• ফুটবল

আমি ব্রাজিলকে কাঁদিয়েছিলাম

পোস্টটি ৬১৬৮ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

Paolo-Rossi-v-Brazil-1982-World-Cup.

‘ফেবারিট’ তকমাটা ইতালি নামের পাশে বলতে গেলে কখনোই থাকে না, তা ইউরো হোক আর বিশ্বকাপই হোক। অবশ্য তকমা ছাড়াই যদি চারবার বিশ্বকাপ এবং একবার ইউরো জেতা যায়, তাহলে তা-ই সই! এই চারবারের মধ্যে খুব সম্ভবত ইতালীয়দের কাছে সবচেয়ে স্মরণীয় হবে ’৮২ বিশ্বকাপ। ’৩৮ বিশ্বকাপ জেতার পর ‘আজ্জুরি’রা ফাইনাল খেলে ’৭০ বিশ্বকাপে। দীর্ঘ ৩২ বছর অপেক্ষাটা অবশ্য মধুর হয়নি একেবারেই। সেবার ইতালীয়দের হারিয়ে তৎকালীন ‘জুলে রিমে’ চিরকালের জন্য নিজেদের করে নেয় টোস্টাও, পেলেদের ব্রাজিল। এর প্রায় এক যুগ পর, স্পেন বিশ্বকাপে হয় ইতালীয়দের শাপমোচন। ’৮২ বিশ্বকাপ, যাকে মানুষ এখনো এক নামে  ‘পাওলো রসির বিশ্বকাপ’ হিসেবে চেনে।

 

১৯৫৬ সালে তাসকানি প্রদেশে জন্ম নেওয়া রসির ক্যারিয়ারটা শুরু হয় মিডফিল্ডার হিসেবে। কিন্তু মধ্যমাঠ নিয়ন্ত্রণের চেয়ে আক্রমণভাগে অংশ নেওয়ার প্রবণতা দেখে তাকে আক্রমণভাগে খেলানোর সিদ্ধান্ত নেন ভিসেঞ্জোর কোচ ফাব্রি। প্রথমে উইঙ্গে শুরু করলেও নিজের গোল এবং অ্যাসিস্ট করার ক্ষমতা দিয়ে পুরোদস্তুর স্ট্রাইকারে পরিণত হন রসি। ক্লাব ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন জুভেন্টাসে। কিন্তু তিন তিনবার হাঁটুর গুরুতর ইঞ্জুরিতে পড়ায় প্রথম আট বছরে তুরিনের বুড়িদের হয়ে খেলেছেন হাতেগোনা কিছু ম্যাচ। ধারে খেলে বেড়িয়েছেন কোমো, ভিসেঞ্জোর মত দ্বিতীয় বিভাগের ক্লাবগুলোতে। ভিসেঞ্জোতে প্রথম মৌসুমেই ২১ গোল করে দলকে নিয়ে আসেন সিরি এ-তে। সিরি এ-তে নিজের প্রথম মৌসুমে করেন ২৪ গোল। এই সুবাদে পরপর দুই মৌসুমে ইতালীয়ান লিগের দুই বিভাগে টপস্কোরার হওয়া একমাত্র খেলোয়াড় বনে যান এই স্ট্রাইকার।

 

ভিসেঞ্জোতে ধারাবাহিক পারফরম করার সুবাদে প্রথমবারের মত ডাক পান ইতালীর জাতীয় দলে। কোচ এনজো বেয়ারজট হীরে চিনতে ভুল করেননি। ১৯৭৭ সালে জাতীয় দলে অভিষেকের পর সুযোগ পান ’৭৮-এর বিশ্বকাপ স্কোয়াডে। সেবার ৩ গোল, ৪ অ্যাসিস্ট করে ইতালির সেমিফাইনালে যাওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখেন রসি। ইতালি চতুর্থ হলেও টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন রসি। ইঞ্জুরির ছোবল থেকে ফিনিক্স পাখির মত পুনরোত্থানে জয় করে নেন সমর্থকদের মন। কিন্তু হায়!  রসির জন্য তখনো অপেক্ষা করছিলো ক্যারিয়ারের সবচেয়ে অন্ধকার অধ্যায়।

 

ভিসেঞ্জোতে দুটি সফল মৌসুম কাটানোর পর নাপোলি চোখ পড়ে রসির ওপর। কিন্তু নেপলসে পাড়ি না জমিয়ে রসি ধারে চলে যান পেরুজিয়াতে। ১৯৮০ সালে অ্যাভেলিনোর সাথের ম্যাচে ঘুষ নেওয়ার গুজব রটে রসির নামে। তদন্তের পর সবধরণের ফুটবল থেকে তিন বছরের জন্য নিষিদ্ধ হন সবার প্রিয় ‘পাবলিতো’। যদিও আজ পর্যন্ত ঘুষ নেওয়ার কথা অস্বীকার করে আসছেন এই কিংবদন্তী স্ট্রাইকার। নিষেধাজ্ঞার পরও ভেঙ্গে পরেননি রসি। তিন তিনবার হাঁটুর ইঞ্জুরিতে হার মানিয়ে, ডাক্তারদের হুঁশিয়ারী তোয়াক্কা না করে ফুটবল ও সমর্থকদের টানে ফিরে আসা ‘গ্ল্যাডিয়েটর’ যে নিষেধাজ্ঞায় ভেঙ্গে পড়বেন না, তা-ই বরং স্বাভাবিক। অন্ধকারের কালমেঘের মাঝে সূর্যকিরণ হয়ে আসলো আপিলের রায়। তিন বছরের নিষেধাজ্ঞা কমে হল দুই বছরের। রসি এটাই চাচ্ছিলেন। কারণ, তিন বছর হলে তাকে যে ’৮২ বিশ্বকাপ দর্শক হয়েই কাটাতে হত!

 

’৮২ বিশ্বকাপের ঠিক আগে আগে শেষ হয় রসির নিষেধাজ্ঞা। ফুটবলে ফিরে আসলেও ইতালীয়দের এককালের চোখের মণি সিংহভাগ ইতালীয়র চক্ষুশূলে পরিণত হন। খেলার মধ্যে না থাকায় ফিটনেস এবং আগের ধার হারানো রসিকে বিশ্বকাপ স্কোয়াডে নিয়ে সমগ্র ইতালির তুমুল সমালোচনার সম্মুখীন হন এনজো বেয়ারজট। কেউ পাশে না থাকার পরও ঠিকই রসির পাশে ছিলেন এই ইতালীয় কোচ। সেই ’৮২ থেকে আজ অব্দি এই কোচের প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই রসি। এমনকি এনজোকে ইতালি জাতীয় দলের ‘সর্বকালের সেরা কোচ’ হিসেবেও অভিহিত করেছেন পাওলো। কোচের আস্থার প্রতিদান ঠিকই দিয়েছিলেন রসি। ’৮২ বিশ্বকাপের আগে সমগ্র জাতির চক্ষুশূল এবং সমালোচনার পাত্র এই জুটিকে আজো পরম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে ইতালিবাসী।

 

স্পেন বিশ্বকাপের গ্রুপপর্বে পোল্যান্ড, পেরু, ক্যামেরুনের মুখোমুখি হয় ইতালি। সহজ ড্র পেলেও একেবারেই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে গ্রুপপর্ব পার হন রসিরা। গ্রুপপর্বের তিন ম্যাচে ইতালি জাল খুঁজে পায় মাত্র দুবার। দ্বিতীয় রাউন্ডে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনার মুখোমুখি হয় ইতালি। আর্জেন্টিনাকে ইতালি ২-১ গোলে এবং ব্রাজিল ৩-১ গোলে হারালে ইতালি-ব্রাজিল ম্যাচটি দাঁড়ায় নকআউট হিসেবে। জিতলেই সেমিফাইনাল নিশ্চিত-এমন সমীকরণের সামনে দাঁড়িয়ে রসি ফুটবলবিশ্বকে উপহার দেন সর্বকালের অন্যতম সেরা হ্যাটট্রিক।

 

'৮২ বিশ্বকাপ শুরুর আগে রসিকে তার প্রিয় বন্ধু গুস্তাভো উপহার দেন একটি লাল-সাদা লকেট। অন্যকোনো ম্যাচে না পড়লেও প্রিয়বন্ধুর কথা মনে করে লকেটটি পড়েই খেলতে নামেন রসি। ম্যাচের মাত্র পাঁচ মিনিটেই ইতালিকে এগিয়ে নেন রসি। কিন্তু মাত্র ৭ মিনিট পরেই সক্রেটিসের গোলে ম্যাচে ফেরে ব্রাজিল। প্রথমার্ধের শেষভাগে আবারো ইতালিকে এগিয়ে দেন রসি। কিন্তু ৬৮ মিনিটে আবারো সমতায় ফেরে ব্রাজিল; এবার গোল করেন ফ্যালকাও। ড্র হলে বেশি গোল করার জন্য সেমিতে যাবে ব্রাজিল। কিন্তু রসি এত সহজে হার মানার পাত্র নন। ৭৪ মিনিটে আসে রসির শাপমোচনের মাহেন্দ্রক্ষণ। তারদেল্লির দূর্বল শট ভাগ্যক্রমে খুঁজে পায় রসিকে। মাত্র ৬ গজ দূর থেকে নেওয়া শটে নিজের হ্যাটট্রিকের পাশাপাশি দলকে তৃতীয়বারের মত লিড এনে দেন ‘পাবলিতো’। ব্রাজিলের আর ম্যাচে ফেরা হয়নি। অনেকের মতে এটিই ছিল সর্বকালের সেরা বিশ্বকাপ ম্যাচ। রসি তো ম্যাচটিকে এই শতাব্দীরই সেরা ম্যাচ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। সেমিতে পোল্যান্ডকে ২-০ গোলে হারায় ‘আজ্জুরি’রা। জোড়া গোল করেন রসি। আর ফাইনালে জার্মানীকে ৩-১ গোলে হারিয়ে ৪৪ বছর পর আবারো বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয় ইতালি। নায়ক? সেই ‘চক্ষুশূল’ পাওলো রসি...

 

’৮২ বিশ্বকাপে করেন ৬ গোল, জেতেন গোল্ডেন বুট এবং গোল্ডেন বল। ঐ সালেই ফিফার বর্ষসেরা ফুটবলার হন রসি। ইতালির বিশ্বকাপ ইতিহাসে এখনো সর্বোচ্চ গোল তার(৯)। গারিঞ্চা, কেম্পেসের পর মাত্র তৃতীয় খেলোয়াড় হিসেবে একই বিশ্বকাপে টপস্কোরার ও সেরা খেলোয়াড় হন পাওলো রসি।

 

বিশ্বকাপের পর ‘৮২-‘৮৩ মৌসুমে জুভেন্টাসকে ইতালীয়ান কাপ জেতান রসি, করেন ৫ গোল। তার ৬ গোলের সুবাদে ঐ মৌসুমে ইউরোপীয়ান কাপের রানারআপ হয় তার দল জুভেন্টাস। ৮৩-৮৪ মৌসুমে জেতেন ইতালীয়ান লিগ, ইউয়েফা সুপার কাপ ও ইউয়েফা কাপ উইনার্স কাপ। জুভেন্টাসে নিজের শেষ মৌসুমে এসে জেতেন ইউরোপীয়ান কাপ। এসি মিলান ও হেলাস ভেরোনাতে একটি করে মৌসুম খেলে ইতি টানেন ক্লাব ক্যারিয়ারের। ১১ মে, ১৯৮৭ সালে চীনের বিপক্ষে এক প্রীতি ম্যাচ দিয়ে বিদায় জানান জাতীয় দলকে। শেষ ম্যাচে সমগ্র স্টেডিয়ামের ‘রসি! রসি!!’ চিৎকারে ভারী হয়ে উঠেছিল নেপলসের আকাশ। বলা বাহুল্য, নিজেদের প্রিয় সন্তানের দোষ ক্ষমা করে দিয়েছে ইতালিবাসী।

 

ছিল না ক্ষীপ্রগতি বা অসামান্য শারীরিক শক্তি। দেখতে আর দশটা ইতালীয় জোয়ানের মতই ছিলেন রসি। ক্লাব ক্যারিয়ারে মোটে ১০৩ গোল। ইতালীর হয়ে ৪৮ ম্যাচে ২০ গোল। এই অতি সাধারণ শারীরিক গঠন এবং সাদামাটা রেকর্ডধারী পাওলো রসিই গড়েছেন খুব সম্ভবত ইতালির ফুটবল ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ ফুটবলীয় কাব্যগাঁথা। ‘বিগ ম্যাচ প্লেয়ার’ উপাধিটা তার চেয়ে আর কারো সাথেই বোধহয় এভাবে খাপে খাপ মিলে যায় না। এমনকি এসি মিলানে যে দুটি গোল করেছিলেন, সে দুটিও এসেছিল তাদের চিরশত্রু ইন্টার মিলানের বিপক্ষে।

 

একদিন রসি চলে যাবেন না ফেরার দেশে, কিন্তু তার কিংবদন্তী ঠিকই থেকে যাবে। ফুটবলের কেতাবী পরিসংখ্যান ছাপিয়েও মানুষ তাকে মনে রাখবে ভস্ম থেকে মাথা উঁচু করে পুনর্জন্ম নেওয়া সেই ফিনিক্স পাখি হিসেবে, যে কাঁদিয়েছিলো ব্রাজিলের সর্বকালের সেরা দলকে। যে কাঁদিয়েছিলো ‘জোগো বোনিতো’ আবিষ্কার করা সমগ্র জাতিটিকে...