• ইউরো
  • " />

     

    ইউরো-স্মৃতির সরণির বাঁকে: পর্ব ৯

    ইউরো-স্মৃতির সরণির বাঁকে: পর্ব ৯    

    একটা টুর্নামেন্ট জিততে হলে প্রথমে কী দরকার? ভালো স্কোয়াড, দারুণ কোচ, ঠিকঠাক ট্রেনিং, দর্শকদের সমর্থন, একটু ভাগ্যের সহায়তা... এসবই তো? হ্যাঁ, এসব তো দরকার বটেই, তবে তারও আগে দরকার ওই টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করা। কেমন হয় যদি বাছাইপর্ব পেরোতে না পারা কোন দলই শেষ পর্যন্ত টুর্নামেন্টের শিরোপা জিতে যায়? ঠিক এই ঘটনাটাই ঘটেছিল ১৯৯২ সালের ইউরোতে।

    ইউরোপীয় ফুটবলের ফুটবলীয় মহোৎসব উয়েফা ইউরোপীয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ, বা সংক্ষেপে ইউরোর সতেরোতম আসর চলাকালে, দ্যা অ্যাথলেটিক হেঁটেছে স্মৃতির সরণি বেয়ে, যে পথের বাঁকে বাঁকে উঠে এসেছে আগের ষোল আসরের জানা-অজানা খুঁটিনাটি তথ্য আর গল্পের পেছনের গল্পগুলো। এই সিরিজের নবম পর্বে থাকছে ১৯৯২ সালে অনুষ্ঠিত ইউরোর নবম আসর আর ডেনমার্কের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গল্প।

    Image Source: Getty Images

    কেমন ছিল সেই ইউরো?

    এই টুর্নামেন্টটা ছিল সম্ভবত সর্বকালের সবচেয়ে অদ্ভুত টুর্নামেন্ট। 

    প্রথমে কোয়ালিফাই-ই করতে না পারা ডেনমার্ক পরে জিতে নেয় ১৯৯২-এর ইউরোটাই। দেশে যুদ্ধ চলার কারণে উয়েফা থেকে যুগোস্লাভিয়াকে নিষিদ্ধ করায় যখন টুর্নামেন্টে ডেনমার্কের প্রবেশ নিশ্চিত হয়, ইউরো শুরু হতে পনেরো দিনও বাকি নেই। এদিকে যুগোস্লাভিয়া ততদিনে স্বাগতিক সুইডেনের মাটিতে অনুশীলন শুরু করেছে, ওদিকে বাছাইপর্বের গ্রুপে যুগোস্লাভিয়ার দ্বিতীয় স্থানটা পেয়ে যায় ডেনমার্ক। 

    হুট করে টুর্নামেন্টে খেলার সুযোগ আসায় ডেনমার্ক নিজেদের প্রস্তুতি নেওয়ার তেমন সুযোগ পায়নি। তাই বলে "সব খেলোয়াড়ই ছুটি কাটাচ্ছিলেন", এই ধারণা করাটাও বাড়াবাড়ি। মাত্র দুজন ছিলেন ছুটিতে, এছাড়া বেশিরভাগ খেলোয়াড়ই সদ্য ডেনিশ লিগের খেলা শেষ করে জাতীয় দলের হয়ে প্রীতি ম্যাচ খেলার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।

    তবে স্বাগতিক সুইডেনের ভৌগোলিক অবস্থানটা ডেনমার্ক এবং ডেনিশ সমর্থকদের পক্ষে ছিল। টুর্নামেন্টে তাদের প্রথম ম্যাচটা অনুষ্ঠিত হয়েছিল মালমোতে, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেন থেকে মালমোর দূরত্ব ছিল একটা ছোট্ট ফেরি-ভ্রমণের সমান।

    ম্যানেজার

    টুর্নামেন্ট শুরুর আগ পর্যন্তও রিচার্ড মোলার নিয়েলসেনকে খুব বেশি মানুষ চিনতেন না। খেলোয়াড়ি জীবনে ত্রিশ বছর আগে ডেনমার্কের হয়ে দুটো ম্যাচ খেলেছিলেন তিনি। এছাড়া তাঁর ঝুলিতে আছে দুটো ঘরোয়া চ্যাম্পিয়নশিপের ট্রফি আর কোচ সেপ পিয়োন্তেকের সহকারী হওয়ার অভিজ্ঞতা।

    সাহসী ফুটবল খেলানোর জন্য পিয়োন্তেক বেশ বিখ্যাত ছিলেন। ১৯৮৬ সালে তাঁর দলের খেলাটা অনেক নিরপেক্ষ দর্শককে মুগ্ধ করেছিল। তবে তাঁর সহকারী হয়েও নিয়েলসেন অত সাহসী ফুটবল খেলাতে চাইতেন না। আকর্ষণীয় ফুটবলের বদলে তাঁর কাছে গুরুত্ব পেতো কাঠামোবদ্ধ ফুটবলটাই। তাঁর মৌলিক, রক্ষণাত্মক, অনাকর্ষণীয় ঘরানার ফুটবলের সাথে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান ফুটবলের মিল পাওয়া যায়।

    কোচ রিচার্ড মোলার নিয়েলসেন; Image Source: Getty Images

    তাঁর দলের গোলরক্ষক পিটার স্মাইকেল, যাঁকে এখন অনেকেই চেনেন বর্তমান ডেনিশ গোলরক্ষক ক্যাসপার স্মাইকেলের পিতা হিসেবে, ম্যানেজারের এই খেলানোর ধরনের সরাসরি সমালোচনা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, পিয়োন্তেক যেখানে "উঁচু ঘরানার" ফুটবলে অভ্যস্ত করেছিলেন ডেনিশদের, নিয়েলসেন সেখানে খেলাচ্ছেন "নিচু ঘরানার" ফুটবল। পরবর্তীতে অবশ্য মিডিয়ায় এমন বক্তব্য দেওয়ার জন্য ক্ষমা চাইতে হয় তাঁকে।

    তাঁর খেলানোর ধরন এতটাই রক্ষণাত্মক ছিল, যে সর্বকালের অন্যতম সেরা ডেনিশ ফুটবলার মাইকেল লাউড্রপ বিরক্ত হয়ে জাতীয় দল থেকে সরে গিয়েছিলেন। লাউড্রপ এমনটাও বলেছিলেন, নিয়েলসেন দায়িত্ব থেকে না সরা অবধি তিনি জাতীয় দলের জার্সি গায়ে চড়াবেন না। তাঁর ভাই ব্রায়ানও একই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাঁদের এই সিদ্ধান্ত নিয়েলসেনের বিপক্ষে দেশব্যাপী ক্ষোভকে আরো তাতিয়ে দেয়।

    তবে ইউরোতে ডেনমার্কের আকস্মিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত হলে ব্রায়ান তাঁর সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন। তবে মাইকেল লাউড্রপ তাঁর সিদ্ধান্তে ছিলেন অনড়, এবং পুরো ইউরো তিনি আমেরিকাতে ছুটি কাটাতে কাটাতে টেলিভিশনে উপভোগ করেন। ডেনমার্কের ইতিহাসের সেরা মুহূর্তটাও মাঠের খেলোয়াড় হিসেবে উপভোগ করা হয়নি তাঁর। তবে এক বছর পর মাঠে ফেরেন তিনি, ১৯৯৬ ইউরো আর ১৯৯৮ বিশ্বকাপে খেলেন দেশের জার্সি পরে।

    ট্যাকটিক্স 

    স্বভাবসুলভ ৫-৩-২ ফরমেশনেই বরাবরের মতো টুর্নামেন্টটা খেলতে নেমেছিল ডেনমার্ক। তবে টুর্নামেন্ট যত সামনের দিকে এগোতে থাকে, ততই প্রয়োজনের সাথে তাল মিলিয়ে ফরমেশনে পরিবর্তন আসতে থাকে। টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে গোলশূন্য ড্র আর দ্বিতীয় ম্যাচে স্বাগতিক সুইডেনের বিপক্ষে ১-০ ব্যবধানে পরাজয়ের পর নিয়েলসেন তাঁর অফফর্মে থাকা স্ট্রাইকার বেন্ট ক্রিস্টেনসেনকে বেঞ্চে বসিয়ে মাঠে নামেন অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হেনরিক লারসেনকে।

    ব্রায়ান লাউড্রপ; Image Source: Getty Images

    দুটো কারণে এই সিদ্ধান্তটা পরবর্তীতে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণিত হয়। প্রথমত, গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে ফ্রান্সের বিপক্ষে ২-১ ব্যবধানে জয়ের ক্ষেত্রে প্রথম গোলটা করেন লারসেন। এই জয়েই নকআউট পর্বে কোয়ালিফাই করে ফেলে ডেনমার্ক। এরপর সেমিফাইনালে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ২-২ গোলে ড্রয়ের ম্যাচেও দুটো গোল করেছিলেন তিনি।

    দ্বিতীয়ত, লারসেনের অন্তর্ভুক্তির ফলে ব্রায়ান লাউড্রপ আরেকটু সামনের দিকে খেলার সুযোগ পেয়ে যান। যেহেতু ডেনমার্কের আক্রমণভাগে তিনিই ছিলেন সবচেয়ে বড় নাম হিসেবে, তাঁকে আরেকটু আক্রমণাত্মক পজিশনে খেলানোর প্রয়োজন ছিল। সেন্টার ফরোয়ার্ড পোভলসেন, যিনি অবশ্য গোল করার চেয়ে ‘ডার্টি ওয়ার্ক’-ই বেশি করতেন, তাঁর কাছ থেকে সেরাটা বের করে আনার জন্যও এই ব্যাপারটার দরকার ছিল।

    Image Source: The Athletic

    ফাইনাল ম্যাচের জন্য ডেনমার্কের লাইনআপ ছিল এমন। পরিবর্তন এসেছিল মূলত রক্ষণে, লেফট উইংব্যাক হেনরিক অ্যান্ডারসেন সেমিফাইনালে হাঁটুর চোটে পড়ে ছিটকে গিয়েছিলেন ফাইনালের একাদশ থেকে।

    নিয়েলসেনের এই দলটা ছিল মূলত কাউন্টার-অ্যাটাক নির্ভর। বেশ কয়েকজন ভালো ডিফেন্ডার ছিলেন এই দলে, তাঁদের সামনে ছিলেন পরিশ্রমী এবং দারুণ ট্যাকেল করতে অভ্যস্ত জন জেনসেন। তবে আক্রমণে ওঠার সুযোগ পেলে পিছপা হতো না দলটি। তিন মিডফিল্ডার তো বটেই, সাথে আক্রমণে উঠতেন উইংব্যাকরাও। 

    মূল খেলোয়াড়

    আগেই বলা হয়েছে, মাইকেল লাউড্রপের অনুপস্থিতিতে ডেনমার্কের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় ছিলেন তাঁর ভাই ব্রায়ান লাউড্রপ। ফ্রান্সের বিপক্ষে তাঁর চমৎকার উইং প্লে দেখেছিল পুরো ইউরোপ। আর সেমিতে নেদারল্যান্ডসের ফ্রাঙ্ক ডি বোরকে তো একেবারে এলোমেলো করে দিয়েছিলেন তিনি।

    তবে মূল খেলোয়াড় হিসেবে একজনের নাম বলতে চাইলে, পিটার স্মাইকেলের নামই নিতে হবে। তখন ডেনিশ ফুটবলাররা নিজ দেশের বাইরের কোন লিগে খুব বেশি অংশ নিতেন না। তবে স্মাইকেল ছিলেন ব্যতিক্রম, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে ততদিনে একটা বছর কাটিয়ে ফেলেছিলেন তিনি।

    প্রথম ম্যাচে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে গোলশূন্য ড্রয়ের ক্ষেত্রে বেশ নড়বড়ে ছিলেন এই গোলরক্ষক। স্ট্রাইকার পোভলসেনও মিডিয়ার সামনে খোঁচা মেরেছিলেন তাঁকে, "অনেকেই বলে যে আমাদের দলে নাকি বিশ্বের সেরা গোলরক্ষকটা আছে, কিন্তু আমার মনে হয় সে আমাদের সাথে এখানে আসেনি।"

    পিটার স্মাইকেল; Image Source: Getty Images

    তবে টুর্নামেন্টের বাকি ম্যাচগুলোতে স্মাইকেল ছিলেন দুর্দান্ত। বিশেষত ক্রস ঠেকানোর ক্ষেত্রে তাঁর আগ্রাসন ছিল চোখে পড়ার মতো। সেমিফাইনালে নেদারল্যান্ডসের ডেনিস বার্গক্যাম্পের শটে পরাস্ত হয়েছিলেন তিনি, ডাচরাও ম্যাচে ফিরেছিল ওই গোল দিয়ে। তবে টাইব্রেকারে মার্কো ফন বাস্তেনের শট ঠেকিয়ে ঠিকই নায়ক হয়ে যান তিনি। এরপর ফাইনালেও দেখা গেছে তাঁর ঝলক, ওয়ান ভার্সেস ওয়ানে স্টেফান রয়টারের শট ঠেকিয়েছেন সামনে এগিয়ে এসে, ইয়ুর্গেন ক্লিন্সম্যানের হেডার ঠেকিয়েছেন রীতিমতো উড়ে গিয়ে। আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ সেভ ছিল তাঁর।

    এটাও বলে রাখতে হবে, টুর্নামেন্টে ডেনমার্কের মূল যে ট্যাকটিক্স ছিল, সেই ব্যাকপাস নির্ভর ফুটবলে মূল খেলোয়াড় ছিলেন স্মাইকেল। এই টুর্নামেন্টের পরই নতুন নিয়ম করা হয়, যে নিয়মে সতীর্থের কোন পাস গোলরক্ষক হাত দিয়ে ধরতে পারেন না। তবে আগের নিয়মের পুরো সুবিধাটা ততদিনে ডেনমার্ক নিয়ে নিয়েছে। 

    ডিফেন্স বা মিডফিল্ড থেকে নিয়মিতই ব্যাক পাস দেওয়া হতো স্মাইকেলের উদ্দেশ্যে, আর তিনিও বলটা হাত দিয়ে ধরে সময় নষ্ট করতেন। পরবর্তীতে অবশ্য এই নিন্দনীয় কৌশলে শিরোপা জেতার জন্য কিছুটা বিব্রত হয়েছিলেন স্মাইকেল, নিয়ম পরিবর্তনে তাঁর সমর্থনও প্রকাশ করেছিলেন।

    জেনে অবাক হবেন যে…

    টুর্নামেন্টের শুরুর দিকে ডেনমার্ক অত সিরিয়াস ছিল না। তাদের নিজেদেরই ধারণা ছিল, শুধু গ্রুপ পর্বের তিনটা ম্যাচ খেলতেই তাদের সুইডেনের মাটিতে পা রাখতে হবে। এই নির্ভার মানসিকতা চলমান থাকে পুরো টুর্নামেন্ট জুড়েই। ম্যানেজার নিয়েলসেনও শৃঙ্খলার ব্যাপারে বেশ ছাড় দিয়েছিলেন, ব্যাপারটা তাঁর স্বভাবসুলভ না হলেও।

    ব্লিজার্ড ম্যাগাজিনে ডেভ ফেরার তাঁর আর্টিকেলে যেমনটা বলেছেন, গ্রুপের শেষ ম্যাচটা ছিল ডেনমার্কের জন্য বাঁচামরার। কিন্তু সেই ম্যাচের আগে ডেনিশ ফুটবলারদের মূল মনোযোগ ছিল মিনি গলফ খেলার প্রতি। এরপর সেমিফাইনালের দুই রাত আগে বার্গার কিংয়ে ডিনারও করেছিল পুরো দল। আর ফাইনালের আগে জীবনসঙ্গিনীদের নিয়ে নিজেদের টিম হোটেলে অবস্থানের অনুমতিও পেয়েছিল দলের সদস্যরা। জার্মান সমর্থকেরা যে স্টকহোমের প্রতিটা হোটেল বুক করে ফেলেছিলেন ততদিনে!

    ফাইনাল ম্যাচ

    সেমিফাইনালে নেদারল্যান্ডসকে টাইব্রেকারে পরাজিত করলেও ফাইনালে জার্মানির বিপক্ষে ডেনমার্ককে বিবেচনা করা হচ্ছিল আন্ডারডগ হিসেবেই। অপেক্ষাকৃত দুর্বল স্কোয়াড এবং একদিন কম বিশ্রাম পাওয়ার ব্যাপারটা বাদ দিলেও, টুর্নামেন্টের ফাইনাল অবধি তাদের পৌঁছানোকে ধরা হচ্ছিল বিস্ময়ের ব্যাপার হিসেবে।

    জার্মানরা ম্যাচটা শুরুও করেছিল দারুণ আক্রমণাত্মকভাবে। প্রথমার্ধেই বেশ কয়েকটা সেভ করতে বাধ্য হন গোলরক্ষক পিটার স্মাইকেল। ডেনিশ খেলোয়াড়রা পরবর্তীতে স্বীকার করেছিলেন, শুরুতেই গোল হজম করলে ম্যাচে ফেরা খুব কঠিন হতো তাদের জন্য। কিন্তু ভাগ্য তাদের পক্ষে ছিল, আর খেলার ধারার বিপরীতেই গোল পেয়ে যায় ডেনমার্ক।

    জেনসেনের ওই গোল; Image Source: Getty Images

    জেনসেনের শট নেওয়ার সক্ষমতা সম্পর্কে সবাই কমবেশি অবগত ছিলেন। পরবর্তীতে আর্সেনালের হয়েও সেটা কাজে লাগিয়েছিলেন তিনি। তবে এইক্ষেত্রে, বক্সের ঠিক কোণায় বল পেয়ে অসাধারণ শটে কাছের পোস্ট দিয়ে বলটাকে জালে জড়িয়ে দেন। ব্রিটিশ টেলিভিশনে মার্টিন টেইলর তখন গলা ফাটাচ্ছেন, "ইয়েস! জেনসেন! জন জেনসেন হ্যাজ ফাইনালি গট ওয়ান রাইট!"

    তবে মূল নায়ক জেনসেন নন, পিটার স্মাইকেল। পরাশক্তি জার্মানিকে আটকে রাখার মূল কৃতিত্বটা তাঁরই। তবুও, শিরোপা নিশ্চিত করতে, এবং একটু নিশ্চিন্ত হতে, ডেনমার্কের দ্বিতীয় গোলের দরকার ছিল।

    ব্যবধান গড়ে দিয়েছিল যে মুহূর্ত

    হুট করে ইউরোতে সুযোগ পাওয়া, ছুটি কাটাতে কাটাতে ইউরোর ডাক আসা, ইউরোকে অত সিরিয়াসভাবে না নেওয়া, এই সব মজার গল্পের পেছনে লুকিয়ে ছিল একটা ব্যক্তিগত দুঃখজনক গল্প।

    ফাইনালে জার্মানির বিপক্ষে ডেনমার্কের দ্বিতীয় গোলটা এসেছিল মিডফিল্ডার কিম ভিলফোর্টের পা থেকে। ইন বিহাইন্ড রান নিয়েছিলেন, এরপর ইনসাইড কাট করে বলটাকে পাঠিয়ে দেন গোলপোস্টে।

    দ্বিতীয় গোলটা এসেছিল ভিলফোর্টের পা থেকে; Image Source: Getty Images

    কিন্তু ভিলফোর্টের কন্যা তখন লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা কন্যার পাশে থাকার জন্য পুরো টুর্নামেন্ট জুড়েই সুইডেন-ডেনমার্ক দৌড়েছেন ভিলফোর্ট। ট্রেনিংয়েও ঠিকমতো উপস্থিত থাকতে পারতেন না তিনি, ডেনিশ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন ব্যাপারটাকে গণমাধ্যমের সামনে উপস্থাপন করেছিল ব্যক্তিগত কারণ হিসেবে। কিন্তু একটা মিডিয়া ঠিকই আসল কারণটা খুঁজে বের করে প্রকাশ করে দেয়। এতে পারিবারিকভাবে বেশ মনক্ষুণ্ন হয়েছিলেন ভিলফোর্ট। 

    জনসাধারণের কাছে তথাকথিত 'নায়ক' হতে চাননি ভিলফোর্ট। বরং চেয়েছিলেন নিজের অসুস্থ কন্যার পাশে থাকতে। তাই শুধু পরিবারের চাওয়ায় সেমিফাইনাল আর ফাইনালে খেলতে ডেনমার্ক থেকে সুইডেনে গিয়েছিলেন তিনি। বাকিটা সময় কাটাতে চেয়েছিলেন কন্যার পাশে। বিয়োগান্তক ঘটনাটা ঘটে ভিলফোর্টের খেলোয়াড়ি জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জনের কিছুদিন পরেই। তাঁর কন্যা পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে পরপারে পাড়ি জমায়।

    ডেনমার্ক কি সত্যিই ইউরোপের সেরা দল ছিল?

    ইউরোতে চ্যাম্পিয়ন হওয়া দলটিকে সাধারণভাবে ইউরোপের সেরা দল বলতে পারার কথা। কিন্তু সেই সিদ্ধান্তে বাঁধ সাধে সরাসরি ইউরোতে কোয়ালিফাই করতে না পারার ব্যাপারটা। পুরো টুর্নামেন্ট বিবেচনা করলে ডেনমার্ক মোটে দুটো ম্যাচ জিতেছে, যেহেতু টাইব্রেকারে গড়ানো ম্যাচকে ড্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ভাগ্যও দারুণভাবে সহজ করেছিল তাদের। ফ্রান্সের বিপক্ষে তাদের একটা গোল অফসাইডের জন্য বাতিল হতেই পারতো, আর ফাইনালে ভিলফোর্টের গোলটা তো অনেকের চোখেই নিশ্চিত হ্যান্ডবল। 

    ইউরোর ট্রফিতে চুমু আঁকছেন পিটার স্মাইকেল; Image Source: Getty Images

    তবে এটাও ঠিক, ভাগ্য হোক আর যাই হোক, প্রথম দুই ম্যাচে ইংল্যান্ড আর সুইডেনের বিপক্ষে জয়হীন থাকা, মাত্র এক পয়েন্ট অর্জন, এরপর ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস এবং জার্মানির মতো তিনটা ফেভারিট দলকে পেছনে ফেলে টুর্নামেন্টের শিরোপা জয় ব্যাপারটা চাট্টিখানি কথা নয়। নিয়েলসেনের রক্ষণাত্মক কৌশল নিয়ে কথা হতেই পারে, কিন্তু এটাও সত্য, তাঁর দল ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস আর জার্মানির মতো পরাশক্তির বিপক্ষে মোট ছয়টা গোলও করেছিল। 

    "আমাদের টিম স্পিরিট ছিল অসাধারণ," ভিলফোর্ট বলেন, "আমাদের দলে হয়তো সেরা খেলোয়াড়রা ছিল না, কিন্তু দল হিসেবে আমরা সেরা ছিলাম।"