• ক্রিকেট

মি. ডিপেন্ডেবল, আপনার ব্যাটিংই চাই...

পোস্টটি ৩৭০৩ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।
  1. FB_IMG_1486957379171বাংলাদেশের হয়ে এর আগেও টানা দুই টেস্টে সেঞ্চুরি করেছেন দুইজন, যারা ভারতের সাথে এই টেস্টেও খেলছেন। তামিম ইকবাল আর মুমিনুল হক। চট্টগ্রামের উইকেট কঠিন ছিলো, বল ব্যাটে আসছিলো ধীরে, সেই পরিস্থিতিতে ট্রেন্ট বোল্ট, নিল ওয়াগনারদের বল সামলে মুমিনুল হকের ১৮১ রানের ইনিংস খেলা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে, কিংবা মিরপুরের ১০০ রানও কম সৌরভ ছড়ায় নি। নিজের স্বভাবজাত খেলার বিপরীতে গিয়ে জিম্বাবুয়ের সাথে ৩৩২ বলে ১০৯ রানের ইনিংসটা বাহবা কুড়োবেই, কিংবা পরের টেস্টেই আবারো ১০৯ রানের ইনিংসটাকেও খারাপ বলা যাবে না। তবে নিউজিল্যান্ডের মাটিতে খেলা আগের টেস্টেই ছিলো ১৫৯ রানের ইনিংস, উপমহাদেশের বিরুদ্ধ কন্ডিশনে এই ইনিংসের কথা মাথায় রাখলে এই তিন জোড়ের মাঝে মুশফিকের জোড়াটাই সেরা হবার দাবি রাখে। 

 

নিউজিল্যান্ডের সেঞ্চুরি বাদ দিলেও, ভারতের সাথে সেঞ্চুরি বাংলাদেশের পক্ষে সেরা টেস্ট ইনিংস কিনা, সেই দাবিই এখন উঠতে পারে।

 

মুশফিকের ব্যাটিং দেখা সবসময়ই দৃষ্টিসুখকর ব্যাপার। তাঁর প্রতি শটেই মিশে থাকে রেশমের পেলব। এই ইনিংসও তাঁর ব্যত্যয় নয়। তবে তাঁর ২০০ রানের ইনিংসও যতটা না মাহাত্ম্য বহন করে, এই ইনিংস বহন করে তার চেয়ে ঢের বেশি। ২৬২ বলে ১২৭ রান কেবল যার ভূমিকাই টানে, বর্ণনা করার সাধ্য নেই।

 

ক্রিজে যখন এসেছিলেন, দলের রান ১০৯, সাকিবের খেলা সেরা স্পেলের বোলিং তখন চলছে। আরো বোলিংয়ে আছেন আইসিসি র‍্যাংকিংয়ের নাম্বার ১ আর ৩। নিজভূমে যাদের মুখোমুখি হওয়া মানে কলজে হাতে নিয়ে লড়াই। তিনি সাকিবের সাথে জুটি বাঁধলেন। ১০৭ রানের জুটিতে তিনি পার্শ্বচরের ভুমিকায়। অধিকাংশ রানই এলো সাকিবের ব্যাটে। ক্রিজে জুটি বাঁধা লাগে, মুশফিকের ভুমিকা যেন কেবল জোট বাঁধাতেই আবদ্ধ। সাকিব গেলেন, সাব্বির এসে তার স্বভাবগত আক্রমণাত্মক খেলাই খেললেন। মুশফিক অবিচল। অত:পর মিরাজ এলেন। মুশফিক যেন পণই করে নেমেছিলেন, যা-ই করো বাপু, টিকে থাকবোই। মিরাজের সাথে ৮৭ রানের জোট, ৫১ রানই মিরাজের ব্যাটে। দাঁতে দাঁত চেপে ব্যাটসম্যান প্রতি বল ডিফেন্স করে যাচ্ছেন, দর্শকেরা এই দৃশ্য দেখেছেন বারেবার। কেবল ৪৬ থেকে ৪৭ রানে যেতেই এমন ঘটনা ২০ বার। ৬ষ্ঠ থেকে ৭ম বাউন্ডারির মাঝে দূরত্ব ৬৬ বলের। আবার এই দুর্ভেদ্য ডিফেন্সের মাঝেও তিনি ঠিকই রান বের করেছেন। ১৬ চার আর ২ ছয়ের কোনো শট দেখে মনে হয়েছে, তিনি রিস্ক নিচ্ছেন, তার ঘোর শত্রুও এমন কথা বলতে পারবেন না। ৬৮৮ রানের এভারেস্টে চাপা পড়ে, যেই ব্যাটিং দরকার ঠিক সেই ব্যাটিং-ই। ক্রিকেট লেখকেরা এই ইনিংস বর্ণনে বলতেই পারেন, just what the doctor's ordered.

 

এ গেলো ইনিংসের গল্প। ইনিংসের পার্শ্বগল্পগুলোও কম রোমাঞ্চকর নয়। সদ্যই ইনজুরি ফেরত ব্যাটসম্যান, ধকল কাটিয়ে ওঠারও যথেষ্ট সময় পাননি, তার আগেই ক্রিজে। ক্রিজে এসে যত ধরনের বিপর্যয়ের মুখোমুখি হওয়া সম্ভব সবকিছুর এন্তেজাম তার সতীর্থরা করে গিয়েছিলেন। কিছুক্ষণ পর সাকিব, সাব্বির 'আমি এভাবেই খেলি'র দোহাই দিয়ে প্যাভিলিয়নের পথ ধরলে বিপর্যয় বাড়ে বৈ কমে না। আনকোরা লোয়ার অর্ডার নিয়ে তিনি এরপর যে পুরো দুই সেশন পাড়ি দিলেন, তা তাঁর ইনিংসের মাহাত্ম্য আরো বাড়িয়ে দেয়। ইশান্ত শর্মার বল তার ভাঙা আঙুলে লাগার পরের বলেই চার মারা, দলের বাকি সতীর্থদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, টেস্ট ক্রিকেট কিভাবে খেলা লাগে। আঙুল ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে তিনি ঠিক করে দেন, দলের প্রতি নিবেদনের মাত্রা। তার ২৬২ বলের ইনিংস তাই শুধু ১৬ চার আর ২ ছয়ের মারকাটারি বিনোদনের গল্পেই সীমাবদ্ধ নয়, দাঁতে দাঁত চেপে ব্যাটসম্যানের লড়াইয়ের গল্প, টেস্ট ক্রিকেটের সত্যিকারের সৌন্দর্যের গল্প।

 

তবুও এই ব্যাটিং দলের জন্য কতটা কাজে এসেছে, প্রশ্ন থেকেই যায়। ৩৮৮ রান করার পরও মাথার উপর ২৯৯ রানের ঋণ। এই দেনার পেছনে মুশফিকের অবদানও কম নয়।

 

গত কিছুদিন বাংলাদেশ ফিল্ডিংরত অবস্থায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঢুঁ মারলে মনে হবে, মুশফিকুর রহিমের সাথে বোধহয় সবার জাতীয় শত্রুতা চলছে। যার জন্য মুশফিককেই সর্বাগ্রে দায়ী করা যায়।

 

উইকেটের সামনে মুশফিক যতটাই সাবলীল, ততটাই কিংবা তারও বেশি ছন্দহীন উইকেটের পেছনে। হাফ চান্সগুলোর কথা যদিওবা বাদ দিই, ফুল চান্সগুলো উইকেটের পেছনে তার হাত ধরে হাতছাড়া হওয়ার সংখ্যাও কম নয়। এবারের ভারত সিরিজে ঋদ্ধিমান সাহার যে স্ট্যাম্পিং তিনি মিস করেছেন, পাড়ার ক্রিকেটেও এই মিস করলে পরবর্তী ম্যাচে কিপার আর কিপিং গ্লাভস হাতে তুলতেন না। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, এরকম মিস ইদানীং তাঁর নিয়মিতই হচ্ছে, আর কিপিং তাঁর উপর চাপ হয়ে যাচ্ছে কিনা প্রশ্ন উঠলে তিনি হাসিমুখে বলে যাচ্ছেন, কিপিং করেও আমি ২০০ করেছি। তিনি নিজে থেকে কিপিং ছাড়বেন না, জানিয়েও দিয়েছেন।

 

কিন্তু মুশফিক, এভাবে আর কত! বেঞ্চে বসে আছেন নুরুল হাসান, লিটন দাসের মতো উইকেটকিপার। ব্যাটিংটাও যে তারা ভালোই জানেন, ইতিহাস সে সাক্ষ্যই দেয়। তবুও আপনার একগুঁয়েমি কেন?

 

১৫০ ওভার কিপিংয়ের পর ছয়ের আগে ব্যাট করা যেকোনো কিপারের জন্যই কঠিন। আপনিও তাঁর ব্যতিক্রম নন। কুমার সাঙ্গাকারা টেস্ট ম্যাচে কিপিংয়ের ধকল সামলাতে পারেননি। ভারত দিনের পর দিন ঋদ্ধিমান সাহার বাজে পারফরমেন্সের পরও খেলিয়ে গিয়েছে, দলে লোকেশ রাহুলের উপস্থিতি সত্ত্বেও। লোকেশ রাহুলের ওপেনিং ব্যাটিংটাই তাদের দরকার, আর উইকেটের পেছনে ঋদ্ধিমান সাহার বিশ্বস্ততা। 

 

টু ডাউন দলের সেরা ব্যাটসম্যানেরই জায়গা। বাংলাদেশের বেলায় সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার জায়গা এই পজিশনই, বরাবরই। আশরাফুল থেকে মাহমুদুল্লাহ, নির্ভরতা দিতে কেউই। টেকনিক বা মানসিক, এই পজিশন আপনাকেই সবচেয়ে বেশি মানায় 'মি. ডিপেন্ডেবল'।

 

একজন ব্যাটসম্যান বেশি খেলানোর চেয়ে দলে নির্ভরতা জোগানো একজন খেলোয়াড়ই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মুশফিকুর রহিম, শুনতে পাচ্ছেন?