যুদ্ধের উইকেটে অমর তাঁরা
পোস্টটি ৬২৮৩ বার পঠিত হয়েছেনখ কামড়ানো উত্তেজনার শেষ ওভারে ব্যাটসম্যান একটা চার মারলেন। গ্যালারিতে চিৎকার, উৎসব বা হতাশা। কিন্তু খেলা কি আবার সাথে সাথেই শুরু হয়? না। বোলিং দলের ক্যাপ্টেন গিয়ে বোলারের সাথে কিছু কথাবার্তা চালাবে, কিংবা দুই ব্যাটার মাঝ-পিচে এসে হয়তো একটু স্ট্র্যাটেজি ঠিক করে নিলো। এই লম্বা সময় ধরে দর্শকেরা করবেটা কী, টিভির সামনে অথবা স্টেডিয়ামে বসে? তাদের উত্তেজনার পারদ চড়বে। সেই পারদের গতি দ্রুততর হবে যদি ব্যাটার বা বোলারদের কেউ বলবার মতো কোনো স্লেজিং বা উদযাপন বা ঘটনার জন্ম দিয়ে বসে। এসব হলে সংখ্যার বাইরে ম্যাচের গল্পটায় আরো রঙ যোগ হয়। কারণ দিন শেষে বল আর ব্যাটের প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফাঁক গলে, ক্রিকেট কিন্তু গল্পেরও খেলা। ক্যাচ ফেলে দেয়ায় হার্শেল গিবসকে স্টিভ ওয়াহ কী বলে এলেন, তা না জানলে কী হয়? কিচ্ছু না। খেলার মাঠে ঢুকে পড়া দর্শককে আগলে মাশরাফি বিন মর্তুজা পরিসংখ্যানের খাতায় কি কোনো রান বা উইকেট যোগ করেন? না, তাও না।
তবু এইসব টুকরো ঘটনা, মাঠে বা মাঠের বাইরেও, ক্রিকেটকে কেবল রান আর উইকেটের সীমায় আটকে রাখে না। ক্রিকেট হয়ে ওঠে জীবনেরও গল্প। লিকলিকে এক কিশোর, দিনের বেলা কয়লাখনিতে কাজ করে সে হয়তো রাতের আঁধারে দেয়ালে উইকেট এঁকে বল ছুঁড়ে যায় ক্রমাগত। গল্প হয়ে গেলে, সেই ছেলেটাই দারিদ্র্য আর কয়লাখনির অন্ধকার পেছনে ফেলে হয়ে ওঠে হ্যারল্ড লারউড - ব্রাডম্যান নামের অট্টালিকার ভিত্তিও নড়ে যায় তার ধাক্কায়। এসব গল্প না থাকলে, ক্রিকেট আর ক্রিকেট থাকলো কোথায়?
১৯৩৬-৩৭ মৌসুমের অ্যাশেজ সিরিজের শেষ টেস্টের স্কোরকার্ড, আমাদের এরকম একটা গল্প শোনায়।
রস গ্রেগরী ক হেডলি ভেরিটি ব কেন ফার্নেস ৮০(১৮১ বল)
টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে খুঁজে এমন ত্রিভুজ আর মিলবে না। রস গ্রেগরী, হেডলি ভেরিটি, কেন ফার্নেস- তিনজনই মিলে গেছেন একটি বিন্দুতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কেড়ে নিয়ে গেছে তাঁদের তিনজনেরই প্রাণ। এর মাঝে অজি পাইলট রস জেরাল্ড গ্রেগরির মৃত্যুটা তো হয়েছে আমাদের ঘরের মাটিতেই, তাঁর বিমান বিধ্বস্ত হয়েছিলো বর্তমান ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে।
এবার বলা যাক আরও দু'জনের গল্প। এঁদের কেউই টেস্ট খেলেননি। ঘরোয়া ক্রিকেটের পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখলে তাঁদের স্মরণীয় কোনো কীর্তি মিলে যেতেও পারে। তারপরও গ্রেগরী, ভেরিটি বা ফার্নেসের সাথে একই সমতলে থাকবেন আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল আর মুশতাক আহমেদ। আভিজাত্যের সাদা পোশাক গায়ে না চড়িয়ে, অথবা গর্বোদ্ধত টেস্ট ক্যাপ মাথায় না তুলেও, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতায় জুয়েল আর মুশতাক পেয়ে গেছেন অমরত্ব। শহীদের অমরত্ব।
মুশতাক ছিলেন ক্রিকেট সংগঠক। আজাদ বয়েজ ক্লাব ছিলো তাঁর প্রেমের নাম। ভালোবাসার এই ক্লাব তিনি ছেড়ে যাননি কখনো, এমনকি মৃত্যু মুহুর্তেও। কালোরাত্রি ২৫ মার্চে ক্লাব-তাঁবুতেই মুশতাককে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানের আর্মি।
জুয়েলের গল্প আরেকটু নাটকীয়! আশুতোষ গোয়াড়িকার কী অলিভার স্টোনের হাতে যুতসই চিত্রনাট্য পড়লে সিনেমার পর্দায় অমর করে রাখা যেতো তাঁকে। ছিলেন ঐ আজাদ বয়েজ ক্লাবেরই ড্যাশিং ওপেনার। ক্রিকেট ব্যাট ফেলে যুদ্ধের মাঝে যোগ দিলেন সেক্টর টু-এর ক্র্যাক প্লাটুনে। যে ঢাকার মাঠ দাপিয়ে বেড়িয়েছিলেন জুয়েল, যুদ্ধদিনে স্টেনগানে ভরসা দিয়েছিলেন সেই ঢাকাকেই। ২৯শে আগস্ট, '৭১ এর রাতে রুমী, আজাদ, বদি সহ ক্র্যাক প্লাটুনের আরো অনেক যোদ্ধাকে ধরে ফেলে পাকিস্তানি আর্মি। আর কখনো মাঠে ফেরা হয় নি জুয়েলের।
তাঁদের স্মরণ করতেই ১৯৭২ সাল থেকে নিয়মিত আয়োজিত হচ্ছে শহীদ মুশতাক একাদশ আর শহীদ জুয়েল একাদশ প্রীতি ক্রিকেট ম্যাচ। আজ, বিজয় দিবসেও বাংলাদেশের ক্রিকেটারেরা মাঠে নামবেন এই প্রীতিম্যাচ উপলক্ষ করে জুয়েল আর মুশতাককে মনে করতে।
৪৫ বছরে অনেকটা পথ হেঁটে এসেছে বাংলাদেশের ক্রিকেট। নিশ্চিত, ভবিষ্যতে যাবে আরো বহদূর। বাংলার বাঘেরা এখন যে গর্জনে কাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে বিশ্ব, ক্রিকেট মাঠে সেই অধিকার দিতে বাংলাদেশের হয়ে প্রথম আত্মত্যাগ ছিলো শহীদ মুশতাকের। সাকিব-তামিম-মুশফিকেরা যে লাল-সবুজের জার্সি গায়ে জড়িয়ে নামছেন মাঠে, সেই জার্সির মালিকানা কেড়ে আনতে স্টেনগান হাতে যুদ্ধের উইকেটে নেমে পড়েছিলেন শহীদ জুয়েল।
আহত পা নিয়ে বল ছুঁড়তে গিয়ে মাশরাফি বিন মর্তুজা যখন টেনে নিয়ে যান বাংলাদেশ ক্রিকেটের চ্যারিয়ট, সেই রথের গায়ে মুশতাক আর জুয়েলের গল্প যে লাল সবুজে খোদাই করা। রান বা উইকেটের তুচ্ছ হিসাবে, ক্রিকেট কি এই ছবি কখনো ধরতে পারবে?
- 0 মন্তব্য