‘নক-আউট’ মানেই জুভেন্টাস, ‘ফাইনাল’ মানেই রিয়াল
শেষ ষোলর নাটকীয়তার পর আজ থেকে মাঠে গড়াচ্ছে ইউয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ ২০১৭-১৮ মৌসুমের কোয়ার্টার ফাইনাল। গত বছরের দুই ফাইনালিস্ট জুভেন্টাস এবং রিয়াল মাদ্রিদ আবারও মুখোমুখি হচ্ছে একে অপরের। আজকের অন্য ম্যাচে বায়ার্ন মিউনিখের প্রতিপক্ষ সেভিয়া। আগামীকাল পাঁচবারের চ্যাম্পিয়ন বার্সেলোনার মুখোমুখি হবে এএস রোমা। ২০
‘নক-আউট’ মানেই জুভেন্টাস, ‘ফাইনাল’ মানেই রিয়াল
জুভেন্টাস বনাম রিয়াল মাদ্রিদ; কোয়ার্টার ফাইনাল প্রথম লেগ; জুভেন্টাস স্টেডিয়াম; ৩ (৪) এপ্রিল, রাত ১২ঃ৪৫; টেন ২
চ্যাম্পিয়নস লিগে তীরে এসে তরী ডোবানোটা যেন ‘রুটিন’ই বানিয়ে ফেলেছে জুভেন্টাস। সব মিলিয়ে মোট ৭ বার ফাইনাল হেরেছে তারা। এর মধ্যে দু'বার হেরেছে আজকের প্রতিপক্ষ রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষেই। কিন্তু দুই লেগের ‘নক-আউট’ লড়াইয়ে আবার তুরিনের বুড়িদের জুড়ি মেলা ভার। রিয়ালের বিপক্ষে তিনবার ‘নক-আউট’ পর্বে দেখা হয়েছে জিয়ানলুইজি বুফনদের, তিনবারই টুর্নামেন্ট থেকে রিয়ালকে বিদায় করে দিয়েছে তারা। কিন্তু প্রতিযোগীতাটা যখন চ্যাম্পিয়নস লিগ, তখন রিয়াল বলতে গেলে অনবদ্যই। লা লিগা, কোপা ডেল রে থেকে ছিটকে পড়লেও সাম্প্রতিক ফর্মের বিচারে এগিয়ে আছে জিনেদিন জিদানের দলই। তবে বরাবরের মত এবারও নিজেদের ‘ফেভারিট’ মানতে নারাজ ‘জিজু’, “হ্যাঁ এটা সত্যি যে আমরা গত দু’বারের চ্যাম্পিয়ন কিন্তু এটা তেমন কিছুই না। কিন্তু আমাদের নিজেদের মাঠে আবারও প্রমাণ করতে হবে। গত মৌসুমের চেয়েও ভাল করতে হবে আমাদের। জুভেন্টাস দুর্দান্ত দল। তাদের বিপক্ষে দুটি ম্যাচই অত্যন্ত কঠিন হবে”। খেলোয়াড়ি জীবনে রিয়ালের আসার আগে জুভেন্টাসেই খেলেছিলেন জিদান। ম্যানেজার হিসেবে প্রথমবারের মত ইতালিতে ফেরার আগে স্বভাবতই কিছুটা আবেগতাড়িতও বোধ হয় হয়ে পোড়লেন , “নিজ শহর বোর্দো ছেড়ে আসাটা আমার জন্য অনেক কঠিন ছিল। কিন্তু জুভেন্টাসে পাড়ি জমানোর পর আমার সতীর্থ, সমর্থক, এবং কোচ মার্সেলো লিপ্পি আমাকে সাদরে বরণ করে নিয়েছিল। জুভেন্টাস অধ্যায়টা ছিল আমার ক্যারিয়ারের গুরুত্বপূর্ণ এক সময়। একজন ফুটবলার এবং মানুষ হিসেবে অনেক কিছুই আমি শিখেছি তুরিনে থেকে। জুভেন্টাসের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকব।"
জিদানের মতই প্রতিপক্ষের বন্দনায় মেতেছিলেন দুই বর্ষীয়ান জর্জিও কিয়েলিনি এবং জিয়ানলুইজি বুফন। অনেকের মতে বিশ্বসেরা ডিফেন্ডারের উপাধি পাওয়া কিয়েলিনির কাছে সেরা রামোসই, “নিঃসন্দেহে সে (রামোস) বিশ্বের সেরা ডিফেন্ডার। তার মত খেলা বোঝার বা ফরওয়ার্ডদের মতিগতি ধরে ফেলার ক্ষমতা আমি আর কারো মাঝে দেখিনি। সেই সাথে সে একজন দারুণ অধিনায়কও বটে”। ওদিকে রিয়ালকে ‘ফেভারিট’ মেনে নিয়ে ‘লস ব্লাঙ্কোস’দের মূল তারকা ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর প্রশংসায় পঞ্চমুখ বুফন, “সে একজন গুপ্তঘাতক। বয়সের সাথে যেন আরও দুর্দান্ত খেলছে প্রতিনিয়ত। খেলার ধরণে পরিবর্তন আনলেও আগের মতই দুর্ধর্ষ এখনও। আমার পূর্ণ শ্রদ্ধা-সম্মান তার প্রতি”।
বুফন-কিয়েলিনির মতই রিয়ালের প্রশংসা করেছেন জুভেন্টাস কোচ ম্যাক্সিমিলিয়ানো অ্যালেগ্রিও, “রিয়াল চ্যাম্পিয়নস লিগে দুর্দান্ত একটি দল। শেষ দু’বারের শিরোপা তারা ঘরে তুলেছে। তাদের হারাতে পারলে আমাদের আত্মবিশ্বাস দারুণ বাড়বে, কারণ এবারও ফেভারিট তারাই।”
প্রতিপক্ষ কোচ জিদানে রীতিমত মুগ্ধ এই ইতালিয়ান, “সবাই জানে জিদান কত বড় মাপের ফুটবলার ছিলেন। এখন কোচ হিসেবেও সে নিজেকে প্রমাণ করে চলছে। মাত্র ২ বছরে সে অনেকগুলো শিরোপা ঘরে তুলেছে। এত অল্প সময়ে ইউরোপের অন্যতম সেরা কোচের উপাধিও পেয়েছে সে। নিঃসন্দেহে সে দুর্দান্ত কাজ করে চলেছে রিয়ালে।”
রিয়ালকে হারানোর টোটকা কি হবে? সেটাও নিয়ে বললেন অ্যালেগ্রি, “রিয়াল পজেশন ধরে রাখতে এবং প্রতি আক্রমণে খেলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। ওদের বিপক্ষে আমাদের ইস্পাতদৃঢ় রক্ষণ দিতে হবে। আর মাঝ মাঠে জায়গা করে খেলা বুঝে তাদের চাপে ফেলতে হবে। তাহলেই কেবল তাদের হারানো সম্ভব বলে মনে হয় আমার।”
কথার লড়াইয়ে তেমন উত্তাপের আঁচ পাওয়া না গেলেও মাঠের খেলা যে একেবারেই ব্যতিক্রম কিছু হবে- তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ইউরোপের অন্যতম সেরা দুই ট্যাকটিশিয়ান জিদান এবং অ্যালেগ্রির দল বাছাই নিয়ে জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। মৌসুমের শুরুতে ৪-৩-৩ ফর্মেশনে খেলালেও ইদানিং ৪-৪-২ ফর্মেশনে খেলেই স্বরুপে ফিরেছে রিয়াল। গ্যারেথ বেল, ইস্কো নন; জিদানের দলে রোনালদো, রামোস, মদ্রিচদের সাথে রীতিমত অপরিহার্য হয়ে পড়েছেন লুকাস ভাজকেজ এবং মার্কো আসেন্সিও। দুই স্প্যানিশ উইঙ্গারের দারুণ ধারাবাহিকতার কারণে ‘পেকিং অর্ডার’-এ কিছুটা পিছিয়েই পড়েছেন বেল এবং ইস্কো। সেক্ষেত্রে মূল একাদশে রোনালদোদের সাথে ভাজকেজ-আসেন্সিওর কাউকে দেখা গেলে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। তবে গত সপ্তাহে লাস পালমাসের সাথে জোড়া গোল করে নিজের সামর্থ্যের জানান দিয়ে রেখেছেন বেল। আর্জেন্টিনার বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করে ইস্কোও দেখিয়েছে, রিয়ালের হয়ে ফর্মহীনতায় ভুগলেও দলের প্রয়োজনে জ্বলে উঠতে পারেন তিনি। মূলত মাঝ মাঠে কাসেমিরো, টনি ক্রুস, লুকা মদ্রিচদের সাথে কে নামবেন- দল বাছাইয়ে এটিই জিদানের একমাত্র দুশ্চিন্তা। রিয়ালকে আটকাতে হলে মধ্যমাঠের মানিকজোড় ক্রুস-মদ্রিচকে দাবিয়ে রাখতেই হবে স্যামি খেদিরা-ব্লেজ মাতুইদিদের।
রিয়ালের রক্ষণে রামোস, রাফায়েল ভারানদের মূল লক্ষ্য থাকবে আর্জেন্টাইন জুটি পাওলো দিবালা এবং গঞ্জালো হিগুয়াইনের দারুণ বোঝাপড়া যতটা সম্ভব ভেস্তে দেওয়া। তবে জুভেন্টাস আক্রমণভাগের ‘তুরুপের তাস’ হতে পারেন ডগলাস কস্তা। গতি, ড্রিবলিং, দারুণ পাসিং, সর্বোপরি হিগুয়াইন-দিবালার সাথে বোঝাপড়া- সব মিলিয়ে এই ব্রাজিলিয়ানের দিকে আলাদা নজরই রাখা লাগবে রিয়ালের রক্ষণভাগকে। সাম্প্রতিক সময়ে চিরাচরিত ৩-৫-২ ফর্মেশনের সাথে ৪-২-৩-১ ফর্মেশনেও দলকে খেলাচ্ছেন অ্যালেগ্রি। দুই উইং ব্যবহার করেই টটেনহাম হটস্পার্সের বিপক্ষে ম্যাচে ফিরেছিল জুভেন্টাস। দ্বিতীয় লেগে তুরিনের বুড়িদের জয়ের অন্যতম মূল কারিগর ছিলেন দুই ফুলব্যাক স্টেফান লিচস্টাইনার এবং অ্যালেক্স সান্দ্রো। রিয়ালের ফুলব্যাক জুটি দানি কারভাহাল এবং মার্সেলোর রক্ষণভাগ ছেড়ে আক্রমণভাগে উঠে যাওয়ার প্রবণতার সু্যোগটা বেশ ভালমতই হয়ত লুফে নিতে পারবেন তারা। তবে নিষেধাজ্ঞার কারণে মাঝ মাঠে মিরালেম পিয়ানিচের অভাবটা বেশ ভোগাতে পারে জুভেন্টাসকে। আক্রমণভাগের চেয়ে দুই রক্ষণভাগ এবং মাঝ মাঠের ওপরই নির্ভর করছে খেলার ভাগ্য। কাসেমিরো এবং খেদিরার কথা না বললেই নয়। রক্ষণভাগে ডিফেন্ডারদের সাহায্য করার পাশাপাশি আক্রমণভাগে বল যোগান দেওয়ায় ইউরোপে তাদের জুড়ি মেলা ভার। রোনালদো-দিবালার মতই দলের জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন এই দুজন।
ইনজুরির কারণে রিয়ালের হয়ে ম্যাচটি মিস করবেন নাচো ফার্নান্দেজ। এছাড়া পূর্ণশক্তির দলই পাচ্ছেন জিদান। তবে দল বাছাইয়ে ‘জিজু’র মত নির্ভার থাকতে পারছেন না অ্যালেগ্রি। পিয়ানিচের মতই বহিষ্কারাদেশের কারণে কালকের ম্যাচ মিস করবেন মেধি বেনাতিয়া। তবে ইনজুরি কাটিয়ে দলে ফিরেছেন অ্যালেক্স সান্দ্রো, মারিও মাঞ্জুকিচ এবং হুয়ান কুয়াদ্রাদো।
সম্ভাব্য মূল একাদশঃ
জুভেন্টাস (৪-২-৩-১): বুফন; লিচস্টাইনার, কিয়েলিনি, বার্জাগলি, সান্দ্রো; খেদিরা, মাতুইদি; কস্তা, দিবালা, মানজুকিচ; হিগুয়াইন
রিয়াল মাদ্রিদ (৪-৪-২): নাভাস; কারভাহাল, ভারান, রামোস, মার্সেলো; ক্রুস, কাসেমিরো, মদ্রিচ, ভাজকেজ; রোনালদো, বেনজেমা
ফর্ম এবং সাম্প্রতিক ইতিহাস- সব দিক দিয়েই এগিয়ে রিয়াল। জিদানের অধীনে চ্যাম্পিয়নস লিগে দুই লেগের কোনো টাই হারেনি তারা। আবার জুভেন্টাসের বিপক্ষেও কখনও জেতা হয়নি দুই লেগ মিলিয়ে। ক্যারিয়ারে প্রায় পাঁচ শতাধিক ক্লিনশিট রাখলেও রোনালদোর বিপক্ষে প্রতিবারই গোল হজম করেছেন বুফন। রিয়াল কি পারবে জুভেন্টাসের ‘দুই লেগ’ গেরো কাটাতে? নাকি কার্ডিফের প্রতিশোধ নেবে অ্যালেগ্রির দল?
‘গালিভার’ বায়ার্নের সামনে ‘লিলিপুট’ সেভিয়া
সেভিয়া বনাম বায়ার্ন মিউনিখ, কোয়ার্টার ফাইনাল প্রথম লেগ; স্তাদিও রামোন সানচেজ পিজুয়ান; ৩ (৪) এপ্রিল, রাত ১২ঃ৪৫; টেন ১
শেষ ষোলর ড্রয়ের পর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে সেভিয়াকে গোণায় ধরেননি বেশিরভাগ পন্ডিত, ফুটবলবোদ্ধারাই। কিন্তু ওল্ড ট্রাফোর্ডে হোসে মরিনহোর ‘রেড ডেভিল’দের হারিয়েই নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবারের মত শেষ আটে জায়গা করে নিয়েছে সেভিয়া। বায়ার্নের সাথে খেলা পড়ায় এবারও ‘আন্ডারডগ’ সেভিয়া। কিন্তু ইউনাইটেডের বিপক্ষে তাদের খেলা দেখে সতর্কই থাকছেন কোচ ইয়ুপ হেইঙ্কস, “সেভিয়া দারুণ এক বিস্ময় উপহার দিয়েই শেষ আটে জায়গা করে নিয়েছে। এতদূর আসার পর এখন আর কোনো ‘ফেভারিট’ নেই। সবাই সমান। আগামীকাল তাদের মাঠে মৌসুমের অন্যতম কঠিন ম্যাচে মাঠে নামছি আমরা”।
গত সপ্তাহেই জার্মানিতে নিজেদের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বরুশিয়া ডর্টমুন্ডকে ৬-০ গোলে বিধ্বস্ত করেছে বায়ার্ন। ওদিকে বার্সেলোনাকে প্রায় হারিয়েই দিয়েছিল সেভিয়া। তবে শেষমেশ ২-২ গোলের ড্র নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় ভিন্সেঞ্জো মন্তেয়ার দলকে। তবে বায়ার্নের বিপক্ষে ম্যাচটা উপভোগ করাই নিজেদের মূল লক্ষ্য হিসেবে মানছেন মন্তেয়া, “কোয়ার্টার ফাইনালে আসতে পারাটা আমাদের জন্য দারুণ। চ্যাম্পিয়নস লিগে এবারের মৌসুমটা রীতিমত স্বপ্নের মত কেটেছে আমাদের। বায়ার্ন নিঃসন্দেহে ফেভারিট কিন্তু আমরা আবারও আরেক বিস্ময়ে জন্ম দেওয়ার লক্ষ্যেই নামব আজ”।
সম্ভাব্য মূল একাদশঃ
সেভিয়া (৪-২-৩-১): রিকো; কিয়ার, মার্কাদো, এস্কুদেরো, লঙ্গলে; এন’জঞ্জি, পিজারো; কোরেয়া, ভাজেকেজ, মুরিয়েল; বেল ইয়েদের
বায়ার্ন মিউনিখ (৪-৫-১): উলরিখ; কিমিচ, বোয়াটেং, হামেলস, আলাবা; মার্টিনেজ, রবেন, হামেস, রিবেরি, মুলার; লেভান্ডফস্কি