মার্ক কাসাদো: বার্সার মাঝমাঠ-সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান
কখনো ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ং, কখনো ওরিয়ল রোমেউ, কখনো আন্দ্রেয়াস ক্রিস্টেনসেন, আবার কখনো এরিক গার্সিয়া। ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে সার্জিও বুসকেটসের রেখে যাওয়া জায়গায় অনেককেই বিবেচনা করেছে ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনা, কিন্তু বুসকেটসের মতো করে তাঁর জুতোজোড়া পরতে পারেননি কেউই। সেই কারণেই বিভিন্ন সময়ে গুঞ্জন উঠেছে ইয়োশুয়া কিমিখ, মার্তিন জুবিমেন্দি, গুইদো রদ্রিগেজ, আমাদু ওনানাদের বার্সায় আগমনের। তবে শেষোক্ত নামগুলোর মধ্যে একজনের গায়েও ওঠেনি কাতালান ক্লাবটির মেরুন-নীল জার্সি।
তবে শেষ পর্যন্ত বুসকেটসের জায়গাটা সম্ভবত পূরণ করতে চলেছেন আরেকজন লা মাসিয়ানই। মার্ক কাসাদো, ওই সার্জিও বুসকেটসকেই যিনি আইডল মানেন। আর ভোরের সূর্য যেমনটা আভাস দিচ্ছে, তাতে হ্যান্সি ফ্লিকের অধীনে দুর্দান্ত শুরু করা কাসাদোর ভবিষ্যতটা বেশ উজ্জ্বল বলেই মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক।
মার্ক কাসাদো; Image Source: Getty Images
‘দুর্দান্ত’ বললে কম বলা হয়। পরপর তিন ম্যাচে বায়ার্ন মিউনিখ, রিয়াল মাদ্রিদ আর এসপানিওলের বিপক্ষে চোখধাঁধানো অ্যাসিস্ট করা কাসাদো চলতি মৌসুমের প্রথম ১৩ ম্যাচেই মোট ৫টা গোলে সহায়তা করে ফেলেছেন। আর শুধু অ্যাসিস্ট করাই নয়, ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে দলের রক্ষণে সাহায্য করা, ঠিকঠাক প্রতিপক্ষের ফরোয়ার্ডদের ট্যাকল করা, লাইন ব্রেকিং পাস দেওয়া, প্রত্যেকটা কাজই কাসাদো করে চলেছেন দারুণভাবে। আপাতত দলে নতুন ডিএম আনার চিন্তা থেকেও যেন মুক্তি দিয়েছেন ক্লাবকে।
অথচ গত মৌসুমেও কাসাদো ছিলেন বার্সা অ্যাথলেটিক দলের অধিনায়ক। ২০০৩ সালে বার্সেলোনাতে জন্মগ্রহণ করা এই লা মাসিয়ান অধিনায়কত্ব করেছেন বার্সার বয়সভিত্তিক দল জুভেনিল ‘এ’-তেও। ২০২২ সালে কাতালান দলটির হয়ে অভিষেক হয় তাঁর, এরপর বার্সার মূল দলের স্কোয়াডে থাকলেও মাঠের একাদশের বদলে বেঞ্চেই তাঁর জায়গা হতো নিয়মিত। সাবেক কোচ জাভি হার্নান্দেজের পছন্দের তালিকায় তিনি নেই, কাসাদোকে সুযোগ দেওয়ার বদলে জাভি চুক্তির মেয়াদ বাড়াতে চান সার্জি রবার্তোর সাথে, এমন বিভিন্ন কথাও ভেসে বেড়াচ্ছিল কাতালুনিয়ার বাতাসে।
বার্সার বয়সভিত্তিক দলগুলোতে অধিনায়কত্ব করেছেন কাসাদো; Image Source: Getty Images
গত গ্রীষ্মে জাভি হার্নান্দেজের প্রস্থানের পর বার্সার ম্যানেজার হয়ে আসেন জার্মান কোচ হ্যান্সি ফ্লিক। ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার পজিশনে বার্সেলোনার খেলোয়াড় সংকট, ওদিকে অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে খেলোয়াড় কিনতে না পারা, সব মিলিয়ে তিনি নজর দেন দুই লা মাসিয়ান মিডফিল্ডার, মার্ক কাসাদো এবং মার্ক বের্নালের দিকে। প্রাক-মৌসুমে দুজনেই বেশ ভালো পারফর্ম করছিলেন, তাই তাঁদের ওপর ভরসা রেখে নতুন কোন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার কেনার চিন্তা থেকে সরে আসে বার্সেলোনা।
তবে সিঙ্গেল পিভটে ভালো খেলতে পারার দক্ষতার কারণে মৌসুমের শুরুতে একাদশে নিয়মিত ছিলেন মার্ক বের্নাল। বিশেষ করে ম্যাচের কোন পর্যায়ে সিঙ্গেল পিভট খেলানোর প্রয়োজন হলে বের্নালই ছিলেন ফ্লিকের প্রথম পছন্দ। ওদিকে লা লিগার প্রথম তিন ম্যাচের মধ্যে শুধু একটিতেই মাঠে নামার সুযোগ পেয়েছিলেন কাসাদো। কিন্তু ওই তৃতীয় ম্যাচেই ঘটে একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। রায়ো ভায়োকানোর বিপক্ষের ওই ম্যাচে অ্যান্টেরিওর ক্রুশিয়েট লিগামেন্টের ইনজুরিতে পড়ে মৌসুমটা কার্যত শেষ হয়ে যায় মার্ক বের্নালের। ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ং, আন্দ্রেয়াস ক্রিস্টেনসেন আর এরিক গার্সিয়ার নামও তখন ইনজুরি-লিস্টে। কোচ হ্যান্সি ফ্লিক তখন ঝুঁকলেন মার্ক কাসাদোর দিকে। আর তাতেই যেন মৌসুমের গতিপথটা পাল্টে গেল, মার্ক কাসাদোর এবং ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনার।
মার্ক বের্নালের সিজনশেষ হয়ে যাওয়া চোট; Image Source: Getty Images
ডাবল পিভটে পেদ্রি গঞ্জালেসের সাথে মার্ক কাসাদোকে খেলানো শুরু করলেন হ্যান্সি ফ্লিক। কাসাদোও আলো ছড়ানো শুরু করলেন। জিরোনার বিপক্ষে পেদ্রিকে চমৎকার একটা অ্যাসিস্ট করলেন, তাঁর আচমকা ডিফেন্সচেরা পাসটার কোন উত্তর ছিল না প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারদের কাছে। এরপর চ্যাম্পিয়নস লিগে তাঁর বাড়ানো লং বলটা লামিন ইয়ামালের পা ঘুরে খুঁজে নিলো মোনাকোর জাল। বার্সা ওই ম্যাচটা না জিততে পারলেও, কাসাদো অ্যাসিস্ট পেয়ে গেলেন উপর্যুপরি ম্যাচে। বলে রাখা ভালো, এর আগে পুরো বার্সা অ্যাথলেটিক ক্যারিয়ারে কাসাদোর ছিল মাত্র দুটো অ্যাসিস্ট।
নিঃসন্দেহে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারদেরকে গোল-অ্যাসিস্টের পরিসংখ্যান দিয়ে বিবেচনা করা বোকামি, কিন্তু বায়ার্ন-রিয়াল-এসপানিওল, টানা তিনটা বড় ম্যাচে তিনটা অসাধারণ অ্যাসিস্ট পেয়ে গেলে তাঁকে আলাদাভাবে বিবেচনা করতেই হয়।
বায়ার্নের বিপক্ষে অ্যাসিস্টের কথাই ধরা যাক।
বার্সার অর্ধের ডানদিকে প্রেস করছিলো বায়ার্ন, চেষ্টা করছিলো হাইলাইন আর নিউমেরিক্যাল সুপেরিওরিটি দিয়ে বল কেড়ে নিয়ে দ্রুত আক্রমণে ওঠার। কাসাদো সেটা বুঝতে পেরেছিলেন ভালোভাবেই। তাই নিজেদের অর্ধে বল পেয়েই দ্রুত লং বল পাঠালেন মাঠের বিপরীত দিকে, বায়ার্নের অর্ধের বামদিকে। ওদিকে তখন তীরের বেগে ছুটছেন লেফট উইঙ্গার রাফিনহা। বল রিসিভ করলেন, বায়ার্নের রাইটব্যাক রাফায়েল গেরেরোকে পরাস্ত করলেন, এরপর গোলরক্ষক ম্যানুয়েল নয়্যারকে বাধ্য করলেন জাল থেকে বল কুড়িয়ে আনতে। গোলটা লেখা হয়ে গেল রাফিনহার নামে, কিন্তু এর পেছনের কারিগর হিসেবে সমর্থকদের মন জিতলেন কাসাদো।
বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে কাসাদোর অ্যাসিস্ট; Image Source: La Liga
সমর্থকদের হৃদয় জেতার কাজটা কাসাদো আরেকবার করলেন ঠিক পরের ম্যাচেই, এল ক্লাসিকোতে। মৌসুমের প্রথম ক্লাসিকোতে রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে ঘটনাবহুল প্রথমার্ধটা কেটে গেল গোলশূন্যভাবেই। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুর দিকেই এলো কাসাদোর ‘ম্যাজিক-মোমেন্ট’। মাঝমাঠে বল পেয়ে দারুণ একটা পাস বাড়ালেন তিনি, রিয়ালের রক্ষণের দুটো রেখা ভেঙে সেই পাসটা পৌঁছে গেল রবার্ট লেওয়ানডস্কির কাছে, এরপর পোলিশ তারকার নিখুঁত ফিনিশিং। ওই-ই শুরু, এরপর আর ম্যাচে ফিরতে পারেনি মাদ্রিদের ক্লাবটি।
রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে কাসাদোর অ্যাসিস্ট; Image Source: Sony LIV
কাসাদোর টানা তৃতীয় অ্যাসিস্টটা এলো ‘কাতালান ডার্বি’তে, নগরপ্রতিদ্বন্দ্বী এসপানিওলের বিপক্ষে। মাঝমাঠ থেকে তাঁর লং বলটা খুঁজে নিলো ঠিক সময়ে দৌড় শুরু করা রাফিনহাকে, আর বাকিটা শুধুই রাফিনহার দারুণ ফিনিশিংয়ের জাদু।
এসপানিওলের বিপক্ষে কাসাদোর অ্যাসিস্ট; Image Source: La Liga
তবে শুধু অ্যাসিস্ট নয়, কাসাদোর দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের দেখা মিলছে ডিফেন্ডিং, পাসিং আর গোলের সুযোগ সৃষ্টি করার ক্ষেত্রেও। এসপানিওল ম্যাচ পর্যন্ত, সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে প্রতি নব্বই মিনিটে কাসাদো সঠিক পাস দিয়েছেন শতকরা ৮৯.৯ ক্ষেত্রে। আর সেই হিসেবে ইউরোপের মিডফিল্ডারদের সেরা দশভাগের মধ্যে অবস্থান করছেন কাসাদো। শর্ট রেঞ্জের পাসিংয়ের অ্যাটেম্পট, এবং সঠিক পাসের শতকরা হারেও কাসাদো অবস্থান করছেন ইউরোপের সেরা পনেরো-বিশভাগ মিডফিল্ডারের মধ্যেই, মিডিয়াম রেঞ্জের পাসিংয়ে সেটা সেরা দশ-পনেরো ভাগে। প্রতি নব্বই মিনিটে গড়ে ৬.৬৯ বার প্রতিপক্ষের রক্ষণ থার্ডে পাস দেন কাসাদো, তাতে তিনি আছেন ইউরোপের সেরা দশ শতাংশ মিডফিল্ডারের মধ্যে।
ক্ষেত্র | প্রতি নব্বই মিনিটে | পার্সেন্টাইল |
সঠিক পাসের হার | ৮৯.৯% | ৯০ |
শর্ট রেঞ্জে পাস অ্যাটেম্পট | ৩০.০৬ | ৮৭ |
শর্ট রেঞ্জে সঠিক পাসের হার | ৯২.৭% | ৮১ |
মিডিয়াম রেঞ্জে পাস অ্যাটেম্পট | ২৪.৯৩ | ৮৭ |
মিডিয়াম রেঞ্জে সঠিক পাসের হার | ৯৩.৮% | ৯৫ |
প্রতিপক্ষের রক্ষণ থার্ডে পাসের সংখ্যা | ৬.৬৯ | ৯০ |
রক্ষণেও কাসাদো ভূমিকা রাখছেন। ট্যাকলের অ্যাটেম্পট এবং তাতে সফল হওয়া, দুটোতেই ইউরোপের সেরা পনেরো শতাংশ মিডফিল্ডারদের একজন কাসাদো। বিশেষ করে প্রতি নব্বই মিনিটে মাঠের মাঝ অংশে ১.৬৫টা এবং অ্যাটাকিং থার্ডে ০.৪৬টা সফল ট্যাকল করেন কাসাদো, যা এই মেট্রিকে তাকে নিয়ে গেছে চলতি মৌসুমের ইউরোপের সেরা দশভাগ মিডফিল্ডারদের কাতারে। বোঝাই যাচ্ছে, ফ্লিকের প্রেসিং ফুটবলের সিস্টেমে নিজেকে যেন অবিচ্ছেদ্য অংশ করে তুলেছেন কাসাদো। এর বাইরে, প্রতি নব্বই মিনিটে গড়ে ০.৭৩টা গোল ক্রিয়েটিং অ্যাকশন তৈরি করেন কাসাদো, সেই হিসেবেও ইউরোপের সেরাদের সেরা তিনি।
ক্ষেত্র | প্রতি নব্বই মিনিটে | পার্সেন্টাইল |
ট্যাকল অ্যাটেম্পট | ২.৭৫ | ৮৪ |
সঠিক ট্যাকল সংখ্যা | ১.৭৪ | ৮৪ |
মাঠের মাঝের থার্ডে সফল ট্যাকল সংখ্যা | ১.৬৫ | ৯৬ |
মাঠের অ্যাটাকিং থার্ডে সফল ট্যাকল সংখ্যা | ০.৪৬ | ৯২ |
গোল ক্রিয়েটিং অ্যাকশন | ০.৭৩ | ৯৯ |
শট ক্রিয়েটিং অ্যাকশন | ২.৬৬ | ৬০ |
তরুণ এই কাতালান মিডফিল্ডারের কিছু দুর্বলতাও আছে। উচ্চতা মাত্র ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি হওয়ায় এরিয়াল ডুয়েলে একটু খাবি খেয়ে যান তিনি। প্রতিপক্ষের পোস্টে শট নেওয়া এবং গোল করার ক্ষেত্রেও তাঁর দুর্বলতা আছে। ড্রিবল করে প্রতিপক্ষকে কাটিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেও কিছু সমস্যায় ভুগতে হয় তাঁকে।
গত মৌসুমের শেষ ম্যাচে কান্নায় ভেঙে পড়েন কাসাদো; Image Source: Esport
সব মিলিয়ে, চলতি মৌসুমে বার্সার মাঝমাঠে কাসাদো নিজের নামটা পাকা করে ফেলেছেন। বুসকেটসের প্রস্থানের পর ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডের ওই অবস্থানেও প্রথমবারের মতো নির্ভরযোগ্য একজনকে পেয়ে গেছে কাতালানরা। অথচ গত মৌসুমের শেষ দিকে, তাঁরই নেতৃত্বে বার্সা অ্যাথলেটিকের সামনে সুযোগ এসেছিল স্প্যানিশ ফুটবলের দ্বিতীয় স্তরে প্রোমোশন পাওয়ার। কিন্তু খুব কাছে গিয়েও, শেষ ম্যাচে কর্দোবার কাছে হেরে আর প্রোমোশন পাওয়া হয়নি বার্সা অ্যাথলেটিকের। ওই ম্যাচ শেষে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন অধিনায়ক কাসাদো, সমর্থকদের কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন অশ্রুসজল চোখে। আর ঠিক কয়েক মাস পরেই, মূল দলের হয়ে একের পর এক দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দিয়ে কাসাদো হাসি ফোটাচ্ছেন বার্সেলোনার সমর্থকদের মুখে।
রবার্ট লেওয়ানডস্কি, লামিন ইয়ামাল, রাফিনহা, দানি অলমো, পেদ্রিদের মতো বড় তারকাদের ভিড়ে কাসাদোর নামটা সেভাবে উচ্চারিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। কিন্তু তাতে কী! ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডাররা তো পুরো ক্যারিয়ারে নিজের কাজটা করে যান নীরবে-নিভৃতেই!