অতিমানব রোনালদোকে তুরিনের কুর্নিশ
তুরিনে শুরু থেকেই দুয়ো শুনে যাচ্ছিলেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। কারণ শুরু থেকেই তো খেলাটা দলের পক্ষে নিয়ে গিয়েছিলেন গোল করে। এরপর প্রায় ঘন্টাখানেক দুয়োই শুনলেন। কিন্তু ৬৪ মিনিটে যা করলেন সেটা দেখে শুধু জিনেদিন জিদানের মাথাতেই হাত পড়ল না। দুয়োর বদলে দুই হাত এক করে জুভেন্টাস সমর্থকেরাই তালি বাজালেন সেই রোনালদোর জন্য! এমন প্রতিপক্ষের কাছে হারটাও তো সম্মানের! চ্যাম্পিয়নস লিগ, রিয়াল মাদ্রিদ, রোনালদো- গল্পটা যেন একই সুতোয় গাঁথা। গল্পটা যেন মুখস্থ, অনেকবার শোনা। সেই গল্পটা এবার তুরিনেও লিখল রিয়াল মাদ্রিদ, নাকি রোনালদোর মাদ্রিদ? রোনালদোর অতিমানবীয় হয়ে ওঠার রাতে জুভেন্টাসকে কোয়ার্টার ফাইনালের প্রথম লেগে ৩-০ গোলে হারিয়েছে রিয়াল মাদ্রিদ। অবিশ্বাস্য কিছু না ঘটলে সেমিফাইনালের জায়গাও নিশ্চিত হয়ে গেল জিনেদিন জিদানের দলের।
প্রতিপক্ষ যখন রিয়াল মাদ্রিদ, জুভেন্টাসের সব ভয় তখন একজনকে ঘিরেই ছিল। আগের ৫ ম্যাচের সবগুলোই জুভেন্টাসের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, গোল করেছিলেন সবগুলোতেই। মাঠে নামার আগে হয়ত জিয়ানলুইজি বুফনের একটাই চাওয়া ছিল নিজ ডিফেন্ডারদের কাছে, রোনালদোকে দূরে রাখো। যাকে ঘিরে এতো প্রস্তুতি সেই রোনালদোই আরও একবার ভয়ঙ্কর হয়ে উঠলেন, জোড়া গোল করে জুভেন্টাসের বিদায় নিশ্চিত করেছেন প্রায় একাই।
বৃষ্টিভেজা তুরিনে জুভেন্টাসের শুরুটা ছিল দুঃস্বপ্নের মতো। ম্যাচের মাত্র ৩ মিনিটেই গোল করে রোনালদোই আসলে বদলে দিয়েছিলেন ম্যাচের চিত্র। বাঁ দিক থেকে করা ইস্কোর ক্রস দারুণ এক ফিনিশে বল জালে জড়ান রোনালদো। চ্যাম্পিয়নস লিগে টানা ১০ ম্যাচে গোল করা একমাত্র খেলোয়াড়ও বনে গিয়েছিলেন ওই গোল দিয়ে। রেকর্ড ভাঙা-গড়াই যার কাছে তার কাছে এ আর এমন কী! আর দলে জায়গা পেয়ে ইস্কোও আরও একবার চিনিয়েছেন নিজেকে, বদলি হয়ে যাওয়ার আগে শতভাগ নির্ভুল পাস দিয়েই মাঠ ছেড়েছেন।
গোল হজম করে অবশ্য প্রথমার্ধে দারুণভাবে ফিরে এসেছিল জুভেন্টাস। কিন্তু রিয়ালের রক্ষণ দুর্গ পার হয়ে আর যাওয়া হয়নি তাদের। প্রথম ১৫ মিনিটে পাউলো দিবালা আর রদ্রিগো বেন্টাকুরের শট দুইবার ব্লক করে দলকে বিপদের হাত থেকে বাঁচান সার্জিও রামোস। রক্ষণ পার করতে পারলেও জুভেন্টাসের সামনে প্রথমার্ধে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছিলেন কেইলর নাভাস। দিবালার ফ্রি কিক থেকে হিগুয়াইনের ভলি আটকে দিয়ে তিনিও যোগ দেন রামোসের সঙ্গে জুভেন্টাস আটাকনোর মিশনে। প্রথমার্ধে আরও একবার কর্নার থেকে ভালো বল পাঠিয়েছিলেন দিবালা, কিন্তু ফাঁকায় থেকেও হেডটা জায়গা মতো করতে পারেননি কিয়োলিনি। কিয়োলিনির ওই হেডের কিছুক্ষণ আগেই অবশ্য ম্যাচ থেকে ছিটকে যেতে পারত জুভেন্টাস। দুই মিনিট আগে টনি ক্রুসের শট বারপোস্ট কাঁপিয়ে না আসলে দুই গোলের লিডটা তখনই পেয়ে যেত জিদানের দল।
প্রথমার্ধে দুই দলের হাইপ্রেসিং খেলা জমজমাট কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছিল। বিরতির সময় অ্যালিয়াঞ্জ স্টেডিয়ামে এসিডিসির গান বাজিয়ে হয়ত সমর্থকদের মনোবল ধরে রাখারও খানিকটা চেষ্টা করল জুভেন্টাস। কিন্তু তাতে আরও চাঙা হলেন উলটো রোনালদোই। প্রথমার্ধে মাঠের দুই গোলরক্ষক বাদে তার চেয়ে কম বলে টাচ করেননি কেউই। সেই রোনালদোই আবার দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই প্রায় এগিয়ে দিচ্ছিলেন দলকে। কিন্তু ৬ গজ বক্সের ভেতর থেকে ডানদিকে দিয়ে করা কোণাকুণি শটটা একটুর জন্য চলে যায় বাইরে দিয়ে।
দ্বিতীয় গোলের জন্য এরপর খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি রোনালদোর। তবে এর মাঝের সময়টায় জুভেন্টাসও মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল। দিবালাকে আটকাতে গিয়ে হলুদ কার্ড দেখে পরের ম্যাচে রামোসের খেলতে না পারাটাও নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু রোনালদোর একটা মুহুর্ত নিমিষেই সব দুশ্চিন্তা দূর করে দিল রিয়ালের জন্য।
৬৪ মিনিটে ভুলটা করেছিলেন কিয়েলিনি। ব্যাকপাস দিয়েছিলেন, এগিয়ে আসতে থাকা বুফনের কাছে পৌছায়নি সেই বল। ডিবক্সের কোণায় বল পেলেন রোনালদো, পাস দিলেন বদলি খেলোয়াড় লুকাস ভাসকেজকে। তিনি শট নিতে নিতে বুফন পৌঁছে গেছেন নিজের জায়গায়। নিজের বাঁ দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বুফন বল ক্লিয়ার করলেন। সেটাই ডেকে আনল বিপদ। ডানদিক থেকে দানি কারভাহালের ক্রস এসে পড়ল আবার বুফনের ডিবক্সের ভেতর। রোনালদো শূন্যে লাফ দিলেন, করলেন বাইসাইকেল কিক। বল গিয়ে পড়ল বুফনের জালের কোণায়। ঠায় দাঁড়িয়ে বুফন, অবিশ্বাসে চোখ কচলাবেন সেই সুযোগও নেই।
গোলের পর জুভেন্টাস সমর্থকদের জানানো সম্মান চোখ এড়ায়নি রোনালদোরও। দুই হাত জোর করে ক্ষমাই চাইলেন একসময়, বুকে হাত দিয়ে জানান দিলেন তার হৃদয়ে জায়গা আছে তাদের জন্যও। এরপর চলে গেলেন সেন্টারলাইনে, রোনালদোর গোলক্ষুধা- সে কী আর মেটে!
রাতটা ক্রমেই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে থাকা জুভেন্টাসের জন্য দুর্দশা তখনও বাকি। প্রথমার্ধে হলুদ কার্ড দেখেছিলেন দিবালা, দুই গোলে পিছিয়ে যাওয়ার পর দেখলেন লাল কার্ড। দুই মিনিটেই জুভেন্টাসের ম্যাচে ফেরার আশা প্রায় শেষ হয়ে গেল সেখানেই।
দশজনের জুভেন্টাসের বিপক্ষে ম্যাচটা আরও একপেশে বানিয়ে দিল রিয়াল। এই গোলের উৎসও রোনালদো, তার পাস থেকে স্কোরশিটে নাম লেখান মার্সেলো। হ্যাটট্রিকটাও করে ফেলতে পারতেন রোনালদো। শেষদিকে এসে ফাঁকাবারে রোনালদো বল উড়িয়ে না মারলে জুভেন্টাসের গ্লানি বাড়ত আরও। আর পুরো ম্যাচে একটা গোলের জন্য হন্যে হয়ে ছোটা জুভেন্টাস শেষদিকেও নাভাসের কাছে হার মেনে আর নিজেদের বাজে ফিনিশের জন্য থেকে গেছে গোলশূন্যই। এমনসব রাতে বোধ হয় কিছুই কাজে দেয় না!