আমার পর্তুগালবেলা
পোস্টটি ১৯৯৭ বার পঠিত হয়েছেপর্তুগালের সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয় স্কুলের সমাজ বইয়ে। অবাক হলেন নাকি? বিখ্যাত পর্তুগীজ নাবিক ভাস্কো ডা গামা ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ইউরোপিয়ান হিসেবে পা রেখেছিলেন এই উপমহাদেশে এটা পড়েননি? সঠিক মনে নেই, তবে তিনি যেদিক দিয়ে ঢুকেছিলেন সে জায়গাটা সম্ভবত এখন ভারতের গোয়া / পুনেতে অবস্থিত।
যা বলছিলাম। পরিচয় তো হলো। সেই পর্তুগালের প্রেমে পড়লাম ক্লাস সেভেনে থাকতে। ২০০০ সালের কথা বলছি। সময়টা তখন পর্তুগালের সোনালী প্রজন্মের। লুইস ফিগো, রুই কস্তা, নুনো গোমেজ, পেদ্রো পলেতা, হোয়াও পিন্টোসহ একঝাঁক তরুণের জয়গান তখন পর্তুগাল দলে। হল্যান্ড এবং বেলজিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়েছিল সেবারের ইউরো। অসাধারণ খেলছিল পর্তুগাল সেবার। ৩ ম্যাচে ৯ পয়েন্ট নিয়ে উঠে গেলো কোয়ার্টার ফাইনালে। গ্রুপপর্বে ইংল্যান্ডের সাথে প্রায় মাঝমাঠ থেকে ফিগোর নেওয়া এক জোরালো শটে ইংল্যান্ডের গোলকিপার ডেভিড সিম্যানের পরাস্ত হওয়া চোখে ভাসে এখনও। কোয়ার্টার ফাইনালে তুরস্ককে হারিয়ে পর্তুগাল চলে গেল সেমিতে। কিন্তু সেমির গেরো আর খোলা গেল না। বলা ভালো, খুলতে দিলেন না জিদান নামের এক অতিমানব। অতিরিক্ত সময়ে পেনাল্টি থেকে করা তাঁর গোলেই বিদায় হল পর্তুগাল।
দুই বছর পর। জাপান কোরিয়া বিশ্বকাপ। ইউরোতে যেভাবে খেলেছে সেরকম খেলতে পারলেও অনেকদূর যাওয়ার আশা করাই যায়। কিন্তু কোরিয়ার চোরামি আর নিজেদের দোষে সেবার দ্বিতীয় রাউন্ডেই উঠতে ব্যর্থ হল পর্তুগাল। কোরিয়ার চোরামির দোষ দিয়ে লাভ নাই অবশ্য। গ্রুপে কোরিয়া, পোল্যান্ড আর আমেরিকাকে পেয়েও উঠতে না পারলে সেটাতে নিজেদের ব্যর্থতাই বেশী। পোল্যান্ডকে হালি দিয়েছিল পর্তুগাল। পরেরদিন দৈনিক সংবাদে হেডলাইনই ছিলঃ অবশেষে ঝলসে উঠলো পর্তুগাল। পোল্যান্ডের সাথে জিতলেও আমেরিকা আর কোরিয়ার সাথে হেরে প্রথম রাউন্ড থেকেই বাড়ী ফিরতে হল সেবার।
আমার মনে পড়ে স্কুলে খুব বড়গলায় বলেছিলাম পর্তুগালের কথা। প্রথম রাউন্ডেই বিদায় নেয়ার পরে আমি আর বড়গলা ছোট হয়ে গেছিলো। :(
২ বছর পরে এলো সুবর্ণ সুযোগ। নিজের দেশ, নিজের মাঠ। হোম টিমের এডভান্টেজ নিতে হবে না? সেই মিশনে প্রথম ম্যাচেই গ্রীসের কাছে হার। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে একে একে রাশিয়া এবং স্পেনকে হারিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠলো পর্তুগাল। কোয়ার্টার ফাইনালে শ্বাসরুদ্ধকর এক টাইব্রেকারে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে সেমিতে ডাচদের বধ করলো তারা। ফাইনালে প্রতিপক্ষ আবার সেই গ্রীস।
সেবারে হয়তো জিতেই যেতো পর্তুগাল। কিন্তু মাউন্ট অলিম্পাস থেকে জিউস, হারমিস, পসাইডন, হারকিউলিসরা সেবারই নেমে আসার সিদ্ধান্ত নিলেন যে! স্বশরীরে নয় অবশ্যই, গ্রীসের খেলোয়াড়দের রূপে। (আহ! গ্রীকরা কখনোই ফেয়ার খেলেনা। বিশ্বাস হচ্ছে না আমার কথা? ট্রয়ের হেক্টরকে জিজ্ঞেস করে দেখুন না!) ফাইনালে পর্তুগালকে ১-০ গোলে হারিয়ে ইউরোপসেরা হল গ্রীস।
বছর দুয়েক পরের জার্মানি বিশ্বকাপ। ইরান, অ্যাঙ্গোলা আর মেক্সিকোকে নিয়ে ‘গ্রুপ অফ কমফোর্ট’এ পড়লো পর্তুগাল। :P রোনালদো তখন ফুল হয়ে ফুটে সৌরভ ছড়াতে শুরু করেছেন। ফিগোর ক্যারিয়ার গোধূলিলগ্নে। প্রথম রাউন্ড ভালোভাবে পার হলেও ঝামেলা শুরু হল দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে। দ্বিতীয় রাউন্ডে নেদারল্যান্ডের সাথে যে কুৎসিত ম্যাচটা হল তা পরিচিতি পেল ‘ব্যাটল অফ ন্যুরেমবার্গ’ নামে। কি হল না সে ম্যাচে? ১৬ হলুদ কার্ডের সাথে ৪ লাল কার্ড। তবে মানিশের গোলে জয় হল পর্তুগালেরই। (এই প্লেয়ারটাকে আমি ২০০৬ বিশ্বকাপের পরে আর কখনও দেখি নাই! :/ ) কোয়ার্টার ফাইনালে কাগুজে বাঘ ইংল্যান্ডকে টাইব্রেকারে হারালো পর্তুগাল। গোলকিপার রিকার্ডো একাই হয়ে দাঁড়ালেন চীনের প্রাচীর। <3 ইউ রিকার্ডো। ল্যাম্পার্ড আর জেরার্ডের শট ঠেকিয়ে পৌঁছে দিলেন সেমিফাইনালে।
সেমিফাইনালে খেলা পড়লো ফ্রান্সের সাথে। থিয়েরি অরিকে বাধা দেয়ায় পেনাল্টি পেল ফ্রান্স। হুদাই। পেনাল্টিটা ছিল না। বড়জোর ফ্রিকিক দেয়া যেতো। সাথে একটা হলুদ কার্ড। পেনাল্টি থেকে গোল করে ফ্রান্সকে এগিয়ে নিলেন জিদান। এরপর মুহুর্মুহু আক্রমণ চালায় পর্তুগাল। কি হল জানতে চান? পরেরদিনের প্রথম আলোর শিরোনামটাই যথেষ্ট। ‘খেলল পর্তুগাল, জিতল ফ্রান্স।’ :( :’(
২০০৭ থেকে ২০১১ সাল আমার জন্য প্রবল হতাশার একটা সময়। ২০০৮ ইউরোর সময় আমি ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। তখনও ইন্টারনেট মৌলিক চাহিদায় পরিণত হয়নি। খবরের কাগজই ছিল ভরসা। সেবার জার্মানির কাছ থেকে কোয়ার্টারেই বিদায় নিল পর্তুগাল। ২০১০ বিশ্বকাপের অবস্থা আরও খারাপ। ব্রাজিল, আইভরি কোস্ট আর উত্তর কোরিয়াকে নিয়ে গড়া গ্রুপ অফ ডেথ থেকে গ্রুপ রানার্সআপ হয়ে উঠলেও দ্বিতীয় রাউন্ডেই স্পেনের কাছে হেরে গেলো রোনালদোবাহিনী। দুষ্টু লোকেরা বলে ডেভিড ভিয়া নাকি যে গোলটা করেছিল সেটা নাকি অফসাইড ছিল। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে বলুন?
২০১২ ইউরো এলো। পর্তুগাল পড়লো মৃত্যুকূপে। একই গ্রুপে জার্মানি, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ড আর পর্তুগাল। প্রথম ম্যাচে জার্মানির সাথে হেরে খাদের কোণায়। ডেনমার্কের সাথে ২-০ গোলে এগিয়ে গিয়েও ২-২ এ সমতা এনে ফেলল ডেনমার্ক। ড্র করে ইউরো থেকেই যখন ছিটকে যাওয়ার উপক্রম তখনই ভারেলার গোল। ৩ পয়েন্ট। শেষম্যাচ শুধুই রোনালদো শো। যারা বলেন রোনালদো বিগ ম্যাচের খেলোয়াড় না, নেদারল্যান্ডের সাথে এই ম্যাচ তাদের জন্য মোক্ষম জবাব। ১ গোলে পিছিয়ে পড়ার পরে নেদারল্যান্ডের ডিফেন্সকে নিয়ে ছেলেখেলা করে দলকে নিয়ে গেলেন কোয়ার্টারে। নিজে করলেন জোড়া গোল।
কোয়ার্টারে চেক রিপাবলিককে পর্তুগাল হারাল ‘হেড’মাস্টার রোনালদোর একমাত্র গোলে। সেমিতে আবার সেই স্পেন। সেই ম্যাচও তো রোনালদো জিতিয়েই দিচ্ছিলেন প্রায়। পিকেকে বোকা বানিয়ে, ক্যাসিয়াসের মাথার উপর দিয়ে যে বলটা চিপ করে দিলেন সেটা যে গোল হবে তা নিয়ে কোন সন্দেহ ছিল না। কিন্তু উড়ে এসে জুড়ে বসলেন নানি। বল যেখানে ঢুকে যাচ্ছে জালে সেখানে নানি এগিয়ে আসায় অফসাইডের পতাকা উড়িয়ে দিলেন লাইন্সম্যান। রোনালদোর হাত-পা ছুঁড়ে সে কী নিষ্ফল আক্রোশ!!! কিন্তু কে জানতো, ৪ বছর পরে এই নানিই রোনালদোর জন্য জানপ্রাণ উজাড় করে দিয়ে খেলবেন!!! কাল বোধহয় নানির ৪ বছরের জ্বালা জুড়িয়েছে।
২০১৪’র বিশ্বকাপ। তার আগে যাওয়া যাক একটু বরং। বাছাইপর্বে গ্রুপে দ্বিতীয় হওয়ায় সুইডেনের সাথে প্লে অফ খেলতে হবে পর্তুগালকে। নিজেদের মাঠে তো ১-০ তে জেতা গেলো। কিন্তু সুইডেনের মাঠে ভয়ংকর হয়ে উঠলেন ইব্রাহিমোভিচ। ২ গোল করে সুইডিশদের স্বপ্নে লাগালেন রঙ। খেলার স্কোর তখন ২-১। পর্তুগাল এগিয়ে আছে শুধুমাত্র অ্যাওয়ে গোলের সুবাদে। কিন্তু সুইডেন যেভাবে খেলছে তাতে সেই অ্যাওয়ে গোলও যথেষ্ট মনে হচ্ছে না। সেসময়ই জ্বলে উঠলেন রোনালদো। হার জিনিসটা যার ভীষণ অপছন্দ। প্রথম গোলটা করেছিলেন। এরপরে আরও দুই গোল করে পূর্ণ করলেন হ্যাট্রিক, নিজে হাতে, দুঃখিত নিজে পায়ে দলকে নিয়ে গেলেন বিশ্বকাপে।
২০১৪ বিশ্বকাপ নিয়ে আর কিছু বলার নেই। আমার দেখা সবচেয়ে বাজে পারফরম্যান্স ছিল পর্তুগালের। তবে এখন মনে হয় ভালোই হয়েছে। নাহলে পাওলো বেন্টোকে সরিয়ে ফারনান্দো সান্তোসকেও আনা হতো না। আর সান্তোসকে না আনলে ২০১৬’র ১০ জুলাই রাতটাও ফিরে আসতো না।
২০১৬ ইউরো। আমি আমার দল নিয়ে জানতাম। তাই বেশীকিছু আশা করিনি। সেমি পর্যন্ত যেতে পারলেই খুশী ছিলাম। তবে এই গ্রুপ থেকেও যে তৃতীয় হয়ে উঠতে হবে সেটা কল্পনাতেও ছিল না। আরও কল্পনাতে ছিল না গ্রুপে তৃতীয় হয়েও শেষমেশ চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা। বাট ট্রুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন। আইসল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরির সাথে ড্র করে খোঁড়াতে খোঁড়াতে উঠলাম দ্বিতীয় রাউন্ডে। ক্রোয়েশিয়ার সাথে অতিরিক্ত সময়ের গোল, পোল্যান্ডের সাথে টাইব্রেকারে জয়। শুধু ওয়েলসকেই হারালাম নির্ধারিত সময়ের মধ্যে। কত সমালোচনা, কত কথা। পর্তুগাল বিরক্তিকর ফুটবল খেলছে, পর্তুগাল ইউরোর শিরোপা ডিজার্ভ করে না। সর্বশেষ বধ করলাম ফ্রান্সকে। এখন যতখুশী সমালোচনা করুন। কোন সমস্যা নেই। আপনাদের সমালোচনা রেকর্ডবুকে লেখা থাকবে না। লেখা থাকবে ২০১৬ সালের ইউরো চ্যাম্পিয়নের নাম।
নামটা পর্তুগাল।
পর্তুগাল তৃতীয় হয়ে ওঠার পরে এক ফুটবল গ্রুপের একজন জনৈক ফুটবলবোদ্ধা মন্তব্য করেছিল, “তৃতীয় হয়ে পরের রাউন্ডে যাওয়াটা নাকি অনেকটা মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসনের মতো।” তাকে বলছি, “‘সংরক্ষিত আসন’ থেকেই যদি চ্যাম্পিয়ন হওয়া যায়, তবে তাই ভালো।”
হ্যালো ফুটবলবোদ্ধা, আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন?
- 0 মন্তব্য