিল গ্রীষ্মের দীর্ঘ খরতাপের পর এক পশলা স্বস্তির বৃষ্টি। তপ্ত মরুতে তৃষ্ণার্ত, ক্লান্ত-শ্রান্ত বেদুইনরা যেভাবে শান্তির বারি খুঁজে বেড়ায়, তেমনি ফুটবলকে কেন্দ্র করে আর্জেন্টাইনরাও একটু শান্তি খুঁজে বেড়াচ্ছিল। 

     

    নিজ দেশের মানুষদের জন্য শান্তির হাওয়া এনে দিয়েছিলেন করডোবার দুই গোল্ডেন বয়, মারিও কেম্পেস-ড্যানিয়েল বার্তোনি। বিশ্বকাপ জেতানো গোল করে পরেরদিনের পত্রিকার হেডলাইনে জায়গাও করে নিলেন তারা। ক্যামেরার লেন্স আর ফ্ল্যাশলাইটও খুঁজে নিচ্ছিল তাদের। অধিনায়ক ড্যানিয়েল পাসারেলা হাতে তুলে নিলেন আরাধ্য শিরোপা। রাজধানী বুয়েন্স এইরেস থেকে ছড়িয়ে গেল আর্জেন্টাইনদের বিশ্বজয়ের গল্প। এরপর বিশ্বকাপ ট্রফি হাতে নিয়ে স্টেডিয়ামের রানিং ট্র্যাকে ভিক্টোরি ল্যাপে ব্যস্ত হয়ে পড়েন কেম্পেস-পাসারেলারা। 

    আর্জেন্টিনার ঐতিহাসিক এই জয়ের নেপথ্যে ছিলেন ডাগ আউটে দাঁড়ানো লিকলিকে গড়নের এক ভদ্রলোক। সিজার লুইস মেনোত্তি। শারীরিক গঠন হালকা-পলকা হওয়ায় যার ডাকনাম, ‘এল ফ্লাকো’। যার লম্বা চুল নেমে এসেছে ঘাড় অবধি। আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপজয়ী এই কোচ ফুটবল তো ভালোবাসতেনই। ভালোবাসতেন ধুমপান করতেও। তর্জনী-মধ্যমার মাঝখানে একটা জ্বলন্ত সিগারেট যেন তার সিগনেচারই ছিল। 

     

    তুমুল ধূমপায়ী সেই লোকটার হাত ধরেই কেম্পেসরা স্বর্ণালি ট্রফিটা জিতেছিলেন সামরিক শাসনের মোড়কে। সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে সেনা শাসক হোর্হে রাফায়েল ভিদেলা তখন বসেছেন আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্টের মসনদে। তার একনায়কতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় ততদিনে ভিন্ন মতাদর্শের প্রাণ হারিয়েছেন অনেকেই। গোটা দেশটাই হয়ে উঠেছিল ‘টর্চার সেল’। সাধারণ নাগরিকদের প্রাণও হয়ে উঠেছিল ওষ্ঠাগত। ভিদেলার মোট সাত বছরের শাসনামলে ৩০ হাজারেরও বেশি আর্জেন্টাইন নাগরিকের কোনো হদিসই পাওয়া যায়নি। তারা হারিয়ে গেছেন কালের অতল গহ্বরে। 

    রাজনৈতিক এই সহিংসতার প্রভাব সেবার বিশ্বকাপ ফুটবলেও পড়েছিল। বিশেষ করে পেরুর বিপক্ষে আর্জেন্টিনার ৬-০ গোলে জয়ের পর অনেক প্রশ্নই ছুটে এসেছিল। জোর দাবি আছে, আর্জেন্টিনাকে ফাইনালে তুলতে সেই ম্যাচটা পেরুর স্বৈরশাসকদের সাথে মিলে পাতিয়েছিলেন ভিদেলা। সেসব ছাপিয়ে উত্তাল সেই সময়কার নরকতূল্য আর্জেন্টিনায় মেনোত্তির শিষ্যরা নান্দনিক ফুটবলে ফিরিয়েছিলেন স্বর্গের শীতল হাওয়া। 

    স্বাভাবিকভাবেই বামপন্থী রাজনীতিতে বিশ্বাসী মেনোত্তি একেবারেই পছন্দ করতে না ভিদেলাকে। কথিত আছে, বিশ্বকাপ ট্রফি নেয়ার সময় ভিদেলার সাথে হ্যান্ডশেকও করেননি তিনি। কারণ স্বভাবে দার্শনিক এই মানুষটির নিজের মতাদর্শের ওপর ছিল অগাধ বিশ্বাস। তার শিষ্যরাও সেটা অনুসরণ করতেন সানন্দে। 

     

    ১৯৩৮ সালে রোজারিওতে জন্ম নেয়া মেনোত্তির কোচিংয়ে আসার গল্পটাও বেশ মজার। জাতীয় দলের হয়ে ৩ বছরের ক্যারিয়ারে খেলেছেন মোট ১১ ম্যাচ। বুটজোড়া তুলে রেখেছিলেন ১৯৬৯ সালে। এর বছরখানেক পর বন্ধু মিগুয়েল হুয়ারেজকে নিয়ে চড়ে বসেন মেক্সিকোর বিমানে ১৯৭০ বিশ্বকাপ দেখতে। মেনোত্তির নয়ন জুড়ালো ব্রাজিলের ড্রিম টিমের ছন্দময় খেলায়। মেনোত্তির সিদ্ধান্ত পাকা, কোচিং শুরু করবেন। নেপথ্যে তার স্বপ্ন, আর্জেন্টিনাও একদিন এমন নান্দনিক ফুটবল খেলবে। 

     

    দেশে ফিরে কোচিংয়ের দীক্ষা নিয়ে দাঁড়ান নিউ ওয়েলস ওল্ড বয়েজের ডাগ আউটে। তবে নামডাক ছড়াল ১৯৭৩ সালে হ্যারিকেনকে মেট্রিপলিটানো চ্যাম্পিয়নশিপ জেতানোর পর। সবাই যতটা না অবাক হয়েছিল তার চেয়ে বেশি সমালোচনা হচ্ছিল মেনোত্তির ফুটবল দর্শন আর ট্যাকটিকস নিয়ে। কারণ ওই ধরনের ফুটবলের সাথে আর্জেন্টিনার তখনও পরিচয় হয়নি; ওয়ান টাচ মুভমেন্ট, নাটমেগ, ওভারল্যাপ আর দুর্দান্ত পাসিংয়ে দৃষ্টিনন্দন খেলা। যদিও আর্জেন্টিনা তখন বিশ্বাসী ছিল আগ্রাসী, গতিময়, শরীরী ফুটবলে। বহুল চর্চিত সেই ‘এন্টি-ফুটবল’ নীতির বাইরেও যে খেলা যায় আর্জেন্টিনাকে মেনোত্তিই দেখিয়েছিলেন। 

    ‘দার্শনিক’ খ্যাত মেনোত্তির একটা প্রকট ছাপ পাওয়া যায় তার ফুটবল দর্শনেও। দর্শন আর শিল্পের মিশেলে গড়া নিজের সেই ট্যাকটিকসকে মেনোত্তি বলতেন ‘বামপন্থী ফুটবল’। যেখানে ত্যাগ আর সংগ্রামই শেষ কথা। তার মতে, বামপন্থী ফুটবল ঠিক যাপিত মানবজীবনের মতো; যেখানে শত প্রতিকূলতার মাঝেও ত্যাগ-তিতিক্ষা দিয়ে জয় ছিনিয়ে আনতে হয়।  

    ১৯৭৪ সালের বিশ্বকাপটা আর্জেন্টিনার কাছে বিভীষিকাময় ছিল। কোনোরকমে প্রথম রাউন্ড উতরে গেলেও দ্বিতীয় রাউন্ডে আর পাত্তা পায়নি আলবিসেলেস্তেরা। ইয়োহান ক্রুইফের হল্যান্ড আর ‘টোটাল ফুটবল’-এর কাছে ৪-০ গোলে হারের পরই মূলত বেজে যায় বিদায় ঘণ্টা। বিধ্বস্ত আর্জেন্টাইনদের দরকার ছিল বিশাল একটা পরিবর্তনের। সেই পরিবর্তনের মূল প্রভাবক হয়ে এলেন মেনোত্তি। প্রথমেই ফুটবলারদের দিলেন নিজের ভেতর লালিত দর্শনের বার্তা, ‘সবার আগে দল।’

    মেনোত্তি বিশ্বাস করতেন, প্রতিষ্ঠিত একজন ফুটবলারের কাজ কেবল বুটের ছোঁয়ায় হাজার হাজার দর্শককে আনন্দে ভাসানোই নয়। বরং ফুটবল পায়ে মানুষের স্বপ্ন-অনুভূতির ভাষান্তরও করা। গোটা আর্জেন্টিনার স্বপ্ন ছিল একটা বিশ্বকাপ জেতা। দার্শনিক মেনোত্তির ছোঁয়ায় ১৯৭৮ সালে কেম্পেসরা সেই স্বপ্নকে রুপ দিয়েছেন বাস্তবে, ক্রুইফের সেই হল্যান্ডকে হারিয়েই। 

    অবশ্য সেবার একটা দুঃসাহসিক কাজ করে বসেছিলেন মেনোত্তি। ১৭ বছরের তরুণ তুর্কি দিয়েগো ম্যারাডোনা দারুণ ছন্দে থাকলেও তাকে বিশ্বকাপ স্কোয়াডে রাখেননি তিনি। তরুণ বয়সে বিশ্বকাপের চাপ সামলাতে পারবেন না বলে। যদিও ১৯৮৬ সালে ম্যারাডোনা একাই বিশ্বকাপ জিতিয়েছিলেন দেশকে। 

    এর ওপর মেনোত্তির ফুটবল স্কুলের মূল লক্ষ্য ছিল ‘রাফ অ্যান্ড টাফ’-এর চাদর থেকে বেরিয়ে আর্জেন্টিনার ফুটবলে সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনা। ম্যারাডোনা সেই ধাচে খেলতে পারবেন কিনা, সেটাও ছিল মেনোত্তির চিন্তার কারণ। আর্জেন্টাইনদের বিশাল ফুটবল ইতিহাসে এই ধারণাকে বলা হয় ‘মেনোত্তিজম’। ফুটবলকে উপভোগ্য করে তুলতে যা যা করা দরকার, সেটাই করতে রাজি ছিলেন মেনোত্তি আর তার শিষ্যরা। মেনোত্তিজমে ম্যাচ জেতার চেয়ে মাঠের খেলায় অলংকরণই ছিল মূখ্য।

     

    মেনোত্তির অধীনে ৮ বছরে আর্জেন্টিনার ট্রফি ক্যাবিনেটে কেবল একটা বিশ্বকাপ ছাড়া আর কিছুই উঠেনি। তবুও কেন এত চর্চা তাকে নিয়ে? ফ্লুইড বল মুভমেন্ট আর পাসিংকে ভরসা করে যে দারুণ ছন্দে দলকে ফুটবল খেলাতেন, সেটাই হয়ে উঠেছিল চর্চিত বিষয়। পাসিং ফুটবলে তার বিশ্বাস ছিল প্রকট, শিষ্যদেরও বলতেন গোলও একটা পাসই। শুধু সতীর্থের জায়গায় গোলপোস্ট সেটা আটকাচ্ছে। এই ধারণাকেই উপজীব্য করেই একটা লম্বা পথ পাড়ি দিয়েছিলেন মেনোত্তি। যেখানে অর্জনের চেয়ে তার প্রভাবের রোশনাই বেশি; গানের সুরের মতো ছন্দময় ফুটবল, হাতে আঁকা নিখুঁত একটা ছবির মতো নিখুঁত পাসিং। 

     

    ‘দ্য বিউটিফুল গেম’ খ্যাত ফুটবলের বিশাল মঞ্চে মেনোত্তিও অন্যতম এক চরিত্র। দার্শনিক, ধূমপায়ী তো বটেই খানিকটা উদাসীও বলা চলে। তার চেয়ে ভালো টেকনিক-ট্যাকটিক্সের কোচও আর্জেন্টিনা পেয়েছে। কেউ সফল হয়েছে, কেউ ব্যর্থতার বোঝা মাথায় নিয়ে সরে দাঁড়িয়েছে। কারো ট্রফি ক্যাবিনেট হয়তো তার চেয়েও ভারী। হয়তো ম্যারাডোনার ‘ঈশ্বর’ হয়ে ওঠার ‘৮৬ বিশ্বকাপটাই আর্জেন্টাইন সমর্থকদের কাছে স্মরণীয়। বিশেষজ্ঞদের যতই আপত্তি থাকুক মেনোত্তির কোচিংয়ের ধরন কিংবা দর্শন নিয়ে, যে উত্তাল সময়ে মেনোত্তির দলটা বিশ্বকাপ জিতেছিল, সেটার সাথে কোনো কিছুর তুলনা হয়?

    ইতিহাস স্বাক্ষী, ১৯৭৮ সালে নরকে পরিণত হওয়া আর্জেন্টিনায় স্বস্তি ফিরিয়েছিল মেনোত্তির দল। যতই তর্ক-বিতর্ক হোক, সেখানেই স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে; আর্জেন্টিনার প্রথম বিশ্বকাপজয়ী কোচ লুইস সিজার মেনোত্তি। যার লিকলিকে শরীরের ঘাড় অবধি নেমে এসেছে চুল। চিন্তিত চেহারায় দার্শনিকতার ছাপ, তর্জনী-মধ্যমার ফাঁকে গুঁজে রাখা জলন্ত সিগারেট আর মাথাভর্তি চিন্তা, কীভাবে ফুটবলটাকে আরও সুন্দর করে খেলা যায়।