যে ম্যাচ বাংলাদেশ খেলেছিলো ১২ জন নিয়ে !
পোস্টটি ৪৩২৯৫ বার পঠিত হয়েছে১০ বছর সময়টা একেবারে কম না।
একটু ব্যাক্তিগত হিসাব করি। এই ১০ বছরে বলার মতো কি কি পরিবর্তন হয়েছে?
জুতার সাইজটা বেশ বড় হয়েছে। স্কুল কলেজ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি। আগের মতো রগচটা স্বভাবটাও আর নেই।
বন্ধু-বান্ধবের একটা বড় অংশই বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে। জীবন কত অনাকাঙ্ক্ষিত ছন্দ পতনের সাক্ষী হয়েছে এই ১০ বছরে। ১০ বছরে সুখ দুখের সংজ্ঞা কতবার বদলালো তা হিসাব রাখিনি। কত কিছুই আজকাল আর মনে পড়ে না।
তবু, ১০ বছরের হিসেব করলে কিছু কথা মনে পড়ে।
আমাদের জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ আনন্দ বেদনার কাব্য রচনা হয়েছে ক্রিকেটের হাত ধরে। ক্রিকেটে খেতাম, ক্রিকেটে ঘুমাতাম, ক্রিকেটে হারাতাম। ছোট মানুষের অনাচার।
শহরের কংক্রিটের সড়কে ক্রিকেট খেলে কত বাড়িওয়ালাদের গ্লাস ভেঙ্গেছি। ভেঙ্গেই দৌড়ে পালিয়েছি। গলির মধ্যে তিন তিনজন স্যার এর কোচিং সেন্টার ছিলো।
বিকেলের দিকে মহল্লার যাবতীয় সুন্দরীদের পদধূলি পড়তো আমাদের গলিতে। কিছুটা ক্রিকেট ভালবেসে আর বাকিটা তাদের ভালবেসে যত্ন করে আমরা হাওয়ায় উড়িয়ে দিতাম টেপ টেনিসের বলগুলো। যদিও আমাদের নিয়মে ছিলো ছক্কা মারলেই আউট! সুন্দরীদের সামনে সেই বয়সে আউট হওয়ার মধ্যেও বীরত্ব ছিলো যে খুব, তাই সবার কাছ থেকে চান্দা তুলে কেনা বল হারাতে মায়া দয়া হতো না কারোই।
দোয়া দূরুদের দিনগুলোতে ক্রিকেট
সেই সময়ে টেলিভিশনে বাংলাদেশের ম্যাচ থাকা মানেই পেটে ব্যাথা শুরু হয়ে যাওয়া। পেট ব্যাথা, মাথা ব্যাথা কিংবা কাকতালীয় সৌভাগ্যের জ্বরে ভুগে স্কুল ফাঁকি দেয়ার কি আপ্রাণ চেস্টা করেছি তখনকার দিনে।
আপ্রাণ চেস্টা করতো আমাদের খেলোয়াড়েরাও। সম্মানজন স্কোরের জন্য কিংবা সম্মানজনক হারের জন্য ! আমাদের অবুঝ মন। খেলার দিনগুলোতে সৃষ্টিকর্তার কাছে করজোড়ে দোয়া করতাম, এই ম্যাচটা যদি জিতিয়ে দাও খোদা। খেলার মাঝপথে দোয়া পালটে যেতো। তখন পঞ্চাশ ওভার খেলতে পারাই বিরাট চ্যালেঞ্জের বিষয়। জিম্বাবুয়ে সফর করতে আসলে অবশ্য ভিন্ন কথা। তখন অবশ্য পূর্ণ বিশ্বাসে জয়ের আশা নিয়ে খেলা দেখা যেতো...
একটি বিশ্বকাপ এবং স্বপ্ন
২০০৭ এর বিশ্বকাপ দেখতে দেখতে চলে এসেছিলো। চারিদিকে কত বিশ্লেষণ। কত আয়োজন। বিশ্বকাপে ভালো খেলার তেমন সুখস্মৃতি বাংলাদেশের নেই। তাছাড়া হাজার হাজার মাইল দূরের ওয়েস্টইন্ডিজে বাংলাদেশ কেমন খেলবে সেটি নিয়েও বিস্তর কথা চারদিকে।
তবুও, দোয়া এবং স্বপ্নকে সম্বল করে আমরা বুনছিলাম একটু একটু আশা। বিশ্বজয় নয়, বিশ্ববাসীর সামনে একটু ভালো খেলা প্রদর্শন করবে দল এই আশা।
১৬ই মার্চ,২০০৭,খুলনা
জাতীয় দলের ক্রিকেটার মাঞ্জারুল ইসলাম রানা বাড়ি ফিরছিলেন বাইকে করে। পথে ঘটলো মর্মান্তিক সড়ক দূর্ঘটনা।
মাত্র ২২ বছর বয়সে ২২ গজের দুনিয়া ছেড়ে অন্যলোকে চলে গেলেন সতীর্থদের প্রিয় বন্ধু রানা। যেদিন মারা যান সেদিনও লোকাল একটি খেলায় ম্যান অব দ্যা ম্যাচ হয়েছিলেন মানুষটা। শোকের ছায়া নেমে আসে সারা দেশে।
একটি শোক ও একটি প্রতিজ্ঞা
জাতীয় দল তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজে। পরদিনই বিশ্বকাপ ম্যাচ, ভারতের বিপক্ষে। মানসিক ভাবে নিশ্চয়ই অনেক আঘাত পেয়েছিলেন দলের সব সদস্য'রা। কিন্তু রানার চলে যাওয়ার শোককে শক্তিতে পরিণত করার মন্ত্র নিশ্চয়ই নিয়েছিলেন দলের সবাই। বিশ্বকাপের মতো একটি বড় আসর। ভারত দলে তখন গাংগুলি, শেবাগ, শচীনেরা। তবু টলে যাননি কেউ। অশ্রুসজল চোখে হয়ত টিম মিটিং এ সবাই একটাই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন জিততেই হবে ম্যাচটা। রানার জন্যে, দেশের জন্যে, সমালোচকদের জন্যে,সমর্থকদের জন্যে।
ধরে দিবানি
মাশরাফি বিন মর্তুজার "ধরে দিবানি" বাক্যটা এখন তুমুল জনপ্রিয়। আমরা এই বাক্যটা শুনলেই প্রেরণা পাই, নতুন করে অনুপ্রাণিত হই। ভারতের বিরুদ্ধে ম্যাচের আগে সাংবাদিকরা ম্যাচটি নিয়ে প্রশ্ন রাখলেন মাশরাফির কাছে। মাশরাফি বললেন,
"যদি উইকেট একটু ভেজা থাকে আর আমরা বল করি তাহলে ভারতকে 'ধরে দিবানি'"
সাহসী মাশরাফি, যোদ্ধা মাশরাফি এরপর আমাদের কতবার ঘুরে দাঁড়ানো শিখিয়েছেন, ঘাড়টা বাঁকা করে নিজেকে চ্যালেঞ্জ করা শিখিয়েছেন, হাল ছেড়ে না দেয়ার মন্ত্র শিখিয়েছেন। কিন্তু বিশ্বকাপের মতো একটি আসরে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচের আগে বলা এই দুইটি শব্দ-ধরে দিবানি-আসলে ক্রিকেট বিশ্বে বাংলাদেশের নতুন যুগে প্রবেশ করার ট্যাগলাইন। অন্তত আমি এটিই মনে করি।
মাশরাফিতেই ধরার শুরু
ত্রিনিদাদের পোর্ট অব স্পেনে একটি রোদ্রজ্জল দিন।
ভারতের টস জয়। ব্যাটিং এর সিদ্ধান্ত নিলেন তারা। কিন্তু যেদিন মাঠে একরাশ দুঃখ আর হৃদয়ের বন্ধু রানার চলে যাওয়ার ক্ষত নিয়ে মাশরাফিকে মাঠে নামতে হয়েছে সেদিন কে কত বড় ব্যাটসম্যান তা নিশ্চয়ই মাশরাফির কাছে বড় বিষয় নয়। শুরুটা করলেন শেবাগকে দিয়ে। গতি আর নিখুঁত লাইনে করা বলটা শেবাগ বুঝতেই পারলেন না কি থেকে কি হলো ! তার ব্যাট হালকা ছুঁয়ে স্ট্যাম্প ভাঙ্গলো বলটা। এরপর গুণে গুণে আরো তিনটি উইকেট নিলেন মাশরাফি। ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা বোলিং -টি সেদিন করেছিলেন মাশরাফি। ৩৮ রান দিয়ে চার উইকেট।
কে জানে, হয়ত মাঠের কোথাও কোনো এক কোন থেকে নিরব দর্শক হয়ে হাততালি দিচ্ছিলেন মাঞ্জারুল ইসলাম রানা।
রাজ্জাক-রফিক ঘূর্ণিঝড়
বাঁহাতি স্পিনের সেরা সময় ছিলো তখন, এইটুকু নিশ্চিন্তে বলা যায়। আর দিনটি যখন শুরুই হয়েছিলো জয়ের প্রতিজ্ঞা নিয়ে তখন সেরা পারফর্মেন্সটাই আসবে তাদের কাছ থেকে এমনটা তো প্রত্যাশিত ছিলো। রাজ্জাক তুলে নিলেন তিনটি উইকেট যার মধ্যে ছিলো শচীন আর যুবরাজের উইকেটটিও। রফিক ও সমান তিনটি উইকেট নিলেন। উইকেট গুলো ছিলো গাংগুলি, রাহুল দ্রাবিড় আর মহেন্দ সিং ধোনির ! কি অসাধারণ বোলিং-ই না করেছিলেন এই জুটি সেদিন। এক একটি উইকেটের পতনে স্বপ্নের কাছাকাছি যাওয়ার কাজটা তারাই করে দিলেন।
তামিম ইকবাল দ্যা বিগিনিং অফ আ ফিয়ারল্যাস স্টোরি
২০০৭ এর বিশ্বকাপে তামিমের বয়স ছিলো মাত্র ১৭ বছর।
ক্ষ্যাপাটে তামিম, পাগলাটে তামিম। শুরু থেকেই খেলছিলেন আক্রমণাত্মক ক্রিকেট। হটাত জহির খান এর একটি বাউন্সার হেলমেটে গিয়ে লেগে ফিল্ডারের হাতে পড়লো। ক্যাচ এর আবেদন আম্পায়ার নাকচ করে দেন। কিন্তু ঘাড়ের দিকে কিছুটা ব্যাথা পান তামিম। এরপর যা দেখালেন তামিম এমন সাহসী ব্যাটিং এর আগে আর কেউ দেখায়নি। জহির খানের শর্ট বলগুলোকে ডাউন দ্যা ট্র্যাকে এসে কাউন্টার এট্যাক করে মাঠ ছাড়া করলেন। মিড উইকেটে একটি ছয় গ্যালারির দো'তলায় গিয়ে পড়লো। তামিমের আগ্রাসী ব্যাটিং এ হা হয়ে তাকিয়ে থাকলেন জহির খান। বেচারার কিছুই করার ছিলো না...
তামিম-মুশফিক-সাকিবের ফিফটি
ঐতিহাসিক ম্যাচটি তামিম ফিফটি করে বিদায় নিলেন। মুশফিক নামলেন। ৫৬ রান করে অপরাজিত থেকে ম্যাচটিকে মাঠে থেকে জয়ের বন্দরে তিনি পৌঁছে দেন। মাঝখানে সাকিব খেললেন ৮৬ বলে ৫৩ রানের দায়িত্বশীল ইনিংস।
এটি এমনই এক ম্যাচ যা বাংলাদেশ ক্রিকেটের শুভ দিনের আগমনী বার্তা দিয়েছিলো। এই তিন ব্যাটিং স্তম্ভ এখনো জাতীয় দলের মূল খেলোয়াড়। তাদের ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে পুরো দল।
অথচ, এরই মধ্যে কত খেলোয়াড় ঝড়ে গেলেন, কতজনের অভিষেক তাদের সাথেই হয়েছিলো, কতজন সম্ভাবনা জাগিয়েও দলে থাকতে পারলেন না। কিন্তু এই ত্রয়ী যে আমাদের ক্রিকেটের নির্ভরতার প্রতীক। সেটির বার্তা তারা দিয়েছিলেন ১০ বছর আগেই!
অতঃপর পাঁচ উইকেটের স্মরণীয় জয়
উইনিং শটটি এসেছিলো মুশফিকের চারে।
৯ বল বাকি ছিলো মাত্র। হয়ত স্বাচ্ছন্দ্যে জেতা হয়নি ম্যাচটি। হয়ত অন্য কোনোদিন হলে তারা ব্যাটিং কলাপস করতেই পারতেন। হয়ত নার্ভাসনেস ঝেঁকে ধরতেই পারতো।
"হয়ত" "যদি" "সম্ভবত" কোনোকিছুকেই সত্যি হতে দিলেন না কেউ। একক নৈপুণ্য নয়, বাংলাদেশের এই জয়টি ছিলো একটি দলীয় সংগীত। যে সংগীত এক সুরে গেঁথে দিয়েছিলেন মাঞ্জারুল ইসলাম রানা।
যে সুর আলোড়ন জাগিয়েছিলো ধরে দিবানি'তে। যে সুরের পথ ধরে ১০ বছর পর এখন বাংলাদেশ সমীহ জাগানিয়া দল ! আমাদের পরম সৌভাগ্য এই সুরময় ছন্দের প্রতিটি তালে আমরা সাক্ষী ছিলাম।
..................
দশ বছর কম সময় নয়। স্মরণীয় ঘটনার তালিকা তাই বোধহয় লম্বাই হয়ে যায়। হয়ত সব মনে রাখা যায় না। তবুও বাঁকবদলের কতকথা চাইলেও ভোলা যাবে না।
২০০৭ এর বিশ্বকাপ, ভারতের বিপক্ষে জয় এমনই একটি গল্প।
যে ম্যাচে শুধু ওরা এগারোজন খেলে নি, আরো একজনও যে ছিলেন। তার চলে যাওয়া, রেখে যাওয়া স্মৃতি, ঐকতানের গল্প, ড্রেসিং রুমের প্রতিজ্ঞা এবং একটি জয় সব কিছু একই সূত্রের চলমান ধারা। যে ম্যাচটির নায়কেরা এখনো বাংলাদেশ দলকে আগলে রেখেছেন। পথ দেখিয়ে যাচ্ছেন।
সৃষ্টিকর্তা মাঞ্জারুল ইসলাম রানাকে ভালো রাখুক, ভালো রাখুক দেশের প্রতিটা ক্রিকেটারকে। ভালো থাকুক বাংলাদেশ ক্রিকেট ও স্বপ্নগুলো। নিশ্চয়ই আমরা করবো জয় একদিন আরো বড় মঞ্চ......
- 0 মন্তব্য