• ক্রিকেট

পেস বোলিংয়ের নতুনত্বে "দ্যা ফিজ"

পোস্টটি ৬১৫৫ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

ক্রিকেট যখন থেকে দেখি তখন থেকে নানা ধরনের পেসারদের বোলিং দেখেছি। কিছুটা ক্যাটাগরাইজ করার চেষ্টা করি।

কার্টলি অ্যামব্রোস, কোর্টনি ওয়ালশরা ব্যাটসম্যানকে কাবু করতেন গতি আর বাউন্সের মিশেলে। অ্যামব্রোসের বিশেষত্ব ছিল পায়ের সামনে থেকে বল বুকের উপরে ওঠাতেন। বল গুড লেংথ অথবা প্রায় ফুল লেংথ জোনে পড়ছে। ব্যাটসম্যান সাধারণত এই সময়ে ফ্রন্টফুটে গিয়ে ড্রাইভ অথবা কাট করার চেষ্টা করার কথা। কিন্তু অ্যামব্রোসের বল বিষ্ময়করভাবে লাফিয়ে উঠতো। যেখানে বল পড়লে অন্যান্য বোলারদের বল হাঁটু কি বড়জোর কোমর উচ্চতায় ওঠে সেখানে অ্যামব্রোস-ওয়ালশ বুকের উপরে বল ওঠাতেন। ব্যাটসম্যানকে বিব্রত হতে হতো। সমস্যা হচ্ছে, এই ব্যাপারটা কিন্তু ইউনিক থাকেনি কখনো। আগেও হয়েছে আর ইংল্যান্ডের মাটিতে বাংলাদেশ যখন ২০০৫ সালে খেলতে যায় তখন আশরাফুল বলেছিলেন যে হার্মিসন পায়ের সামনে থেকে বল তুলে অ্যাডজাস্ট করতেই সমস্যা হয়। আবার অ্যাডজাস্ট করে ফেললে স্ট্রোক খেলা যায়। প্রথম দুই টেস্টের পর বলা এই কথা যে তিনি ওয়ানডে টুর্নামেন্টে ভালোই কাজে লাগিয়েছিলেন সেটা বিশেষ করে ইংল্যান্ডের বিরূদ্ধে ৫২ বলে ৯৪ রানের ইনিংস দেখলেই বোঝা যায়। আশরাফুল ব্যাকফুটে গিয়ে হার্মিসনকে পুল করে ছক্কা মেরেছিলেন বেশ কয়েকটা।

পেস বোলিংয়ের কতগুলো যুগ আছে। সেই হ্যারল্ড লারউডের যুগ ছিল গতি, বাউন্স দিয়ে ব্যাটসম্যানকে ভয় দেখানো। এই ব্যাপারে পূর্ণতা আসে সত্তর-আশির দশকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিখ্যাত পেস কোয়ার্ট্রেটে! থিওরি খুব সহজ। শুধুমাত্র প্যাড-গ্লাভস পরা ব্যাটসম্যানটিকে বাউন্স আর পেস দিয়ে নাড়িয়ে দিতে থাকো তারপর হঠাৎ করে ইয়োর্কার দেও। ব্যাটসম্যানের সাধ্য নেই সেই বল খেলার। পা বাঁচাও নাহলে স্টাম্প বাঁচাও। ডেনিস লিলি সেই থিওরিতে সুইং যোগ করলেন। তবু ব্যাপারটাতে কিছুটা অপূর্ণতা ছিল।

অপূর্ণতা দূর হলো নব্বই দশকে টু ডাব্লিউর হাত ধরে। সরফরাজ নেওয়াজ, ইমরান খানেরা শুরু করেছিলেন। কিন্তু ওয়াসিম-ওয়াকার রিভার্স সুইং নামক শিল্পকে ব্যাটসম্যানদের কাছে আনপ্লেয়েবল করা শুরু করলেন। এই দুইজনের অভিধানে 'নাই' বলে কোন শব্দ ছিল না। দুই প্রান্ত থেকে দুইজনের একই ধরনের বোলিংয়ে ব্যাটসম্যানরা খাবি খাওয়া শুরু করলেন। ওয়াসিম সব পারতেন। ওভারের ৬টা বল ৬ রকমভাবে করতে পারতেন। ওয়াকারও ফুল পেসে ইন্সুইং ইয়োর্কার দেন। কিন্তু বোলিংয়ের দিক থেকে যে তারা পুরো অনন্য ছিলেন তা কিন্তু না। তারা অন্য সব বলগুলোই পারতেন। সবার চেয়ে ভালো পারতেন। অনেক অনেক ভালো পারতেন এই পার্থক্য। কিন্তু এই স্কিলের ব্যাপারটা পরবর্তীতে আরও এসেছে। ওয়াকারের কাজগুলো খুব স্বল্প সময়ের জন্য শোয়েব আখতারও করেছেন। আমিরের শুরুর সময়ে সে ব্যানানা সুইং করিয়ে "ওয়াসিমের চেয়েও ভালো" বলে মনে করাতো। আসিফও সুইং বোলিংয়ের প্রদর্শনী দেখিয়েছে নিয়মিতই।

ওইদিকে মোটামুটি অল্প তূণ দিয়ে সবচেয়ে বেশি কার্যকরিতা দেখিয়েছেন গ্লেন ম্যাকগ্রাথ, শন পোলক আর চামিন্ডা ভাস। খুব বেশি সুইং করাতে পারতেন না কেউই। এয়ার সুইংও নেই। কিন্তু ব্যাটসম্যানকে পড়তে পারার অসম্ভব ক্ষমতা আছে। বলের পর বল একই জায়গায় করে যাচ্ছেন। ব্যাটসম্যানকে পড়ে বল কিছুটা স্লোয়ার দিচ্ছেন, একটু ঢোকাচ্ছেন। ব্যাস, তাতেই ব্যাটসম্যান কুপোকাত। পরবর্তীতে নিজের সীমাবদ্ধতা বুঝে বল করার মতো এসেছেন জহির খান। ভারত দল থেকে ব্যাটসম্যানকে বোঝার ক্ষমতা কেবলমাত্র জহিরের ছিল।

অ্যালেন ডোনাল্ড থেকে ব্রেট লি, শোয়েব আখতার, শেন বন্ডরা এলেন আবার সেই গতি নিয়ে। তাদের বাউন্সে ব্যাটসম্যানদের নাক দিয়ে রক্ত ঝড়ে, ৯৫+ মাইলের বলে ইনসুইং খেলতে পারার সাধ্য কোন ব্যাটসম্যানের ছিল না। মালিঙ্গা এসে একটা জিনিস শুধু পরিবর্তন করলেন। তিনি টো-ক্রাশিং ইয়োর্কারের সাথে স্লোয়ার ইয়োর্কারও দিতেন। তবে সেটাও কিন্তু শোয়েব ইংল্যান্ডের সাথে ২০০৬ সিরিজে দেখিয়েছিল।

এরপরে গত ১০-১২ বছরে পরিপূর্ণ বোলার হয়ে এসেছেন শুধুমাত্র ডেল স্টেইন আর জেমস অ্যান্ডারসন। সুইং, ইয়োর্কার, বাউন্স সব দিতে পারেন।

এতোক্ষণ ধরে এতো কথা বলার কারণ গত ২৫ বছরে অন্তত ক্রিকেটে বোলাররা নির্দিষ্ট কিছু স্কিলের উপরেই কাজ করেছেন। পেস বোলিংয়ে যুগ পরিবর্তন অথবা ধারণা পরিবর্তনের কাজটা সর্বশেষ টু ডাব্লিউ করেছিলেন। এরপর সেইসব স্কিলকে আরও ভালো করা ছাড়া নতুন কিছু খুব কম বোলারই করতে পেরেছেন। কেউ খুব বেশি ভালো পারতেন, কেউ একটু কম। কেউ সীমিত দক্ষতা ব্যবহার করে ভালো করেছেন। কেউ তাদের অপার দক্ষতার সর্বোচ্চ ব্যবহারও করেছেন। কেউ আবার তাদের দক্ষতাকে নষ্টও করেছেন।

এই যুগের বোলিং পরিবর্তনের নতুন কারিগর হলেন মুস্তাফিজ! আমি অন্তত গত ২৫ বছরে এই ধরনের ধারণা পরিবর্তন করা বোলার দেখেছি বলে মনে করতে পারি না। "গতির মাস্টার" বললে অনেকগুলো "এক্সপ্রেস" এসেছেন। ওয়াকার থেকে ডোনাল্ড, ব্রেট লি, শোয়েব, বন্ড, টেইট, মালিঙ্গা। সুইং এর সুলতান তো ওয়াসিম। তারপর সুইং করিয়েছেন স্টেইন, অ্যান্ডারসন, বোল্টেরা পর্যন্ত। মিডিয়াম পেসেও মাস্টার পাবেন আপনি ম্যাকগ্রাথ, পোলক, ভাসকে। পেস-বাউন্সে অ্যামব্রোস-ওয়ালশ-মার্শালরা যা করেছেন সেটা মিচেল জনসন, মরকেলরা অনুসরণ করেছেন। এখন বলেন তো কাটার মাস্টার হিসেবে আপনি মুস্তাফিজ বাদে আর কারও নাম মনে করতে পারেন কিনা? নাই, নাই, নাই!

কাটার অবশ্য অনেকেই করেছেন। ওয়াসিম করতেন মাঝেমধ্যে। চামিন্ডা ভাস প্রায়ই করতেন। ডানহাতিদের মধ্যে ভারতের মুনাফ প্যাটেল ভালো কাটার করতেন। নাথান ব্র্যাকেন বেশ ভালো করতেন ওয়ানডেতে। কিন্তু তাদের কাটারের একটা নির্দিষ্ট ক্যাটাগরি ছিল। সেই একরকমের কাটারই তারা পারতেন। কিন্তু মুস্তাফিজের মতো পেসে এতো বৈচিত্র্য নিয়ে কাটার বোধকরি ক্রিকেট ইতিহাসে কেউই পারতেন না। অন্তত গত ২৫ বছরে যে কেউই পারেননি সেটা কোন সন্দেহ ছাড়াই বলতে পারি। তার রিস্ট পজিশন দুর্দান্ত, অবিশ্বাস্য। একই পজিশনে কিভাবে একটা বল ১২০, পরেরটা ১৩০ আর পরেরটা ১৪০ কিমি গতিতে যায় সেটা এক মুস্তাফিজ বাদে কেউই জানে না। নানা ধরনের ভিডিও দেখেও ব্যাটসম্যানেরা তা রিড করতে পারছেন না। সাথে যোগ হয়েছে এখন ইয়োর্কার দেবার ক্ষমতা। একটু শক্তি বাড়লে বাউন্সারগুলোও দুর্দান্ত হবে। পেসও ১৪৫ কিমি নিয়মিতই ক্রস করবে। আর বল জায়গামতো ফেলতে পারার সহজাত প্রতিভা নিয়ে "দ্যা ফিজ" জন্মেছেনই! সাথে এখন যোগ করুন লাক্সমান, ওয়ার্নার, ওয়াকার, মুডিদের এক কথা। ছেলেটার "ক্রিকেট ব্রেইন" অসাধারণ! এতো স্কিল থাকার পরেও ক্রিকেট ব্রেইন না থাকার কারণে অনেক বোলার ঝরে পড়েছেন। দ্যা ফিজের মধ্যে প্রায় সব আছে! টেস্টের জন্য মূলত আউটসুইং (ডানহাতিদের জন্য ভিতরে ঢোকা) বলটা শিখতে হবে। সানরাইজার্সে ওয়াকার নিশ্চয়ই তাঁকে ভিতরে ঢোকা বল শেখাবেন। একটা জিনিস সহজাতভাবে নেই তার মধ্যে সেটা হচ্ছে ব্যানানা সুইং। সামনে সাসেক্সে খেলতে যাবেন। সেখানে টেম্পারামেন্ট আর প্রফেশনালিজমের চূড়ান্ত অভিজ্ঞতাটা নিয়ে আসবে। যদিও সেটা ফিজের মধ্যে এখনই আছে।

সত্তরের দশক থেকে পেস বোলিংয়ের পরিবর্তন হয়েছিলো ক্যারিবিয়ান পেস কোয়ার্ট্রেটের হাত ধরে, তারপর নব্বইয়ের শুরুতে টু ডব্লিউ পেস বোলিংয়ে নতুন মাত্রা যোগ করেছিলেন। এরপর এই পরিবর্তনের মাত্রা আসতে পারে মুস্তাফিজের হাত ধরে! ভুবেনেশ্বর কুমার, বারিন্দ্রা সানেরা ফিজের কাছ থেকে এখন কাটার শিখে। ঠিক যেমন ইংলিশ বোলারেরা ওয়াসিম- ওয়াকারের কাছ থেকে কাউন্টিতে রিভার্স সুইং শিখতো। বোল্ট নিশ্চয়ই শিখছেন। বিশেষ করে বর্তমান যুগের টিটুয়েন্টিতে প্রতিপক্ষের রান ১৭০ থেকে ১৪০ এ নামিয়ে আনতে এই ভ্যারিয়েশন বোলিংয়ের কোন বিকল্প নেই।

আগামী দশ বছরে পেস বোলিংয়ে নতুন যুগের সূচনা হচ্ছে। পেস, বাউন্স, ইয়োর্কার, সুইং এর সাথে বোলাররা নিয়মিতই ব্যাটসম্যানকে ফক্স করতে থাকবে নানা ধরনের কাটার দিয়ে। নানা ধরনের স্লোয়ার কাটার-ফাস্টার কাটারে। "দ্যা ফিজ"-ই এই পরিবর্তনের সূচনাকারী!

আইসিসি যদি পিচটাকে একটু হলেও বোলারদের অনুকূলে বানাতো!

আর হ্যা, "দ্যা ফিজ"-কে দেখে রাখবার দায়িত্ব আমাদের সবার। বিসিবির, দর্শকদের, খেলোয়ারদের, তার পরিবারের- সবার!