যে পরাজয় জয়ের বেশি
পোস্টটি ৯২৯৬ বার পঠিত হয়েছে
১ বলে ৪ রান দরকার। আইজাজ চিমার ব্লকহোলে ফেলা বলটিকে ব্যাটে বলে লাগাতে পারলেন না শাহাদাত। পড়িমরি করে ছুটলেন রানের জন্য। ১রান এল,লেগবাই থেকে। পুরো স্টেডিয়াম স্তব্ধ। ধাতস্থ হতে সময় লাগারই কথা, বাংলাদেশ মাত্র ২ রানে পাকিস্তানের কাছে পরাজিত হয়ে এশিয়া কাপ ২০১২-এর চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সুযোগ হারাল। কিছু মুহূর্ত পরেই স্টেডিয়াম হাততালিতে ফেটে পড়ল, মাহমুদুল্লাহ রিয়াদরা ড্রেসিং রুমে পোঁছানো পর্যন্ত করতালি চলতেই থাকল। দর্শকেরা চোখে জল নিয়ে অভিনন্দন জানাচ্ছেন পরাজিত, শ্রান্ত বাংলাদেশকে –এই ম্যাচকে বর্ণনা করার জন্য এই কাব্যিক মুহূর্তটিই যথেষ্ট।
আচ্ছা বাংলাদেশ দলের ভুল কি ছিল? শাহাদাত হোসেনের ৫০তম ওভারে ১৯ রান দেওয়া? নাকি নাজিমউদ্দিনের স্লথ গতিতে ৫২ বলে ১৬ রান? অথবা সাকিব আল হাসানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে–যখন ৩৯ বলে ৫৮ রান দরকার – তখন উইকেট বিলিয়ে আসা?
ভুল ধরতে চাইলে ছোট ছোট অনেক ভুলই সামনে চলে আসে। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান সরফরাজের ৫২ বলে ৪৬ রানের ইনিংস, এই ম্যাচের আগে যার সর্বোচ্চ রানই ছিল ২৪, মাত্র ৬২ স্ট্রাইকরেট নিয়ে। অথবা আফ্রিদির ৩২ বলে ২২ রান এবং ১০ ওভারে ২৮ রান দিয়ে ১ উইকেট নেওয়া। এগুলোই তো পাকিস্তানের জয়ের ভিত গড়েছিল।
কোন কোন দিন এমন হয় না যে ম্যাচের শুরু থেকেই মনে হতে থাকে যে বাংলাদেশ আজ জিতবেই-–আমার কাছে শুরুটা এমনই মনে হয়েছিল। শুধু শুরু কেন, শেষ বল পর্যন্ত আমি বিশ্বাস করিনি বাংলাদেশ হারতে পারে।
খেলা শুরুর প্রথম ১০ ওভার বাসে এফএম রেডিওতে শুনতে হয়েছিল, শাহবাগ থেকে কুর্মিটলা ক্যান্টনমেন্ট যাচ্ছিলাম ফুপুর বাসায় । ৫ম ওভারে মাশরাফির বলে নাসির জামশেদের আউট হওয়ার পর বাসের মধ্যে চিৎকার আর হাততালির বন্যা শুরু হয়। যেটা আরো বিস্তৃত হয় ঠিক তার পরের ওভারেই, নাজমুল হোসেন এলবিডব্লিউ-এর ফাঁদে ফেলেন ইউনুস খানকে।
ধীরে ধীরে সময় যায় আর বাংলাদেশ খেলার নিয়ন্ত্রণ নিতে থাকে। ২২তম ওভারে হাফিজ আবদুর রাজ্জাকের বলে নাজমুলের অসাধারণ ক্যাচে সাজঘরে ফেরেন ৮৭ বলে ৪০ রানের স্লথ ইনিংস খেলে। শেষমেশ আফ্রিদির ছোট ক্যামিও ইনিংস, সরফরাজের দায়িত্বশীল ব্যাটিং এবং শাহাদাতের শেষ ওভারে ১৯ রানের খরুচে বোলিং-এর ফলে পাকিস্তান ২৩৮ রানের সম্মানজনক স্কোর করতে সক্ষম হয়।
বাংলাদেশের ইনিংসের গোড়াপত্তন করতে আসেন তামিম ইকবাল ও নাজিমউদ্দিন। কিন্তু শুরুতেই খেই হারিয়ে ফেলেন নাজিম, ২য় ওভারে উমর গুলের প্রথম ৫ বলের ৪টিতেই সম্পূর্ণভাবে পরাস্ত হন তিনি। যেখানে তার দায়িত্ব ছিল ইনিংসের হাল ধরার আর তামিমের আক্রমণাত্মক খেলার, সেখানে তামিম তার কাজ ঠিকঠাক পালন করে গেলেও নাজিমউদ্দিন সম্পূর্ণভাবে রান তোলার দায়িত্ব তামিমের ওপর ছেড়ে দেন। ৫২ বলে ১৬ রানের ইনিংস খেলে তিনি সাজঘরে ফেরেন। এরপর দ্রুতই ফেরেন জহুরুল, আজমলের দুসরার শিকার হয়ে। কিছুক্ষণ পর নতুন পার্টনারশিপ থিতু না হতেই টানা ৪র্থ অর্ধশতক হাঁকিয়ে ৬৮ বলে ৬০ রানের ইনিংস খেলে সাজঘরে ফেরেন তামিম।
ব্যাটিংয়ে নামেন সাকিব এবং প্রথম বলেই ৪ মেরে বাংলাদেশ দলের ব্যাটিংয়ে হুট করে জেগে ওঠা অস্বস্তি দূর করার প্রতিশ্রুতি দেখান। সাকিব তার স্বভাবসুলভ ব্যাটিং করে রানের চাকা সচল রাখলেও নাসির রানের জন্য রীতিমত যুদ্ধ করতে থাকেন। ফলে আস্কিং রানরেট ৮-এর উপর উঠে যায়।
৪৩ তম ওভারে নাসির ৬৩ বলে ২৮ রান করে উমর গুলের শিকারে পরিণত হন। সাকিব একই ওভারে উমর গুলকে স্কুপ করে ছক্কা মেরে চাপ কমানোর আভাস দেন। কিন্তু পরের ওভারে আইজাজ চিমার বলে একই রকম শট খেলতে গিয়ে বোল্ড হয়ে সাজঘরে ফেরেন সাকিব।
৫ ওভারে যখন ৪৭ রান দরকার মুশফিক আইজাজ চিমার বলে ৪ মেরে জানান দেন এই বাংলাদেশকে গুটিয়ে ফেলা সহজ নয়। গুলের ৪৭তম ওভারে মাশরাফি ও মাহমুদুল্লাহ ৪ বলে ৩টি বাউন্ডারি হাঁকিয়ে টার্গেট ১৫ বলে ১৯-এ নিয়ে আসেন।মাশরাফি শর্ট ফাইন লেগে ক্যাচ দিয়ে আজমলের দ্বিতীয় শিকারে পরিণত হন।
শেষ ওভারে প্রয়োজন ছিল ৯ রান। মাহমুদুল্লাহ স্ট্রাইকে। প্রথম বলে ১ রান নেওয়ার পর দ্বিতীয় রান নেওয়ার সময় চিমার সাথে ধাক্কা লাগায় দ্বিতীয় রান নেওয়া মাহমুদুল্লাহর পক্ষে সম্ভব হয়নি। এরপরের বলে সিঙ্গেল, পরের বল ডট এবং তার পরের বলে ৩ রানে টার্গেট দাঁড়ায় ২ বলে ৪ রান। স্ট্রাইকে ছিলেন রাজ্জাক। কিন্তু তিনিও সাকিবের মত স্কুপ করতে গিয়ে বোল্ড হয়ে প্যাভিলিয়নের পথে পা বাড়ান।
শেষ বল, ৪ রান দরকার । স্ট্রাইকে শাহাদাত হোসেন, পারলেন না তিনি,লেগবাই থেকে ১ রানের বেশি এল না।
আমি পাশে তাকালাম, আমার ফুপা নিশ্চুপ হয়ে স্ক্রিনে তাকিয়ে আছেন। আমার দুই কাজিন একেবারে চুপ। আমার কানে ভেসে আসছে কমেন্ট্রি বক্স থেকে –“Pakistan winning the Asia Cup 2012 & Bangladesh have won the hearts of everyone.”
মাঠের মধ্যে সাকিব-মুশফিক কাঁদছে , দর্শকেরা কাঁদছে। ২০১১-এর বিশ্বকাপের পর দায়িত্ব পাওয়া কোচ স্টুয়ার্ট ল, যিনি এই স্বল্প সময়ে দলের আমূল পরিবর্তন এনেছেন- সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
আমি বসে আছি ম্লানমুখে। এই বাংলাদেশ এক ভিন্ন বাংলাদেশ, এরা হারার আগে হার স্বীকার করে না। আজ হেরেছি,কাল জিতব। আমি এক উজ্জ্বল সূর্যের আভাস পাচ্ছিলাম যেন। এই ম্যাচ বাংলাদেশের বড় দল হয়ে ওঠার ম্যাচ,এই ম্যাচ বাংলাদেশের হেরেও না হারার ম্যাচ। এই ম্যাচ কোটি কোটি ভক্তকে কাঁদিয়েও তাদের হৃদয়ে জায়গা করে নেওয়ার ম্যাচ। হ্যাঁ, এই ম্যাচে বাংলাদেশ হেরেছে –কিন্তু এটাই আমার দেখা বাংলাদেশের সেরা ম্যাচ ।
- 0 মন্তব্য