• ইউরো
  • " />

     

    ইউরো-স্মৃতির সরণির বাঁকে: পর্ব ৭

    ইউরো-স্মৃতির সরণির বাঁকে: পর্ব ৭    

    ইউরোপীয় পরাশক্তি হিসেবে ফ্রান্স অংশগ্রহণ করেছিল প্রতিটি ইউরোতেই। কিন্তু আকাঙ্ক্ষিত সর্বোচ্চ সাফল্য আসছিলো না। অবশেষে, ইউরোর ইতিহাসের চব্বিশতম বছরে এসে ফাঁড়া কাটলো ফরাসিদের। নিজের দেশে, নিজেদের মাঠে, নিজেদের দর্শকদের সামনে শিরোপা উঁচিয়ে ধরলো মিশেল প্লাতিনির দল।

    ইউরোপীয় ফুটবলের ফুটবলীয় মহোৎসব উয়েফা ইউরোপীয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ, বা সংক্ষেপে ইউরোর সতেরোতম আসর চলাকালে, দ্যা অ্যাথলেটিক হেঁটেছে স্মৃতির সরণি বেয়ে, যে পথের বাঁকে বাঁকে উঠে এসেছে আগের ষোল আসরের জানা-অজানা খুঁটিনাটি তথ্য আর গল্পের পেছনের গল্পগুলো। এই সিরিজের সপ্তম পর্বে থাকছে ১৯৮৪ সালে অনুষ্ঠিত ইউরোর সপ্তম আসর আর ফ্রান্সের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গল্প।

    Image Source: Getty Images

    কেমন ছিল সেই ইউরো?

    ১৯৮৪ ইউরোতে ফ্রান্সের খেলা ধরন ছিল মনোমুগ্ধকর। ওই টুর্নামেন্টের সেটা দল তো বটেই, ইউরোর প্রথম চব্বিশ বছরের ইতিহাসে অমন আধিপত্য দেখিয়ে শিরোপা জিততে পারেনি অন্য কোন দলই। 

    চার বছর আগে, ইতালিতে অনুষ্ঠিত ইউরোটা ভালো যায়নি ফ্রান্সের জন্য। চার বছর পরের ইউরোর স্বাগতিক হওয়ার জন্য ফ্রান্সকে বেছে নেওয়ার পদ্ধতি নিয়েও অনেকের মনে কিঞ্চিৎ সন্দেহ ছিল। বড় মঞ্চে ফ্রান্সের ভালো পারফরম্যান্স এসেছিল বিক্ষিপ্তভাবে, অনেক ক্ষেত্রে খেলাটার প্রতি তাদের সমর্থকদের ভালোবাসা নিয়েও উঠেছিল প্রশ্ন। তবে সাম্প্রতিক পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে, এই ইউরোতে ফরাসিরাই ছিল ফেভারিট। এর সাথে ব্যালন ডি'অর বিজয়ী মিশেল প্লাতিনির উপস্থিতিতে টুর্নামেন্ট শুরুর আগেই ফ্রান্সের হাতে শিরোপা দেখছিলেন অনেকেই।

    "টুর্নামেন্টের শুরু থেকেই সবাই আক্রমণাত্মক ফুটবল প্রত্যাশা করছিলেন," ইউরোর আগে ওয়ার্ল্ড সকার ম্যাগাজিনে লিখেছিলেন লেসাইল ভেরমন, "আর স্বাগতিকরাই ছিলেন আক্রমণাত্মক ফুটবলের সবচেয়ে বড় বাহক। টুর্নামেন্টের আগে প্রীতি ম্যাচে পশ্চিম জার্মানিতে ১-০ ব্যবধানে জয়ের ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছিল তাদের দুর্দান্ত আকর্ষণীয় ফুটবল। মাঝমাঠে অ্যালেইন জিরেস, জ্যঁ তিগানা এবং মিশেল প্লাতিনির উপস্থিতি ফ্রেঞ্চদের খেলার সৌন্দর্যকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল।"

    "ফ্রান্সের গোলক্ষুধা বেড়ে গিয়েছিল এই ত্রয়ীর কারণে। মাঝমাঠে বল সার্কুলেশনেও ঘটেছিল উন্নতি। তবে এই তিনজনের মধ্যে প্লাতিনিই কেড়েছিলেন বাড়তি নজর। দারুণ পাসিং আর চমৎকার ফিনিশিংয়ে টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ও ছিলেন তিনি।"

    টুর্নামেন্ট শুরুর আগেই যে হাইপ ছিল ফ্রান্সকে নিয়ে, সেই হাইপের সাথে পারফরম্যান্সের মিল রাখা একটু কঠিনই। কিন্তু এই কঠিন কাজটা সম্পন্ন করেছিল ফ্রান্স।

    ম্যানেজার

    রক্ষণের দৃঢ়তা নাকি ফুটবলীয় শিল্প? এই প্রশ্নের উত্তর বহুবার খুঁজেছে ফ্রান্স, একেকবার দ্বারস্থ হয়েছে একেক ধরনের কোচের।

    অতঃপর মিশেল হিদালোগের কাছে এসেই থিতু হয়ে দলটি।

    খেলোয়াড়ি জীবনে মিশেল হিদালোগ ছিলেন একজন প্রতিভাবান মিডফিল্ডার। ১৯৫৬ সালের ইউরোপিয়ান কাপের ফাইনালে রেইমসের হয়ে গোলও করেছিলেন তিনি। এরপর অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার হিসেবে স্টেফান কোভাক্সকে সাহায্য করেছেন অনেকদিন। ১৯৭৬ সালে ফ্রান্সের দায়িত্ব নেন ম্যানেজার হিসেবে।

    ফ্রান্সের কোচ মিশেল হিদাগোল; Image Source: AFP

    ফ্রেঞ্চ ফুটবল হিদালগোকে নিযুক্ত করেছিল ম্যানেজার হিসেবেই। কিন্তু দায়িত্ব নেওয়ার পর ফ্রান্সের ফুটবলকে খোলনলচে বদলে দিয়েছিলেন। বিশেষত ফ্রান্সের খেলায় এনেছিলেন এক অভাবনীয় পরিবর্তন, ১৯৮২ বিশ্বকাপে তুলেছিলেন সেমিফাইনালে। সেমিতে অবশ্য পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে ৩-৩-এ ড্র করার পর টাইব্রেকারে হেরে বাদ পড়ে দলটি।

    তবে ফ্রান্সের সামনে সুযোগ ছিল ওই টুর্নামেন্টেটা জিতে দেশে ফেরার। স্পেনের মাটিতে অনুষ্ঠিত হইয়া ওই বিশ্বকাপটা জিতেছিল ইতালি, কিন্তু হিদালগো যেমনটা বলেছেন, "ইতালিয়ানদের মতো হিসাব নিকাশ করলে থাকলে ফুটবলকে আর খেলা বলে মনে হয় না"। হিদালগো আরো বলেন, "ওই স্টাইলটা ফরাসিদের সাথে যায়ই না।"

    তবে ইউরো শুরুর আগেই সবাই জানতেন যে এই টুর্নামেন্টের পরই সরে দাঁড়াবেন কোচ হিদালগো। অর্থাৎ ইউরোর ফাইনালই ছিল তাঁর কোচিং ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ।

    মূল খেলোয়াড়

    অবশ্যই, এবং অবশ্যই মিশেল প্লাতিনি।

    টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচে ডেনমার্কের বিপক্ষে স্নায়ুক্ষয়ী ম্যাচে গোল করে ফ্রান্সের শুভসূচনা নিশ্চিত করেন প্লাতিনি। বেলজিয়ামের বিপক্ষে ৫-০ ব্যবধানের জয়ের ম্যাচে করেন হ্যাটট্রিক, যুগোস্লাভিয়ার বিপক্ষে ৩-২ ব্যবধানে জয়ের ক্ষেত্রে করেন আরো তিন গোল। এর আগে ইউরোতে একাধিক হ্যাটট্রিক ছিল না কোন ফুটবলারের, কিন্তু প্লাতিনি সেটা সম্পন্ন করেন চার দিনের মধ্যেই।

    গ্রুপ পর্বের সাথে তুলনা করলে, নকআউট পর্বে প্লাতিনির ঝলকটা একটু কমই ছিল। তবুও, পর্তুগালের বিপক্ষে সেমিফাইনাল ম্যাচের ১১৯তম মিনিটে গোল করে দলের জয় নিশ্চিত করেন তিনি, এরপর ফাইনালে করেন দলের প্রথম গোল।

    মিশেল প্লাতিনি; Image Source: Getty Images

    প্লাতিনির কাছ থেকে এমন দুর্দান্ত পারফরম্যান্স প্রত্যাশিতই ছিল। ইউরোপের তৎকালীন সেরা খেলোয়াড় হিসেবে তাঁকে ততদিনে স্বীকৃতি দিয়েছে সবাই। ১৯৮৩ এর ব্যালন ডি'অর বিজয়ী তো তিনি হয়েছিলেনই, তাঁর সমান ভোট পেতে দ্বিতীয়-তৃতীয়-চতুর্থ-পঞ্চমের প্রাপ্ত ভোট যোগ করার প্রয়োজন হয়েছিল।

    হ্যাঁ, এটা সত্য যে তখনকার ব্যালন ডি'অর শুধুই ইউরোপীয় ফুটবলারদের জন্য বরাদ্দ ছিল, কিন্তু এটাও সত্য যে জুভেন্টাসের প্লাতিনিকে অনেকে সেই সময়ের দিয়েগো ম্যারাডোনার চেয়েও এগিয়ে রাখতেন। বার্সেলোনায় নিজের ফর্মের সাথে যুঝছিলেন ম্যারাডোনা, তবে ইউরো শেষ হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে তিনি পাড়ি জমান নাপোলিতে। বাকিটা শুধুই ইতিহাস।

    ফুটবলের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, মূলত মিডফিল্ডার আর ফরোয়ার্ডরাই সবচেয়ে বেশি প্রশংসিত হন। পেলে, ম্যারাডোনা, ইয়োহান ক্রুইফ, আলফ্রেডো ডি স্টেফানো, ফেরেঙ্ক পুসকাস কিংবা লিওনেল মেসি, প্রত্যেকেই একই সাথে গোল করতেন এবং করাতেন। এই তালিকায় মিশেল প্লাতিনির নামও যোগ করা যেতে পারে, অ্যাটাকিং মিডফিল্ড থেকে খেলা শুরু করলেও গোল করতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। টানা তিন মৌসুমে সিরিআর সর্বোচ্চ গোল সংগ্রাহক হয়েছিলেন, এই ইউরোতে নয় গোল করে পেরিয়েছিলেন জ্যঁ ফন্টেইনের ফরাসি রেকর্ডও।

    তবে পেশাদারিত্বের দিক থেকে সব সময়ে আদর্শ অবস্থায় থাকতেন না প্লাতিনি। কিছু কিছু ম্যাচে নিজের স্বরূপে থাকতেন না, আশা করতেন সতীর্থরা দায়িত্ব নিয়ে ম্যাচ জেতাবেন। দলের ফিটনেস কোচের কথাও পুরোপুরি মেনে চলতেন না প্লাতিনি, ড্রেসিংরুমে ধূমপান করতেন। পরে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ১৯৮৪-এর ইউরোই একমাত্র মেজর টুর্নামেন্ট, যেটাতে তিনি সম্পূর্ণ ফিট থেকে অংশ নিয়েছিলেন।

    প্লাতিনির কথার সত্যতা পাওয়া যায় তাঁর পাঁচ ম্যাচে নয় গোলের পরিসংখ্যানে। এক ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো ছাড়া ইউরোর ইতিহাসে তাঁর চেয়ে বেশি গোল আর কেউ করেননি। আর পর্তুগিজ ফরোয়ার্ড এই রেকর্ড ভেঙেছিলেন পাঁচ আসর মিলিয়ে, প্লাতিনি যে রেকর্ড গড়েছিলেন এক গ্রীষ্মেই।

    সব মিলিয়ে, প্লাতিনির ওই আসরের পারফরম্যান্সই কোন বড় টুর্নামেন্টে কোন একজন খেলোয়াড়ের সেরা ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স বললে খুব বেশি ভুল হবে না। 

    ট্যাকটিক্স

    ফ্রান্সের ওই দলে কোন বিশ্বমানের স্ট্রাইকার ছিলেন না। তাই কোচ হিদালগো তাঁর দলের মাঝমাঠকে সাজিয়েছিলেন অনেকটা বর্গাকৃতিতে। "লা কার ম্যাজিগ" নামক ওই কৌশলটা বিশ্ব ফুটবলের ইতিহাসেই বেশ বিরল, তবে বিখ্যাত।

    ওই বর্গের চারজনই ভালো এবং অলরাউন্ডার খেলোয়াড় ছিলেন, কিন্তু ফ্রান্স হেঁটেছিল ঐতিহ্যবাহী পথেই। একজন তারকাকে কেন্দ্রে রেখেই সাজানো হলো মাঝমাঠ, বাকিরা করতেন 'ডার্টি ওয়ার্ক'।

    লুইস ফার্নান্দেজের ওপর দায়িত্ব ছিল প্রতিপক্ষের পা থেকে বল কেড়ে নেওয়ার। তবে ক্লদ মাকেলেলের মতো প্রথাগত 'বল উইনার' তিনি ছিলেন না, সময়ে সময়ে প্রতিপক্ষের বক্সে রান নিতেন তিনি, খুঁজতেন গোল করার সুযোগ। বক্স টু বক্স দৌড়াতেন তিগানা, হালের ব্লেইজ মাতুইদির সাথে তুলনা করা যায় তাঁর। ড্রিবলার নন, তিনি ছিলেন পুরোদস্তর 'ওয়ার্কহর্স'। ওদিকে প্লেমেকার জিরেস তো তখন 'ফ্রেঞ্চ ফুটবলার অব দ্যা ইয়ার'। অবশ্য তখন এই পুরস্কারের জন্য শুধুই ফরাসি লিগে খেলা ফুটবলারদেরই মনোনীত করা হতো। আর এই তিনজনের সামনে খেলতেন মিশেল প্লাতিনি, দর্শকদের চোখে যিনি কেবলই জাদুকর।

    ১৯৮৪ এর ইউরোর আগে ফ্রান্স দল সম্পর্কে বলতে গেলে যে কেউ প্রথমে প্লাতিনির দুর্দান্ত ফর্মের কথাই বলবেন, এরপর বলবেন এই চমৎকার মিডফিল্ডের কথা। বলাটাই স্বাভাবিক।

    Image Source: The Athletic

    তবে, এখানে একটা 'কিন্তু' আছে।

    ফ্রান্স এই টুর্নামেন্ট শুরু করেছিল তাদের মিডফিল্ড কোয়ার্ট্রেট নিয়েই। কিন্তু ডেনমার্কের বিপক্ষের ওই ম্যাচে ফরাসি সেন্টারব্যাক ম্যানুয়েল অ্যামোরোস লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়েন, এবং নিষিদ্ধ হন পরের ম্যাচের জন্য। অপর সেন্টারব্যাক ইভো লে রৌও চোটে পড়েন। নিরুপায় হিদালগো তখন গ্রুপ পর্বের বাকি দুই ম্যাচের জন্য ৩-৫-২ ফরমেশন বেছে নিতে বাধ্য হন।

    মাঝমাঠের গঠন তখন পরিবর্তিত হয়ে যায়। চার নক্ষত্রই মাঠে থাকলেন, কিন্তু ওই বর্গ তৈরির বাধ্যবাধকতা আর রইলো না। ফার্নান্দেজ চলে এলেন ডান দিকে, জিরেস একটু নিচে নেমে খেলতে থাকলেন, তিগানা পরিণত হলেন ডান পাশের নম্বর এইটে, আর প্লাতিনি রইলেন সবার সামনে। আর পঞ্চম মিডফিল্ডার হিসেবে বার্নার্ড জেনঘিনি খেলতে থাকলেন সবার বামে। ম্যাজিক স্কয়ার যেন পরিণত হলো ম্যাজিক পেন্টাগনে!

    তবে সেমিফাইনালে আবারও ওই চার মিডফিল্ডারের তত্ত্বেই ফিরে যান হিদালগো, যদিও সেটা ছিল তাঁর ট্যাকটিক্যাল ভুল। ওই ম্যাচে ফ্রান্সের শুরুটা একেবারেই ভালো হয়নি। পরবর্তীতে একটা জুয়া খেলেন হিদালগো, একজন ডিফেন্ডারকে একটু উপরে তুলে খেলাতে শুরু করেন মিডফিল্ডার হিসেবে। অবশেষে ম্যাচের অতিরিক্ত সময়ে আসে প্লাতিনির সেই গোল।

    ব্যবধান গড়ে দিয়েছিল যে মুহূর্ত

    যেকোন টুর্নামেন্টের সেমিফাইনাল ম্যাচগুলো সবসময়েই বাড়তি আকর্ষণ বহন করে। ইউরো ১৯৮৪-এর সেমিফাইনালের ফ্রান্স-পর্তুগাল ম্যাচটাই সম্ভবত ওই টুর্নামেন্টের সেরা ম্যাচ ছিল। আক্রমণ আর পাল্টা আক্রমণে মার্সেইয়ের স্তাদে ভেলোড্রোমে জমে উঠেছিল ম্যাচটা। এরই মাঝে জোড়া গোল বিনিময় করে ফেলেছিলেন ফরাসি ডিফেন্ডার জ্যঁ-ফ্রাঙ্কো ডোমের্গ এবং পর্তুগিজ স্ট্রাইকার হোর্দাও। 

    চমৎকার ফুটবলের অনুপম প্রদর্শনী নিয়ে নেমেছিলেন ফরাসি ফুটবলাররা। কয়েকটা ওয়ান-টু এর পরই দ্রুত ঢোকার চেষ্টা করছিলেন পর্তুগালের বক্সে। ভয়ঙ্কর সুন্দরের সাথে অনিশ্চয়তা মিশিয়ে ফ্রান্স হয়ে উঠেছিল পুরোপুরি দুর্বোধ্য।

    পর্তুগালের বিপক্ষে প্লাতিনির ম্যাচ জেতানো গোল; Image Source: Getty Images

    তবুও ম্যাচটা এগোচ্ছিল টাইব্রেকারের পথে। নির্ধারিত সময়ের পর অতিরিক্ত সময়েও সমতা থাকবে, এমনটাই ধরে নিচ্ছিলেন সবাই। কিন্তু অতিরিক্ত সময়ের একেবারে শেষ মুহূর্তে, দুই দলই যখন শেষ আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখনই জিরেসের একটা নিখুঁত পাস থেকে বল পেয়ে ঝড়ের গতিতে দৌড় দেন তিগানা। তাতেই ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে পর্তুগালের রক্ষণ, এরপরই তিগানার কাটব্যাকে গোলরক্ষক আর তিন ডিফেন্ডারকে পরাস্ত করে প্লাতিনির দুর্দান্ত গোল। তাতে ফ্রান্সের ফাইনালে ওঠার সাথে নিশ্চিত হলো টুর্নামেন্টের প্রতিটি ম্যাচে প্লাতিনির গোল করার ধারাবাহিকতাও।

    ফাইনাল ম্যাচ

    পুরো টুর্নামেন্টের দুর্দান্ত ফুটবলের প্রতিচ্ছবি অবশ্য পার্ক দে প্রিন্সেসের ফাইনালে পাওয়া যায়নি। সেমিফাইনালে ডেনমার্ককে টাইব্রেকারে পরাজিত করে ফাইনালে ওঠা স্পেনের সামনে বেশ কিছু সুযোগ এসেছিল শিরোপায় নিজেদের নাম খোদাই করার, কিন্তু তারা কাজে লাগাতে পারেনি সেই সুযোগগুলো। মাঠের দর্শক সমর্থনও ছিল পুরোপুরি ফ্রান্সের পক্ষে, নিরপেক্ষ দর্শকেরাও অবস্থান নিয়েছিলেন ফরাসিদের দিকেই। 

    আগেই বলা হয়েছে, ফাইনালেও স্কোরকার্ডে নিজের নাম তুলেছিলেন মিশেল প্লাতিনি। যদিও, সত্যি বলতে, গোলটা তেমন সুন্দর ছিল না। প্লাতিনির বাঁকানো ফ্রিকিকটা ঠিকমতো ধরতে পারেননি গোলরক্ষক লুইস আরকোনাদা, উল্টো বল পেরিয়ে যায় গোললাইন। 

    ফাইনালের প্রথম গোলটা এলো প্লাতিনির পা থেকে; Image Source: Getty Images

    তবে দ্বিতীয় গোলের ক্ষেত্রে অবশ্য সৌন্দর্যের কমতি ছিল না। স্কোয়াডে ভালো নম্বর নাইন না থাকা, এবং নিজের গতির কারণে সুযোগ এসেছিল ব্রুনো বেলোনের সামনে, আর ম্যাচের যোগ করা সময়ে সেই সুযোগটাই কাজে লাগালেন তিনি। তিগানার পাস ধরে এগিয়ে যান বেলোন, এরপর অপেক্ষা করছিলেন আরকোনাদার সামনে আগমনের। বাধ্য হয়ে সামনে এগোতেই হলো আরকোনাদাকে, বেলোনও চিপ করে দিলেন তাঁর মাথার ওপর দিয়ে। ছবির মতো সুন্দর ওই গোলেই নিশ্চিত হয় ফ্রান্সের শিরোপা।

    জেনে অবাক হবেন যে…

    ফ্রান্সে ফুটবলের সাথে রাজনীতির মিশে যাওয়ার উদাহরণ রয়েছে অনেক। '৯৮-এর বিশ্বকাপজয়ী দলটাকে নিজের নির্বাচনের প্রচারণার কাজে ব্যবহার করেছিলেন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী জ্যঁ-মেরি লে পেন।

    তবে '৮৪-এর ঘটনাটা আরো সরাসরি। সাফল্যের পর দলটির ম্যানেজার হিদালগোকে ক্রীড়ামন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়া প্রস্তাব দিয়েছিলেন নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী লরে ফাবিয়াস। হিদালগো ওই প্রস্তাবে রাজি হননি, বরং গ্রহণ করেছিলেন ফ্রান্স জাতীয় দলের টেকনিক্যাল ডিরেক্টরের পদ। যদিও পরবর্তীতে নিজের এই সিদ্ধান্তের জন্য আফসোস করেছিলেন তিনি।

    "একটা নতুন অ্যাডভেঞ্চারের সুযোগ হেলায় হারিয়েছি আমি। জীবনের একটা নতুন অধ্যায় যোগ করতে পারতাম হয়তো," ২০০৭ সালে ফরাসি সংবাদপত্র লা ফিগারোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে হিদালগো বলেন, "একটা অবিশ্বাস্য প্রস্তাব আমি গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলাম। কোচ হিসেবে সবসময়েই ফ্রান্সের প্রতিনিধিত্ব করতে ভালো লেগেছে আমার, তবে মন্ত্রিত্বটা আমার সাথে সম্ভবত আরো ভালোভাবে যেত।"

    ফ্রান্স কি সত্যিই ইউরোপের সেরা দল ছিল?

    ওই ফ্রান্স দলটা ইউরোর ওই আসর তো বটেই, সম্ভবত টুর্নামেন্টের ইতিহাসের সেরা দল ছিল।

    তুলনার প্রশ্নে '৭২-এর জার্মানি কেবল ধারেকাছে আসতে পারে, আশেপাশে থাকবে ইউরো ২০০০-এর ফ্রান্স আর '০৮ আর '১২-এর স্পেন দলটাও। তবে সত্যি কথা বলতে, ওই ফ্রান্স দলটা আসলেই অন্য মাত্র এনে দিয়েছিল ফুটবলে। "শ্যাম্পেন ফুটবল" নামক ওই গালভরা নামের খেলাটা তাদেরকে পরিচিত করেছিল "ইউরোপের ব্রাজিল" নামে।

    যোগ্য দল হিসেবেই ইউরো জিতেছিল ফ্রান্স; Image Source: Getty Images

    "১৯৭০ বিশ্বকাপের পর এই ইউরোর চেয়ে ভালো টুর্নামেন্ট আর হয়নি। আর ইউরোর ইতিহাসে তো অবশ্যই সেরা," কেইর রাদনেজ লিখেছিলেন ওয়ার্ল্ড সকার ম্যাগাজিনে, "ফ্রান্সের শিরোপা জয়টা আনন্দে ভাসিয়েছিল পুরো ফুটবল দুনিয়াকেই। যেমন করে চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে দলটির খেলা, যেভাবে দর্শকদের বিনোদনের ক্ষেত্রে এসেছিল এক পশলা ঠাণ্ডা মুক্ত বাতাস হয়ে, এই শিরোপাটা তাদের প্রাপ্যই ছিল। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দলগুলো দিনশেষে তাদের প্রাপ্য বুঝে পায় না, কিন্তু ফ্রান্স ঠিকই বুঝে পেয়েছে তাদের ন্যায্য ট্রফিটি।"