• সেরা ফুটবল ক্লাব
  • " />

     

    ফুটবলের "বাপকা-বেটাদের" গল্প

    ফুটবলের "বাপকা-বেটাদের" গল্প    

    ম্যাচে নামার মাত্র ১৮ মিনিটেই বাজিমাত। ছেলে এনজো জিদানের গোল দেখে নিশ্চয় মুচকি হেসেছেন জিনেদিন জিদান। রিয়াল মাদ্রিদে নিজের প্রথম গোলের জন্যও আরও অনেক অপেক্ষা করতে হয়েছে বড়ে জিদানকে। ‘বাপকা বেটা’ বলে প্রশংসায় সিক্ত হলেও বাবার লেভেলে আসতে এনজোকে পাড়ি দিতে হবে পাহাড়সম পথ। ফুটবলে বাবার অধীনে ছেলের খেলাটা এবারই অবশ্য প্রথম নয়। মালদিনি, স্মেইকেল, ফার্গুসন, ল্যাম্পার্ড, রেডন্যাপ- বাবার দিকনির্দেশনায় ছেলের খেলার হদিস আছে আরো অনেক।


    সিজার ও পাওলো মালদিনি

    খুব সম্ভবত ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে সফল বাপ-বেটা জুটি। ইতালি ও এসি মিলানের হয়ে খেলেছেন দুজনই। সিনিয়র মালদিনি এসি মিলানের হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের ঠিক চার দশক পর ‘রোজোনেরি’দের হয়ে রূপোর ট্রফিটায় চুমো খেয়েছেন জুনিয়র মালদিনিও। নব্বইয়ের দশকে সিজার মালদিনির অধীনেই অনুর্ধ্ব-২১ এ নিজের চেনাতে শুরু করেন পাওলো। ’৯৬-এ আরিগো সাচ্চির পর ইতালির জাতীয় দলের কোচ হন সিজার মালদিনি। পাওলোকে বানান নিজ দলের অধিনায়ক।

    বাপ-বেটার জুটির দারুণ বোঝাপড়া ও জাদুতে ’৯৮ বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব পেরিয়ে কোয়ার্টারেও চলে যায় ‘আজ্জুরি’রা। কিন্তু জিদান, অঁরিদের ফ্রান্সের কাছে পেনাল্টিতে হেরে রূপকথার সমাপ্তি ঘটে। বিশ্বকাপের পরপরই চাকরিচ্যুত হন সিজার। ’০১-’০২ মৌসুমে এসি মিলানের কোচ হয়ে আসেন সিজার। তখন আবার মিলানের ক্যাপ্টেন ছিলেন পাওলো মালদিনি। কিন্তু এবারো ঠিক তেমন জ্বলে উঠতে পারেননি মালদিনিরা। মৌসুম শেষেই মিলান ছাড়েন সিজার মালদিনি। এভাবেই কিছুটা অতৃপ্তি নিয়ে শেষ হয় বাপ-বেটার পথচলা।

    ফুটবলের সাথে মালদিনিদের গাঁটছাড়া অবশ্য এখনই শেষ হচ্ছে না। কারণ, পাওলোর দুই ছেলে ক্রিশ্চিয়ান ও ড্যানিয়েল মালদিনি ইতোমধ্যেই এসি মিলানের বয়স ভিত্তিক দলে খেলছেন। অবশ্য বাবা সিজারের মত কোচ হওয়ার সম্ভাবনা বহু আগেই উড়িয়ে দিয়েছেন পাওলো। সেক্ষেত্রে আরেক মালদিনি বাপ-বেটা জুটিকে না পেলেও মালদিনি পরিবারের সাথে ‘রোসোনেরি’দের সেতুবন্ধ ঠিকই দীর্ঘায়িত হবে- এমনটা বলাই যায়।


    আর্নর ও আইডার গুডিয়নসন
    ফুটবলে বাপ-বেটা জুটিটা সাধারণত বাবা কোচ, ছেলে খেলোয়াড় হিসেবেই হয়। কিন্তু আইসল্যান্ডের এই দুই কিংবদন্তী খেলেছেন একই দলে! ১৯৯৬ সালে এস্তোনিয়ার বিপক্ষের এক ম্যাচে বাবার বদলি হিসেবে নেমে আন্তর্জাতিক অভিষেক হয় আইডর গুডিয়নসনের। এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাবা ছেলের খেলার একমাত্র নিদর্শন এই জুটিই।

    ইঞ্জুরি বাঁধ না সাধলে আর্নর ও আইডরকেই আইসল্যান্ডের স্ট্রাইকার জুটি হিসেবে দীর্ঘদিন দেখতে পারতো ফুটবলবিশ্ব। বোল্টন, বার্সেলোনা, চেলসির মত স্বনামধন্য ক্লবে খেলায় বাবা আর্নরের চেয়ে ছেলে আইডরের পরিচিতি বেশি। এছাড়া ইউরো ’১৬ তে দেশের জন্য অবসর ভেঙ্গে খেলতে আসায় প্রশংসায় সিক্ত হয়েছিলেন আইডর। বোর্দো, আন্ডারলেখটের মত গড়পড়তা ক্লাবে খেলায় বাবা আর্নরের পরিইতিটা তাই কিছুটা হলেও কম। কিন্তু আইসল্যান্ডের হয়ে সত্তরোর্ধ্ব ম্যাচ খেলায় আইসল্যান্ডবাসীর কাছে ঠিকই পরম শ্রদ্ধার পাত্র আর্নর।


    ফ্র্যাঙ্ক ল্যাম্পার্ড সিনিয়র ও জুনিয়র


    বাবা ফ্র্যাঙ্ক ল্যাম্পার্ড সিনিয়রের মত জুনিয়র ল্যাম্পার্ডের ক্যারিয়ারটাও শুরু হয়েছিল ওয়েস্ট হ্যামেই। সুদীর্ঘ ১৮ বছর কাটিয়ে দিয়েছেন ক্লাবটিতে। ওয়েস্ট হ্যামের ইতিহাসের সেরা লেফটব্যাক খেলোয়াড়ি জীবন শেষে সাত বছর সেই ক্লাবেরই সহকারী ম্যানেজার ছিলেন। ভাইপো হ্যারি রেডন্যাপের অধীনেই ওয়েস্ট হ্যাম জার্সিতে অভিষেক হয় ‘ছোট’ ল্যাম্পার্ডের। রেডন্যাপের কাছে ছেলেকে খেলানোর সুপারিশটা করেছিলেন ফ্র্যাঙ্ক সিনিয়র নিজেই।


    কিন্তু বাবার প্রিয় দল ‘দ্যা হ্যামারস’ ছেড়ে ০১-০২ মৌসুমে চেলসিতে পাড়ি জমান ল্যাম্পার্ড জুনিয়র। ‘ব্লুজ’দের হয়ে সুদীর্ঘ ১৩ বছরে জিতেছেন প্রিমিয়ার লিগ ও চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। বনে গিয়েছেন চেলসির সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা। ফ্র্যাঙ্ক ল্যাম্পার্ড বললে ফুটবল অনুরাগীরা এখন সিনিয়র নয়, জুনিয়র ল্যাম্পার্ডকেই চেনে। 


    জিনেদিন ও এনজো জিদান


    সর্বকালের অন্যতম সেরা মিডফিল্ডার জিনেদিন জিদানের তিন ছেলেই (এনজো, লুকা, থিও) খেলছেন রিয়ালের বিভিন্ন বয়সভিত্তিক দলে। আঞ্চেলত্তির সহকারী হয়ে রিয়ালে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন ‘জিজু’। সহকারী ম্যানেজার হিসেবে ‘লা ডেসিমা’ জিতে পরবর্তী মৌসুমে রিয়াল মাদ্রিদ কাস্তিয়ার ম্যানেজার হন জিদান।

    নিজ দলের অধিনায়ক বানান ছেলে এনজোকে। ইতোমধ্যেই বাপ-বেটার খেলায় একাধিক সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন ফুটবল বিশ্লেষকরা। কাস্তিয়ায় নিজের সামর্থ্যের জানান দেওয়ার পুরষ্কারস্বরূপ মূল দলে একাধিকবার ডাক পেয়েছিলেন এনজো। কিন্তু অফিশিয়াল অভিষেকটাই হচ্ছিল না। কালচারাল লিওনেসার বিপক্ষে পেয়ে গেলেন অভিষেক আর অভিষেকেই জানান দিলেন, বাবার পথেই হাঁটছেন ‘ছোট’ জিদান। 

     

    ইয়োহান ও জর্ডি ক্রুইফ
    ‘টোটাল ফুটবল’ এর জনক ও সর্বকালের অন্যতম সেরা মিডফিল্ডার ইয়োহান ক্রুইফ ম্যানেজার হিসেবেও নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলেন অন্য উচ্চতায়। তাঁর অধীনেই স্পেন এবং পরবর্তীতে ইউরোপে রাজত্ব করেছিল বার্সা। গার্দিওলার আগ পর্যন্ত বার্সার সর্বকালের সেরা ম্যানেজার ইয়োহান ক্রুইফের ছেলে জর্ডি ক্রুইফও খেলেছেন কাতালানদের হয়ে।

    বাবার মত আয়াক্স একাডেমীতেই ফুটবলের হাতেখড়িটা শুরু হয়েছিলে ‘খুদে’ ক্রুইফের। অবশ্য মাত্র ১৪ বছর বয়সেই বাবার সাথে আয়াক্স ছেড়ে বার্সায় পাড়ি জমান জর্ডি। দুই মৌসুম বার্সা বি-তে খেলার পর ৯৪-৯৫ মৌসুমে ছেলেকে মূল দলে অভিষেকের সুযোগ দেন ইয়োহান। কিন্তু বাবার ও ক্লাবের আস্থার প্রতিদান দিতে না পারায় মাত্র দুই মৌসুম পরেই বার্সা ছাড়তে হয় জর্ডিকে। একই মৌসুমে বরখাস্ত হন ইয়োহান ক্রুইফ। বাবার মতই প্রতিভাধর শুরু করলেও ক্যারিয়ারটা কখনোই সঠিক কক্ষপথে আনতে পারেননি জর্ডি। সম্ভাব্য সব ধরণের সুযোগ-সুবিধা পেয়েও হারিয়ে গেছেন কালের অতল গর্ভেই।

    বাবার অধীনে ছেলের ক্যারিয়ার গড়তে পারার জুটি আর আছে ফুটবলে। যেমন, হ্যারি ও জেমি রেডন্যাপ, ব্রায়ান ও নাইজেল ক্লফ, মিগুয়েল ও জাবি আলোন্সো, স্যার অ্যালেক্স ও ডানকান ফার্গুসন, বব ও মাইকেল ব্র্যাডলি, স্টিভ ও অ্যালেক্স ব্রুস প্রমুখ। কেউ কেউ হতে পেরেছেন মালদিনি জুটির মত সফল, আবার কেউ কেউ হারিয়ে গেছেন জেমি ও হ্যারি রেডন্যাপদের মতই। কেউ আবার আজীবন হয়ে ছিলেন বাবার ছায়া হয়েই (জর্ডি ক্রুইফ), আবার কেউ কেউ বাবাকে ছাড়িয়ে গেছেন অনেক আগেই (ফ্র্যাঙ্ক ল্যাম্পার্ড জুনিয়র)। এনজো জিদান ও ক্রিশ্চিয়ান মালদিনিরা এখন কোন পথে হাঁটেন- সেই আগ্রহ নিয়ে ব্যগ্র হয়ে বসে আছেন এসি মিলান ও রিয়াল মাদ্রিদ সমর্থকেরা। ফুটবলবিশ্বও অপেক্ষা করছে আরেক জিদান ও মালদিনির আশায়...