'রোনির' জন্য আনন্দটাই থাক...
সে এক রোনালদিনহো আছে, কেবলই লাবণ্য ধরে।
একটু ভুল কি হলো? 'ধরে' শব্দটা বদলে দিয়ে বোধ হয় ‘ধরত’ই লেখা উচিত। এইসব জানুয়ারির কুয়াশামাখা সকালে আমরা নিশ্চিত জেনে যাই, রোনালদিনহো আর কখনো সবুজ মাঠে নামবেন না। সে মধুময় হাসি আর দেখা যাবে না মাঠে, পায়ে আর খেলবে না বিজলী। বল নিয়ে যা করেছেন, কেউ আগে করছে কি না সন্দেহ। সামনেও আর কেউ করবে কি না, সেই বাজিও রেখে ফেলা যায়।
আপনি ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করতেই পারেন, গ্লাসের অর্ধেকটা তো আসলে খালি। রোনালদিনহো পেয়েছেন সবই, কিন্তু পেতে পারতেন আরও অনেক কিছু। ফর্মের তুঙ্গে ছিলেন বড়জোর চার বছর। স্বর্গে উঠেছেন যত দ্রুত, সেখান থেকে পতনও হয়েছে তারও আগে। বার্সেলোনার প্রতীক যখন হয়ে গিয়েছিলেন, ব্রাজিলের বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় স্বপ্নসারথী ছিলেন তিনি। ১১ বছর আগে বিশ্বকাপে যা করেছেন, তাতে ব্রাজিলের অনেক সমর্থক তাঁকে কখনো ক্ষমা করতে পারবে না। ট্রফিটা যখন তাঁর পায়ের লুটানোর কথা ছিল, ব্যাখ্যাতীত কোনো কারণে বিশ্বকাপে তাঁর পা যেন কথা বলল না!
হ্যাঁ, বিশ্বকাপ তিনি জিতেছেন বটে। ইংল্যান্ডের সঙ্গে ২০০২ সালের কোয়ার্টার ফাইনালের ওই গোলটাই তো তাঁকে এক মুহূর্তে হাজির করেছিল বিশ্ব ফুটবলের ঝলমলে জাঁকালো মঞ্চে। ডেভিড সিম্যানকে বোকা বানানো ওই ফ্রিকিকটা বিশ্বকাপেরই সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্তগুলোর একটি। তবে ওই ম্যাচে তাঁর দুর্দান্ত পাস থেকেই গোল পেয়েছিলেন রিভালদো, দৃশ্যটা কারও কারও স্মৃতির সেলুলয়েডে ঝাপসা হয়ে যেতে পারে। সেই ম্যাচেই আবার দেখেছিলেন লালকার্ড, সেটাও হয়তো অনেকের মনে আছে। কিন্তু ওই বিশ্বকাপ তো ঠিক তাঁর ছিল না। রিভালদো, রোনালদোর ‘র’ এর দ্যুতিতে ঢাকা পড়ে গিয়েছিলেন আরেক 'র'।
কিন্তু দিব্যি কেটে বলুন তো, শুধু ট্রফির জন্যই কি আপনি রোনালদিনহোকে মনে রেখেছেন? ব্রায়ান লারা অবসরের আগে প্রশ্ন রেখে গিয়েছিলেন, ‘ডিড আই এন্টারটেইন ইউ?’ অন্তত রোনালদিনহোর জন্য এই প্রশ্নের উত্তরে পৃথিবীর সব পরীক্ষার্থীই ‘হ্যাঁ’তে টিক দিয়ে আসবেন। বৈরি বার্নাব্যুতেও যাঁকে স্যালুট দেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে যান রিয়াল সমর্থকেরা, ‘আনন্দধারা বহিছে ফুটবলে’ কথাটা তাঁর জন্য তো এতটুকু বাড়াবাড়ি নয়।
রোনালদিনহোর নাম বলার সঙ্গে সঙ্গে চোখ বন্ধ করুন, সেই আনন্দ নিয়ে দিব্যি হাসতে শুরু করে দিয়েছেন, তাই না? যে হাসি কুৎসিত বলে একদিন রিয়াল তাঁর দিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, তারা বুঝতেই পারেনি বাণিজ্যের কত বড় একটা দাঁও একটা হারিয়েছে। ওই হাসি পুঁজি করেই অনেকটা ‘কার্টুন চরিত্রের’ মতো রোনালদিনহো হয়ে গেছেন কাতালান ফুটবলের প্রতীক। রিয়াল মাদ্রিদের সঙ্গে দুর্দান্ত হ্যাটট্রিক করেছেন; মুখে লেগে আছে হাসি। আবার অবিশ্বাস্য এক কারিকুরিতে সম্ভাব্য সবকিছু করার পরও গোলটা পেতে পাওয়া হয়নি, তখনও সেই হাসিই লেগে আছে মুখে। এমন একজনকে কি ভালো না বেসে পারা যায়?
সেই ভালোবাসার জন্যও একটা উপলক্ষ লাগে। রোনালদিনহোর চেয়ে বেশি অমন মুহূর্ত সবুজ মাঠে খুব বেশি কেউ এনে দেননি। চেলসির সঙ্গে চ্যাম্পিয়নস লিগ কোয়ার্টার ফাইনালের ওই গোলের কথা কল্পনা করুন। সামনে দাঁড়িয়ে ডিফেন্ডার, দুপাশ থেকে এগিয়ে আসছেন আরও দুজন। ডান পা একটু নাচালেন, তাতেই যেন হয়ে গেল চিচিং ফাঁক। পিওতর চেক অসহায় হয়ে দেখলেন, শটটা জড়িয়ে যাচ্ছে জালে। এই চেলসি অবশ্য তাঁকে শেকল পরিয়ে রাখার কম চেষ্টা করেনি, রোনালদিনহো তো তাদের তাঁর মুখোমুখি সবচেয়ে কঠিন প্রতিপক্ষই বলেছেন।
বল যদি কথা বলতে পারত, তাহলে রোনালদিনহো তাকে দিয়ে নিশ্চয় কোনো মহাকাব্যই লেখাতেন। নিজেই বলেছিলেন, ‘যখন আপনার পায়ে বল, আপনি পাখির মতো স্বাধীন’। রোনালদিনহো এমনই মুক্ত বিহঙ্গ হয়ে যেতেন, অন্য দিকে তাকিয়েও তো কতবার পাস দিয়েছেন নির্ভুল। বা এই ভিডিওর মতো, নিজ চোখে বার বার দেখার পরও যা বিশ্বাস হতে চায় না (ইউটিউবের ইতিহাসে প্রথম ১ মিলিয়ন বার দেখা হয়েছিল এই ভিডিও)। টানা চার বার পোস্টে বল লাগানো, তাও আবার মাটিতে না ফেলে... বল কি আরও কথা শুনতে পারে? রোনালদিনহোর চেয়ে বলকে এমন কি আপন করে নিতে কেউ কি পেরেছে?
হাসির মতো তিনি নাকি ছিলেন দুষ্টের শিরোমণি। আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন মজার একটা ঘটনা। বার্সার কোনো একটা লিগ ম্যাচের আগে ইনিয়েস্তাকে ডেকে রোনালদিনহো চুপি চুপি বলেছিলেন, পরের দিন ম্যাচটাই হতে যাচ্ছে বার্সার হয়ে তার শেষ ম্যাচ। কিন্তু সেটা যেন কোনোভাবেই অন্য কারও কানে না যায়। পরদিন দেখা গেল, সবাইকেই রোনালদিনহো একই কথা বলেছেন। এবং সতীর্থেরা তাকে এতোটাই ভালোবাসতেন, অন্য কাউকে তা বলেনইনি। সেটা নিয়ে তো নিজে পরে হেসে কুটিকুটি! যদিও রোনালদিনহো পরে সেটা স্বীকার করেননি। চোখ টিপে শুধু বলেছেন, ‘কিছু কথা থাক না গোপন!’
তবে রোনালদিনহো বলেই ঘটনাটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় না। যেমন হয় না এই পুঁজিবাদময় ফুটবলের যুগে তাঁর কথাটা, ‘ফুটবলকে এত সিরিয়াসলি নেওয়ার কী আছে? মজাই তো আসল!’ ফিলিপ কোকু যেমন তাঁকে নিয়ে বলেছিলেন, ‘ওর পা এত দ্রুত নড়ে অর্ধেক সেকেন্ডের মধ্যে ও চাইলে চার বার বল স্পর্শ করতে পারবে। সেটা করতে গেলে আমি নিশ্চিত পায়ে ব্যথা পাব।’ ফুটবলটা হৃদয় দিয়ে ভালো না বাসলে বোধ হয় এমন কিছু সম্ভব নয়।
কিন্তু এই ভালোবাসাই কি কাল হলো শেষে? আনন্দটা বড় করে দেখেছিলেন বলেই কি নিজের তিলে তিলে ক্ষয়ে যাওয়াটা উপেক্ষা করেছিলেন? লাগামছাড়া নৈশজীবনের জন্যই খিদেটা মরে গিয়েছিল? নইলে পেপ গার্দিওলা আসার আগেই বার্সায় এত দ্রুত অপাংক্তেয় হয়ে পড়বেন কেন?
কিন্তু রোনালদিনহোকে নিয়ে এসব প্রশ্ন ওঠাটাই অনুচিত। কী করতে পারতেন, কী পারতেন না, এমন প্রশ্নও আসলে অর্থহীন। যে আনন্দ তিনি দিয়েছেন, সেটা অর্জনের পাল্লায় মাপলে সেটা হয়ে যাবে শুভঙ্করের অনেক বড় ফাঁকি। ব্রাজিল কিংবদন্তি টোস্টাও তো এমনি এমনি বলেননি, ‘রোনালিদনহোর ড্রিবলিং ছিল রিভেলিনোর মতো। দেখার চোখ ছিল গার্সনের মতো, গারিঞ্চার মতো আনন্দ আর উপভোগের দীক্ষা। গতি, শক্তি হচ্ছে জেয়ারজিনহো আর রোনালদোর মতো, টেকনিক্যাল সামর্থ্য ছিল জিকোর মতো আর রোমারিওর মতো সৃষ্টিশীলতা।’
এতোকিছু এত অল্প সময়ের জন্যই এসেছিল, সেটা নিয়ে আপনি চাইলে আফসোস করতে পারেন। কিন্তু ওই যে, রোনালদিনহোর কাছ থেকে ‘নগদ পাওয়াটুকুই’ তো মহার্ঘ্য। কী পাননি, সেই হিসেবের চেয়ে কী দিয়েছেন সেটাই আসল। এমন আনন্দদায়ী একজন আবার কবে আসবেন, কে জানে!
সূত্রঃ সিড লো, গার্ডিয়ান
ফোর ফোর টু