• ক্লাব ফুটবল
  • " />

     

    বার্সেলোনার ‘লা মাসিয়া’, নাকি রিয়াল মাদ্রিদের ‘লা ফ্যাব্রিকা’?। লা মাসিয়া সিরিজ। পর্ব ৩

    বার্সেলোনার ‘লা মাসিয়া’, নাকি রিয়াল মাদ্রিদের ‘লা ফ্যাব্রিকা’?। লা মাসিয়া সিরিজ। পর্ব ৩    

    পেপ গার্দিওলা, লিওনেল মেসি, জাভি হার্নান্দেজ, আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা, সার্জিও বুসকেটস, ফুটবল ইতিহাসের এই বড় বড় নামগুলোর সাথে জড়িয়ে আছে বার্সেলোনার ‘লা মাসিয়া’ একাডেমির নাম। এই নামগুলোর ভারেই একাডেমি হিসেবে লা মাসিয়াকে বেশ উঁচুমানের বলেই ধরা হয়। সেই তুলনায় চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদের একাডেমি ‘লা ফ্যাব্রিকা’ যেন অনেকটাই অবহেলিত। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে, ইউরোপে খেলোয়াড় সরবরাহের দিক দিয়ে লা ফ্যাব্রিকা পিছিয়ে নেই একেবারেই। 

    বার্সা-রিয়ালের চিরাচরিত প্রতিদ্বন্দ্বিতাটা চলে একাডেমি পর্যায়েও, কথাটা সম্ভবত একেবারেই বাড়াবাড়ি নয়। লা মাসিয়ার বর্ণাঢ্য ইতিহাস, মলিন অতীত, উজ্জ্বল বর্তমান আর স্বর্ণালী ভবিষ্যতের গল্প তো বলা হয়েছেই, সাথে বলা হয়েছে তাদের খেলোয়াড় বাছাই করার প্রক্রিয়াও। এবারে একটু তাকানো যাক লা ফ্যাব্রিকার দিকে।

    রিয়াল মাদ্রিদের ভালদেবেবাস একাডেমি কমপ্লেক্সে ঢুকলে আপনি সবার আগে যে দরজাটা দেখবেন সেটা ক্লাবের সবচেয়ে কমবয়সী খেলোয়াড়দের ড্রেসিংরুম। এই খেলোয়াড়দের কারোর বয়সই পাঁচ পেরোয়নি, আর এই বয়সীদের নিয়েই শুরু হয় মাদ্রিদের খেলোয়াড় তৈরির কার্যক্রম।

    রিয়াল মাদ্রিদের একাডেমি, লা ফ্যাব্রিকা; Image Source: Getty Images

    স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদ থেকে ১২.৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ভালদেবেবাসে মোট ১১টা ফুটবল মাঠ আছে, আছে আলফ্রেডো ডি স্টেফানো স্টেডিয়ামও। আর আছে অনেকগুলো বিল্ডিং। একেবারে কম বয়সে এই একাডেমি কমপ্লেক্সে ঢোকা খেলোয়াড়টিকে পেরোতে হয় এই সব ‘বিল্ডিং’-এর বাধা, তবেই এক সময়ে পা রাখা সম্ভব হয় স্বপ্নের সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে।

    রিয়াল মাদ্রিদের মূল দলে জায়গা পাওয়া, কিংবা স্বপ্নের বার্নাব্যুতে পা রাখার পথটা স্বাভাবিকভাবেই বেশ কণ্টকাকীর্ণ। প্রতিনিয়ত কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে ওঠা পথটা পেরোতে পেরোতে সেটা খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারেন লা ফ্যাব্রিকার ‘ছাত্র’রা। ১৩ বছর বয়স হওয়া অবধি তাদের বিবেচনা করা হয় ‘লো ক্যান্তেরা’ বা কম বয়সী হিসেবে। তখন তাদের ড্রেসিংরুমের দেয়ালেও থাকে হলুদ রঙ। বয়স তেরো পেরিয়ে পেলে তাদেরকে বিবেচনা করা হয় ‘হাই ক্যান্তেরা’ বা বেশি বয়সী হিসেবে। ড্রেসিংরুমের দেয়ালও তখন পরিণত হয় নীল রঙে।

    গত বছরের পরিসংখ্যান অনুসারে, বয়সভিত্তিক সব দল মিলিয়ে মোট ৩৬৪ জন খেলোয়াড় ভর্তি রয়েছেন এখানে। ২০২১-২২ মৌসুমের হিসাব অনুসারে, এই পুরো সিস্টেমটা চালু রাখার জন্য প্রায় ২৫ মিলিয়ন ইউরো খরচ হয়েছিল রিয়াল মাদ্রিদের। একই সময়ে, ‘একাডেমি অ্যাক্টিভিটিজ‘ থেকে ক্লাবটির আয় হয়েছে প্রায় ৩৬ মিলিয়ন ইউরো।

    ব্যবসায়িক দিক থেকে লা ফ্যাব্রিকা তাই বেশ লাভজনকই বটে। আর এই লাভের সিংহভাগই আসে তরুণ খেলোয়াড়দের বিক্রি করার মাধ্যমে। গত ১০ বছরে এই খেলোয়াড়দের বিক্রি করে প্রায় ৩৩০.৫ মিলিয়ন ইউরো উপার্জন করেছে রিয়াল মাদ্রিদ। সর্বশেষ ট্রান্সফার উইন্ডোতে দলটি বিক্রি করেছে ‘একাডেমি গ্র্যাজুয়েট’ রাফা মারিন এবং হুয়ানমি লাতাসাকে, লোনে গেতাফেতে পাঠিয়েছে আলভারো রদ্রিগেজকে, আর ছেড়ে দিয়েছে অভিজ্ঞ নাচো ফার্নান্দেজকে। এর আগে বিভিন্ন সময়ে ক্লাব ছেড়েছেন আন্তোনিও ব্লাঙ্কো, বোর্হা মায়োরাল, মিগুয়েল গিতিয়েরেজ, ভিক্টর চুস্টের মতো তরুণরা। একাডেমির খেলোয়াড় বলতে দানি কারভাহাল, লুকাস ভাসকেজ আর ফ্রান গার্সিয়াই এখনো রয়েছেন রিয়াল মাদ্রিদে। এর বাইরে ভিনিসিয়াস জুনিয়র, ফেদেরিকো ভালভার্দে, রদ্রিগোরা তরুণ বয়সে যোগ দিয়েছিলেন রিয়াল মাদ্রিদের রিজার্ভ টিম কাস্তিয়ায়।

    এবার একটু  লা ফ্যাব্রিকার ব্যাপারে কথা বলা যাক। স্প্যানিশ ‘লা ফ্যাব্রিকা’কে ইংরেজিতে অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘দ্য ফ্যাক্টরি’, আর বাংলায় ‘কারখানা’। ‘লা ফ্যাব্রিকা’ নামটা প্রথম ব্যবহার করেছিলেন রিয়াল মাদ্রিদের কিংবদন্তি খেলোয়াড় এবং ম্যানেজার আলফ্রেডো ডি স্টেফানো। তবে এই একাডেমিটা শুরু হয়েছিল রিয়াল মাদ্রিদের সম্ভবত সবচেয়ে বিখ্যাত প্রেসিডেন্ট সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর হাত ধরেই। তাঁর ওই প্রজেক্টের সাথে তুলনীয় কোনো কিছুই তখন ছিল না স্পেনে।

    ওই সময়ে, অর্থাৎ পঞ্চাশের দশকে মূলত স্থানীয় স্কুল অথবা টুর্নামেন্টগুলো থেকে শিশু-কিশোরদের বাছাই করা হতো একাডেমির জন্য। রিয়াল মাদ্রিদের ইতিহাসের প্রথম চার ‘হোমগ্রোন’ খেলোয়াড় ছিলেন হুয়ান সান্তিস্তেবান, আন্তোনিও রুইজ, র‍্যামন মার্সাল এবং এনরিক মাতেওস। তাঁদের মধ্যে এনরিক মাতেওস ছিলেন রিয়াল মাদ্রিদের ১৯৫৬ থেকে ১৯৬০ সালের ইউরোপিয়ান কাপজয়ী দলের সদস্য।

    এর পরের ব্যাচটাকে অনেকেই ডাকেন “ইয়ে-ইয়ে বয়েজ” বলে। ওই সময়ের একটি গানের দলের অনুকরণেই তাঁদের নামকরণ। এই ব্যাচের উল্লেখযোগ্য খেলোয়াড় ছিলেন পেদ্রো ডি ফেলিপে, ফার্নান্দো সেরেনা, র‍্যামন গ্রোসো এবং ম্যানুয়েল ভেলাজকেজ। ১৯৬৬ সালে, রিয়াল মাদ্রিদের ইতিহাসের ষষ্ঠ ইউরোপিয়ান কাপটা জিতেছিল এই দলটাই।

    সেই 'কুইন্তা দেল বুইত্রে 'দল; Image Source: Imago

    আশির দশকের ব্যাচ, যাকে “কুইন্তা দেল বুইত্রে” বা “দ্য ভালচার ফাইভ”-ও বলা হয়, লা ফ্যাব্রিকার ইতিহাসের অন্যতম সেরা ব্যাচ। নামের “বুইত্রে” অংশটা এসেছে রিয়াল মাদ্রিদের সাবেক খেলোয়াড় এমিলিও বুত্রাগুয়েনো থেকে, যিনি এখন রয়েছেন ক্লাবের ‘ইনস্টিটিউশনাল রিলেশনস’ বিভাগের পরিচালক হিসেবে। ব্যাচের বাকি চারজন ছিলেন মানোলো সানচিস, মিগুয়েল পারদেজা, মিশেল এবং মার্টিন ভাসকেজ। আশির দশকের মাঝামাঝিতে জারাগোজাতে চলে গিয়েছিলেন পারদেজা, তবে বাকিরা রয়ে গিয়েছিলেন মাদ্রিদেই। ১৯৮৫-৮৬ থেকে ১৯৮৯-৯০, এই টানা পাঁচটা লিগ জয়, এবং ১৯৮৪-৮৫ ও ১৯৮৫-৮৬-এর দুটো ইউয়েফা কাপ জয়ে এই চারজনের ছিল বড় ভূমিকা।

    এই চারজনের ক্ষেত্রে আরেকটা বিশেষ ব্যাপার ছিল। তখনকার প্রথা অনুসারে শারীরিকভাবে আরো সুগঠিত করার জন্য লা ফ্যাব্রিকা থেকে তরুণ খেলোয়াড়দের পাঠানো হতো গ্যালিসিয়ার সেডেইরাতে। মূলত পুষ্টিকর খাবারের মাধ্যমে খেলোয়াড়দের শারীরিকভাবে শক্তিশালী করাই ছিল এর উদ্দেশ্য, কেননা অপুষ্টি ছিল তখনকার তরুণ খেলোয়াড়দের অন্যতম বড় সমস্যা। কিন্তু এই চারজনের কাউকেই লা ফ্যাব্রিকার বাইরে পাঠানো হয়নি। 

    ২০২০ সাল থেকে লা ফ্যাব্রিকার দায়িত্বে রয়েছেন রিয়াল মাদ্রিদের সাবেক ফুটবলার ম্যানুয়েল ফার্নান্দেজ। তাঁর বাবা ছিলেন রিয়াল মাদ্রিদের সাবেক পরিচালক, আর তিনি নিজেও মাদ্রিদের একাডেমিতে ছয় বছর কাটিয়েছেন কোচ হিসেবে।

    লা ফ্যাব্রিকায় তাঁর ডান হাত হিসেবে ধরা হয় আবিয়ান পের্দোমোকে। এছাড়া রিয়াল মাদ্রিদের বয়সভিত্তিক দলগুলোতে কোচিং করান রাউল গঞ্জালেস এবং আলভারো আরবেলোয়ার মতো দলটির সাবেক খেলোয়াড়রা। এছাড়া অন্যান্য ভূমিকায় থাকেন আরো কয়েকজন সাবেক খেলোয়াড়: হুয়ান হোসে ভ্যালিনা, হুয়ান কার্লোস দুকে, জর্দি কোদিনা প্রমুখ।

    রাউল গঞ্জালেস এখন কোচিং করাচ্ছেন লা ফ্যাব্রিকায়; Image Source: Getty Images

    লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে লা মাসিয়ার চেয়ে লা ফ্যাব্রিকা অনেকটাই আলাদা। লা মাসিয়া যেখানে মূলত খেলোয়াড় তৈরি করে ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনার জন্য, লা ফ্যাব্রিকার লক্ষ্য থাকে ‘বৈশ্বিক’ খেলোয়াড় তৈরি করে। একটা নির্দিষ্ট ধরনের খেলাতে আটকে না থেকে বরং বিভিন্ন স্টাইলের সাথে মানিয়ে নেওয়ার মতো করে তৈরি করা হয় খেলোয়াড়দের। এর মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন পরিবেশে ভালো করার মতো প্রতিযোগিতাপূর্ণ মনোভাব তৈরি হয় খেলোয়াড়দের মধ্যে। ২০২২-২৩ মৌসুমে লা লিগার বিভিন্ন ক্লাবজুড়ে মোট ৫৫ জন্য ‘লা ফ্যাব্রিকা গ্র্যাজুয়েট’ খেলেছিলেন, এমনকি চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বার্সেলোনার লেফট উইংব্যাক মার্কোস আলোনসোও ছিলেন এই একাডেমি থেকে উঠে আসা।

    ব্যাপারটাকে ব্যাখ্যা করেছেন মাদ্রিদের দল লা রোজার হয়ে স্পেনের পঞ্চম পর্যায়ে খেলা গঞ্জালো এক্সপোজিতো। রিয়াল মাদ্রিদের যুব পর্যায়ে নয় বছর কাটানো এই খেলোয়াড় বলেন, “মাদ্রিদে আমি শুরু করেছিলাম রাইটব্যাক হিসেবে, এরপর আমাকে নিয়ে আসা হয় সেন্টারব্যাকে। অনেক কোচ আমাকে মিডফিল্ডার হিসেবেও খেলিয়েছেন। একাডেমি আমাকে ফুটবল বোঝা শিখিয়েছে, বিভিন্ন পজিশনে খেলা শিখিয়েছে।”

    সাধারণত অনূর্ধ্ব-১৪ এবং এর নিচের বয়সভিত্তিক দলগুলোর খেলোয়াড়দের ক্ষেত্রে লা ফ্যাব্রিকা মূলত গুরুত্ব দেয় খেলার প্রতিই। ড্রিল বা অন্যান্য ট্রেনিং করিয়ে মূল খেলা থেকে উঠতি খেলোয়াড়দের মনোযোগটা সরাতে চান না তাঁরা। অনূর্ধ্ব-১৫ থেকে পরবর্তী দলগুলোর ক্ষেত্রে বিশেষায়িত ট্রেনিংয়ের ওপরে জোর দেওয়া হয়, যদিও সেক্ষেত্রেও কিছু নমনীয়তা থাকে। সিস্টেম অনুসারে খেলোয়াড় তৈরি করতে চায় না লা ফ্যাব্রিকা, খেলোয়াড় অনুযায়ী সিস্টেম তৈরি করে।

    লা মাসিয়ার মতো লা ফ্যাব্রিকাও খেলোয়াড় বাছাই শুরু করে ছোটবেলা থেকেই। শিশু খেলোয়াড়দের জন্য অনুষ্ঠিত টুর্নামেন্টগুলোর দিকে সাধারণত চোখ রাখে বড় ক্লাবগুলো। এমন সব টুর্নামেন্ট থেকেই সম্ভাবনাময় খেলোয়াড়দের নজরবন্দী করা হয়, পরে ট্রায়ালের মাধ্যমে তাদেরকে বাছাই করা হয় একাডেমির জন্য। এই পথ ধরেই উঠে এসেছিলেন ইকার ক্যাসিয়াস এবং সানচিসের মতো কিংবদন্তি খেলোয়াড়রা।

    এখন অবশ্য আগের মতো ওপেন ট্রায়াল খুব বেশি অনুষ্ঠিত হয় না, অথবা টুর্নামেন্টের একটা বা দুটো ম্যাচ দেখেই খেলোয়াড়দের বাছাই করে নেওয়া হয় না। বরং খেলোয়াড়দের যেতে হয় আরো বেশি যাচাইয়ের মাধ্যমে, অন্তত ছয়-সাত ম্যাচ দেখে তবেই একাডেমিতে নেওয়া হয়।

    ১২ বছরের কমবয়সী খেলোয়াড়দের একাডেমিতে আনার ক্ষেত্রে রিয়াল মাদ্রিদ মূলত মাদ্রিদের স্থানীয় খেলোয়াড়দের ওপরেই নির্ভর করে। এক্ষেত্রে রিয়াল মাদ্রিদের আন্তর্জাতিক স্কাউটের তেমন কোনো নেটওয়ার্ক নেই। পাশাপাশি, ফিফার পরামর্শ মেনে শিশু-কিশোর খেলোয়াড়দের নিজস্ব বাসস্থান থেকে খুব বেশি দূরের একাডেমিতে না আনার ব্যাপারটাও অনুসরণ করে মাদ্রিদ।

    তবে দেশের বাইরে স্কাউট নেটওয়ার্ক না থাকলেও স্পেনের মধ্যে মাদ্রিদ ঠিকই তীক্ষ্ণ চোখ রাখে। কাতালুনিয়া, আন্দালুসিয়া, ক্যানারি আইল্যান্ডসহ স্পেনের ১৭টা এলাকায় একজন করে স্কাউট রয়েছে মাদ্রিদের। ২০১৪ সাল থেকে রিয়াল মাদ্রিদের একাডেমিতে বসবাসের সুযোগ রয়েছে মাদ্রিদের বাইরের তরুণ খেলোয়াড়দের।

    Image Source: Getty Images

    তবে লা ফ্যাব্রিকার পরিচালনার দায়িতে যারা রয়েছেন, তাঁরা জানেন, পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে সাধারণত মাদ্রিদে জন্ম নেওয়া খেলোয়াড়দেরই মূল দলে সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। বর্তমান দলের দানি কারভাহাল, বা সদ্য মাদ্রিদ ছেড়ে যাওয়া নাচো ফার্নান্দেজের ক্ষেত্রেও এই ব্যাপারটা প্রযোজ্য।

    নাচোর ব্যাপারটা এক্ষেত্রে বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। মাদ্রিদের বয়সভিত্তিক দলগুলোতে তাঁর উদাহরণ উঠে আসে প্রায়ই। মাদ্রিদের আলকালা দে এনারেসে জন্মগ্রহণ করা নাচো অধিনায়কত্ব করেছেন লস ব্লাঙ্কোসদের বয়সভিত্তিক পর্যায়ের প্রতিটি দলে। পাশাপাশি নিজের আচরণ দিয়েও সবার মনে জায়গা করে নিয়েছিলেন তিনি।

    এই আচরণগত ব্যাপারটাকে মাদ্রিদে বেশ গুরুত্বের সাথে দেখা হয়। এমিলিও বুত্রাগুয়েনো বলেছিলেন, “খেলোয়াড়দের খেলোয়াড়ি শিক্ষার পাশাপাশি পারস্পরিক সম্মান ও মূল্যবোধও শিক্ষা দেওয়া হয় এখানে। এই একেকজন খেলোয়াড়ই তো আসলে আমাদের ক্লাবের প্রতিনিধি। এই মূল্যবোধগুলো খেলোয়াড়ের জীবন এবং ক্যারিয়ারে ভালো প্রভাব রাখে। তাই মাঠে এবং মাঠের বাইরে খেলোয়াড়দের আচার-ব্যবহারকে আমরা পর্যবেক্ষণে রাখি, পারস্পরিক সম্পর্কের দিকে খেয়াল রাখি।”

    এই ব্যাপারগুলোর সম্মিলিত ফলের নামই “রিয়াল মাদ্রিদ ডিএনএ”। প্রত্যাশা, যাচাই-বাছাই আর সাফল্য দিয়ে তৈরি এই ডিএনএ।

    তবে স্বাভাবিকভাবেই, সাফল্য তো সবাই পায় না। একাডেমির খেলোয়াড়দের বেশিরভাগই শেষ পর্যন্ত রিয়াল মাদ্রিদের মূল দলে জায়গা পান না। অনেকে তো ফুটবল খেলাকে পেশা হিসেবেও নেন না শেষ পর্যন্ত। আবার পর্যাপ্ত প্রতিভা ও দক্ষতার অভাবে বিভিন্ন সময়ে অনেক খেলোয়াড়কেই ছাঁটাই করতে বাধ্য হয় ক্লাব কর্তৃপক্ষ, এক বুক স্বপ্ন নিয়ে লা ফ্যাব্রিকায় আসা শিশু-কিশোরদের জন্য সময়টা যে কতটা কষ্টের, সেটা বোধ হয় না বললেও চলে!

    খেলোয়াড় ছাঁটাইয়ের মূল ব্যাপারটা ঘটে মূলত দুটো পর্যায়ে। প্রথম পর্যায়ে, আলেভিন থেকে ইনফান্তিল (অনূর্ধ্ব-১২ থেকে অনূর্ধ্ব-১৩) পর্যায়ে উত্তরণের সময়ে অনেককেই লা ফ্যাব্রিকা ছাড়তে হয়। আবার ক্যাডেট থেকে জুভেনিল (অনূর্ধ্ব-১৬ থেকে অনূর্ধ্ব-১৭) পর্যায়ে গমনের সময়েও খেলোয়াড়দের একটা বড় অংশকে ছাঁটাই করা হয়।

    তবে অনেক খেলোয়াড়কে ছাঁটাই করলেও, রিয়াল মাদ্রিদ কিন্তু তাদের ওপর থেকে চোখ ফেরায় না। নতুন একাডেমি বা নতুন ক্লাবে তাদের পারফরম্যান্সকে ঠিকই পর্যবেক্ষণে রাখা হয়, এবং সব ঠিকঠাক থাকলে আবারও ফিরিয়ে আনা হয় রিয়াল মাদ্রিদের মূল দল বা রিজার্ভ দল কাস্তিয়ার জন্য। গোলরক্ষক মারিও দে লুইজের কথা এক্ষেত্রে বলা যায়, মাদ্রিদের একাডেমিতে বেড়ে ওঠা এই খেলোয়াড়কে একটা সময়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু নতুন ক্লাব রায়ো ভায়েকানোতে তিনি কেমন করেন, তার ওপরে নজর রাখা হয়েছিল। রিয়াল মাদ্রিদের এই প্রতিবেশী ক্লাবের হয়ে তাঁর দারুণ পারফরম্যান্সে মুগ্ধ করে সবাইকে, তাই আবারও ক্লাবে ফেরানোর চিন্তা করা হয়। এখন রাউল গঞ্জালেসের কাস্তিয়ায় খেলছেন এই ২২ বছর বয়সী তরুণ।

    ফ্রান গার্সিয়া, দ্যা লা ফ্যাব্রিকা গ্র্যাজুয়েট; Image Source: Getty Images

    সহজ কথা, সত্যিকারের প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের জন্য মাদ্রিদের দরজা খোলা থাকে সবসময়েই। তাই খেলোয়াড়দের বিক্রি করার সময়েও পুনররায় তাদের দলে টানার ধারাটা উল্লেখ করা থাকে চুক্তিতে। লোনে কয়েক দফায় ক্লাবের বাইরে গেলেও, ফ্রান গার্সিয়া ক্লাবে ফিরে এসেছেন এভাবেই।

    “শুধু প্রতিভা থাকলেই হয় না। পাশাপাশি দরকার হয় ভাগ্য, পরিশ্রম আর অনেক অনেক ত্যাগ,” বলেছিলেন ফ্রান গার্সিয়ার চেয়ে বয়সে এক বছরের বড় গঞ্জালো এক্সপোজিতো।

    তাঁর সাথে একমত রিয়াল মাদ্রিদ এবং স্পেন জাতীয় দলের সাবেক কোচ ভিসেন্তে দেল বস্কও। ১৯৯৯ সালে লস ব্লাঙ্কোসদের ম্যানেজার হওয়ার আগে তিনি দুই দশক কাটিয়েছেন মাদ্রিদের যুব একাডেমিতে। “আপনি যদি খুব ভালো খেলেন, ক্যাসিয়াস বা রাউলের মতো, সেক্ষেত্রে হয়তো এসব ছাড়াও মূল দলে সুযোগ পেয়ে যাবেন।”

    ক্যাসিয়াস-রাউল বা মেসি-জাভি-ইনিয়েস্তা হওয়ার বুকভরা স্বপ্ন নিয়েই তো লা ফ্যাব্রিকা বা লা মাসিয়ায় ভর্তি হন শিশু-কিশোররা। লা মাসিয়া খেলোয়াড়দের তৈরি করার চেষ্টা করে নিজেদের মতো করে, অপর দিকে লা ফ্যাব্রিকায় খেলোয়াড়রা বিকশিত হতে পারেন নিজেদের প্রতিভা এবং দক্ষতা অনুসারে। তাই স্বাভাবিকভাবেই বার্সেলোনার খেলোয়াড় সাপ্লাইয়ে একটা বড় ভূমিকা রাখে লা মাসিয়া, অপর দিকে লা ফ্যাব্রিকার ‘গ্র্যাজুয়েট’রা ছড়িয়ে গেছেন সারা বিশ্বেই। দুটো একাডেমির লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের পক্ষে-বিপক্ষেই যুক্তি দেখানো সম্ভব, কিন্তু দিনশেষে ফুটবল খেলা আর নিজের ক্লাবের প্রতি ভালোবাসাটাই হয়তো সবচেয়ে মুখ্য।

    এই দুটো ব্যাপারই শিশুমনে খুব ভালোভাবে গেঁথে দিতে পারে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাবের দুই একাডেমি, লা মাসিয়া আর লা ফ্যাব্রিকা!