কোন পথে জিদানের রিয়াল?
মৌসুমের মাঝপথে রিয়াল মাদ্রিদের দায়িত্ব নিয়েছিলেন জিনেদিন জিদান। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বার্সেলোনার থেকে তখন ১০ পয়েন্টে পিছিয়ে ছিল রিয়াল। মৌসুম শেষে বার্সা লিগ জিতলেও ব্যবধানটা কমে দাঁড়িয়েছিল মাত্র ১-এ, এর মধ্যে নিজের প্রথম ক্লাসিকোতে বার্সাকে ন্যু ক্যাম্পেই হারিয়ে আসেন এই জিজু। সেরা অর্জনটা অপেক্ষা করছিল তখনও। অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদকে হারিয়ে ধুঁকতে থাকা রিয়ালকে ৬ মাসের ভেতরই করলেন ইউরোপ সেরা। মিলানের সেই বিখ্যাত রাতের মাস দুয়েক পর রিয়ালের হয়ে নিজের প্রথম পূর্ণাঙ্গ মৌসুম শুরু করলেন জিদান। পরেরবার ছাপিয়ে গেলেন আগের সব অর্জনকেও। কোপা ডেল রে বাদে সব শিরোপাই ঘরে তুলল রিয়াল। জিদানের দলের সামনে পাত্তা পেল না বার্সা, বায়ার্ন মিউনিখ, জুভেন্টাসের মত রাঘব-বোয়ালরা। পাঁচ বছর পর রিয়ালকে জেতালেন লা লিগা। একমাত্র দল হিসেবে চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপাও ধরে রাখল ‘লস ব্লাঙ্কোস’রা।
২০১৭-১৮ মৌসুমের শুরুটাও হয়েছিল দারুণ রিয়ালের, ইউয়েফা সুপার কাপ এবং হারিয়ে স্প্যানিশ সুপারকাপ জিতে। কিন্তু কিছুদিন যেতেই এবার যেন মুদ্রার ওপিঠটা দেখতে শুরু করলেন জিদান। ভ্যালেন্সিয়ার বিপক্ষে ড্র দিয়ে শুরু। একের পর এক অপ্রত্যাশিত ফলাফলে মৌসুমের মাঝপথেই বার্সার চেয়ে ১৮ পয়েন্টে পিছিয়ে জিদানের মাদ্রিদ। লা লিগা টেবিলের চার নম্বরে অবস্থান রিয়ালের; পা হড়কালেই হারাবে সরাসরি আগামী মৌসুমে সরাসরি চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলার সুযোগ। ‘পুঁচকে’ লেগানেসের বিপক্ষে হেরে বাদ পড়েছে কোপা ডেল রে থেকেও। রিয়ালের সাম্প্রতিক ফর্ম চ্যাম্পিয়নস লিগের শেষ ষোলতে পিএসজির বিপক্ষেও ম্যাচ জয়ের আশা দেখাচ্ছে না। ওদিকে জিদানের চাকরি হারানোর গুঞ্জনও ডালপালা ছড়াচ্ছে বেশ। কিন্তু কেন এমন হল? সেই ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, সার্জিও রামোস, লুকা মদ্রিচদের সবাই-ই তো খেলছেন বিখ্যাত সাদা জার্সি গায়ে চাপিয়ে? কী এমন হল গত কয়েক মাসে যা রীতিমত মাটিয়ে নামিয়ে আনল স্প্যানিশ জায়ান্টদের?
ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, আপনি কোথায়?
২০০৯ সালে রিয়ালে আসার পর থেকেই ক্লাবটির সব সাফল্যের মূল কারিগর তিনিই। গত মৌসুমেও ৫০ গোলের মাইলফলক স্পর্শ করা রোনালদোকে খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না এবার। ৯ গোল নিয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগের গ্রুপপর্বের সর্বোচ্চ গোলদাতা হলেও লা লিগায় ২১ ম্যাচ শেষে ‘সিআর৭’-এর গোল মাত্র ৮টি। গোল খরায় ভুগতে থাকা রোনালদোও হাসছেন না, হাসছে না রিয়ালও। লেভান্তে, এইবারের মত মাঝারি সারির দলগুলোর বিপক্ষেও জাল খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি। মদ্রিচ, ক্রুসদের পাসেরও সদ্ব্যবহার করতে পারছেন না ঠিকঠাক। বয়সের ভারেই এমনটা হচ্ছে, নাকি আত্মবিশ্বাসের অভাবে- তা হয়ত জানেন না খোদ রোনালদোও।
অন্তিম মুহূর্তই যখন বিভীষিকাঃ
গত মৌসুমে একাধিকবার শেষদিকে গোল করে দলের জন্য পয়েন্ট ছিনিয়ে এনেছিলেন রামোস-রোনালদোরা। কিন্তু এবার যেন ব্যাপারটা একেবারেই উলটো। রিয়াল তো শেষদিকে গোল করতেই পারছে না, উলটো গোল হজম করে হারাচ্ছে নিশ্চিত জয়। শেষদিকে গোল খেয়ে এই মৌসুমে এখন পর্যন্ত ১৩ পয়েন্ট হারিয়েছে রিয়াল। এই তো এ সপ্তাহেই লেভান্তের বিপক্ষে ৯০ মিনিটে গোল খেয়ে জয়ের বদলে ড্র নিয়েই মাঠ ছাড়তে হয়েছে রিয়ালকে।
গত মৌসুমের শক্তি, এই মৌসুমের দুর্বলতাঃ
ফাবিও কোয়েন্ত্রাও, হামেস রদ্রিগেজ, আলভারো মোরাতা। গত মৌসুমে একাধিকবার রোনালদো, বেনজেমা, মদ্রিচদের বিশ্রাম দিয়েও অনায়াসেই জয় তুলে নিয়েছিল রিয়াল। তাছাড়া অনেক ম্যাচে বদলি হিসেবে নেমে রিয়ালকে জয়ও এনে দিয়েছিলেন বদলি খেলোয়াড়রা। এখন হামেস ধারে খেলছেন বায়ার্নে, ওদিকে চেলসিতে পাড়ি জমিয়েছেন মোরাতা। হামেসের বদলি হিসেবে রিয়াল দলে ভিড়িয়েছে দানি সেবায়োসকে, ওলভসবার্গ থেকে এসেছেন বোরহা মায়োরাল। শক্তিশালী বেঞ্চের বদৌলতে গত মৌসুমে একাধিক ম্যাচ জেতা রিয়ালের বদলি খেলোয়াড়দের কেউই এখনও নজর কাড়তে পারেননি আলাদা করে। ফলে রোনালদোরা তো বিশ্রাম পাচ্ছেনই না, সেই সাথে ম্যাচের ফলাফল নিজেদের পক্ষে আনতে বেঞ্চের উপরও নির্ভর করতে পারছেন না জিদান। নতুনদের নিয়ে সঠিন সমন্বয়টাই খুঁজে বের করতে পারছেন না রিয়াল ম্যানেজার।
উদ্দেশ্যহীন ক্রস নির্ভর খেলাঃ
গত মৌসুমে রিয়ালের অন্যতম সেরা এবং ধারাবাহিক দুই খেলোয়াড় ছিলেন দানি কারভাহাল এবং মার্সেলো। রক্ষণে রামোসদের সাথে দুর্ভেদ্য এক দেয়াল গড়ে তোলার পাশাপাশি আক্রমণেও বেল-রোনালদোদের একাধিক গোলের উৎস ছিলেন তারাই। দুই ফুলব্যাকের ক্রস ছাড়াও দৃষ্টিনন্দন পাসিং ফুটবলও ছিল দেখার মতো। কিন্তু এই মৌসুমে পাসিং-এর বদলে ক্রস নির্ভর খেলাতেই ব্যস্ত জিদানের দল। তাতে লাভ হচ্ছে অল্পই। দুই ফুলব্যাকের মতো তাঁদের ক্রসগুলোও পার্থক্য গড়ে দিতে পারছে না ম্যাচে। আগের মত নিখুঁত ক্রসে ব্যর্থ হচ্ছেন রিয়ালের ফুলব্যাকেরা; কর্নার থেকেও রোনালদো-রামোস-ভারানদের খুঁজে পেতে বেগ পাচ্ছেন ক্রুস-মদ্রিচ। সেই সাথে খেলোয়াড়দের মাঝে বোঝাপড়ার অভাবটা স্পষ্ট হচ্ছে প্রায় প্রতি ম্যাচেই।
বার্নাব্যু যখন রিয়ালেরই ‘অ্যাকিলিস হিল’
নিজেদের মাঠ সান্তিয়াগো বার্নাব্যুকে রীতিমত এক অভেদ্য দুর্গেই পরিণত করেছিল রিয়াল গত মৌসুমে। বায়ার্ন, অ্যাটলেটিকোদের উড়িয়ে দেওয়া রিয়াল এই মৌসুমে নিজেদের মাঠে হেরেছে বেটিস, লেগানেসের মত দলগুলোর কাছে। দলের স্বভাবসুলভ পারফরম্যান্সের অভাবে সমর্থকদের উৎসাহ-উদ্দীপনাতেও পড়েছে ভাটা। বেশ কয়েকটি ম্যাচে দুয়ো দিয়ে গেছেন সমর্থকেরা। দুয়ো থেকে ছাড় পাননি রামোস-মার্সেলো-রোনালদোদের মতো খেলোয়াড়রাও। মৌসুমের অর্ধেক পেরুতেই বার্সার চেয়ে লিগে ১৮ পয়েন্ট পিছিয়ে পড়ায় এবং কোপা ডেল রে থেকে বাদ পড়ার পেছনে বার্নাব্যুতে রিয়ালের এমন পারফরম্যান্স অন্যতম মূল কারণ।
মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন ভাগ্যদেবীওঃ
গত মৌসুমে বেশকিছু ম্যাচে গড়পড়তা খেলেও ঠিকই জয় ছিনিয়ে এনেছিল রিয়াল। একেবারে শেষদিকে গোল করে দলকে উঠিয়ে এনেছিলেন রোনালদো-রামোসরা। 'চ্যাম্পিয়নস লাক' বোধ হয় একেই বলে! কিন্তু এবার হচ্ছে উলটোটা। ভাল খেলেও বেশ কয়েকবার খালি হাতে বা ড্র নিয়ে ফিরতে হয়েছে রিয়ালকে। সেই সাথে হারিয়ে গেছে অন্তিম মূহূর্তে গোল করে জয়ের নাটকীয়তাও। গোল করাটাই যাদের অভ্যাস ছিল, তারাও গোলের খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরেছেন। ভাগ্যদেবীর মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার মতই রেফারিদের একাধিক ভুল বা বিতর্কিত সিদ্ধান্তও ভুগিয়েছে রিয়ালকে। বেটিসের বিপক্ষে হেরে যাওয়া ম্যাচে দুটি নিশ্চিত পেনাল্টি থেকে রিয়ালকে বঞ্চিত করেছেন রেফারি। মৌসুম জুড়েই এমন আরও বেশ কিছু সিদ্ধান্তের কারণে জয় থেকে বঞ্চিত হতে হয়েছে রিয়ালকে।
নতুন খেলোয়াড় দলে ভেড়াতে জিদানের অপারগতাঃ
এই স্কোয়াড নিয়েই স্পেন এবং ইউরোপ জয় করায় স্বাভাবিকভাবেই নিজ খেলোয়াড়দের ওপর অগাধ আস্থা জিদানের। কিন্তু এই আস্থাই এখন পরিণত হয়েছে নেতিবাচকতায়। আক্রমণভাগে বেল-রোনালদোরা দীর্ঘদিন ধরে গোলখরায় ভুগতে থাকলেও শীতকালীন দলবদলে কোনো ফরওয়ার্ডকেই দলে আনেননি জিদান। আর্জেন্টাইন স্ট্রাইকার মাউরো ইকার্দির নাম জোরেশোরে শোনা গেলেও শেষমেশ তা আর হয়ে উঠেনি। নিজ স্কোয়াডের ওপর এই ‘অন্ধ’ বিশ্বাস থেকেই মোরাতাকে বিক্রি করার পরও কাউকে দলে না ভিড়িয়ে বেনজেমাতেই আস্থা রেখেছেন জিদান। ইউরোপের প্রায় সব বড় ক্লাবগুলোই ব্যস্ত ছিল শীতকালীন দলবদলের বাজারে। সেখানেও শীতনিদ্রায় ছিলেন জিদান। সুযোগ পেয়েও কাজে না লাগানোর খেসারতই কি দিচ্ছেন এখন?
সব পেলে নষ্ট জীবনঃ
জিদানের অধীনে গত দুই বছরে কোপা ডেল রে বাদে সম্ভব্য সব শিরোপাই জিতেছে রিয়াল। প্রথম দল হিসেবে চ্যাম্পিয়নস লিগ, ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ এবং ইউয়েফা সুপারকাপ ধরে রেখেছে, সেই সাথে পাঁচ বছর পর ঘরে তুলেছে লা লিগা। ওদিকে ব্যক্তিগত অর্জনের ঝুলিটাও ভারী হচ্ছে দলের সবারই। জিদান জিতেছেন সেরা কোচের খেতাব, রোনালদো পঞ্চমবারের মত ঘরে তুলেছেন ব্যালন ডি’অর। সব মিলিয়ে একপ্রকার আত্মতুষ্টিতে ভুগতেই পারে জিদানের দল। সব কিছু জিতে যাওয়ায়, ইউরোপের সেরা দলগুলোকে হারিয়ে ইউরোপে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করায় হয়তো অনুপ্রেরণার অভাবেই ভুগছে ‘লস ব্লাঙ্কোস’রা।