আশির্ধ্বো তাঁরা...
পোস্টটি ৬৩৩৮ বার পঠিত হয়েছে১.
অকল্যান্ডের ইডেন পার্কে মিসবাহ উল হকের যখন অভিষেক হচ্ছে, ততদিনে ইউসুফ-ইনজামাম-ইজাজদের ভিড়ে, মিডল অর্ডারে নিজের একটা স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরী করে ফেলেছেন ইউনুস (ইংরেজীতে তাঁর নামটা ইউনিস হলেও, তিনি ইউনুস নামেই স্বচ্ছন্দ বোধ করেন) খান। মিসবাহ খেলেছিলেন তিনে, ইউনুস পাঁচে। দু’জনে আট রানের ছোট্ট একটি জুটিও গড়েছিলেন।
তখন কে আর জানত যে, তিন সহস্রাধিক দৌড়ের পথচলা শুরু হলো মাত্র!
২.
প্রায় বছর পাঁচেক পর, নাটকীয় প্রত্যাবর্তন করে ৩৩ বছর বয়সী মিসবাহ যখন পরিণত হলেন পাকিস্তান ক্রিকেট দলের অবিচ্ছেদ্য অংশে, তখনো ইউনুস খান আছেন পাকিস্তান মিডল অর্ডারের অন্যতম স্তম্ভ হয়ে! মিসবাহ দলে থিতু হওয়ার চেষ্টা করছিলেন, আর ইউনুস চেষ্টা করছিলেন অনুপ্রেরণামূলক নেতৃত্বে, দলে যেন একটা স্থিতি নিয়ে আসা যায়। নিজের প্রথম ত্রিশতকের পথে, মিসবাহর সাথে ইউনুস গড়েছিলেন ১৩০ রানের (পনেরোটি শতরানের জুটির প্রথমটি) জুটি।
তখনো কেউ ভাবতে পারেনি, এই দুজনই হবেন পরবর্তী এক দশকের পাকিস্তান ক্রিকেটের মহাগুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায়ের অতি গুরুত্বপূর্ণ দুই চরিত্র!
৩.
সেবার বিলেতি গ্রীষ্মে অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের সাথে দুটি টেস্ট সিরিজ খেলল পাকিস্তান। সেখানে ছিলেন না মিসবাহ, ছিলেন না ইউনুসও। ফিক্সিং কেলেংকারীতে টালমাটাল হলো পাকিস্তান ক্রিকেট। অস্তিত্বের সংকটে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড দ্বারস্থ হলো, শ্বেত-শুভ্র চরিত্রের দু’জন মানুষের দ্বারে। মিসবাহ ফিরলেন নেতৃত্ব নিয়ে, ইউনুস ফিরলেন দলের ব্যাটিংয়ের প্রাণভোমরা হয়ে।
ইউসুফ-বাট-আফ্রিদীতে অস্থির পাকিস্তান নেতৃত্বে 'স্থিতধি' মিসবাহ দিলেন স্থিতিশীলতা, আর দলের অনভিজ্ঞ ব্যাটিং লাইনআপে ইউনুস দিলেন নির্ভরতা। কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে মধ্য তিরিশের দু’জন ক্রিকেট চরিত্র শুরু করলেন, স্বদেশের সম্মান পুনরুদ্ধার মিশনের এক মহাযজ্ঞ।
তখনো বোঝা যায়নি, তাঁরা কতটা সফল হতে পারবেন! কিংবা আদৌ সফল হতে পারবেন কি না!
স্বদেশের ক্রিকেটের কঠিন দুঃসময়গুলোতে লড়ে গেছেন কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে।
৪.
কলম্বোয় শ্রীলংকার বিপক্ষে দ্বিতীয় টেস্ট চলছিল। শান মাসুদ দলে নেই, তাই মন ভালো নেই তাঁর। মনমরা শান মাসুদের দিকে এগিয়ে গেলেন মিসবাহ। আস্তে করে জিজ্ঞেস করেন, “বয়স কত তোর?”
“পঁচিশ”, উত্তর দেন শান।
“তুই জানিস তোর বয়সে আমি কোথায় ছিলাম? মাত্রই স্নাতক শেষ করে বের হয়েছিলাম। তখনো খেলিনি প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট। আমি পাকিস্তানের হয়ে প্রথম খেলেছিলাম ২৭ বছর বয়সে। মরা উইকেটেও বিকেল-ব্রেট লিদের সামলাতে পারিনি। অথচ তুই ইতিমধ্যেই প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ৪০০০ রান করে ফেলেছিস। বিশ্বের এক নম্বর দলের বিপক্ষে অভিষেকে দারুণ খেলেছিস। তোর সামনে দারুণ একটা ভবিষ্যত পড়ে আছে। কেন শুধু শুধু চিন্তা করছিস?”
শান মাসুদ যেন একটু আশ্বস্ত হলেন অধিনায়কের কথায়।
পরের টেস্টেই সুযোগ পেলেন, শান। কিন্তু প্রথম ইনিংসে নিজেকে প্রমাণে ব্যর্থ হলেন। দ্বিতীয় ইনিংসে পাকিস্তানের লক্ষ্য দাঁড়ালো ৩৭৭। চতুর্থ ইনিংসে এত রান তাড়া করার ইতিহাস একদমই হাতে গোণা, পাকিস্তান তো কখনোই করতে পারেনি। পাকিস্তান ১৩ রানে হারিয়ে বসল ২ উইকেট। শান মাসুদকে সঙ্গ দিতে চার নাম্বারে এলেন ইউনুস খান। অপর প্রান্তে থেকে ইউনুস দেখলেন, মাসুদকে। যেসব সমস্যা ইউনুসের চোখে পড়ল, তিনি জানালেন শানকে। ইউনুসের উপদেশ আর সাহচর্য্যে সময়ের সাথে শান হয়ে উঠলেন, সাবলীল ও স্বচ্ছন্দ। ইউনুস-শানের ২৪২ রানের জুটিতে, পাকিস্তান পেল তাদের ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বোচ্চ রান তাড়া করে জয়।
পাকিস্তান ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বড় রান তাড়া করে, জয় নিয়ে ফিরছেন তাঁরা।
মাসুদকে নির্ভরতা দিয়েছিলেন মিসবাহ, পথ দেখিয়েছিলেন ইউনুস। এই দু’জনের যৌথ চেষ্টায়, এক তরুণ ক্রিকেটার ফিরে পেয়েছিলেন নিজের প্রতি বিশ্বাস। শুধু শান মাসুদই নন, মিসবাহ-ইউনুস নামের দুই বটবৃক্ষের ছায়ায় বেড়ে উঠেছেন আজহার, আসাদ, সরফরাজ, সামী আসলাম, বাবর আজমের মতো তরুণেরা।
“আমি তাদের দু’জনের কাছ থেকেই অনেক কিছু শিখেছি। তাঁরা দু’জনই দৃঢ় মানসিকতার অধিকারী। ইউনুস খান থেকে আমি শিখেছি, কিভাবে কঠিন সময়েও শান্ত থেকে লক্ষ্যে অবিচল থাকা যায়। তাদের অভিজ্ঞতা ও উপদেশে আমি তো উপকৃত হয়েছিই, আরো অনেক তরুণ ক্রিকেটারও লাভবান হয়েছে।” বলেছিলেন আজহার আলী।
বোলিং-ব্যাটিং দুই বিভাগেই ভারসাম্য উপহার দিয়ে, মিসবাহ-ইউনুস পাকিস্তান ক্রিকেটকে রেখে যাচ্ছেন দারুণ এক স্থিতিশীল অবস্থায়।
৫.
ইতিহাসে মাত্র বারো জন ব্যাটসম্যান ছুঁয়েছেন দশহাজার রানের উচ্চতা। সেই উচ্চতা ছোঁয়ার নিঃশ্বাস দূরত্বে দাঁড়িয়ে ইউনুস। একসময় স্যার ডন ও হার্বাট সাটক্লিফের পর মাত্র তৃতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে চার ইনিংসেই তাঁর গড় পঞ্চাশ পেরিয়েছিল, এখনও পঞ্চাশের অধিক গড় আছে তিন ইনিংসে। পরিসংখ্যান বিচারে তাঁকে পাকিস্তান ক্রিকেটের সেরা ব্যাটসম্যান বললেও খুব বেশী অত্যুক্তি হয় না।
কিন্তু তিনি বলেন, “পাকিস্তানের সেরা ব্যাটসম্যান বললে আসবে জাভেদ মিঁয়াদাদ, জহির আব্বাস, ইনজামাম উল হকের নাম। আরো অনেকেই আছেন সেরার তালিকায়। আমি কোনমতেই সেরা ব্যাটসম্যান নই। আমি বরং চাই যে, সবাই আমাকে মনে রাখুক এইভাবে, আমি আমার দেশের জন্য নিজেকে উজার করে ক্রিকেট খেলেছি। এটাই আমার কাছে বেশী গুরুত্বপূর্ণ। যখন আমি অবসরে যাবো, তখনো যেন সবাই আমাকে স্মরণ করে একজন ফাইটার হিসেবে। যে তাঁর দেশের জন্য ক্রিকেট মাঠে লড়াই করত!”
পরিসংখ্যান মিসবাহকেও বলবে দেশের ইতিহাসের অবিসংবাদিত সেরা অধিনায়ক। ৫৩ টেস্টে নেতৃত্ব দিয়ে ২৪টিতেই এনে দিয়েছেন জয়। দেশের ইতিহাসে প্রথম বারের মতো র্যাংকিংয়ের শীর্ষেও তুলেছেন পাকিস্তানকে। কিন্তু মিসবাহ বলেন, তিনি শুধু তাঁর দলকে, তাঁর দেশকে সাহায্য করেছেন। তিনি সেরা অধিনায়কের মুকুট চান না, সে মুকুট অন্য কারো জন্য তোলা থাক। তিনি তো কেবল তাঁর দেশকে, তাঁর সতীর্থদের সহযোগিতা করতে চান।
৬.
পাকিস্তান ক্রিকেটের দুই মহানায়কই কেবল বিদায় নিচ্ছেন না, ক্রিকেট হারাচ্ছে তাঁর অন্যতম দুই শ্রেষ্ঠ সন্তানও। অস্থির পাকিস্তান ক্রিকেট, ফিক্সিংয়ে জেরবার পাকিস্তান ক্রিকেট, কলুষিত পাকিস্তান ক্রিকেট থেকে উঠে এসে, নিজেদের এমন শুদ্ধ চরিত্র বজায় রাখতে পেরেছেন ক’জন? ক্রিকেট খেলাটাকে তাদের মতো করে আত্নস্থ করতে পেরেছেন ক’জন? এই টালমাটাল যুগেও অমন শান্ত-শুভ্র ও মহান চরিত্রের অধীকারী আছেন ক’জন?
নিঃসন্দেহে সংখ্যাটা একদম হাতে গোণা।
তাই মিসবাহ ও ইউনুস যখন ক্রিকেটকে ছেড়ে যাবেন, ক্রিকেটও নিশ্চয় কম ব্যথিত হবে না!
ভালো থাকুন, মিসবাহ। ভালো থাকুন, ইউনুস। আপনাদের আলোকাজ্জ্বল ভবিষ্যত কামনা করছি।
- 0 মন্তব্য