দ্য কোপাইটস: অ্যানফিল্ড থেকে সারা পৃথিবীতে। ফুটবলের পাগলা ফ্যানরা। পর্ব ৫
৭ মে, ২০১৯।
ইউয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালের প্রথম লেগে ঘরের মাঠ ক্যাম্প ন্যু থেকে বড় জয় নিয়েই অ্যানফিল্ডে পা রাখলো বার্সেলোনা। লিওনেল মেসির জোড়া গোল, এর মধ্যে একটা তো ওই বিখ্যাত ফ্রিকিক থেকে, সব মিলিয়ে ৩-০ ব্যবধানে এগিয়ে থাকা কাতালানদের একটা পা যেন ফাইনালেই ছিল। তাই অ্যানফিল্ডেও লিওনেল মেসির আরো একটা অসাধারণ পারফরম্যান্স আর বার্সেলোনার ফাইনালে ওঠাকে চাক্ষুষ দেখার অপেক্ষাতেই ছিলেন দর্শকেরা। এমনকি ম্যাচের প্রথমার্ধ শেষে যখন মার্সিসাইডের দলটা ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে, তখনও বেশিরভাগ সমর্থকই বার্সাকেই ফাইনালে দেখছিলেন।
কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে লিভারপুল আক্রমণ করছিল অ্যানফিল্ডের গ্যালারির সবচেয়ে উত্তাল অংশ, ‘দ্য কপ’-এর দিকে। আর তাতেই খেলাটা পুরোপুরি ঘুরে গেল।
প্রথমার্ধের একটার সাথে দ্বিতীয়ার্ধের আরো তিন গোল। মেসির বার্সাকে হতবুদ্ধি করে চ্যাম্পিয়নস লিগের মোহনীয় রাতে আরো একটা ক্লাসিক লিখে লিভারপুল পৌঁছে গেল ফাইনালে। খেলোয়াড়দের দুর্দান্ত পারফরম্যান্স তো ছিলই, সাথে অ্যানফিল্ডের ‘দ্য কপ’-এর পাগলাটে সমর্থনটাও অবদান রেখেছিল ওই অসাধারণ প্রত্যাবর্তনের গল্প লেখার ক্ষেত্রে।
Image Source: Getty Images
ফুটবলের এমন বিখ্যাত পাগলাটে সমর্থকদলের গল্প নিয়েই প্যাভিলিয়নের এই আয়োজন, “ফুটবলের পাগলা ফ্যানরা”। এই সিরিজের পঞ্চম পর্বে থাকছে লিভারপুলের সমর্থকদল ‘দ্য কোপাইটস’-এর গল্পগুলো।
বলে রাখা ভালো, লিভারপুলের হোম ভেন্যু অ্যানফিল্ডের গ্যালারিকে মূলত চারভাগে ভাগ করা হয়। ‘দ্য মেইন স্ট্যান্ড’, ‘অ্যানফিল্ড রোড স্ট্যান্ড’, ‘স্যার কেনি ডালগ্লিশ স্ট্যান্ড’ এবং ‘দ্য কপ’। ‘কোপাইটস’ শব্দটা এসেছে এই ‘কপ’ শব্দটা থেকেই। এই ‘কপ’ শব্দটার আবার একটা ইতিহাস আছে। সেটা জানার জন্য আমাদের ফিরে যেতে হবে ১১০ বছর আগে।
গত শতাব্দীর শেষ ভাগে আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলে অনুষ্ঠিত হয় “দ্বিতীয় বোর যুদ্ধ”। এই যুদ্ধটা ছিল মূলত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সাথে আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলের বোরদের, অর্থাৎ ট্রান্সভাল বা দক্ষিণ আফ্রিকা রিপাবলিক এবং অরেঞ্জ ফ্রি স্টেটের। এই যুদ্ধের অংশ হিসেবে, ১৯০০ সালের ২৪ জানুয়ারি, দক্ষিণ আফ্রিকার নাটাল অঞ্চলের ‘স্পাইওনকপ’ পাহাড়ে একটা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। ওই খণ্ডযুদ্ধে শুধু ব্রিটিশরা পরাজিতই হয়নি, তাদের জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতিও হয়। বিশেষ করে ল্যাঙ্কাশায়ার রেজিমেন্টের অনেক সৈন্যের প্রাণহানি ঘটে, যাদের বেশিরভাগই ছিলেন লিভারপুলের অধিবাসী।
এই ঘটনার ছয় বছর পরে, ১৯০৬ সালে স্টেডিয়াম সংস্কার করার সময়ে অ্যানফিল্ডের গ্যালারির দক্ষিণ দিকে একটা নতুন স্ট্যান্ড নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। স্থানীয় সাংবাদিক আর্নেস্ট এডওয়ার্ডসের আইডিয়া অনুসারে, স্পাইওনকপ পাহাড়ে নিহত সৈন্যদের স্মরণ করে অ্যানফিল্ডের গ্যালারির দক্ষিণ অংশের নামকরণ করা হয় ‘দ্য কপ’।
Image Source: British Battles
নামকরণের পর থেকেই ‘দ্য কপ’ হয়ে ওঠে লিভারপুলের শ্রমজীবী মানুষের প্রতীক। বিংশ শতাব্দীর মাঝের দিকে অ্যানফিল্ডে একটা পরিচিত দৃশ্য ছিল, রোদ-ঝড়-বৃষ্টির মাঝেও কর্মজীবী দর্শকেরা ‘দ্য কপ’-এ জড়ো হয়েছেন প্রিয় দলের খেলা দেখতে। গান গাইছেন, চিৎকার করছেন, স্লোগান দিচ্ছেন, বিপক্ষ দলের জন্য পরিবেশটা আরো ভয়ঙ্কর করে তুলছেন। বলা বাহুল্য, গ্যালারির এই 'দ্য কপ' অংশে অবস্থান করা দর্শকদেরই বলা হয় ‘কোপাইটস’।
শুধু সংখ্যা আর দলকে সমর্থন করার জন্যই না, কোপাইটরা বিখ্যাত ফুটবলের সাথে তাঁদের সংস্কৃতিকে মিলিয়ে দেওয়ার জন্যও। “ইউ’ল নেভার ওয়াক অ্যালোন”-এর কথা তো সবাই জানেন। ষাটের দশকের এই গানটা হয়ে গেছে লিভারপুল আর অ্যানফিল্ডের সমার্থক। ম্যাচের আগে বা ম্যাচের মাঝে সমস্বরে “ইউ’ল নেভার ওয়াক অ্যালোন” গাওয়াটা বুঝিয়ে দেয়, মাঠের ফলাফল যাই হোক, দলকে সমর্থনের প্রশ্নে কোপাইটদের একতায় ছেদ পড়বে না কখনোই। তবে শুধু “ইউ’ল নেভার ওয়াক অ্যালোন”-ই নয়, এর পাশাপাশি “আলে আলে আলে”, “ফিল্ডস অব অ্যানফিল্ড রোড”, “পোয়েট্রি ইন মোশন”, এই গানগুলোও বাজতে থাকে অ্যানফিল্ডে।
লিভারপুলের ফ্যানবেজ নিয়েই যেহেতু কথা হচ্ছে, হিলসবরো ট্র্যাজেডির কথা না বললেই নয়।
Image Source: Getty Images
১৯৮৯ সালের ১৫ এপ্রিল। এফএ কাপের সেমিফাইনালে শেফিল্ডের হিলসবরো স্টেডিয়ামে মুখোমুখি হয়েছিল লিভারপুল এবং নটিংহ্যাম ফরেস্ট। ওই ম্যাচ দেখতে অনেক বেশি জনসমাগম হয়েছিল। আর তখনই ঘটে দুর্ঘটনা। জনতার চাপে পদদলিত হয়ে ৯৭ জন লিভারপুল সমর্থক প্রাণ হারান। আহত হন আরো অনেক। কিন্তু এই ঘটনার ঠিকঠাক তদন্ত না করেই দক্ষিণ ইয়র্কশায়ারের পুলিশ দোষটা চাপিয়ে দেয় লিভারপুল সমর্থকদের উচ্ছৃঙ্খল আচরণের ওপর। কোপাইটরাও এই অবিচারের প্রতিবাদ জানান। দিনের পর দিন প্রতিবাদ এবং আইনি লড়াই চলার পরে কর্তৃপক্ষ তদন্ত করে জানায় যে এই দুর্ঘটনার দায় স্টেডিয়ামের ভুল নকশা এবং পুলিশের অব্যবস্থাপনার। কোপাইটদের সেই অন্যায় দায় থেকেও মুক্তি দেওয়া হয়।
হিলসবরো ট্র্যাজেডিটা লিভারপুলের ইতিহাসের একটা দুঃখজনক অধ্যায়, তবে বিয়োগব্যথার পাশে এই অধ্যায়ে লেখা আছে লিভারপুল সমর্থকদের ঐক্য আর সংহতির গল্পও।
‘দ্য কপ’-এর বর্তমান অবস্থা কী?
‘দ্য কপ’ এখন আর আগের মতো নেই। ১৯৯৪ সালে স্টেডিয়াম সংস্কার নীতিমালার আওতায় দ্য কপকেও সংস্কার করা হয়েছে। এখন আর আগের দাঁড়িয়ে খেলা দেখা সম্ভব নয়, বরং বাধ্যতামূলকভাবে সব দর্শকের জন্য সিট নিশ্চিত করা হয়েছে। তবে কোপাইটরা এখনও লিভারপুলকে সমর্থন করে যান আগের মতো করেই। সেই গান-স্লোগান-চিৎকার এখনো আগের মতোই রয়েছে।
Image Source: Getty Images
আর শুধু অ্যানফিল্ড না, কোপাইটদের কমিউনিটি এখন ছড়িয়ে গেছে বিশ্বব্যাপী। পৃথিবীর অনেকগুলো দেশেই লিভারপুলের অফিশিয়াল ফ্যানক্লাব গঠিত হয়েছে।
কোপাইটদের সহিংসতা
ইতিহাস ঘেঁটে কোপাইটদের সহিংসতার কিছু উদাহরণ পাওয়া যায়, তবে মোটাদাগে, রিয়াল মাদ্রিদের ‘উলত্রাস সুর’ বা বার্সেলোনার ‘বইসোস নয়েস’-এর মতো কোপাইটরা সেই অর্থে আল্ট্রাস বা গোঁড়া নন।
১৯৮৫ সালে ইউরোপিয়ান কাপের ফাইনালে বেলজিয়ামের হেইসেল স্টেডিয়ামে জুভেন্টাসের বিপক্ষে মুখোমুখি হয়েছিল লিভারপুল। ওই ম্যাচের আগে, দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে স্টেডিয়াম-সংলগ্ন একটা দেয়াল ধ্বসে পড়ে। তাতে নিহত হন ৩৯ জন দর্শক, যাদের বেশিরভাগই জুভেন্টাস সমর্থক। অনেকে এই দুর্ঘটনার পেছনে মূলত কোপাইটদের দায় দেখেন।
Image Source: The Observer
এছাড়া সত্তর ও আশির দশকে ইংল্যান্ডজুড়ে ছড়িয়ে পড়া ফুটবল হুলিগানিজমের ঢেউ এসে পড়েছিল লিভারপুলেও। যদিও কোপাইটদের বেশিরভাগ অংশই হুলিগানিজম থেকে নিজেদের দূরে রেখেছিল, তবুও এ সময়ে ঘটেছিল বেশ কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা।
সব মিলিয়ে বিল শ্যাঙ্কলির ওই কথাটাই স্মরণ করতে হয়, “কোপাইটরা একটু অ্যারোগেন্ট, তবে সেটা ভালো অর্থে। তারা নিজেদের ক্লাবকে নিয়ে অনেক গর্বিত।”
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, বিশেষ করে ইয়ুর্গেন ক্লপের অধীনে কোপাইটদের সাথে দলের সম্পর্কের বেশ উন্নতি দেখা গেছে। সমর্থকেরা ক্লমের ডাকনাম দিয়েছিলেন দলের ‘টুয়েলফথ ম্যান’, আবার ক্লপ নিজেও বিভিন্ন সময়ে কোপাইটদের প্রশংসা করেছেন। ম্যাচের পরে গ্যালারির দিকে এগিয়ে গিয়ে তাঁর উদযাপনগুলো হয়তো এখনও লিভারপুল সমর্থকদের আবেগাপ্লুত করে তোলে।
Image Source: Getty Images
সব মিলিয়ে, ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতিতে কোপাইটরা শুধু ইংল্যান্ডে না, পুরো ইউরোপেই একটা বিশেষ জায়গা দখল করে রেখেছেন। নিজেদের দলকে সমর্থনের ক্ষেত্রে তাঁরা এখনো একাত্মা।
মাঠের খুব খারাপ সময়েও তাই দলের উদ্দেশ্যে তাঁরা গেয়ে চলেন, “ইউ’ল নেভার ওয়াক অ্যালোন…”