হিগুয়াইন, এবার হবে তো?
অমরত্ব আর নশ্বরতার মধ্যে পার্থক্যটুকু? বা, নায়ক আর খলনায়ক হওয়ার মধ্যে? গঞ্জালো হিগুয়াইনকে জিজ্ঞেস করুন। হয়তো বলবেন, কয়েক ইঞ্চি। ব্রাজিল বিশ্বকাপে জার্মানির সাথে সেই ফাইনালের কথা কথা মনে আছে? ম্যানুয়েল নয়্যারকে একা পেয়েও যখন বল বাইরে দিয়েছিলেন। বা দুই বছর পর কোপা আমেরিকার ফাইনালের কথা? এবারও রক্ষণের ভুলে একা পেয়ে গিয়েছিলেন চিলির গোলরক্ষক ক্লদিও ব্রাভোকে। এবারও তো ইঞ্চির জন্য গোলটা করতে পারেননি। বা তার আগের কোপায় সেই ফাইনালের কথা? এবারও সেই চিলির সঙ্গেই তো একটুর জন্য বলটা জড়াতে পারেননি জালে।
আচ্ছা, হিগুয়াইনের কথা থাক। আমরা বরং ৩১ বছর আগের একটা গল্পের কথা শুনে আসি। ডিয়েগো ম্যারাডোনা সেবার ফর্মের তুঙ্গে। ১৯৮৬ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের সঙ্গে দুনিয়া কাপানো ওই গোল জোড়ার পর ম্যারাডোনা-আফিমে বুদ বিশ্ব। কিন্তু ফাইনালে জার্মানির লোথার ম্যাথাউস বোতলবন্দি করে রেখেছিলেন। ম্যারাডোনা জানতেন, এর মধ্যেই একটা সুযোগ বানিয়ে দিয়েছিলেন হোর্হে বুরুচাগাকে। আর্জেন্টিনাকে জিতিয়ে দিয়েছিল ওই গোলই, ম্যারাডোনা রাতারাতি হয়ে গিয়েছিলেন জীবন্ত কিংবদন্তি। আচ্ছা, ওই গোলটা যদি বুরুচাগা দিতে না পারতেন? বলটা যদি বাইরে চলে যেত? ম্যারাডোনা কি আজকের ম্যারাডোনা হতে পারতেন?
হিগুয়াইন নিশ্চয়ই বুরুচাগার কথা জানেন। আর্জেন্টিনায় শহুরে পুরাণ হয়ে যাওয়া গল্পটা তাঁর না জানার কারণ নেই। তবে বুরুচাগা হওয়া ওঠেনি তাঁর, ফাইনাল এলেই কোনো একটা অদৃশ্য অক্টোপাসের শুঁড় যেন তাঁকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। কোথাও যেন কিছু একটা গড়বড় হয়ে যায়, যে প্রশ্নটা এত দিন তাঁর কাছে জলবৎ তরলং, সেটাই হয়ে যায় কঠিন একটা প্রশ্নপত্র। কিন্তু ফাইনাল এলে কেন এমন সিঁটিয়ে পড়েন? সেই ২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনাল থেকে শুরু। ওই টুর্নামেন্টে তো এর আগেই গোল পেয়েছিলেন, কিন্তু ফাইনালে গিয়ে সব যেন তালগোল পাকিয়ে গেল। পরের বছর কোপার ফাইনালের আগেও হয়ে গেল দুই গোল। কিন্তু আসল মঞ্চে ভুলে গেলেন অভিনয়টা। বা গত বছরের কোপা আমেরিকার কথা নিশ্চয়ই মনে আছে? সেমিফাইনাল পর্যন্ত দুর্দান্ত ফর্মে, চার গোলও হয়ে গেছে। এবার নিশ্চয়ই কিছু একটা করবেন। কিন্তু ফাইনালেই যেন খেলা ভুলে গেলেন। ফাইনাল এলে কী হয় হিগুয়াইনের?
এবার নিশ্চয় এমন কিছু চাইবেন, নাপোলির হয়ে যেমন কোপা ইতালিয়া পেয়েছিলেন?
এমন না, গুরুত্বপূর্ণ সময়ে গোল করেননি। আর্জেন্টিনার হয়ে সেই শুরুর দিকের দিনগুলোর কথাই ধরুন। তখনও আজকের হিগুয়াইন হননি, তরুণ এই স্ট্রাইকারের ওপর ডিয়েগো ম্যারাডোনা আস্থা রেখেছিলেন। পেরুর সঙ্গে বাছাইপর্বে মহামূল্যবান গোল করে সেই আস্থার প্রতিদানও দিয়েছিলেন। বড় ম্যাচে গোল করতে না পারার যে দুর্নাম ছিল, সেটার জবাব এই চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালে মোনাকোর সঙ্গেই দিয়েছেন। প্রথম লেগে তাঁর দুই গোলেই তো জুভেন্টাস বলতে গেলে কার্ডিফের রাস্তায় অর্ধেক চলে গেছে। ২০১৪ বিশ্বকাপ বাছাইয়েও এক গোল করেছিলেন, বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালে বেলজিয়ামের সঙ্গে তাঁর গোলেই আর্জেন্টিনা উঠেছিল সেমিফাইনালে। এই মৌসুমেও জুভেন্টাসের হয়ে অভিষেক মৌসুমেই লিগে করলেন ২৪ গোল। আর্জেন্টিনার হয়ে তাঁর চেয়ে বেশি গোল আছে মাত্র পাঁচজনের। কিন্তু ফাইনাল শব্দটাই যেন হিগুয়াইনের ওপর ভূতের মতো চেপে বসে, সেটা ছাড়ানো কোন ওঝার সাধ্যি?
সেই উত্তর কিছুটা লুকিয়ে আছে হিগুয়াইনের খেলার ধরনে। গোল যেদিন পেয়ে যান, সেদিন তাঁর শরীর থেকে ঠিকরে বেরুতে থাকে আত্মবিশ্বাস। আর যেদিন শুরু থেকেই কেমন অবদমিত থাকেন, সেদিন সহজ গোলও করতে পারেন না। ২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনালের আগেই হিগুয়াইন এমন খোলসে ঢুকে গিয়েছিলেন। ব্যাপারটা চোখে পড়েছিল সতীর্থদের, সেটা কানে পৌছাল ওই সময়ে তাঁর ক্লাব নাপোলি কোচ রাফায়েল বেনিতেজের কাছে। বেনিতেজ বুঝতে পেরেছিলেন, এমন স্নায়ুচাপে থাকলে সর্বনাশ। দ্রুত ছাত্রকে কিছু খুদেবার্তা পাঠালেন। কিন্তু হিগুয়াইনকে সেই যে ফাইনালের জুজুতে ধরল, আর ছাড়ল না। তিন তিন বার ফাইনাল এলেই হিগুয়াইন যেন মূর্ছিত হয়ে পড়েন।
জুভেন্টাসের নিজেদেরই অবশ্য ফাইনাল-জুজু আছে। সেই ১৯৯৬ সালের পর জুভেন্টাস চারটি চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে হেরেছে। এই দলেরই তো কিয়েলিনি, বুফনদের দুই বছর আগে হারের ওই স্মৃতি এখনো মনে থাকার কথা। এক বুফনেরই তো দুইবার সেই অভিজ্ঞতা আছে। কিন্তু হিগুয়াইনের মতো তাতে নিজের 'কৃতিত্ব' খুব একটা নেই। হিগুয়াইনের মতো অপয়া মনে করারও কারণ নেই।
কোপার ফাইনালেও গোল হলো না
কিন্তু হিগুয়াইন নিজে কী মনে করেন? এবার আত্মবিশ্বাসের একেবারেই অভাব নেই, 'দেখুন, ১১ বছর ধরে ইউরোপে খেলছি। এ ধরনের চাপ অনেক সামলেছি। আমি মানসিকভাবে একটু দুর্বল হয়ে যাব, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। হ্যাঁ, কিছু মুহূর্ত একটু অন্যরকম। কিন্তু তখন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না, এমন ভাবার কারণ নেই।' এবারেই জুভেন্টাসের হয়ে কোপা ইতালিয়া জিতেছেন, কিন্তু সেটার সঙ্গে চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালের তুলনা হয় না।
কিন্তু এবারের ফাইনাল তো আরও বড় চাপ হতে পারে। প্রতিপক্ষ রিয়াল মাদ্রিদেই তো ক্যারিয়ারের সোনালী সময়ের বড় একটা অংশ কাটিয়েছেন। পুরনো ক্লাবের সঙ্গে আবার দেখায় কি একটু স্মৃতিকাতর হয়ে পড়বেন না? হিগুয়াইন এবারও আত্মবিশ্বাসী, 'এ বছরও নাপোলির সাথে কোপা ইতালিয়াতে খেলেছি। রিয়ালে আমার দারুণ সময় কেটেছিল, কিন্তু মাঠে নামলে ওসব কিছু মনে থাকবে না। তখন একটাই চিন্তা, জুভেন্টাসের জয়।'
কিন্তু বুফনের সেই গেরো কাটবে কীসে? দানি আলভেসের মতো কারও ছোঁয়ায়, বার্সেলোনার হয়ে তিন বার ফাইনালে শেষ হাসি হাসার স্মৃতি আছে যার? নাকি সেটা আসবে অন্য কারও আশীর্বাদে? যার মাধ্যমেই হোক, আসল কাজটা হিগুয়াইনকেই করতে হবে। টানা চার বছর এমন হলে সেই বেদনা কি সইতে পারবেন? সেটা হয়তো জানা যাবে না, তিনি নিজেই যে রসিকতা করে বলেছেন, 'এবারও এরকম হলে আমাকে কিন্তু সাক্ষাৎকারের জন্য খুঁজে পাওয়া যাবে না।'
হিগুয়াইন এবার নিশ্চয়ই সেই অভিশাপ কাটাতে চাইবেন!