গিলবার্ট জেসপঃ দর্শক নন্দিত একজন বিধ্বংসী
পোস্টটি ৩৪১৩ বার পঠিত হয়েছে১.
প্রথম দুটি টেস্ট ভেসে গেছে বৃষ্টিতে। পরের দুটি টেস্ট অবিশ্বাস্য দৃঢ়তায় জিতে নিয়েছে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বি অস্ট্রেলিয়া। নিয়ম রক্ষার পঞ্চম টেস্টটি তখন আর ইংল্যান্ডের জন্য ‘নিয়ম’ রক্ষার অবস্থায় নেই, রুপ নিয়েছে সম্মান পুনরুদ্ধার মিশনে।
কিন্তু লন্ডনের কেনিংটন ওভালে ইংলিশরা যখন সিরিজের শেষ টেস্টটি খেলতে নামল, তখন স্পষ্ট বোঝা গেল, ওল্ড ট্রাফোর্ড টেস্টের ধাক্কাটা এখনও তাঁরা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। মাত্র ১২৪ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে, ১২০ রানে গুটিয়ে গেলে, ৩ রানে পরাজয়ের ক্ষত শুকোয় কিভাবে?
তাই ওভাল টেস্টে দেখা গেল, অস্ট্রেলিয়ার ৩২৪ রানের জবাবে ইংল্যান্ড মাত্র ১৮৩তেই গুটিয়ে গেছে। দ্বিতীয় ইনিংসে অস্ট্রেলিয়াকে ১২১ রানে বেঁধে ফেলেও, ২৬৩ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে ইংলিশ ব্যাটিংয়ের তথৈবচ অবস্থা। অর্ধেক সাবাড় হয়ে গেছে, ৪৮ রানেই।
ঠিক এই সময়ে মধ্যমাঠে প্রবেশ করলেন, আমাদের আজকের নায়ক। ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি উচ্চতার লিকলিকে গোঁফো তরুণটি যেন একবার দেখে নিলেন মাঠের চারপাশ। কাউন্টি অভিজ্ঞতায় ইংলিশ-দর্শককুল জানেন, গোঁফো তরুণের সক্ষমতা। তাঁরা একটু নড়েচড়ে বসেছেন। এই ম্যাড়ম্যাড়ে পরাজয়ের ম্যাচে হয়তো কিছু চার-ছক্কার বিনোদন পাওয়া যাবে, বেদনার দিনলিপিতে একটু হলেও হয়তো উচ্ছ্বাস বরাদ্দ রাখা যাবে।
২.
১৮৭৪ সালের ১৯শে মে হেনরী এডওয়ার্ড জেসপ নবজাতকের বাবা হলেন, একাদশ বারের মতো। নবজাতকের নাম রাখা হলো, গিলবার্ট। পুরো নাম গিলবার্ট লাইরড জেসপ।
কেনিংটন ওভালের যে গল্প এতক্ষন বলা হচ্ছিল, সেই গল্পের নায়ক এই গিলবার্ট জেসপই। আমাদের লিকলিকে গোঁফো তরুণ।
লিকলিকে গোঁফো তরুণ!
৩.
গিলবার্ট জেসপ ছিলেন একজন ফাস্ট বোলার। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, তিনি ইতিহাসে বিখ্যাত হয়েছেন, তাঁর বেধড়ক পিটুনীর জন্য। বল বা বোলার কোনটার প্রতিই বিন্দুমাত্র মায়া-দয়া ছিল না তাঁর।
স্যার জ্যাক হবস তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন, “নিঃসন্দেহে সে আমার দেখা দিনের পর দিন ধারাবাহিকভাবে দ্রুত রান তুলে যাওয়া ব্যাটসম্যান। সে রান করতে পারবে না, এমন বল করা ছিল প্রায় অসম্ভব। সে ছিল বিগ হিটার। আমার প্রায়ই স্বস্তি হতো এই ভেবে যে, আমি বোলার নই।”
তাঁর আট শতাধিক ইনিংসে তিনি তিন ঘন্টার বেশী ব্যাট করেছেন মাত্র একবার। ২০০ মিনিটের সেই ইনিংসে করেছিলেন ২৪০! তাঁর ক্যারিয়ার সর্বোচ্চ ২৮৬ রান এসেছিল মাত্র ১৭৫ মিনিটে। তাঁর সেঞ্চুরী করার সাধারণ গড় ছিল ৭২ মিনিট। সেই উনবিংশ শতকের সূচনায় তিনি ঘন্টায় কত গড়ে রান করতেন অনুমান করতে পারেন?
স্যার হবস, হ্যামন্ড, ক্লেম হিল ঘন্টায় বড়জোর গড়ে ৪৩ রান করতেন। জি গ্রেস, লেন হাটনের ছিল ৩৬। ব্র্যাডম্যান, কম্পটন, ম্যাকলারেন তুলতেন ৪৭ করে, ম্যাককেব-রণজিৎসিংজী ৫০ আর ফস্টার-ট্রাম্পারদের ৫৫ করে রান তোলার গড় ছিল, প্রতি ঘন্টায়। বিপরীতে গিলবার্ট জেসপ তুলতেন ঘন্টায় ৭৯ রান! সেঞ্চুরী হলে, এই গড় হয়ে যেত প্রায় ৮৩!
জেসপের নির্মমতার মাত্রাটা বুঝতে পারছেন তো?
৪.
পিচ-পরিস্থিতি খুব কমই বিবেচ্য হতো গিলবার্টের। নিজের দিনে যে কোন পরিবেশে, যে কোন বোলিং আক্রমণকে ধ্বসিয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখতেন তিনি। সেজন্যেই হয়তো তাঁর বড় ইনিংসগুলোর ক্ষেত্রে দেখা যায়, দলের অন্য সবাই যেখানে অসহায় আত্মসমর্পণ করেছেন, ঠিক সেখানেই দোর্দন্ড প্রতাপে ব্যাটিং করেছেন তিনি!
একটু পেছন ফিরে যাই, কাউন্টি ক্রিকেটে তাঁর অভিষেক লগ্নে। কি করেছিলেন সেখানে? পরপর দুই বলে দুই উইকেট যাওয়ার পর, হ্যাটট্রিক বলের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে মুখোমুখি হওয়া প্রথম বলেই তিনি চার মেরে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, ভয় বা কাঁপুনি জাতীয় কিছু তাঁর অভিধানে নেই।
১৯০১ সালে কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশীপে সাসেক্সের বিপক্ষে ফলোঅনে পড়া গ্লস্টারশায়ারে হয়ে নেমেছিলেন ৪ রানে ১ উইকেট যাওয়ার পর। যখন আউট হচ্ছিলেন, তখন দলের রান ৭০। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে, মাঝের ৬৬ রানই ছিল গিলবার্টের।
১৮৯৭তে ইয়র্কশায়ারের বিপক্ষে করেছিলেন মাত্র ৪০ মিনিটে সেঞ্চুরী, যা এখনও প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে দ্বিতীয় দ্রুততম। তার এক দশক পর, করেছিলেন ৪২ মিনিটে সেঞ্চুরী। সেই সেঞ্চুরী থেমেছিল ১৯১ তে গিয়ে, সময় নিয়েছিলেন দেড় ঘন্টা! দলের মোট রান ছিল ২৩৪!
তাঁর দুই ঘন্টায় দ্বিশতক করার কীর্তিও সবচেয়ে দ্রুততম হয়ে ছিল বহুদিন। ৭৩ বছর পর ক্লায়েভ লয়েড তাঁর সমান দুই ঘন্টা সময় নিয়ে বসেন তাঁর পাশে। আর ১৯৮৫তে রবি শাস্ত্রী ১১৩ মিনিটে ডাবল সেঞ্চুরী করে ভেঙ্গে দেন গিলবার্টের সেই ৮২ বছর বয়সী রেকর্ড।
দুই বছর পর, ১৯০৫-এ সমারসেটের বিপক্ষেও ১৩০ মিনিটে সেঞ্চুরী করেছিলেন জেসপ।
৫.
এতক্ষণে নিশ্চয় গোঁফো লিকলিকে তরুণকে ভালোই চেনা হয়ে গেছে। তাহলে এবার আমরা ফিরে আসি, লন্ডনের কেনিংটন ওভালে। গল্পটা সূচনা হয়েছিল যেখানে।
উইকেটে এসে সঙ্গী পেলেন স্যার স্ট্যানলি জ্যাকসনকে। তাঁকে নিয়ে খুব দ্রুতই স্কোর বোর্ডে যোগ করলেন ১০৯ রান। এই সময় গিলবার্ট পঞ্চাশ পেরোলেন মাত্র ৪৩ মিনিটে। হিউ ট্র্যাম্বল প্রথম ইনিংসে আট উইকেট নিয়ে একাই ধ্বসিয়ে দিয়েছিলেন ইংল্যান্ডকে। স্যার স্ট্যানলিকে আউট করে আবারও অস্ট্রেলিয়াকে ম্যাচে ফেরালেন সেই ট্র্যাম্বলই। উইকেটে এলেন জর্জ হার্স্ট, একজন অদম্য লড়াকু। দাঁতে দাঁত চেপে তিনি যোগ্য সঙ্গই দিয়ে গেলেন জেসপকে।
উইকেটের চারপাশে বল পাঠিয়ে নিস্তব্ধ ওভালের গ্যালারীতে গিলবার্ট ফিরিয়ে আনলেন প্রাণের জোয়ার। অনেক দূরের বাতিঘর মনে হওয়া জয়টা যেন তখন নাগাল ছোঁয়া দূরত্বে। দারুণ এক স্কয়ার কাটে জেসপ যখন তাঁর একমাত্র আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরীটি তুলে নিলেন, ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে পুরো ওভাল। দর্শকদের উন্মত্ত করতালিতে ঘোষণা হচ্ছিল, মহাকাব্যিক এক ইনিংসের প্রতি সম্মান।
সেঞ্চুরীর পরপর ফিরে গিয়েছিলেন গিলবার্ট জেসপ। মাত্র ৭৭ মিনিটের সেঞ্চুরীটি সময়ের হিসেবে এখনও তৃতীয় দ্রুততম। ইংল্যান্ডের স্কোর তখন ১৮৭/৭। জেসপের গল্প এখানে শেষ হয়ে গেলেও, ওভাল টেস্টের গল্প বাকী ছিল আরো। সে না-হয় আরেকদিন হবে। আপাতত এটুকু বলি, হার্স্টের অনমনীয় দৃঢ়তা আর শেষ উইকেটে উইলফ্রে রোডসের অবিচল প্রতিজ্ঞায় ইংল্যান্ড শেষ পর্যন্ত জয়ের বন্দরে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছিল।
৬.
গিলবার্ট জেসপের আন্তর্জাতিক আঙিনায় মনে রাখার মতো কীর্তি বলতে এটাই। সাগরভীতির জন্য দূর দূরান্তের সফরগুলোতে ছিল তাঁর অনীহা। একবার অস্ট্রেলিয়া থেকে চলে এসেছিলেন, পরে আরো তিনবার ফিরিয়ে দিয়েছেন জাহাজ ভ্রমণে ভিনদেশে ক্রিকেট খেলার যাত্রা। তবুও ১৮ টেস্ট খেলছিলেন, এবং ওভালের ওই মহাকাব্য ছাড়া বলার মতো আর কিছু উপহার দিতে পারেননি।
অথচ প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে, ফাস্ট বোলিংয়ের সাথে অসাধারণ ফিল্ডিং আর প্রচন্ড মারকুটে ব্যাটিংয়ে অনায়াসে ছুঁয়েছেন কিংবদন্তী উচ্চতা। ইতিহাস তাঁকে ভয়ংকর বিধ্বংসী ব্যাটসম্যান হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিলেও, বোলার আর ফিল্ডার হিসেবেও ছিলেন দুর্দান্ত। কতটা দুর্দান্ত?
সর্বকালের সেরা ফিল্ডারদের ছোট্ট তালিকায় তাঁর জায়গা নিয়ে সন্দেহের ন্যুনতম অবকাশও নেই। শুরুর দিকে কাভারে ফিল্ডিং করলেও পরে এক্সট্রা মিড অফে স্পেশালিস্ট হয়ে উঠেন। অনেকটা ডিপে দাঁড়াতেন বলে, অন্য যে কোন ফিল্ডারের ক্ষেত্রে সেখানে একরান নিশ্চিত ছিল। কিন্তু জেসপকে দেখলে নাকি ব্যাটসম্যানরা দৌড়ানোর সাহস করতেন না!
আসলে দারুণ একজন এ্যাথলেটই ছিলেন গিলবার্ট। ফুটবল-হকিতেও ছিলেন সমান পারদর্শী। বাবার মতো বিলিয়ার্ডটাও ভালো খেলতেন।
এমন অমিত প্রতিভাধর একজন যে, বর্ণময় ক্রিকেট-চরিত্র হবেন এতে আর তেমন আশ্চর্য্যের কি!
৭.
১৯৯৬ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে, জয়সুরিয়া-ঝড়ে লন্ডভন্ড অবস্থা হয়ে গিয়েছিল ইংল্যান্ডের। বোলার ডিফ্রেটাস-ইলিংওয়ার্থদের কথা না-হয় বাদ দিন, অধিনায়ক মাইক আথারটন পর্যন্ত যে হতবিহ্বল হয়ে গিয়েছিলেন। নইলে ‘বুদ্ধিভ্রম’ হওয়ার মতো কেন বলে উঠবেন, ফিল্ডিং বাধ্যবাধকতা ফিল্ডিং সাইডের জন্য আনফেয়ার? এটা পরিবর্তন করা হোক!
ইংলিশ সাংবাদিককুলই কি কম তাজ্জব বনেছিলেন? মাতারা হারিকেনের বেদম পিটুনী দেখে, নোট নেয়া বন্ধ করে, জেসপ-স্মৃতিচারণায় মত্ত হয়ে গিয়েছিলেন যে!
গিলবার্ট জেসপকে কেউ কল্পকথার নায়ক বলেন, কেউ মিথ বলেন, কেউ বলেন যতটা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বলা হয়, আসলে ততটা ছিলেন না।
আসলে কতটা কি ছিলেন? স্যার জ্যাক হবস বলেছিলেন, “জেসপ দর্শক টেনে আনতো মাঠে। সে ছিল একজন দর্শক নন্দিত ক্রিকেটার। দর্শকরা ওকে ভালোবাসত। এমনকি আমি বলবো, ব্র্যাডম্যানের চেয়েও বেশী!”
আরেক কিংবদন্তী ক্রিকেটার সি বি ফ্রাই বলেছিলেন, “জেসপ ছিল এমন একজন ব্যাটসম্যান, যে ব্যাটসম্যানদের জন্য উচিৎ নয় এমন প্রায় সবকিছুই করত, তাও আবার দারুণ সাফল্যের সঙ্গে।”
ডাউন দ্য উইকেটে গিয়ে শর্টপিচ ডেলিভারীকে ড্রাইভ করতেন তিনি! প্রায় মাটির সঙ্গে শুয়ে, ব্যাটকে প্রায় মাটির সমান্তরালে নিয়ে, লেগ সাইডে খেলতেন। পা নাড়াচাড়া করতেন বিদ্যুত গতিতে। আর প্রত্যেকটা শটেই থাকতো প্রচন্ড জোর। আবার নমনীয় কব্জী দিয়ে স্কয়ার কাটও খেলতেন দারুণ।
এমনি এমনি কি আর তাঁকে ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত হিটার বলা হয়!
৮.
ক্রিকেটের সুদীর্ঘ পথচলায় অনেক অসম্ভব প্রতিভাশালী ক্রিকেটার এসেছেন। মারকুটে, বিধ্বংসী, খুনে মেজাজের ব্যাটসম্যান তো ক্রিকেট আর কম দেখেনি! পেশী শক্তির নান্দনিক ভঙিমার সাথে, উদ্ভাবনী ব্যাটিংও ক্রিকেট দেখেছে। আজকালকার যুগে অভিনব সব শটে উদ্ভাবনের নিত্য-নতুন মাত্রাও যেন দেখছে ক্রিকেট।
তবে ক্রিকেটের ইতিহাসে হয়তো জেসপ একজনই। তাঁর মতো কেউ না-হবেন, না-হতে পারবেন!
গিলবার্ট জেসপ! অনেক আগেই যার অমরত্বের বন্দোবস্ত হয়ে গেছে। কখনো জয়সুরিয়া, কখনো গেইল, কখনো শেওয়াগ, কখনো ডি ভিলিয়ার্সে যিনি ঠিকই ভর করে বসেন। কোনো এক ছুঁতোয় ঠিক মর্ত্যে ফিরে আসেন তিনি, যুগ যুগান্তর ধরে বেঁচে থাকার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত যে করে গেছেন!
মানুষ জানে, দেখে, বোঝে, ধ্বংসও কখনো কখনো কতই না আনন্দদায়ক!
- 0 মন্তব্য