• ক্রিকেট

‘অস্ট্রেলিয়া দলের কাছে খোলা চিঠি’

পোস্টটি ২৩৮১ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

প্রিয় অস্ট্রেলিয়া দল,

ভালোবাসা নিও। এই পত্র হয়তো কখনোই তোমার কাছে পৌঁছাবেনা। তবুও লিখছি। ঠিকানাবিহীন খামে পাঠিয়ে দেবো এই পত্র।

‘কেমন আছো’ প্রশ্নটি করবোনা। আমি জানি তুমি ভালো নেই। একের পর এক হারে মন ভালো নেই তোমার, হতাশা ঘিরে ধরেছে দলের সবাইকে। কিন্তু হতাশ হলে তো চলবেনা। ঘুরে দাঁড়ানোর অন্য নামই যে অস্ট্রেলিয়া।

 

জানি ঘুরে দাঁড়ানোটা সহজ হবেনা। হয়তো আরও দুঃসময় অপেক্ষা করছে তোমার জন্য। তোমার অনেক ভক্তই এই সময়ে তোমাকে ছেড়ে চলে যাবে। তুমি কি নচিকেতার ‘নীলাঞ্জনা’, মাইলসের ‘প্রথম প্রেমের মতো’  গানগুলো শুনেছ? এই যাহ্‌! কি বোকার মতো প্রশ্ন করে ফেললাম। এগুলো তোমার শোনার কথা না। কিন্তু প্রথম প্রেমিকার প্রতি আবেগের ব্যাপারে তুমি অবশ্যই জানো। তুমি যে আমার প্রথম প্রেম, কিভাবে তোমাকে ছেড়ে চলে যাই বল।

 

তোমাকে ভালবেসেছি সেই ১৯৯৯ সালে। বিশ্বকাপে খাদের কিনারাতে পরে গিয়েছিলে তুমি। পাড়াপড়শির দল তোমাকে বাতিলের খাতায় ফেলে দিলেও আমি দেইনি। জানতাম ঘুরে দাঁড়াবেই। তোমার দলের কান্ডারি স্টিভ ওয়াহ কি অসাধারণ ব্যাটিং করলো দক্ষিন আফ্রিকার সাথে! গিবস যখন তাঁর ক্যাচটা ফেলে দিলো , তোমাকে বোঝাতে পারবোনা কি স্বস্তিটাই না পেয়েছিলাম আমি!

 

এরপর এলো এজবাস্টনের সেই সেমিফাইনাল। পরপর দুটি চার মেরে ক্লুজনার যখন তোমার করা স্কোরকে ছুঁয়ে ফেললো, স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম কিছু সময়ের জন্য। এই বুঝি ফাইনাল খেলার স্বপ্নটা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে। কিন্তু ডোনাণ্ডের সেই পাগলাটে দৌড় ধূসর হয়ে যাওয়া স্বপ্নকে পুনরজ্জিবিত করে তুলল। ফাইনালে অয়ানায়াসেই হারিয়ে দিলে পাকিস্তানকে। হাজার মাইল দূর থেকেও নিজেকে বিশ্বকাপ জয়ী দলের সদস্য মনে হচ্ছিলো। ভালোবাসা ব্যাপারটা কতটা তীব্র হতে পারে তখন বুঝতে পারছিলাম।

 

সময় বাড়ার সাথে সাথে ভালোবাসার গভীরতা বাড়তে থাকে। একটি ম্যাচও বাদ যেতোনা। স্কুল, কোচিং, পরীক্ষা কোনকিছুই বাধা হতে পারেনি। কত বোকা যে খেয়েছি! তুমি হয়তো শুনে হাসবে, তবুও বলি। একবার তোমাকে ‘ভুয়া দল’ বলেছিল একজন। জীবনে কখনো ঝগড়াঝাটি  না করা এই আমি পাক্কা এক ঘণ্টা তর্ক করেছি তার সাথে। আরেকটু হলে তো মারামারি লেগেই যেতো! বাসার সবাই বলতো এসব পাগলামি বাদ দিতে।

হুম পাগলামি তো বটেই। ভালবাসলে তো মানুষ একটু আধটু পাগলামি করেই, কি বল? তুমি যখন পুরো টুর্নামেন্ট অপরাজিত থেকে ২০০৩ সালের বিশ্বকাপ জিতলে, তখন তোমাকে ভুয়া দল বলা ওই মানুষটিকে আরেক দফা কথা শুনিয়ে এসেছিলাম, তার পছন্দের দল তো গ্রুপ পর্ব থেকে বাদ হয়ে গিয়েছিলো ওইবার।

ভালোবাসায় অপর নাম নাকি কষ্ট। ২০০৫ সালের অ্যাশেজ সিরিজ চলাকালে এই কথার বাস্তব রূপ দেখতে পেয়েছি আমি। ২য় টেস্টে যখন ২ রানে হেরে গেলে, কেঁদেকেটে একাকার করে ফেলেছিলাম। ব্রেট লির কান্নাভেজা চেহারা এখনো আমার বুকে কাঁটাতারের মতো বেঁধে। শেষ পর্যন্ত অ্যাশেজের সেই ছোট্ট ট্রফিটি আঠারো বছর পর হাতছাড়া হয়ে গেলো। হতবাকের মতো টিভির সামনে বসে ছিলাম। বিধ্বস্ত চেহারায় দাঁড়িয়ে আছে পন্টিং, ওয়ার্ন, গিলক্রিস্টরা, শিরোপা নিয়ে উল্লাস করছে শত্রুপক্ষ। দৃশ্যটা  আমার জন্য কতটা কষ্টের ছিল তা যদি তোমাকে বোঝাতে পারতাম...

দুঃসময়ের মেঘ এক না একদিন কেটেই যায়। মেঘের আড়ালে উঁকি দেয় আশার সূর্য। হতাশা ঝেড়ে ফেলে অদম্য গতিতে এগোতে থাকলে তুমি। পন্টিং এর নেত্রীত্তে তুমি আবারো হয়ে উঠলে ‘অজেয় অস্ট্রেলিয়া’। ২০০৭ এর ফিরতি অ্যাশেজে নিজেদের মাটিতে ইংল্যান্ডকে ধবলধোলাই করেই পুনরুদ্ধার করলে ‘ছাইদানি’। সেই বছরও অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হলে বিশ্বকাপে। আমার আনন্দ দেখে কে!! বন্ধুদের সাথে বাজি লেগেছিলাম, তুমি জিতবেই জিতবে। সেটায় জিতে গিয়ে মোটামুটি পকেট ভারী করে ফেললাম! সে বছরের বিশ্বকাপে তোমাদের সব ছবি পেপার থেকে কেটে সংগ্রহ করে রেখেছিলাম। মাঝে মাঝে বের করে স্মৃতিগুলো নতুন করে রোমন্থন করি।

‘যেতে নাহি দেবো হায়, তবু যেতে দিতে হয়’, পৃথিবীর এই এক নির্মম নিয়তি। তোমার দলের সেরা কিছু মানুষ অবসরে চলে গেলো সবাইকে কাঁদিয়ে। এতগুলো বছর ম্যাকগ্রা, গিলক্রিস্টরা ঢালের মতো তোমাকে রক্ষা করেছে সব ঝড় ঝাপটা থেকে। তাদের চলে যাওয়াতে তুমি বড় একটা ধাক্কা খেলে।

কবিগুরুর মতে, পুরনোকে পিছনে ফেলে নতুনদের আহ্বান জানানোই উত্তম। তোমার দলে এলো একঝাক নতুন টগবগে তরুন। কিন্তু কোথায় যেনও সুরটা কেটে গিয়েছিলো। একের পর এক সিরিজ হারে জর্জরিত তোমাকে অসহায় আত্মসমর্পণ করতে দেখে খুব বেশি কষ্ট লাগতো। ২০১১ সালে ভারতের কাছে হেরে বিদায় নিলে বিশ্বকাপ থেকে। অভিমান করে খেলা ছেড়ে চলে গেলেন পন্টিং ও। সত্যি বলতে কি, তখন ভেবেছিলাম আর হয়তো তোমার অজেয় রূপটাকে দেখতে পারবোনা।

কথাটা শুনে রাগ করলে? ভাবছ এই আমার ভালোবাসা? কি করবো বলও, সত্যিই অনেক বেশি হতাশ হয়ে গিয়েছিলাম। তবুও খেলাগুলো দেখতাম বসে বসে। একটু একটু করে নিজেদের পুরনো রূপ পেতে শুরু করো তুমি। দলের বেশকিছু খেলোয়াড় মনে করিয়ে দিতো তোমার স্বর্ণযুগের সদস্যদের কথা।

২০১৫ সালের বিশ্বকাপ। নিজ দেশে বিশ্বকাপ ট্রফি জিতে আবারো সিংহাসন দখল করলে দাপটের সাথেই। স্মিথ, ম্যাক্সওয়েল, স্টার্কদের চোখ ধাঁধানো পারফর্মেন্সে বাকিরা কেও পাত্তাই পেলোনা। অস্ট্রেলিয়া জিতল অস্ট্রেলিয়ার মতোই!

অনেক কথা বলে ফেললাম। আজ তোমার টেস্টের সিংহাসন রক্ষা লড়াই। উপমহাদেশে টানা আট ম্যাচ হেরেছ তুমি, স্পিনে একেবারেই নাজুক অবস্থা দলের  ব্যাটসম্যানদের। কিন্তু হতাশ হওয়ার কিছু নেই। ভরশা রাখো, আগেও তুমি ফিরে এসেছ রাজার মতো। এবারো পারবে। শুধু একটুখানি ধৈর্য ধরো। মনে আছে স্টিভ ওয়াহ কি বলেছিল, “ খেলা শেষ হওয়ার আগে অস্ট্রেলিয়া হারেনা”।

মনে রেখো, তুমি হেরে গেলেও তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা একবিন্দুও কমবেনা। ভালোবাসি…...

ইতি

ফাহিম