• " />

     

    সার্জিও রামোস : 'দ্য গুড অ্যান্ড দ্য ব্যাড'

    সার্জিও রামোস : 'দ্য গুড অ্যান্ড দ্য ব্যাড'    

    লিসবনে ঘড়ির কাঁটা সেদিন যেন পাল্লা দিয়ে চলছিল সময়ের সাথে। 

    ঘড়ির কাঁটার টিকটিকের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার একই শহরের দুই ক্লাবের ভিন্নরকম দুই আকুতি। ইনজুরি টাইমের তিন মিনিট অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের কাছে মনে হচ্ছিল অনন্তকাল। আর একটা গোলের জন্য বুভুক্ষ হয়ে ছোটা রিয়াল মাদ্রিদ ফুটবলারদের জন্য প্রতিটা মুহুর্ত যেন একটা সেকেন্ডের চেয়েও বেশিকিছু! ম্যাচ বাঁচানোর ক্ষণ ফুরিয়ে আসছে, সঙ্গে রিয়ালের ১২ বছরের 'লা ডেসিমা' স্বপ্নটা তখন প্রায় ফিকে হওয়ার জোগাড়। শেষ মিনিটে যখন লুকা মদ্রিচ কর্নার-কিক নিতে যাচ্ছিলেন, ডি-বক্সের ভেতর ততক্ষনে রোনালদো, বেল, মোরাতাদের সাথে যোগ দিয়েছেন দলের বাকি সবাই। পাদপ্রদীপের আলোয় ছিলেন রোনালদো-বেলরাই। কর্নার থেকে ভেসে আসা বলটা তাদের দুইজনকেই অতিক্রম করে গেল। সময় যদি সেখানেই থেমে যেত, শিরোপাটা হত অ্যাটলেটিকোরই।  

    সময় গিয়ে লুটিয়ে পড়লো একজনের মাথায়। অনেকটা ঝড়ের বেগে যিনি লাফিয়ে উঠলেন, মাথাটাকে বাঁদিকে ঘুরিয়ে করলেন প্লেসিং হেড। ডানদিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে গোলরক্ষক আপ্রাণ চেষ্টা করলেন হাত ছোঁয়াতে। ব্যর্থ হলেন, বল জড়িয়ে গেল জালে। ১২ সেকেন্ড বাকি থাকতে ১-০ থেকে ফাইনালের স্কোরলাইন হয়ে গেল ১-১! পড়িমরি করে রিয়ালের সবাই ছুটলেন একজনের দিকে। যে পথে আপন আলোয় উজ্জ্বল এক যোদ্ধা ছুটছেন নিজেকে কোটিভক্তের ভালোবাসায় সিক্ত করতে। তার দেখানো পথেই যোগ করা ৩০ মিনিটে ৩ টি গোল দিয়ে রিয়াল মাদ্রিদ ঘরে তুললো তাদের বহু আরাধ্য চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপা। তবে ৪-১ স্কোরলাইনটি দেখে বোঝার উপায় নেই কিভাবে একটি গোলই বদলে গিয়েছিল সেদিনের পুরো ম্যাচের প্রেক্ষাপট। কিভাবে সেদিন একজন ডিফেন্ডার সার্জিও রামোস হয়ে উঠেছিলেন 'গ্ল্যাডিয়েটর', যিনি রক্ষণ সামলানোর সঙ্গে প্রতিপক্ষের আক্রমণও দুমড়ে মুচড়ে দিতে পারেন। 

    ****

    রামোসের আজকের রামোস হয়ে ওঠার গল্পটিও বিচিত্র। পুরো নাম সার্জিও রামোস গার্সিয়া। স্পেনের সেভিল প্রদেশের কালমাস শহরে জন্ম, ফুটবলের প্রতি দূর্বলতা ছিল ছোটবেলা থেকেই। ১৪ বছর বয়সে স্থানীয় সেভিয়া এফসি ক্লাবের নজড়ে পড়লেন। যুবদল থেকে সিনিয়দ দলে ডাকও পেলেন দ্রুতই। 

    ২০০২ সালের স্পেনের উয়েফা ইউরোপিয়ান অনূর্ধ্ব -১৯ চ্যাম্পিয়ন দলের একজন ছিলেন রামোস। ২০০৩ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে সেভিয়ার প্রথম দলে অভিষেক, প্রথম মৌসুমেই নিজের জাত চেনালেন। ২০০৩ সালে লা লিগার বর্ষসেরা উদীয়মান খেলোয়াড় হলেন, নজড়ে পড়ে গেলেন ইউরোপের বড় বড় ক্লাবগুলোর। 

    তবে, ২০০৫ সালের গ্রীষ্মকালীন দলবদলের ‘ডেডলাইন ডে’তে তখনকার রেকর্ড ২৭ মিলিয়ন ডলারে সেভিয়া থেকে রিয়াল মাদ্রিদে যোগ দেন রামোস।

    রিয়াল মাদ্রিদে তখন ‘এল গ্যালাকটিকো’র যুগ। দলে জিদান, রোনালদো,ক্যাসিয়াস, ফিগো, বেকহাম, রাউলদের মত তারকাদের ভিড়ে ঝাঁকড়া চুলের তরুণ রামোসকে নিয়ে তেমন আলোচনা হয়নি। তবে বিশ্বাসটা ছিল, তার মাঝে সম্ভাবনা ছিল একজন সেরা ডিফেন্ডার হওয়ার। সেন্টার ব্যাক হিসেবে শুরু করলেও কিছুদিনের মধ্যেই রিয়াল মাদ্রিদ ও স্পেন দলে মাইকেল সালগাদোকে হটিয়ে নিজের প্রিয় রাইটব্যাক পজিশনটাই নিলেন। রিয়ালে যোগ দেওয়ার পর ৪টি লা লিগা, ৩টি উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ, ৩টি ক্লাব বিশ্বকাপ সহ অন্যান্য প্রতিটি শিরোপা জয়ে রামোসের ছিল প্রত্যক্ষ অবদান। স্পেনের ২০১০ সালের বিশ্বকাপ, ২০০৮ ও ২০১২ সালের ইউরোজয়ী দলের অবিচ্ছেদ্য অংশও ছিলেনতিনি। ২০১৩ সালে মাত্র ২৭ বছর বয়সে স্পেনের জার্সি গায়ে ১০০তম ম্যাচও খেলে ফেলেন। সম্প্রতি খেলে ফেলেছেন ১৫০তম ম্যাচটিও, অধিনায়কের আর্মব্যান্ড হাতেই।

    ২০১৫ সালে রিয়াল মাদ্রিদের জীবন্ত কিংবদন্তি ইকার ক্যাসিয়াস যখন ক্লাব ছেড়ে যান, সৃষ্টি হলো এক শুন্যতার। ক্যাসিয়াস তো ছিলেন রিয়ালের ঘরের ছেলে। চাইলেই তার মত 'মিস্টার মাদ্রিদম্যান' হওয়া তাই অসম্ভব। তাছাড়া রিয়াল মাদ্রিদের মতো ইতিহাস সমৃদ্ধ একটি ক্লাবের অধিনায়ক হওয়া এবং ক্লাবকে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য যেরকম ব্যক্তিত্বের প্রয়োজন, সেরকম কাউকেও তো মেলে না সহজেই!

     ক্যাসিয়াসের প্রস্থানের পর ক্লাবের নিয়ম অনুযায়ী দলের সবচেয়ে সিনিয়র খেলোয়াড় হিসেবে রামোস অধিনায়ক হলেন। খেলেননি রাউল ক্যাসিয়াসদের মত ১৫-২০ বছর ধরে। তবে ‘মাত্র’ ১০ বছরেই তিনি রিয়াল মাদ্রিদকে নিজের ভেতর ধারণ করতে পেরেছিলেন। হোসে মরিনহোর আমলে ইকার ক্যাসিয়াস দল থেকে ছিটকে পড়ার পর থেকেই অধিনায়কের আর্মব্যান্ড প্রায় নিয়মিত পরেছেন। পরবর্তীতে স্পেন জাতীয় দলের অধিনায়ক হিসেবেও তাকেই মনোনীত হয়েছেন।

    ****

    তবে অধিনায়ক হয়েও প্রায়ই রামোস অযথাই মেজাজ হারিয়ে ফেলেন। ‘অপ্রয়োজনীয়’ ফাউদে বিপদে পড়ে দলও। মাত্র ১১ বছরের ক্যারিয়ারেই তিনি রিয়াল মাদ্রিদের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সংখ্যক লাল এবং হলুদ কার্ড দেখে ফেলেছেন! রিয়ালের হয়ে লাল কার্ড পাওয়াদের তালিকায় যিনি দুই নম্বরে আছেন, তার সংখ্যাটা রামোসেরও অর্ধেক। লা লিগার ইতিহাসেই তো রামোসের চেয়ে বেশি লাল কার্ড দেখননি কেউই! আবার একই সাথে ডিফেন্ডার হয়েও করে ফেলেছেন ৭৫টি গোলও! গত মৌসুমেও কতোবার যে গোল করে রিয়ালকে বাঁচিয়েছেন, সেই হিসাব হয়ত তার নিজেরও জানা নেই। 

    রামোস এমনই এক বর্ণিল চরিত্র। মাঠে তার সতীর্থ ফাউলের শিকার হলে সবার আগে তিনিই ছুটে যান, বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়ের সাথে কারণে অকারণে বচসায় লিপ্ত হন। অপ্রয়োজনীয় মুহূর্তে অহেতুক দৃষ্টিকটু ফাউল করে দেখেন হলুদ বা লাল কার্ডও। রেগে যান, মেজাজ হারান এবং দলকে ডোবান। কারণে শিরোনাম হন, যে শিরোনামে থাকতে চান না সেখানেও জায়গা পান।

    আবার সেই তিনিই শেষ মুহূর্তে অবিশ্বাস্য গোল করে চারপাশ ‘রামোস রামোস’ চিৎকারে মাতিয়ে তোলেন। বয়স আর অভিজ্ঞতা যতই হোক না কেন, রামোস হয়তো বদলাবেন না। বলা ভাল, বদলাতে তিনি পারবেনও না। বদলালেই যে রামোস আর ‘রামোস’ থাকবেন না!

    ক্যারিয়ারের শুরুতে ছিলেন গ্যালোকটিকোদের ভীড়ে। আলাদা করে এরপর নিজেকে চিনিয়েছেন। তবে সবকিছু ছাপিয়ে রামোস রিয়াল মাদ্রিদের ইতিহাসে থাকবেন হয়ে থাকবেন 'মি: ৯২:৪৮' হিসেবেই। আর হ্যাঁ, থাকবেন রেফারির নোটবুকেও।