• বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব
  • " />

     

    আইসিসি যখন উদ্ভট এক উটের পিঠে...

    আইসিসি যখন উদ্ভট এক উটের পিঠে...    

    এজন সাকিব আল হাসানকে বিশ্বের কতজন লোক চেনেন?

    বাংলাদেশ তো বটেই, ভারত-পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কার বড় একটা অংশের চেনার কথা। অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকায়ও ক্রিকেটের হকিকত যারা রাখেন তারা চিনতে পারেন। তবে আজ থেকে পাঁচ বছর জিম্বাবুয়েতে হাতেগোণা কয়েকজন বাদে যদি কেউ না চেনেন, খুব একটা অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কে জানে, ক্রিকেট খেলাটাই হয়তো জিম্বাবুয়েতে তখন শখের কিছু হয়ে যাবে!

    বিশ্বাস হচ্ছে না? কেনিয়ার অবস্থা দেখুন। সেই যে ক্রিকেটের মানচিত্র থেকে একবার সরে গেছে, এখন তাদের মাইক্রোস্কোপ দিয়ে খুঁজলেও পাওয়া যাবে না। জিম্বাবুয়ের বিশ্বকাপ-স্বপ্নভঙ্গের পর টেলরদের কারও কারও আবার ইংল্যান্ড বা অন্য কোথাও পাড়ি জমালে সেটা বিচিত্র কিছু হবে না। বিশ্বকাপেই যখন নেই, ক্রিকেট খেলেই বা কী হবে? আর সেজন্য পুরো কৃতিত্বটা আইসিসি দাবি করতেই পারে! জিম্বাবুয়ে, স্কটল্যান্ডের মতো দেশগুলোতে এভাবে ক্রিকেটের টুঁটি চেপে ধরার জন্য তাদের একটা ধন্যবাদ প্রাপ্যই।

    এতক্ষণে প্রসঙ্গটা আপনার ধরে ফেলার কথা। ১৯৮৩ সালের পর এই প্রথম জিম্বাবুয়ে বিশ্বকাপে নেই, সেটাও আপনার জানার কথা। থাকছে না গত কয়েকটা বিশ্বকাপের নিয়মিত মুখ স্কটল্যান্ড। আয়ারল্যান্ড বা আফগানিস্তানের বাদ যাচ্ছে একটা। অথচ প্রতিটা দলই প্রমাণ করেছে, নিজেদের দিনে তারা কেউ যে কাউকেই হারাতে পারে। এই তো, র‍্যাঙ্কিংয়ের ১৮নম্বর দল হয়েও আজ আমিরাত হারিয়ে দিল জিম্বাবুয়েকে। অথচ এই জিম্বাবুয়ে গত বছর শ্রীলঙ্কার মাটিতে গিয়ে হারিয়ে এসেছিল তাদের। আর আইসিসির দোহাই ছিল, বিশ্বকাপে বেশি দল হলে ‘প্রতিযোগিতা’ হয় না বলে তার ডানা কেটে দেওয়া হয়েছে। ১৪টি দল থেকে নেমে এসেছে দশটি দলে।

    ক্রিকেট এমনিতেই খেলে অল্প কয়েকটা দেশ, আইসিসির যদিও কাগজে কলমে ১০৫টি সদস্য রাষ্ট্র। কিন্তু ক্রিকেটের বিশ্বায়নের যে বুলি শোনানো হয়েছিল, সেটা যে পুরোপুরিই ফাঁপা, ১০ দলের বিশ্বকাপ আয়োজনের পর তা নিয়ে আর তর্ক চলে না। ২০১৮ সালে হকি বিশ্বকাপে দল ১২টি থেকে বেড়ে ১৬টি হয়েছে। বাস্কেটবল বিশ্বকাপে সামনের বছর থেকে ২৪টি থেকে হচ্ছে ৩২টি। ফুটবল বিশ্বকাপ তো ১৬ থেকে শুরু করে ২৪, এখন ৩২-এ এসে ঠেকেছে। ২০২৬ থেকে তা হবে ৪৮ দলের। আর ক্রিকেটে সেখানে দলের সংখ্যা কমেছে। এ যেন নিজের বাসার আশেপাশের খোলা প্রান্তের মাঝে একটা পাঁচিল তুলে দেওয়া, বাইরে থেকে কেউ যেন উঁকিও দিতে না পারে।

    আইসিসির যুক্তিটাও ছিল অদ্ভুত। তিন বছর আগে সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী ডেভ রিচার্ডসন দাবি করেছিলেন, বিশ্বকাপটা আরও জমজমাট করার জন্যই তাদের এই আয়োজন। এর ফলে সেরা দলগুলোই শুধু বিশ্বকাপে খেলবে, কোনো ‘গুরুত্বহীন’, ‘একপেশে’ ম্যাচের সংখ্যা কমবে। কথাটা কতটা অর্থহীন, এই বিশ্বকাপ বাছাইয়ের শেষেই টের পাওয়া যাচ্ছে। সুপার সিক্সে কমবেশি সব দলকেই কাঠখড় পুড়িয়ে জিততে হচ্ছে। এমনকি নেপাল, পাপুয়া নিউ গিনির মতো দলও বড়দের ঘাম ঝরিয়ে ছেড়ে দিচ্ছে। আমিরাত তো হারিয়েই দিল জিম্বাবুয়েকে। আর তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে অনেক ম্যাচেই, একটা তো টাই-ই হয়েছে। মোটামুটি বলেই যায়, এদের অনেকেই নিজেদের দিনে বিশ্বকাপে সুযোগ পাওয়া অনেক দলকে ঘোল খাইয়ে ছাড়তে পারত।

    স্কটিশ অধিনায়ক কাইল কোয়েটজার যেমন জিম্বাবুয়ের ম্যাচের পর সরাসরিই টুইট করেছেন, ‘এমন একটা ম্যাচের পর আইসিসি কীভাবে ১০ দলের বিশ্বকাপের যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে পারে? আইসিসি, আমরা সবার এর চেয়ে ভালো কিছু পাওনা।’ সাবেক ক্রিকেটারদের মধ্যে সবাই কমবেশি ধুয়ে দিয়েছেন আইসিসিকে। সাবেক স্কটিশ অধিনায়ক মমসেন জিম্বাবুয়ের সঙ্গে আমিরাতের শ্বাসরুদ্ধকর জয়ের পর টিটকিরি দিয়ে বলেছেন, ‘মনে হচ্ছে বিশ্বকাপে আরেকটি বিরক্তিকর ম্যাচ খেলছে।’

    তাহলে আইসিসির কেন এই উলটোরথে হাঁটা? প্রতিযোগিতার অজুহাত একটা গালগপ্পো মাত্র, আসল কারণ বাণিজ্য। বিশ্বকাপ থেকে যে টাকা পায়, বেশির ভাগ দেশগুলো তা রাখতে চেয়েছে নিজেদের কাছেই। এজন্য ১০ দলের বিশ্বকাপের প্রস্তাবে সবাই রাজি হয়ে গেছে। আর মোড়লদের একটা কলকাঠি তো ছিলই। সেজন্যই এই বিশ্বকাপ বাছাই আইসিসির কাছে গুরুত্বই পায়নি। ‘অলাভজনক’ টুর্নামেন্ট বলে এখানে ডিআরএসও নেই, যেটার জন্য মাশুল দিতে হয়েছে স্কটল্যান্ডকে। এমনকি রাখা হয়নি কোনো রিজার্ভ ডের ব্যবস্থাও।

    আরেকটা বড় কারণও অনুমান করা যায়। ২০০৭ সালে যখন ভারত বাংলাদেশের কাছে হেরে বিশ্বকাপ থেকে বাদ পড়েছিল, টিভি সম্প্রচার থেকে পাওয়া টাকার তহবিল একদিনেই প্রায় নিঃস্বর কাছাকাছি চলে আসে। এরপর আইসিসি নিশ্চিত করে, অন্তত কয়েকটা ম্যাচ না খেলে বাদ পড়ছে না ভারত। এবারের বিশ্বকাপে ১০দল প্রতিটি নিজেদের মধ্যে খেলবে, তার মানে সবার অন্তত নয়টি করে ম্যাচ নিশ্চিত। আইসিসির দাবি, ১৯৯২ বিশ্বকাপের এই ফরম্যাট এখন পর্যন্ত সবচেয়ে জনপ্রিয় বলে তা ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। কিন্তু আসল কারণ, পরে যাই হোক, আপাতত ভারত নয়টি ম্যাচ খেলছেই। টুর্নামেন্টের একটা বড় অংশ পর্যন্ত তো চ্যানেলগুলো ব্যবসা করতে পারবে। সবই হচ্ছে পুকুরে ছড়িয়ে দেওয়া খাবার বড় মাছদের কাড়াকাড়ি করে খাওয়া, ছোট মাছদের জন্য যখন আর কিছুই মেলে না।

    অনেকেরই শঙ্কা, বিশ্বকাপ না থাকলে দেশের ক্রিকেট কাঠামো বড় একটা ধাক্কা খাবে। যেই আশঙ্কা কোনোভাবেই অমূলক নয়। বিশ্ব যখন সামনে চলেছে, উটপাখির মতো বালিতে মাথা গুঁজে আর কদিন চলবে আইসিসি?