• " />

     

    ফিদেল কাস্ত্রোর "খেলা ভাঙার খেলা"

    ফিদেল কাস্ত্রোর "খেলা ভাঙার খেলা"    

    মাথায় কালো টুপি। গোঁফ-দাঁড়ির জঙ্গলে ঢাকা মানুষটা চেঁচিয়ে যাচ্ছেন নিরন্তর। “হাল ছেড়ে দিও না, শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করে যাও”- পাশ থেকে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন অবিরাম। দল বা প্রতিযোগী যখন জিতেছে, ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরেছেন তাঁদের। চোখেমুখে লেগে থাকা প্রাণখোলা হাসি বলে দেয়, এই জয়টা তো আসলে তাঁরই। মাঠে না খেকেও ফিদেল কাস্ত্রো যেন ছিলেন মাঠেরই একজন।

     

    বাতিস্তা সরকারের উৎখাতের পর কিউবায় বিদ্রোহের আগুন কেবল ছড়িয়ে পড়ছে। সেই অরুণোদয়ের অগ্নিশিখা নিয়ে কাস্ত্রো শুরু করলেন নতুন একটা যুগ। শিক্ষা, চিকিৎসা, সংস্কৃতি- সবকিছুতেই এলো আমূল একটা পরিবর্তন। খেলাধুলার সেখানে পাদপ্রদীপের আড়ালেই হয়তো থাকার কথা ছিল। আগের সরকার তো এদিকে খুব একটা নজরই দেয়নি। ১৯২৮ সালে প্রথম ক্রীড়া ও শরীরচর্চা বিষয়ক একটা প্রতিষ্ঠান শুরু হয়েছিল কিউবায়। কিন্তু সরকারের কৃপাদৃষ্টি না থাকায় চার বছর পরেই সেটি বন্ধ হয়ে যায়। অলিম্পিকে কিউবাও ওই সময় তেমন একটা কিছু করতে পারেনি। ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত অলিম্পিকে কিউবার ছিল সাকুল্যে ১২টি পদক।

     

    কাস্ত্রো এসে ঠিক করলেন, খেলাধূলার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করা হবে। ১৯৬১ সালে আগের সেই প্রতিষ্ঠান আবার নতুন করে চালু করা হলো। দেশজুড়ে অ্যাথলেট খোঁজার প্রক্রিয়াও শুরু হলো আবার। সব স্কুলে পাঁচটি খেলা বাধ্যতামূলক করা হলো- বাস্কেটবল, বেসবল, জিমন্যাস্টিকস, ভলিবল ও ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড। সুফলটা পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত। মেক্সিকো সিটি অলিম্পিকে কিউবা জিতেছিল চারটি রূপা। তবে কাস্ত্রোর “ক্রীড়া-বিপ্লবের” চূড়ান্ত ফসলটা ঘরে ওঠা শুরু করেছে চার বছর পর। ১৯৭২ মিউনিখ অলিম্পিকে কিউবা জিতেছিল চারটি সোনা। মন্ট্রিয়লে সেটি বেড়ে হলো ৬, মস্কোতে হলো ৮। হেভিওয়েট বক্সার তিওফিলো স্টিভেনসেন সোনা জিতলেন টানা তিন অলিম্পিকে। প্রথম অ্যাথলেট হিসেবে ৪০০ ও ৮০০ মিটারের সোনা জিতলেন আলবার্তো জুয়ানতোরেনা। ১৯৮০ মস্কো অলিম্পিকে শুধু বক্সিংয়েই ছয়টি সোনা জেতে কিউবা। খেলার চেতনা কতটা ধারণ করে ছিলেন সেটা বোঝা যায় কাস্ত্রোর ওই উক্তি থেকে, “খেলা আমার কাছে কোনো রাজনৈতিক হাতিয়ার নয়, বরং এটা বিপ্লবের একটা ফসলই।”

                                   তিনবারের সোনাজয়ী তিওফিলো স্টিভেনসনের সঙ্গে ফিদেল কাস্ত্রো 

     

    কিন্তু এর মধ্যে কাস্ত্রোকে দেখতে হয়েছে মুদ্রার উল্টো পিঠও। বিলবের পর কিউবার ওপর অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবরোধ আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। ওই সময় কিউবান অ্যাথলেটদেরও ওপরও সেই ঝাপটা এসে পড়ে। ১৯৯২ সাল পর্যন্ত সেই অবরোধ বলবৎ ছিল। এর মধ্যে অনেক দেশসেরা অ্যাথলেট কিউবা থেকে পাড়ি জমিয়েছেন ভিনদেশে। কাস্ত্রো শুরু থেকেই পেশাদার লিগ নিষিদ্ধ করে রেখেছিলেন। সেরা অ্যাথলেটরা তাই পরদেশেই খুঁজতে শুরু করলেন বিবিধ রতন। তখনও কিউবার কোনো অ্যাথলেট সে দেশের পাসপোর্টে যুক্তরাষ্ট্রে খেলতে পারেনি। তবে কাস্ত্রো যে বীজ বুনেছিলেন, সেটা ততদিনে মহীরুহ হয়ে উঠেছে অনেকটাই। ১৯৮৪ ও ১৯৮৮ অলিম্পিক বর্জন করে কিউবা। এরপর ১৯৯২ বার্সেলোনা অলিম্পিকে ফিরে প্রথমবারের মতো বেসবলে অলিম্পিকের সোনা জিতল। অলিম্পিকে সেবারই প্রথমবারের মতো নাম লিখিয়েছিল বেসবল। এর পর আরও দুইবার বেসবলে অলিম্পিকে সোনা জিতেছে কিউবা। একটা সময় এই বেসবলই আবার কাজ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কিউবার সেতুবন্ধ হিসেবে। ১৯৯৯ সালে কিউবার জাতীয় দলের সঙ্গে প্রীতি ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের মেজর লিগ বেসবলের দল বাল্টিমোর ওরেয়লস।

     

    কাস্ত্রো ততদিনে আরও বুড়িয়ে গেছেন। চুল আর দাঁড়িতে পাক ধরেছে, আগের মতো সবজায়গায় দাপিয়ে বেড়ানোর শক্তিও কমে আসছে একটু একটু করে। তবে অলিম্পিক বা অন্য কোনো বড় ইভেন্টে সুযোগ পেলেই যেতেন, অ্যাথলেটদের জন্য হয়ে ছিলেন নিরন্তর প্রেরণা। অন্য লোকে চলে গেলেও যে প্রেরণা কিউবান অ্যাথলেটদের জন্য শিখা অনির্বাণ হয়ে থাকবেন আরও অনেকদিন।