মেসির জন্য ভালোবাসা
পোস্টটি ৭৮৯০ বার পঠিত হয়েছেশুরুর গল্পটা সবারই জানা। রোজারিওর এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম, এগার বছর বয়সে দুরারোগ্য হরমোন রোগে আক্রান্ত হওয়া, বার্সেলোনার ক্রীড়া পরিচালক কার্লোস রেক্সাসকে ট্রায়ালে মুগ্ধ করা, সাথে সাথে টিস্যু পেপারে সই করিয়ে নেওয়া। আর বাকিটা, যেমনটা বলা হয়... ইতিহাস।
নিজ দলের কোচ প্রিয় শিষ্যের ক্ষমতা বোঝাতে গিয়ে বিশেষণহীন হয়ে পড়েন, বিপক্ষ দলের কোচ ‘সে মানুষ না, প্লে-স্টেশনের খেলোয়াড়’ হিসেবে রায় দিয়ে দেন। কারো মতে জাদুকর,কারো মতে শিল্পী। কেউ বলেন মেসিডোনা, কেউ বলেন মেসাইয়াহ, যীশু। আর পাঁচ ফুট সাড়ে ছয় ইঞ্চির ছোটখাট ছেলেটা চিরকালের লাজুক চোখে শিশুর মতো কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে বলে —‘আমি আর কেউ না, আমি মেসি, শুধুই লিওনেল আন্দ্রেস মেসি।’
ম্যারাডোনা,পেলে,জর্জ বেস্ট,প্লাতিনি,জিকো,ডি স্টেফানো –এদের খেলা কখনো দেখা হয়নি।তবে দেখেছি সেরা ফর্মে থাকা রোনালদিনহোর বল পায়ে অলৌকিক কারুকাজ,জিনেদিন জিদানের মাখন মাখানো পায়ে বল কন্ট্রোল, আর্সেনালের অঁরি,বার্গক্যাম্পের দমবন্ধ করা সব গোল, ডি-বক্সের ভেতরের সেরা প্লেয়ার মোটু রোনালদোর ওভারস্টেপিং-এ গোলকীপারকে বোকা বানানো, বেকহামের ফ্রি-কিক...কিন্তু মেসি এই কয়েক বছরে নিজেকে যে উচ্চতায় তুলে নিয়ে গেছেন, সেটা বোধহয় স্পর্শের বাইরেই চলে যাচ্ছে।
রাতের পর রাত জেগে থাকি শুধু বাঁ পায়ের জাদুকরি কিছু মুহূর্ত দেখতে, ঢুলুঢুলু চোখে দেখি মাঠের ডান কোণা থেকে অদৃশ্য এক চুম্বক সাথে নিয়ে বল পায়ে এঁকেবেঁকে দৌড়, অবিশ্বাস্য বডি-ডজে মার্কারকে ছিটকে ফেলা, আলতো পরশে বল নিয়ে ভিনগ্রহের ক্লোজ-কন্ট্রোলে অল্প অল্প করে এগিয়ে যাওয়া,বুলেটের মত শটে হাওয়ায় ভাসিয়ে বা আচমকা মাটি-কামড়ানো শটে অদ্ভূত ফিনিশিং, গোলকীপারের সাথে হাতমেলানো দূরত্বে থেকে কীভাবে যেন (অন্য কোন বিশেষণ সম্ভব না) চিপ করে বল জালে জড়িয়ে দেওয়া... সংখ্যা,গোল,পরিসংখ্যান দিয়ে এই মেসির শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করা সম্ভব না। সে শুধু যে দেখে, সে-ই জানে।
মেসি কত গোল করেছেন, কত গোল করিয়েছেন; এসব কাগুজে হিসেব তাকে পরিসংখ্যানের ভাষায় হয়ত তাকে সেরা করে তুলবে, কিন্তু দিনের পর দিন এই ‘ছোট্ট যাদুকর’ এর দেখানো পায়ের যাদুকে কিভাবে বর্ণনা করবে ! গুরুত্বপূর্ণ সময়ে, গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে গোল করতে মেসির জুড়ি নেই। ২০০৯ এ বিশ্বক্লাব কাপ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইন্যালে ক্রস থেকে মাথা না ছুঁইয়ে সবাইকে বোকা বানিয়ে বুক দিয়ে গোল (যেটিকে কোচ গার্দিওলা পরে বলেছিলেন- ‘Messi Scored That Goal with His Heart’), দুইটি চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইন্যালে ম্যাচজয়ী গোল, প্রথম এল-ক্লাসিকোতেই হ্যাটট্রিক আছে তাঁর।
২০০৭-এ গেটাফের সাথে ৬২ মিটার দূর থেকে দৌড় শুরু করে, ছয়জনকে কাটিয়ে ম্যারাডোনাকে মনে করিয়ে দেয়া সেই গোল মেসির আগমনীগান শুনিয়েছিল সবাইকে।বার্সার মেরুন-নীল জার্সি গায়ে এর মধ্যেই ১৮৬ গোল হয়ে গিয়েছে তাঁর। ম্যান-টু-ম্যান মার্কিং করে কখনো মেসিকে আটকানো সম্ভব হয়নি, তাই ডিফেন্ডাররা একটু নির্মমই থাকেন মেসির প্রতি। কিন্তু কখনো ইচ্ছে করে পড়ে ফাউল আদায় করতে দেখিনি। প্রায় রাতে টিভিতে খেলা দেখে এসে স্ট্যাটাস দিতে হয়েছে আমার মত অনেককে, আমার চেয়ে বয়সে ২৮৭ দিনের ছোট এই ছেলেকে নিয়ে- Incrdible close control/Magical Touch/ You are Freak,You are Incrdible,You dare to Destroy/Impossible Messi/ The Little Magician.. এইসব বিভিন্ন বিশেষণে।
আমি বার্সেলোনা কিংবা আর্জেন্টিনা কোন দলেরই সমর্থক না, কিন্তু মেসি এমন মোহাচ্ছন্ন করে রাখে, যার খেলা দেখে মাঠে প্রবল প্রতিপক্ষেরও হাততালি দিতে ইচ্ছে করে।
নিন্দুকেরা কথা বলার,খুঁত ধরার কিছু উপলক্ষ্য খুঁজে নেন। ডান পায়ে জোর নেই,ভাল ফ্রি-কিক নিতে পারেননা, হেডে দুর্বল,জাভি-ইনিয়েস্তা আছে বলেই এমন খেলতে পারেন এবং আরো একজন খেলোয়াড়, যে তার সবটুকু দেয় ক্লাবের জন্য। ক্লাব ফুটবলে এখন নিজের শতভাগ নিংড়ে দিতে হয়। দেশের জন্য সবটুকু চাইলেও দেয়া যায়না অর্থের ঝনঝনানির এইযুগে এসে। এখন অনেকেই আছেন, যারা ডিফেন্ডার হিসেবে নিজের ক্যারিয়ার করার কথা ভাবেন। তাই গত কয়েক বছরে ফুটবলের সবটুকু সৌন্দর্য নিয়ে ফুটলেও আকাশি-নীল জার্সি গায়ে অনুজ্জ্বলতার এই বদনাম যায়না। এতে দোষ কিন্তু সহ-খেলোয়াড়দেরই বেশি।
নীল চোখের পাওলো মালদিনি কিংবা ‘ব্ল্যাক স্পাইডার’ লেভ ইয়াসিন কখনো বিশ্বকাপ পাননি। কিন্তু সর্বকালের সেরা একাদশে এই দুইজনের নাম না রাখলে আপনার ফুটবল-জ্ঞান নিয়েই প্রশ্ন উঠবে। এরকম উদাহরণ আরো প্রচুর। একটা বিশ্বকাপে চুমো দিতে পারলেই হয়ত মেসির অনেক দোষ ক্ষমা পেয়ে যাবে, বছরের পর বছর দর্শকের চোখে মুগ্ধতা ছড়িয়ে যাওয়া সার্থক হবে। এসব প্রশ্নের উত্তর হয়ত পরে মিলবে। সব ভবিষ্যতের জন্য তুলে রাখি।
কিন্তু মেসি যে জায়গায় সবাইকে ছাপিয়ে গেছেন, তা বুঝতে হলে একটা শব্দই যথেষ্ট : বিনয়। অন্য ফুটবলাররা যেখানে কিছু খ্যাতি,অর্থ পেলেই নারী,মদ,জুয়া,ড্রাগ এর নেশা, নাইট ক্লাবের উদ্দামতায় নিজেকে সঁপে দিতেন, দাম্ভিকতায় মাটির দু-এক ইঞ্চি উপর দিয়েই হাঁটতেন, সেখানে এই গ্রহের সেরা তারকা মেসির জীবন আশ্চর্য ব্যতিক্রম, যেন ‘ফুটবলের শচীন’।
ধন্যবাদ মেসি, এদেশের ফুটবলের সবচে সুন্দর সন্ধ্যা উপহার দেবার জন্য।
ধন্যবাদ, লিওনেল আন্দ্রেস মেসি, আমাদের প্রজন্মের সাথে বড় হয়ে ওঠার জন্য...
(২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকার বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে আর্জেন্টিনা বনাম নাইজেরিয়া খেলার পরে লেখা হয়েছিলো এটি)
- 0 মন্তব্য