ঘরের মাঠে আমাদের প্রথম জয়ের গল্প
পোস্টটি ২০১৯৮ বার পঠিত হয়েছেআজ আমাদের ক্রিকেট এমন একটা অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে যে বড়দলের সাথে সিরিজ জয়কেও মোটামুটি সাধারণ ঘটনা হিসেবেই মনে হয়। কিন্তু এমন একটা সময় ছিল যে বড়দলের বিপক্ষে একটা ম্যাচ জয় তো দূরের কথা,ছোট কোনো দলের বিপক্ষে আন্তর্জাতিক ম্যাচ জয়ের জন্যেও চাতকপাখির মতো অপেক্ষা করতে হতো। একটা ছোট্ট পরিসংখ্যান দিলেই তখনকার পুরো ব্যাপারটা সবার কাছে পানির মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে, ১৯৯৭ সালে ওয়ানডে স্ট্যাটাস পাওয়ার পরে ঘরের মাঠে প্রথম ওয়ানডে জয়ের দেখা পেতে বাংলাদেশকে অপেক্ষা করতে হয়েছিলো ২০০৪ সালের ২৬ শে ডিসেম্বর পর্যন্ত !!!!! এই সাতবছরে বাংলাদেশ বিদেশের মাঠে মোট পাঁচটা ওয়ানডে জিতলেও ঘরের মাঠে জিততে পারে নি একবারও। প্রতিবারই অসংখ্য দর্শক একবুক আশা নিয়ে স্টেডিয়ামে গিয়েছে কিন্তু প্রতিবারই পরাজয়ের স্মৃতি নিয়ে সবাইকে ঘরে ফিরতে হয়েছে। অবশেষে দর্শকদের অপেক্ষার অবসান ঘটে ২০০৪ সালের ২৬ শে ডিসেম্বর, সেদিন বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ভারতকে হারানোর মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো ঘরের মাঠে কোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচে জয়ের দেখা পায় । তখন প্রতিম্যাচে স্টেডিয়াম হাউসফুল না হলেও শততম ওয়ানডের ঐতিহাসিক ম্যাচে পুরো স্টেডিয়াম ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। সেদিন স্টেডিয়ামে বসে যেকজন ওই ঐতিহাসিক ম্যাচজয়ের সাক্ষী হতে পেরেছিলো আমিও ছিলাম তাদের একজন, এই লেখায় সেই ম্যাচজয়ের স্মৃতিটাই তুলে ধরার চেষ্টা করলাম।
- ওই ম্যাচের গল্পে যাওয়ার আগে গল্পের কিছু পূর্বকথা বলে নেওয়া দরকার। ওই ম্যাচটি ছিল ভারত-বাংলাদেশ তিনম্যাচ ওয়ানডে সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচ। প্রথম ওয়ানডেতে চট্টগ্রামে ভারতের ২৪৫ রানের জবাবে নাফিস ইকবালের ৫২ বলে ৯ রানের এক প্রাগৈতিহাসিক ইনিংস সত্ত্বেও হাবিবুল বাশার আর খালেদ মাসুদের জোড়া ফিফটিতে বাংলাদেশ আট উইকেট হারিয়ে ২৩৪ রানে ইনিংস শেষ করে এগারো রানে ম্যাচটা হারে। সেইসময়ে ছোট মার্জিনে হারাটাও আমাদের জন্য অনেক সম্মানজনক ছিল, মূলত এই সম্মানজনক হারেই ঢাকায় দ্বিতীয় ওয়ানডের ব্যাপারে মানুষের আশা অনেকগুণ বেড়ে যায়। সবাই ভাবতে থাকে "ইশ,আজ যদি নাফিস আর এগারোটা বল কম খেলতো তাহলেই তো জিতে জেতাম" কিন্তু প্রতিপক্ষ ভারত কিন্তু ছোট্ট মার্জিনে জেতার পরেও বাংলাদেশকে তেমন পাত্তা দেয় না, উলটো ঘোষণা দেয় যে পরের ম্যাচে তারা তাদের সেরা দুই ব্যাটসম্যান শচীন আর দ্রাবিড়কে ছাড়াই খেলতে নামবে। এই ঘোষণা সবার আশাকে আরো অনেক বাড়িয়ে দেয়, আমি নিজেও সেই আশাবাদিদের দলে ছিলাম তাই সেই ম্যাচটা স্টেডিয়ামে গিয়ে দেখার ব্যাপারে চেষ্টা চালাতে লাগলাম। যেহেতু বয়স কম তাই একা তো আর স্টেডিয়ামে যেতে পারি না তাহলে কি করি ???
ওইযে বললাম প্রথম ওয়ানডের পর অদ্ভুতভাবে সবার মনেই জয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়ে গিয়েছিলো তাই আমার দুই কাজিনকে খেলা দেখতে যাওয়ার কথা বলতেই তারা রাজি হয়ে যায় । আগেই বলেছি সেই সময়ে বাংলাদেশের ম্যাচে স্টেডিয়াম হাউসফুল খুব কম সময়েই হতো তাই আমরা একটু লেট করেই গেলাম কিন্তু স্টেডিয়ামে গিয়েই আমাদের মাথায় হাত কারণ গিয়ে দেখি সব টিকিট বিক্রি শেষ !! তখন বুঝতে পারলাম শুধু আমরা না পুরো দেশবাসীই এই ম্যাচ জয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী। পরে বহুকষ্টে ব্ল্যাকেই টিকিট কিনে স্টেডিয়ামের সাউথ গ্যালারিতে ঢুকলাম খেলা দেখতে।
যেহেতু ব্ল্যাকে টিকিট কিনতে হয়েছিলো তাই ঢুকতে একটু লেট হয়ে গিয়েছিলো,গিয়েই দেখি বাংলাদেশ অলরেডি দুই উইকেট খুইয়ে বসে আছে। পিঞ্চহিটার রফিকের সাথে নাফিস ইকবাল সাজঘরে ফিরেছে অবশ্য নাফিস ইকবাল এর আগের ম্যাচের তুলনায় এই ম্যাচে অনেক ভালো খেলেছিলো,গতম্যাচের মত এইম্যাচেও ৯ রানেই আউট হলেও এইম্যাচে সে এই নয়টি রান করতে নিয়েছিলো মাত্র(!) ২২ টি বল !!! যাইহউক,কোনোমতে পেপার বিছিয়ে বসার একটা ব্যবস্থা করলাম ( তখন স্টেডিয়ামে সাধারণ গ্যালারিতে বসার জন্য সিটের ব্যবস্থা ছিল না ) কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই গতম্যাচে আমাদের সর্বোচ্চ স্কোরার অধিনায়ক হাবিবুল বাশার আউট,দলের স্কোর তখন ৮.৪ ওভারে ৩৭!! তখন মনে ভয় জেগে গেলো,এখুনি বুঝি ব্যাটিং লাইনে মড়ক লেগে ১৫০ রানের ভিতরেই প্যাকড হয়ে যাবো কিন্তু প্রাথমিক ধাক্কা মোটামুটি কেটে যায় আশরাফূল আর আফতাবের ৫৮ বলে ৪৪ রানের জুটিতে। এরমধ্যে আশরাফুল দুই ছক্কার মাধ্যমে পুরো স্টেডিয়ামে দুইদুইবার আনন্দের জোয়ার এনে দিয়েছেন কিন্তু আশরাফুল কার্তিকের বলে কট এন্ড বোল্ড হয়ে ফিরলে সেই জোয়ার থেমে যায় । এর মাত্র দুই ওভার পরেই রাজিন সালেহ দশ বলে শূন্যরানে রান আউট হয়ে ফিরে গেলে স্টেডিয়ামে দর্শকদের আনন্দে ভাটার পড়ে। তখন আবার ১৫০ রানের মধ্যে প্যাকড হওয়ার ভয়। কিন্তু পাইলটের সাথে আফতাব ষষ্ঠ উইকেট জুটিতে আবার ৪৪ রানের জুটি গড়লে সেই ভয় কেটে যায়। দলীয় ১৩২ রানে পাইলট ২০ রানে রান আউট হয়ে ফিরে গেলেও তখন আফতাবের ব্যাটে চড়েই আমরা ২২০+ রানের স্বপ্ন দেখছিলাম কিন্তু সেই স্বপ্নে বড় ধাক্কা লাগে যখন দলকে ১৬৮ রানে রেখে আফতাব ব্যক্তিগত ৬৭ রানে কার্তিকের বলে বোল্ড আউট হয়ে ফিরে যায়। তখন আমাদের সবার একটাই আশা বাংলাদেশ যেনো কোনোমতে ২০০ পার করে কারণ ২০০ এর নীচে আউট হলে তো আর জয়ের স্বপ্ন দেখতে পারবো না। যখন স্বপ্ন ভাঙ্গা গড়ার দোলাচলে আমরা সবাই দোদুল্যমান তখুনি নাটকের দৃশ্যপটে হাজির হন সেদিনের নায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা। নয় নাম্বারে ব্যাটিং করতে নেমে মাশরাফি সেদিন ৩৯ বলে ৩১ রানের অসাধারণ একটা দায়িত্বপূর্ণ ইনিংস খেলেন, মূলত তার এই ইনিংসের কল্যাণেই বাংলাদেশ ২০০ তো পার করে বটেই,ইনিংস শেষ করে ৯ উইকেটে ২২৯ রানে। যেখানে ২০০ হলেই জয়ের চিন্তা করছিলাম সেখানে ২২৯ হয়েছে তাই আমাদের মনে সেই সোনার হরিণ জয়ের আশা আরো অনেক বেশি বেড়ে যায়।
ইনিংসবিরতিতে অনেকেই বাইরে যাচ্ছিলো কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করে টাইমপাস করতে (আগে স্টেডিয়াম থেকে বের হয়ে গেলেও আগের টিকিট শো করে আবার ভিতরে ঢুকা যেতো) কিন্তু আমরা আর বাইরে যাই নি, খেলোয়াড়রা কিভাবে প্র্যাকটিস করে এটা দেখার জন্য বসে ছিলাম । প্র্যাকটিস সেশনে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল একটিই, মাশরাফি একটামাত্র স্ট্যাম্প সই করে প্র্যাকটিস করছিলো, সাধারণত মাত্র একটা স্ট্যাম্পকে সই করে ভাঙ্গাটা খুব কঠিন কাজ কিন্তু মাশরাফি সেটিই প্র্যাকটিস সেশনে করলো !!!! এই ঘটনা দেখেই বলে উঠেছিলাম আজ মাশরাফি অন্তত একজনকে হলেও বোল্ড আউট করবে ।
যথারীতি ভারতের ইনিংস শুরু হলো। কো ইনসিডেন্ট কিনা জানি না আমার প্রেডিকশন ইনিংসের তৃতীয় বলেই মিলে গেলো, মাশরাফির বলে বোল্ড আউট হয়ে সাজঘরে ফিরে গেলেন শেওয়াগ!!! পুরো স্টেডিয়াম তখন আনন্দে উন্মাতাল আর সেই আনন্দ দ্বিগুণ হয়ে যায় ইনিংসের চতুর্থ ওভারে যখন তাপস বৈশ্যর বলে রাজিন সালেহর হাতে ক্যাচ দিয়ে যুবরাজও আউট হয়ে যায়!! ভারতের সংগ্রহ তখন মাত্র পাঁচরান,পুরো স্টেডিয়াম তখন জয়ের নেশায় বুঁদ হয়ে গেছে, কিছুক্ষণ পরপর পুরো স্টেডিয়াম বাংলাদেশ বাংলাদেশ বলে গর্জনে হুঙ্কার দিচ্ছে। ভারতকে তখন এতটাই চেপে ধরেছিলো বাংলাদেশ যে প্রথম ছয় ওভারে ভারতের সংগ্রহ ছিল দুই উইকেট হারিয়ে মাত্র আট রান!! মানে রানরেট ছিল দেড়ের চেয়েও কম!! অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলি অপেক্ষাকৃত নতুন শ্রীরামকে নিয়ে আস্তেধীরে বিপর্যয় সামলানোর চেষ্টা করছিলেন। গাঙ্গুলি-শ্রীরামের ৪৬ রানের জুটিতে যখন স্টেডিয়ামের গর্জনে কিছুটা ভাটা পড়েছিলো তখুনি সেই গর্জন আবার ফিরিয়ে আনেন খালেদ মাহমুদ, গাঙ্গুলিকে মাশরাফির হাতে তালুবন্দী করে আমাদের জয়ের আশা অনেকখানি বাড়িয়ে দেন খালেদ মাহমুদ। কারণ এমনিতেই দলে শচীন দ্রাবিড় নেই তারউপর শেওয়াগ গাঙ্গুলিও আউট। তবে সেই জয়ের আশার প্রদীপ অনেকখানি নিষ্প্রভ হতে বসে শ্রীরামের সাথে কাইফের ৭০ বলে ৬৩ রানের জুটিতে। ঠিক এই সময়েই ম্যাচের রঙ্গমঞ্চে বাংলাদেশের প্রথম ওয়ানডে ম্যাচ জয়ের নায়ক রফিকের আগমন, ক্রিজে সেট হয়ে যাওয়া শ্রীরামকে দলীয় ১১৪ রানে স্ট্যাম্পড করে বাংলাদেশকে আবার ম্যাচে ফিরিয়ে আনেন এই বাঁহাতি স্পিনার,পুরো স্টেডিয়াম তখন আবারো আনন্দ উল্লাসে উন্মাতাল। এর চার ওভার পরেই মঙ্গিয়াকে দলীয় ১৩১ রানে এলবিডব্লির ফাঁদে ফেলে বাংলাদেশের জয়ের আশার প্রদীপে অনেকখানি জ্বালানী দিয়ে দেন তাপস বৈশ্য। এরপর মাত্রই নিজের দ্বিতীয় ম্যাচ খেলতে নামা ধোনীকে সাথে নিয়ে দলকে জয়ের দিকে নেওয়ার চেষ্টা চালাতে থাকে কাইফ কিন্তু সেই জুটিকে ২৪ রানের বেশি বাড়তে দেন নি সেদিনের মূলনায়ক মাশরাফি। ধোনী আউট হওয়ার পর আমরা সবাই হন্যে হয়ে অপেক্ষা করছিলাম কাইফের আউটের জন্য কারণ তখন ভারতের ব্যাটিং লাইনআপে একমাত্র স্বীকৃত ব্যাটসম্যান হিসেবে কাইফই আউট হওয়া বাকি আর যেহেতু রিকোয়ার্ড রানরেট নাগালের মধ্যে তাই কাইফকে আউট না করলে ম্যাচ জেতা যাবে না সেটা বুঝাই যাচ্ছিলো। কিন্তু কাইফ এত্ত সাবলীলভাবে খেলছিলো যে তাকে কিভাবে আউট করা যায় সেটাই আমরা ভেবে পাচ্ছিলাম না। দলীয় ১৭০ রানে অবশেষে কাইফ আউট হয় আর কাইফের আউট হওয়াটা আমার জীবনের অন্যতম স্মরণীয় মুহূর্ত। একটা আউটকে কেনো জীবনের অন্যতম স্মরণীয় মুহূর্ত বলছি তা বুঝতে হলে স্টেডিয়ামে তখনকার পরিস্থিতির ব্যাপারে জানতে হবে ।
ভারতের স্কোর যখন ১৭০/৬ আর কাইফ ব্যক্তিগত ৪৯ রানে ক্রিজে, তখন মনে মনে ভাবছিলাম এসব মাইলস্টোনের আগে সাধারণত ব্যাটসম্যানরা একটু নার্ভাস থাকে আর এই সুযোগে যদি কাইফকে আউট করা যেতো... আমার মনের ইচ্ছা পূরণের জন্য কিনা জানি না কিন্তু ঠিক ওই সময়েই রফিকের বলে কাইফ একটা রিস্কি সিঙ্গেল নিতে গেলে রাজিন সালেহ ডিরেক্ট থ্রো তে স্ট্যাম্প ভেঙ্গে দেয় আর কাইফও নিজেকে বাঁচানোর জন্য ডাইভ দেয়। গ্যালারিতে বসে মনে হচ্ছিলো ডাইভের ফলে কাইফ বুঝি বেঁচেই গেলো কিন্তু যখন দেখলাম আম্পায়ার থার্ড আম্পায়ারকে রেফার করেছে তখন সবার মনের মধ্যে ক্ষীণ আশা জেগে উঠলো। থার্ড আম্পায়ারের ডিসিশন জানার জন্য সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি,তখন বিগ স্ক্রিনে ডিসিশন দেখানোর সিস্টেম আমাদের দেশের স্টেডিয়ামে ছিল না,তাই লাল সবুজ বাতিই ছিল মূলভরসা কিন্তু সেই বাতি যে কোথায় আমি ঠিক খুঁজেই পাচ্ছিলাম না।পুরো স্টেডিয়ামে তখন পিনপতন নীরবতা, যে যার মতন প্রার্থনায় মগ্ন আর আমি মগ্ন লাল সবুজ বাতির সন্ধানে। ঠিক তখুনি পিনপতন নিরবতা থেকে হুট করে পুরো স্টেডিয়াম বিশাল গর্জনে ফেটে পড়ে, থার্ড আম্পায়ার নাকি রেড সিগন্যাল দিয়ে দিয়েছে !!! আমি নিজেও তখন আনন্দে আত্মহারা কিন্তু সেই লালবাতি দেখার আশায় বারবার কাজিনদের আস্ক করছিলাম বাতিগুলো কোথায়, বাতিগুলো কোথায়। আমার পাশে বসা একজন ভদ্রলোক উইকেট পাওয়ার আনন্দে এতটাই আনন্দিত যে সে আমাকে কোলে তুলে নিলো যাতে আমি লালবাতিটা দেখতে পারি। উনি আমাকে বারবার জিজ্ঞাস করছে আমি বাতিটা দেখতে পেরেছি কিনা,বাতি দেখতে না পেলেও উনাকে খুশি করতে বললাম যে আমি বাতিটা দেখতে পেয়েছি। কাইফের আউটের পরেই আমি বুঝে গেছি আমাদের কাছে ক্রিকেট শুধুমাত্র একটা খেলা না, ক্রিকেট আমাদের জীবনেরই একটা অংশ। যেই ক্রিকেটের সামান্য একটা আউটে আনন্দিত হয়ে একজন মানুষ অপরিচিত এক বালককে কোলে তুলে নিতে পারে সেই ক্রিকেটকে কি নেহাত খেলা বলা যায়???
খেলার বর্ণনায় ফিরে যাই। কাইফ আউট হওয়ার পর সেই একই ওভারে আগারকারকে আফতাবের হাতে তালুবন্দী করেন রফিক,এই আউটে পাইলট এতটাই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন যে ম্যাচ শেষ না হওয়া সত্ত্বেও সে স্ট্যাম্প তুলে নিয়ে উদযাপন শুরু করে দেয়। পরে অবশ্য একারণে পাইলটকে জরিমানা গুণতে হয় কিন্তু স্টেডিয়ামে বসে আমরা এই ঘটনা দেখে ভীষণ মজা পেয়েছিলাম। এরপর জহির খানকে নিয়ে ভারতের ২০০৭ টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ের শেষওভারের হিরো যোগিন্দার শর্মা ৩২ রানের জুটি গড়লেও তা বাংলাদেশের জয়ে বাঁধা হতে পারে নি, খালেদ মাহমুদের বলে ম্যাচের নায়ক মাশরাফির হাতে জহির খান তালুবন্দী হলে জয় থেকে মাত্র এক উইকেট দূরে দাঁড়িয়ে থাকে বাংলাদেশ। এর দুই ওভার পরেই আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ,আফতাবের থ্রো তে মুরালি কার্তিকের রান আউটের মাধ্যমে পুরো স্টেডিয়াম জয়ের আনন্দে ভেসে যায়।আমি তো কিছুক্ষণ ননস্টপ শুধু বাংলাদেশ বাংলাদেশ বলে চেঁচিয়েই গেছি কিন্তু তখন খেয়াল করি আমাকে কোলে তুলে নেওয়া ওই ভদ্রলোক জয়ের পর আনন্দে কেঁদেই ফেলেছেন, তখন জানতে পারি যে স্টেডিয়ামের পাশেই তার বাসা হওয়ায় এখন পর্যন্ত এই স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ যতগুলো ম্যাচ খেলেছে সবগুলো ম্যাচই সে দেখেছে,প্রতিদিনই ভেবেছে আজ হয়তো দলকে জিততে দেখবে কিন্তু কোনদিনই সেই আশা পূরণ হয় নি আর একারণেই এই জয়ের আবেগ তাকে এত্তবেশি ছুঁয়ে গেছে। আসলে শুধু তাকেই না,ওই ১৫ রানে জয়ের আনন্দে পু্রো দেশবাসীই ভেসে গিয়েছিলো কারণ একেতো সেটা ছিল বাংলাদেশের শততম ওয়ানডে ম্যাচ তারউপরে ঘরের মাঠে দলকে প্রথমবার জিততে দেখা। নিজের দেশের মানুষের সামনে প্রথমবার জিততে পারার আনন্দে বাংলাদেশের খেলোয়াড়েরাও ছিলেন আনন্দে উদ্বেলিত, নেচে গেয়ে লাফিয়ে কিংবা মাঠে শুয়ে পড়ে যে যেভাবে পারছিলো দর্শকদের অভিবাদনের জবাব দিচ্ছিলো। সেদিন ব্যাটে বলে অলরাউন্ড পারফর্মেন্সের জন্য ম্যাচসেরার পুরস্কার পান মাশরাফি বিন মর্তুজা।
সেই ঐতিহাসিক জয়ের পর একযুগ পেরিয়ে গেছে, আমাদের ক্রিকেটও অনেকদূর এগিয়ে গেছে। এখন ম্যাচজয় তো বটেই আমরা ঘরের মাঠে বড়দলের বিপক্ষে সিরিজও জিতছি। কিন্তু এত্ত জয় দেখার পরেও সেই ২৬ শে ডিসেম্বরের ঐতিহাসিক জয়ের প্রতিটি স্মৃতি আজও অম্লান হয়ে আছে। প্রথম প্রেমকে যেমন কখনো ভুলা যায় না তেমনি ঘরের মাঠে সেই প্রথম জয়কেও কোনোদিন ভোলা ভুলা যাবে না। আফসোস ইন্টারনেটে বাংলাদেশের ১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফির ভিডিও থাকলেও এই ম্যাচের কোনো ভিডিও ইন্টারনেটে তন্নতন্ন করে খুঁজেও পেলাম না, আর একারণেই এই জয় নিয়ে মানুষের মুখে চর্চাও খুব কম হয়।একারণেই এই ম্যাচটা নিয়ে লিখলাম যাতে ২০০৭ এর পরে খেলা দেখা শুরু করা মানুষেরা এই জয়ের ব্যাপারে জানতে পারে। আশা রাখি একদিন না একদিন এই ম্যাচের ভিডিও ঠিকই খুঁজে পাবো, সেদিন হয়তো আবারো স্মৃতির টাইম মেশিনে চড়ে ফিরে যাবো ২৬ শে ডিসেম্বরের সেই ঐতিহাসিক সন্ধ্যায়, আরো অনেক বেশি মনে পড়বে সেই ঐতিহাসিক জয়টাকে........
- 0 মন্তব্য