• ইউরো
  • " />

     

    ইউরো-স্মৃতির সরণির বাঁকে: পর্ব ৮

    ইউরো-স্মৃতির সরণির বাঁকে: পর্ব ৮    

    খেলার ধরনের বিচারে শুধু ইউরোপ নয়, বরং পুরো বিশ্বেরই অন্যতম প্রভাবশালী দল তারা। তবে ট্রফি-কেবিনেটের বিচারে নেদারল্যান্ডসের জায়গা হয় না বড় দলগুলোর কাতারে। তিনটা বিশ্বকাপের ফাইনালে খেললেও দলটার কপালে জোটেনি কোন শিরোপা, বড় টুর্নামেন্ট বলতে এক ইউরোই। তবে সেই ইউরোটা এসেছিল ইউরোপের আরেক পরাশক্তি জার্মানির মাটিতে, ১৯৮৮ সালে। 

    ইউরোপীয় ফুটবলের ফুটবলীয় মহোৎসব উয়েফা ইউরোপীয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ, বা সংক্ষেপে ইউরোর সতেরোতম আসর চলাকালে, দ্যা অ্যাথলেটিক হেঁটেছে স্মৃতির সরণি বেয়ে, যে পথের বাঁকে বাঁকে উঠে এসেছে আগের ষোল আসরের জানা-অজানা খুঁটিনাটি তথ্য আর গল্পের পেছনের গল্পগুলো। এই সিরিজের অষ্টম পর্বে থাকছে ১৯৮৮ সালে অনুষ্ঠিত ইউরোর অষ্টম আসর আর নেদারল্যান্ডসের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গল্প।

    Image Source: Getty Images

    কেমন ছিল সেই ইউরো?

    ইউরোপের মধ্যে ডাচদের ফুটবলীয় সংস্কৃতি সবসময়েই বাড়তি মনোযোগের দাবি রাখে।

    ষাটের দশকের আগ পর্যন্ত নেদারল্যান্ডসে পেশাদার ফুটবল তেমন বিস্তার লাভ করেনি। তবে এরপর থেকে ক্রমাগত উন্নতি করে গেছে দলটি। প্রতিনিয়ত নিজেদের ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে, আর খেলার ধরন দিয়ে প্রভাব রেখেছে পুরো পৃথিবীতে। তবে সেই অনুপাতে শিরোপা জিততে পারেনি দলটি। বড় টুর্নামেন্ট বলতে রয়েছে শুধু ১৯৮৮-এর ইউরোই।

    তবে নেদারল্যান্ডস দলটার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, উত্থান-পতনের মধ্যে দিয়েই এগিয়ে গেছে দলটি। ১৯৩৪ আর ১৯৩৮ বিশ্বকাপে খেলেছিল দলটা, পরের ছয় আসরে আবার বিশ্বকাপেই সুযোগ পায়নি তারা। এরপর ১৯৭৪ আর ১৯৭৮ বিশ্বকাপে ফাইনাল খেলা দলটিই আসর দশকের দুটো বিশ্বকাপে ছিল অবিশ্বাস্যভাবে অনুপস্থিত। ডাচদের একটা প্রজন্ম ততদিনে বুড়িয়ে গেছে, তরুণরা তখনো অপরিপক্ব, বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের বাধাই তাই উতরানো হয়নি তাদের। তবে '৮৮-এর ইউরো আসতে আসতে ওই তরুণরাই অনেকটা পরিপক্ব হয়ে উঠেছিল, যদিও ওই দলের কেউই এর আগে কোন বড় টুর্নামেন্টে খেলেননি।

    আর হ্যাঁ, ডাচরা কিন্তু নিজেদের "হল্যান্ড" বলতেন তখন।

    ম্যানেজার

    রাইনাস মিশেলস, সম্ভবত ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত কোচ। ফিফা তাঁকে শতাব্দীর সেরা কোচের সম্মাননা দিয়েছিল। আর ২০১৯ সালে ফ্রান্স ফুটবলের কাছ থেকে তিনি পান ফুটবল ইতিহাসের সেরা কোচের স্বীকৃতি। টোটাল ফুটবলের আবিষ্কারক হিসেবেও অনেকে তাঁকেই মানেন, মূলত সত্তরের দশকে আয়াক্সকে খেলানোর ধরনের কারণে। এই টোটাল ফুটবল নিয়ে বার্সেলোনাতেও গিয়েছিলেন মিশেলস, '৭৪-এ তো নেদারল্যান্ডসকে বিশ্বকাপটাই এনে দিয়েছিলেন প্রায়। এরপর আবার আয়াক্সে ফিরেছিলেন তিনি। পরে বার্সেলোনা আর পশ্চিম জার্মানি ঘুরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে।

    রাইনাস মিশেলস; Image Source: Getty Images

    ১৯৮৪ সালে আবারও নেদারল্যান্ডসের কোচ নিযুক্ত হন তিনি। তবে কিছুদিন পরই সরে দাঁড়ান নিজের হার্টের সমস্যার জন্য। দুই বছর পর, আবারও একই পদে আসীন হন তিনি।

    তাঁর টোটাল ফুটবলের মূল ব্যাপারটাই ছিল মাঠের ফাঁকা জায়গা কাজে লাগানো, প্রতিপক্ষকে প্রেস করা, মাঠকে বড় করে খেলা এবং নিজেদের পজিশন সুইচ করে খেলা। মিশেলসকে সময়ে সময়ে ওল্ড-স্কুল কোচ বললেও ভুল হবে না, একই সাথে খেলোয়াড়দের থেকে সেরাটা আদায় করে নিতে জানতেন তিনি। ট্রেনিংয়ে ওই ব্যাপারগুলো বারবার অনুশীলন করাতেন, আর তাঁর ডাকনাম হয়ে গিয়েছিল "দ্যা জেনারেল"।

    ওই ইউরোর পরে ওয়ার্ল্ড সকার ম্যাগাজিনে মিশেলসকে বর্ণনা করা হয়েছিল "পরিকল্পনাকারী, ফিজিওলজিস্ট এবং মানুষ হিসেবে টুর্নামেন্টের অন্যান্য ম্যানেজারদের চেয়ে অনেকটা এগিয়ে থাকা একজন" হিসেবে।

    ট্যাকটিক্স

    কোচ হিসেবে মিশেলসকে অনেকে টোটাল ফুটবলের গডফাদার বলে থাকেন। তবে মিশেলসের ১৯৭৪ বিশ্বকাপের নেদারল্যান্ডস দলের সাথে ১৯৮৮ ইউরোর দলের তুলনা করলে অনেক পার্থক্য পাওয়া যাবে। ১৪ বছর পরের ওই ইউরোর দলে রোটেশনটা বেশ কমই করতেন মিশেলস।

    কোচ রাইনাস মিশেলস; Image Source: Getty Images

    দলের আক্রমণের ঝলকানি আর মুভমেন্টের বেশিরভাগই আসতো দলের সেকেন্ড স্ট্রাইকার রুড গুলিতের থেকে। ম্যাচের মধ্যে তিনিই উইংয়ে সরে গিয়ে পাসিংয়ের সুযোগ তৈরি করতেন। মার্কো ফন বাস্তেনের ভূমিকা নিয়ে মতভেদ ছিল, তবে গোলস্কোরার হিসেবেই যে তিনি সেরা, সেটা নিয়ে দ্বিমত ছিল না। তবে মিশেলসের অনুশীলনে সবাইকেই ইন বিহাইন্ড পাসিং অনুশীলন করতে হতো। 

    মাঝমাঠে ইয়ান ঔটার খেলতেন ক্লাসিক হোল্ডিং মিডফিল্ডার হিসেবে। আরউইন কোম্যান এবং আর্নল্ড মুহরেনের ভূমিকা ছিল কিছুটা আক্রমণাত্মক। ডান পাশে উইঙ্গার হিসেবে জেরাল্ড ভ্যানেনবার্গকে খেলানো একটা কৌশলী সিদ্ধান্ত ছিল।

    Image Source: The Athletic

    তবে এই নেদারল্যান্ডস দলের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ ছিল তাদের রক্ষণভাগ। দুর্দান্ত ফ্রাঙ্ক রাইকার্ডের সাথে মিশেলস খুঁজে নিয়েছিলেন একজন দারুণ সেন্টারব্যাককে, আর তাঁর নাম রোনাল্ড কোম্যান। বল পায়ে কোম্যান সময়ে সময়ে মিডফিল্ড বা ফরোয়ার্ড লাইনেও উঠে যেতেন, তাঁর লম্বা ডায়াগোনাল পাস আর প্রচণ্ড গতির শটগুলোও ছিল বিখ্যাত। পুরো ইউরোপে তাঁর মতো টেকনিক্যাল সেন্টারব্যাক আর কেউ ছিলেন না।

    মূল খেলোয়াড়

    টুর্নামেন্ট শুরুর আগে যাবতীয় হাইপ ছিল রুড গুলিতকে নিয়েই। ওই দলের অধিনায়ক ছিলেন তিনি, ব্যালন ডি'অরও ছিল তাঁর দখলেই। আর্জেন্টিনার ১৯৭৮ বিশ্বকাপজয়ী দলের কোচ সিজার লুইস মেনোত্তি তাঁকে অভিহিত করেছিলেন "গত দশকে ইউরোপের সেরা খেলোয়াড়" হিসেবে। অবশ্য বলবেনই না কেন, রক্ষণ-মাঝমাঠ-আক্রমণ তিন ক্ষেত্রেই দারুণ পারফর্ম করতে পারতেন রুড গুলিত।

    রুড গুলিত; Image Source: Getty Images

    তবে পিএসভি আইন্দহোভেন থেকে ইতালির এসি মিলানে যাওয়ার পরে নিজেকে অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছিলেন গুলিত। নিজের সেরা ফর্মে ছিলেন না, পাশাপশি একটা ক্লান্তিও যেন ঘিরে ধরেছিল তাঁকে, যাকে তুলনা করা যায় ১৯৭৪ বিশ্বকাপে ক্রুইফের ক্লান্তির সাথে। সাথে মিশেলসও বলে দেন, তাঁর দল আলাদা করে কোন খেলোয়াড়ের ওপর নির্ভর করতে রাজি নয়। "আমরা একটা দল হিসেবে গড়ে উঠেছি, কোন নির্দিষ্ট খেলোয়াড়কে কেন্দ্র করে নয়," মিশেলস বলেন।

    ডাচদের হয়ে টুর্নামেন্টের সেরা পারফর্মার তাই রুড গুলিত নন, ছিলেন মার্কো ফন বাস্তেন। সেটিও শুধু ফাইনালের পারফরম্যান্সের জন্য নয়, পুরো টুর্নামেন্টেই দারুণ খেলেছিলেন তিনি। গ্রুপ পর্বে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৩-১ ব্যবধানে জয়ের ম্যাচে হ্যাটট্রিক করেছিলেন তিনি। প্রথম গোলে, গুলিতের বুটের বাইরের পাশ দিয়ে বাড়ানো বলটা দারুণভাবে জালে জড়িয়ে দেন তিনি। দ্বিতীয় গোলেও গুলিতের অ্যাসিস্ট ছিল, সেখান থেকে বাম পায়ে ফিনিশিং করেন ফন বাস্তেন। আর তৃতীয় গোলটা এসেছিল কর্নার থেকে তাঁর ডান পায়ের ভলিতে। 

    ইংল্যান্ডের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করেন মার্কো ফন বাস্তেন; Image Source: Getty Images

    সেমিফাইনালে পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে জয়সূচক গোলটাও করেছিলেন তিনি। ঔটারের বাড়িয়ে দেওয়া বল ধরে জার্মানদের রক্ষণে ঢুকে পড়েছিলেন ফন বাস্তেন। এরপর "অনেকটা স্লাইড ট্যাকেল, অনেকটা শট" এমন কিছু একটা থেকে গোল করে জার্মানদের চমকে দেন তিনি। আর এরপর তো ফাইনাল ম্যাচ, আর টুর্নামেন্টে ফোlন বাস্তেনের পঞ্চম গোল। 

    এমন পারফরম্যান্সের পর মনে হতেই পারে, ফন বাস্তেন বোধ হয় খুব অভিজ্ঞ খেলোয়াড় ছিলেন। মোটেই না। বয়সের হিসেবে তিনি তখন তেইশ, গুলিতের সমানই। এসি মিলানে ক্লান্তিকর মৌসুম কাটিয়ে তিনিও যুক্ত হয়েছিলেন ডাচ দলে। চোটের সমস্যাও ছিল তাঁর, সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে তাঁর পরিবর্তে শুরুর একাদশে ছিলেন জন বসমান। ফন বাস্তেন নিজে অবশ্য মিশেলসের এই সিদ্ধান্তে খুবই হতাশ হয়েছিলেন, একবার তো দেশে ফিরে যাওয়ার কথাও ভেবেছিলেন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য ওই ভাবনা থেকে সরে আসেন, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মাঠে নামেন, আর বাকিটা তো ইতিহাস!

    আর মাত্র ২৮ বছর বয়সে কার্যত ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাওয়ায় ফন বাস্তেনের ওই টুর্নামেন্টের পারফরম্যান্সের মাহাত্ম্য আরো বেড়ে যায়। ১৯৯৩ সালের চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে গোড়ালির মারাত্মক চোটে পড়েছিলেন ফন বাস্তেন। 

    এরপরই পেছন থেকে ট্যাকেল করার ব্যাপারে বাধানিষেধ দিয়ে নিয়ম প্রণয়ন করা হয়, পাশাপাশি নিয়মগুলো আরো কঠোরভাবে প্রয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হয়।

    ফাইনাল ম্যাচ

    সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে ২-০ ব্যবধানের জয়। সেটিও নির্বিষ ফুটবল খেলে নয়, বরং ডাচ ফুটবলের অনুপম প্রদর্শনীর মাধ্যমেই। গোল দুটো এসেছিল যথাক্রমে সেট পিস এবং কাউন্টার অ্যাটাক থেকে। প্রথম গোলে, কর্নার-পরবর্তী ফন বাস্তেনের ক্রস থেকে হেড করে বল জালে জড়িয়ে দেন রুড গুলিত। আর দ্বিতীয় গোলটা... সেটা সাধারণ কোন কাউন্টার অ্যাটাক ছিল না। বরং ওই গোলকে ধরা হয় সর্বকালের অন্যতম সেরা গোল হিসেবে।

    ফন বাস্তেনের ওই ভলি; Image Source: Getty Images

    পুরো ম্যাচটাই এগিয়ে চলছিল রক্ষণাত্মক ঢঙে। ফাইনাল বলেই হয়তো, দুই দলই ছিল একটু খোলসবন্দী। সাধারণত বল পায়ে রাখতে অভ্যস্ত নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ম্যাচের শুরুর দিকে আধিপত্য বিস্তার করছিল সোভিয়েতরাই। ওদিকে ডাচরা চেষ্টা করছিল কুইক ড্রিবল বা লং বলের মাধ্যমে সোভিয়েতদের ফেলে আসা স্পেস কাজে লাগানোর।

    তবে এই দুটো দলই আবার মুখোমুখি হয়েছিল গ্রুপ পর্বে নিজেদের প্রথম ম্যাচে। সোভিয়েতরা ওই ম্যাচটা জিতেছিল ১-০ ব্যবধানে। "প্রথমার্ধে আমরা ভালো খেলেছিলাম। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে কাউন্টার অ্যাটাক দিয়েই ওরা আমাদের আক্রমণ করেছিল," প্রথম ম্যাচের ব্যাপারে মিশেলস বলেন, "তাই ফাইনাল খেলার আগেই আমরা জানতাম, এবার আমাদেরকে আরো সতর্কভাবে শুরু করতে হবে।"

    তবে ডাচ ফুটবলের সেটা রূপটা দেখা গিয়েছিল ২-০ ব্যবধানে এগিয়ে যাওয়ার পরে, যদিও তাতে নেদারল্যান্ডসের খানিকটা সৌভাগ্যও মিশে ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের ইগর বেলানোভের দুর্বল পেনাল্টি শট ঠেকিয়ে দেন ডাচ গোলরক্ষক হ্যান্স ফন ব্রুকেলেন। এই ফন ব্রুকেলেনই মাত্র এক মাস আগে ইউরোপিয়ান কাপের ফাইনালে বেনফিকার বিপক্ষে পিএসভিকে টাইব্রেকারে জিতিয়েছিলেন।

    ব্যবধান গড়ে দিয়েছিল যে মুহূর্ত

    আন্তর্জাতিক ফুটবলের বড় মঞ্চে সর্বকালের সেরা গোলের তালিকা করলে তাতে যে কেউ কয়েকটা গোলের উল্লেখ করবেন, যেমন ১৯৭০ বিশ্বকাপের ফাইনালে ইতালির বিপক্ষে ব্রাজিলের কার্লোস আলবার্তোর গোল, ১৯৮৬ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে আর্জেন্টিনার দিয়েগো ম্যারাডোনার গোল, এবং এই ম্যাচে ফন বাস্তেনের গোল। তবে তিনটা গোলের ধরনই পুরোপুরি ভিন্ন। একটা টিম গোল, একটা দুর্দান্ত ড্রিবলিংয়ের পর, আর একটা অসাধারণ শটে। আর তৃতীয়টা সম্ভবত ফুটবলের সবচেয়ে বেশি উদযাপিত শট।

    অ্যাসিস্টটা এসেছিল লেফট উইং থেকে মুহরেনের ক্রসে। মজার ব্যাপার হলো, ওই ম্যাচটাই ছিল দেশের হয়ে মুহরেনের শেষ ম্যাচ। আর ওই অ্যাসিস্টও বুঝেশুনে করেননি তিনি, "আমি একটু বেশিই জোরে ক্রস করে ফেলেছিলাম। মার্কো যদি শটটা কোলনেও   (ফাইনালের ভেন্যু মিউনিখ থেকে পাঁচ ঘণ্টার দূরত্ব) পাঠিয়ে দিতো, সবাই দোষ দিতো আমার ক্রসের। কিন্তু সেই ক্রসটাই এখন সর্বকালের অন্যতম সেরা অ্যাসিস্ট। মার্কোর কারণেই এই সব হয়েছে।"

    গোল করার পরে ফন বাস্তেনের উদযাপন; Image Source: Getty Images

    ফন বাস্তেনের ফিনিশিংটা ছিল পারফেক্ট। ঠিক যতটুকু টপস্পিন করলে বলটা গোলরক্ষকের নাগালের বাইরে পাঠানো যায়, ঠিক ততটুকু জোরে শট নিয়ে টপ কর্নারের জালে বল জড়িয়ে দেন তিনি।

    সোভিয়েত ইউনিয়নের গোলরক্ষক রিনাত দাসায়েভ ধারণাও করতে পারেননি বলের গতিপথ। ক্রসটা যখন আসছিল, দাসায়েভ ডিফেন্ডারদের নির্দেশনা দিচ্ছেন গুলিতকে মার্ক করার। তাঁর মাথায় নিশ্চিতভাবেই ছিল ডাচদের প্রথম গোলের ছবি, ফন বাস্তেনের ক্রস থেকে হেড করে বলটা জালে জড়িয়ে দেন রুড গুলিত। পাশাপাশি, শটটা ঠেকানোর ক্ষেত্রেও দাসায়েভ ছিলেন রং-ফুটেড, ঠিকঠাক বলের কাছেই পৌঁছাতে পারেননি তিনি।

    ফাইনাল ম্যাচের একটি মুহূর্ত; Image Source: Getty Images

    ডাচদের ডাগআউটে রাইনাস মিশেলস তখন আবেগাপ্লুত। তিনিও জানতেন, এই গোলটার রেফারেন্স তিনি ব্যবহার করবেন ভবিষ্যতেও। কাঠামোবদ্ধ ফুটবল থেকে যখন ব্যক্তিগত ঝলক ব্যাপারটা উঠেই যাচ্ছে প্রায়, সেই যুগে এমন গোল যে খুবই বিরল!

    জেনে অবাক হবেন যে…

    সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে ফাইনাল নয়, বরং নেদারল্যান্ডসে সবচেয়ে বেশি উদযাপিত হয়েছিল সেমিফাইনালে জার্মানির বিপক্ষের জয়টা।

    “নেদারল্যান্ডসের জন্য পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষের ম্যাচটাই ছিল আসল ফাইনাল,” অনেক বছর পরে রুড গুলিত বলেন, “চৌদ্দ বছর আগে, ১৯৭৪ বিশ্বকাপের ফাইনালে জার্মানির কাছে ডাচদের পরাজয়ের পরে পুরো জাতি কেঁদেছিল টেলিভিশনের সামনে। আমাদের ওপর দায়িত্ব ছিল সেই দুঃখে খানিকটা হলেও প্রলেপ দেওয়ার।”

    সেমিতে জার্মানি-নেদারল্যান্ডস লড়াই; Image Source: Getty Images

    অনেক দর্শককে বাড়তি আগ্রহ জোগাচ্ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে দুই দেশের রেফারেন্সও। মিউনিখে অনেক ডাচ সমর্থককে স্লোগানও দিতে দেখা গিয়েছিল।

    হামবুর্গে ২-১ ব্যবধানের ওই জয়টা ডাচদের কাছে এতটাই জরুরি ছিল, রুড গুলিত পরে বলেছিলেন, “ওই ম্যাচটাই ছিল আমাদের জন্য ফাইনালের মতো, অন্তত আমার কাছে তো বটেই।” ওই ম্যাচের পরে পার্টিও হয়েছিল নেদারল্যান্ডস দলে, পরেরদিন মিউনিখে হুইটনি হিউস্টনের কনসার্টেও গিয়েছিলেন সবাই। পুরো প্রস্তুতিটা ফাইনালের জন্য হয়তো খুব একটা আদর্শ নয়, কিন্তু গুরুত্বের হিসেবে ডাচদের জন্য জার্মানির বিপক্ষে ওই ম্যাচটাই ছিল ফাইনালের মতো।

    তবে জার্মানদের হারিয়ে নির্ভার নেদারল্যান্ডস ঠিকই সোভিয়েতদের বিপক্ষে ফাইনালটা জিতে নিয়েছিল।

    নেদারল্যান্ডস কি সত্যিই ইউরোপের সেরা দল ছিল?

    সম্ভবত। প্রথম ম্যাচে সোভিয়েতদের বিপক্ষে পরাজয়ের পর বাদ পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। দ্বিতীয় ম্যাচে গোলশূন্য থাকা অবস্থায় ইংরেজদের দুটো শট পোস্টে লেগে ফিরে আসে, এরপরই মার্কো ফন বাস্তেনের ওই হ্যাটট্রিক। তৃতীয় ম্যাচে শেষ মুহূর্তের গোলে রিপাবলিক অব আয়ারল্যান্ডকে ১-০ ব্যবধানে হারিয়ে সেমিফাইনালে নাম লেখানো, এরপর জার্মানি আর সোভিয়েত ইউনিয়নকে হারিয়ে শিরোপায় নাম লিখিয়েছিল ডাচরা।

    মার্কো ফন বাস্তেন, দ্যা হিরো ফর নেদারল্যান্ডস; Image Source: Getty Images

    তবে হ্যাঁ, যেমনটা বলা হয়েছে, কোন ম্যাচেই নিরঙ্কুশভাবে বা প্রতিপক্ষের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই জিততে পারেনি নেদারল্যান্ডস। জার্মানরাই যেমন টুর্নামেন্টের অন্যতম ফেভারিট ছিল, তবে শেষ পর্যন্ত জয় আসেনি ডাচদের বিপক্ষে। সোভিয়েতদের পারফরম্যান্সও শিরোপা জেতার জন্য উপযোগী ছিল না। আর মিশেলস যেমনটা বলেছিলেন, ফাইনালটা ছিল আধুনিক ফুটবল খেলার চেষ্টা করতে থাকা দুই দলের মধ্যে। আর তাতে যোগ্য দল হিসেবেই এগিয়ে থেকে শিরোপা জেতে নেদারল্যান্ডস। 

    ট্রফির হিসেবে ডাচদের ফুটবল ইতিহাসের সেরা সাফল্যও ছিল সেটি, যদিও ধারেভারে হয়তো '৭৪-এর বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলা দলটিই তাদের ইতিহাসের সেরা।