• কোপা আমেরিকা
  • " />

     

    ইউরো-কোপায় গুরু-শিষ্যের জয়!

    ইউরো-কোপায় গুরু-শিষ্যের জয়!    

    প্রায় সাড়ে ছয় ঘণ্টার ব্যবধানে অনুষ্ঠিত হলো দুটো মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের আসরের ফাইনাল। প্রথমে ইউরোর শিরোপাটা গেল স্পেনে, এরপর কোপা আমেরিকার বিজয়ীর মুকুটটা নিজেদের কাছেই রেখে দিলো আর্জেন্টিনা। শুধু স্পেন-আর্জেন্টিনার ট্রফি জয়ই নয়, এই দুটো ঘটনা আরো একটু বিশেষ হয়ে উঠছে অন্য একটা কারণেও। দুই দলের দুই কোচ, লুইস দে লা ফুয়েন্তে আর লিওনেল স্কালোনি যে সম্পর্কে গুরু-শিষ্য!

    শুরুতে দুজনের কোচিং ক্যারিয়ারের দিকে একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক। ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ২০১৭ সালের মে মাস অবধি হোর্হে সাম্পাওলির সহকারী হিসেবে সেভিয়ায় কাজ করেছিলেন লিওনেল স্কালোনি। এরপর সাম্পাওলি দায়িত্ব নেন আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের, স্কালোনিও তাঁর সহকারী হিসেবে যুক্ত হন আলবিসেলেস্তেদের কোচিং প্যানেলে। পরের বছরের বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার ব্যর্থতার পরে ছাঁটাই করা হয় সাম্পাওলিকে, আর ভারপ্রাপ্ত হিসেবে কোচের দায়িত্ব দেওয়া হয় স্কালোনিকে। ওই বছরের নভেম্বরে স্কালোনির চাকরি স্থায়ী হয়। সেই থেকেই আর্জেন্টিনার ম্যানেজারের পদে সাফল্যের সাথে কাজ করে চলেছেন লিওনেল স্কালোনি, আকাশি-সাদাদের জিতিয়েছেন দুটো কোপা আমেরিকা, একটা ফিনালিসিমা আর একটা বিশ্বকাপ।

    আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ জিতিয়েছিলেন লিওনেল স্কালোনি; Image Source: Getty Images

    ওদিকে লুইস দে লা ফুয়েন্তের কোচিং ক্যারিয়ারটা শুরু হয়েছিল ১৯৯৭ সালের জুলাইয়ে। স্পেনের ক্লাব পর্তুগালেতকে কোচিং করিয়েছিলেন তিনি। এরপর অরেরা, অ্যাটলেটিক বিলবাও, আলাভেসের মতো ক্লাবের কোচিং করানোর পরে দায়িত্ব নেন স্পেনের বয়সভিত্তিক দলগুলোর। ২০১৩ সালে অনূর্ধ্ব-১৯, ২০১৪ সালে অনূর্ধ্ব-১৮, ২০১৮ সালে অনূর্ধ্ব-২১ দলের কোচিং করানোর পরে স্পেন জাতীয় দলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন দে লা ফুয়েন্তে। স্পেনের হয়ে শুধু একটা ইউরো আর একটা ইউয়েফা নেশনস লিগই জেতেননি তিনি, সাথে তুলে এনেছেন স্পেনের অনেক তরুণ খেলোয়াড়কেও।

    ১২ বছর পর স্পেনকে ইউরো জেতালেন দে লা ফুয়েন্তে; Image Source: Getty Images

    কিন্তু স্কালোনি আর দে লা ফুয়েন্তের মধ্যে সম্পর্কটা তৈরি হলো কীভাবে?

    তখন ২০১৭ সাল। লিওনেল স্কালোনি ততদিনে সাম্পাওলির সহকারী হিসেবে আর্জেন্টিনা জাতীয় দলে কাজ করছেন। ওদিকে দে লা ফুয়েন্তে তখন স্পেনের অনূর্ধ্ব-১৮ দলের কোচিং করানোর পাশাপাশি ইউয়েফাতে একটা কোর্সও নিচ্ছেন। ইউয়েফা প্রো লাইসেন্সের ওই কোর্সে মূলত প্রথম বিভাগে অন্তত সাত মৌসুম খেলেছেন, এমন সাবেক খেলোয়াড়দের ফুটবলের ট্যাকটিকাল বিষয়গুলো শেখানো হতো।

    রয়্যাল স্প্যানিশ ফুটবল ফেডারেশন (আরএফইএফ) প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত ওই কোর্সে ক্লাস করতেন ফুটবলের বেশ কিছু সাবেক তবে পরিচিত মুখ। লিওনেল স্কালোনি তো ছিলেনই, তাঁর সাথে ছিলেন ফার্নান্দো রেডোন্ডো, হাভিয়ের স্যাভিওলা, লিও ফ্রাঙ্কো, হুলিও সিজার প্রমুখ। ওই কোর্সের সাত বছর পরে, এই ২০২৪ সালে দাঁড়িয়ে অবশ্য কোচ হিসেবে স্কালোনির ধারেকাছেও বাকিদের পাওয়া যায় না।

    লুইস দে লা ফুয়েন্তে এবং লিওনেল স্কালোনি (পেছনের সারিতে বাঁ থেকে প্রথম ও দ্বিতীয়); Image Source: RFEF

    সেই থেকে দে লা ফুয়েন্তেকে নিজের ‘মেন্টর’ হিসেবে মানেন স্কালোনি। দুজনের মধ্যে সম্পর্কও বেশ ভালো। সময়ে সময়ে ক্ষুদেবার্তাও চালাচালি হয় দুজনের মধ্যে, একে অপরের সাফল্যে অভিনন্দিতও করেন পরস্পরকে। কোপা-ইউরো চলাকালে ব্যাপারটা স্বীকার করেছেন স্কালোনি আর দে লা ফুয়েন্তেই।

    কোয়ার্টার ফাইনালে ইকুয়েডরের মুখোমুখি হওয়ার আগে সংবাদ সম্মেলনে আর্জেন্টাইন কোচ লিওনেল স্কালোনিকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ এবং ইউরোপের দলগুলোর মান নিয়ে। এই প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তখনই গুরু লুইস দে লা ফুয়েন্তের কাছে কোচিং কোর্স করার ব্যাপারটা প্রকাশ করেন স্কালোনি। পাশাপাশি ইউরোতে শুভকামনা জানান স্পেনকেও, “আমি চাই স্পেন ভালো করুক। দে লা ফুয়েন্তের কাছে আমরা যারা কোচিং কোর্স করেছি, তাদের প্রত্যেকের জন্য আমার পক্ষ থেকে শুভকামনা। যেভাবে তিনি (দে লা ফুয়েন্তে) নিজেকে পরিচালনা করেন, যেভাবে খেলোয়াড়দের পরিচালনা করেন, ব্যাপারটা আমার ভালোই লাগে।”

    “আমার পরিবারের একটা অংশ স্প্যানিশ,” স্কালোনি আরো বলেন, “সেই হিসেবে আমি স্পেনকেই সমর্থন দেবো।”

    বলে রাখা ভালো, স্কালোনির স্ত্রী এলিসা মন্তেরো নিজে একজন স্প্যানিশ। এছাড়া খেলোয়াড়ি জীবনে স্প্যানিশ ক্লাব ডেপোর্তিভো লা করুনিয়া আর মায়োর্কাতেও খেলেছেন স্কালোনি। স্কালোনির বর্তমান বাসস্থানও স্পেনের মায়োর্কাতেই, তাই স্পেনের সাথে তাঁর সংযোগটা বেশ নিবিড়। স্প্যানিশ কোচ লুইস দে লা ফুয়েন্তের অকুণ্ঠ প্রশংসাও থাকছে তাঁর জন্য।

    লুইস দে লা ফুয়েন্তে এবং লিওনেল স্কালোনি (পেছনের সারিতে বাঁ থেকে প্রথম ও দ্বিতীয়); Image Source: RFEF

    “আমার ভাগ্যটা বেশ ভালোই বলতে হবে। জাভি হার্নান্দেজ, জাবি আলোনসো, রাউলের মতো ফুটবলারদেরকে আমি কোচিং কোর্স করিয়াছি। খেলোয়াড়দের মধ্যে অনেকেরই এখন কোচিংয়ে আসার প্রবণতা বেড়েছে, আর আমার সৌভাগ্য যে আমি লিওনেল স্কালোনিকে কোচিং করিয়েছি,” ফ্রান্সের বিপক্ষে ইউরোর সেমিফাইনাল ম্যাচ খেলার আগে বলেছিলেন দে লা ফুয়েন্তে।

    “আমাদের সম্পর্কও খুব ভালো,” তিনি আরো বলেছিলেন, “স্কালোনি একজন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। হ্যাঁ, শুরুতে তার অভিজ্ঞতার অভাবটা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছিলেন, কিন্তু ভাগ্য তার সাথে ছিল বলেই সে আর্জেন্টিনাকে কোপা আমেরিকা আর বিশ্বকাপের শিরোপা জিতিয়েছে।”

    ইউরো আর কোপা আমেরিকার ফাইনালের আগেও স্কালোনিকে নিয়ে কথা বলেছেন দে লা ফুয়েন্তে, “আমরা একে অপরকে মেসেজ পাঠাই। আরেকটা কোপা আমেরিকার ফাইনালের পৌঁছানোতে আমি তাকে অভিনন্দনও জানিয়েছি। সে রীতিমতো একজন মায়েস্ত্রো, আর মানুষ হিসেবেও সে খুব ভালো। আমি আমার হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে তার এবং আর্জেন্টিনার জন্য শুভকামনা জানাই। আর ওর কারণেই আমি আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের একজন সমর্থক হয়ে গেছি।” 

    “আশা করি আমাদের দুজনের দলই যার যার শিরোপা জিততে পারবে,” তিনি আরো বলেন, “আশা রাখি, ফিনালিসিমাতে আমাদের দেখা হবে। ওর মতো একজন ভালো বন্ধুর সাথে মাঠে আবার দেখা হওয়াটা আমার জন্য খুবই আনন্দের ব্যাপার হবে।”

    গুরু-শিষ্যের দেখা হচ্ছে ফিনালিসিমায়! Image Source: Getty Images

    দে লা ফুয়েন্তের বলা শেষ কথাটাই সম্ভবত এখন ফুটবল-দর্শকদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। ২০২৫ সালে অনুষ্ঠিতব্য আর্জেন্টিনা-স্পেনের ফিনালিসিমা শুধু ইউরোপ-লাতিন আমেরিকার ফুটবলীয় লড়াই-ই নয়, পাশাপাশি থাকবে মাঠে গুরু-শিষ্যের পরস্পরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা আর মাঠের বাইরে পারস্পরিক অকুণ্ঠ শ্রদ্ধাবোধও!