• ফুটবল

ও ফেনোমেনন, মাই ফেনোমেনন!

পোস্টটি ২৩২৮৬ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

তখনও ফুটবলের সাথে গাঁটছড়া অতটা মজবুত হয়নি, ইউরোপিয়ান লীগে মজে থাকার সময়টা এসেছিল আরো পরে। পত্রিকা মারফতই খবর যা একটু রাখা হত। সে সময়টাও বেশ আগের, তখন প্রাইমারি স্কুলের চৌকাঠ পার হইনি। এমন সময় শুরু হয়ে গেল বিশ্বকাপ ফুটবল। ফ্রান্সে ওই আসরের শুরু থেকেই টেকো মাথার দোহারা গড়নের এক খেলোয়াড় নিজের জাত চিনিয়ে দিচ্ছিল। ব্রাজিল সমর্থকদের চোখের মণিতে পরিণত হতেও খুব বেশি সময় লাগল না। ক্ষিপ্রগতির সাথে পেনাল্টি বক্সে দুর্দান্ত ফিনিশিং এর কারণে বাকিদের থেকে সহজেই তাঁকে আলাদা করে যেত। এর মধ্যে ব্রাজিলও তরতর করে ফাইনালে উঠে গেল। প্রতিপক্ষ ফ্রান্স, আর সাথে স্বাগতিক দেশের স্বতঃস্ফূর্ত দর্শক সমর্থন। ব্রাজিলের পাঁড় সমর্থক আমার বাবার মত বাংলাদেশের লাখো ব্রাজিল ভক্ত তখন এককাট্টা , টানা দ্বিতীয়বারের মত শিরোপা এবার ঘরে না এসেই পারেনা। আর তুরুপের তাস ফর্মের তুঙ্গে থাকা রোনালদো তো ছিলই। কিন্তু সব আশায় জল ঢেলে দিয়ে ফাইনালে নায়ক হয়ে গেলেন আরেক জীবন্ত কিংবদন্তী, জিনেদিন জিদান। ওই ম্যাচের আগে রোনালদোর কী হয়েছিল, সেটা এখনো অমীমাংসিত একটা রহস্য। এমনও শোনা যায়, তখনকার কোচ মারিও জাগালোর কথা একরকম অমান্য করেই মাঠে নেমেছিলেন রোনালদো।  কিন্তু পুরো মাঠে নিজের ছায়া হয়েই রইলেন। ব্রাজিলকে ধরাশায়ী করে বিশ্বকাপ গেল লা ব্লুজদের ঘরে।

মূলত তখনই রোনালদো নিয়ে আমার মুগ্ধতার শুরু। তার আগেই অবশ্য বার্সেলোনা থেকে রেকর্ড পরিমাণ ট্রান্সফার ফি তে ইন্টার মিলানে (১৯৯৭ সালে) আসার খবরও আমার অজানা নয়। ইতালিয়ান ফুটবলের রাজপথটা তখনও ঠিকঠাক চেনা হয়ে ওঠেনি, ফলে খবরের পাতায় রোনালদোর কেরদানির কথা পড়েই মন ভরাতে হত। এর মধ্যেই অবশ্য ইনজুরির সাথে মিতালী বেশ জমে উঠেছে। ইন্টারে কতবার শল্যবিদের ছুরির নিচে যেতে হয়েছে, সেটা বোধ হয় রোনালদোর নিজেরই হিসাব নেই। তবে দীর্ঘদিন মাঠের বাইরে থাকার কারণে বিস্মৃতির গর্ভ তলিয়ে যাওয়ার যে সূক্ষ্ণ আশঙ্কা ছিল সেটি অচিরেই ভুল প্রমাণ করলেন। সময়টা ২০০২ সাল। এশিয়ার মাঠে প্রথমবারের মত বিশ্বকাপের আসর। একদিকে শিরোপাধারী ফ্রান্স, আর হট ফেভারিট আর্জেন্টিনার ভীড়ে সেলেকাওদের সেভাবে হয়তো অনেকে গোণায় ধরেননি। পরের ইতিহাসটা অবশ্য সবার জানা। রোনালদো যেন এলেন, দেখলেন আর জয় করলেন। নিজে সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়ার পাশাপাশি দলকেও এনে দিলেন বহুল আরাধ্য পেন্টা। আগের বিশ্বকাপের দুঃসহ স্মৃতিকেও দারুণভাবে ধামাচাপা দিলেন।

২০০২ সাল অবশ্য রোনালদোর জন্য আলাদাভাবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এই বছরেই যে রিয়ালের নক্ষত্ররাজির আরো একটি জ্বলজ্বলে তারা হিসেবে নিজের নাম লেখালেন। খুব সম্ভবত কোনো নির্দিষ্ট ম্যাচে নিজের সেরাটা দেখিয়েছিলেন এর পরেই। ২০০৩ চ্যাম্পিয়ন্স লিগের নক-আউট স্টেজে ওল্ড ট্রাফোর্ডে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে দুর্ধর্ষ ওই হ্যাটট্রিক ছিল বহুদিন চোখে লেগে থাকার মতো। পরের বছরগুলোতে রিয়ালে তার থাকাটা খুব একটা সুখকর হয়নি। ফেরারীর মত ধাওয়া করা সেই ইনজুরি তো ছিলই, সেই সাথে বল্গাহীন ওজন এবং মাঠের বাইরের উটকো সব কারণে তিনি নিয়মিতই সংবাদের শিরোনাম হতে থাকেন। ফলাফল, কোচের গুডবুক থেকে তার নাম কাটা পড়ার দশা হয়। এর মধ্যেই এসে যায় আরেকটি বিশ্বকাপ।

এইবার তাকে দলে নেওয়া নিয়ে বেশ একচোট সমালোচনা হয়ে যায়। ততদিনে তিনি বেশ মুটিয়ে গেছেন, বেঢপ শরীরে তাকে চেনা হয়ে পড়ে দায়। তারপরও ধারে না কাটলেও ভারে নিশ্চয় কাটবেন, এমন আশায় কোচ পাহেইরা তাকে দলে রাখেন। কোচের আস্থার প্রতিদান তিনি এবার আর সেভাবে দিতে পারলেন না। ব্রাজিলের হেক্সা স্বপ্নও কোয়ার্টার ফাইনালে মুখ থুবড়ে পড়ে। এখনো আমার মনে পড়ে, ওইবার স্থূলদেহের রোনালদো বলের পেছনে দৌড়াতে যেভাবে গলদঘর্ম হচ্ছিলেন, ফুটবলভক্তদের জন্য বোধ হয় এর চেয়ে হতাশার কিছু হওয়া কঠিন।  তারপরেও বিশ্বকাপের ইতিহাসে নিজের নামটাকে পাকাপাকিভাবে খোদাই করার ভুল তিনি করেননি। গার্ড মুলারকে ছাড়িয়ে রোনালদো হয়ে যান বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি গোল করা খেলোয়াড়। পরে অবশ্য ক্লোসা সেটি পেরিয়ে গেছেন। এর মাঝে ক্লিন্সমানের পরে টানা তিন বিশ্বকাপে কমপক্ষে তিন গোল করা খেলোয়াড়ও হন তিনি।

এরপরের সময়টাকে আমি বিস্মৃতির সময়ই বলব। রিয়াল থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে খুব তাড়াতাড়ি তিনি এসি মিলানে চলে আসেন। ইতিমধ্যে ফর্মহীনতা,ওজন সমস্যার সাথে সেই পুরনো শত্রু ইনজুরির সাথে তার লড়াই চলতে থাকে। এদিকে মেঘে মেঘে বেলাও কম গড়াল না,  আরেক রোনালদোর আবির্ভাবে একে একে সবাই তাকে ভুলতে বসে। সত্যি বলতে কী, এরপর নিজের আসল ফর্মের ধারেকাছেও তিনি কখনও যেতে পারেননি। তাই ও নিয়ে কথা আর না বাড়াই। তবে তিনবারের ফিফা ফুটবলার অফ দ্য ইয়ার, বিশ্বকাপ ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতা, ইন্টার-মিলান বা রিয়াল-বার্সার মত অবিস্মরনীয় দ্বৈরথগুলোর মুদ্রার দুপিঠ থেকেই দেখতে পারার দুর্লভতম অভিজ্ঞতা আর কার আছে? ক্লাবের হয়ে ৫১৫ ম্যাচে ৩৫২ গোল বা দেশের হয়ে ৯৭ ম্যাচে ৫২ গোল, এসব পরিসংখ্যানও নিঃসন্দেহে ঈর্ষাজাগানিয়া। তবে রেকর্ড অনেক কথাই বলবে, তবে আমি নিজে অন্তত তাকে মনে রাখব ডিফেন্সচেরা থ্রু গুলো আঁচ করতে পারার বিরলপ্রজ স্ট্রাইকিং ইন্সটিংক্ট, মার্কারদের ছিটকে ফেলার দারুণ ক্ষমতা, পেনাল্টি বক্সে চিতার মত ক্ষিপ্রতা, দুপায়েই শট নেওয়ার দক্ষতা এবং অসাধারণ ফিনিশিংয়ের কারণে। আমাদের সময়ে বিশ্ব ফুটবলে সবচেয়ে বড় মঞ্চে তার মত আর কেউ বোধকরি নিজেকে মেলে ধরতে পারেনি। এর মধ্যেই আরো অনেক স্ট্রাইকার আসবে, অনেকে গোলের তুবড়ি ছোটাবেন। কিন্তু দ্য ফেনোমেনন আদপে একজনই।

 

১৯৯৮ সালে উয়েফা কাপ, মুখোমুখি ইন্টার মিলান-লাতসিও। একদিকে সময়ের সেরা স্ট্রাইকার রোনালদো, আরেক দিনে সময়ের সেরা ডিফেন্ডার আলেসান্দ্রো নেস্তা। কিন্তু লড়াইটা হলো একদম একপেশে, নেস্তাকে পুরো ম্যাচে তুর্কি নাচন নাচালেন রোনালদো। ওই ম্যাচে এক গোল করেছিলেন, কিন্তু গোল দিয়ে ঠিক তাঁর প্রভাবটা বোঝা যাবে না। নেস্তা পরে ম্যাচটার ভিডিও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছিলেন, তাঁর গলদটা কোথায় হলো। কিন্তু পরে বুঝলেন, রোনালদো এতোটাই ভালো ছিলেন, তাঁর ভুল করারই সুযোগ ছিল না!

 

এই হচ্ছে রোনালদো। তাঁর মতো কেউ আসেনি, হয়তো আর কেউ আসবেও না।

 

(পূর্বে অন্যত্র প্রকাশিত এবং পরিমার্জিত)