ক্যারিবীয় সাগরে লাল সবুজের সূর্যোদয়
পোস্টটি ৯৪৭৭ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না।
ব্লগের নীতিমালা
ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।
সালটা ২০০৭, ওয়েস্ট ইন্ডিজে বিশ্বকাপের আসর, আগের বছর জিম্বাবুয়ে-কেনিয়া-আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে পাওয়া একগুচ্ছ জয়কে সঙ্গী করে উড়ে যাওয়া ক্যারিবিয়ান সাগরপানে। দলে দারুণ কিছু তরুণ মুখ, মাথার ওপর ছায়া হয়ে আছেন বাশার-আশরাফুল-রফিকদের মতো অভিজ্ঞরাও। প্রথম ম্যাচের প্রতিপক্ষ ভারত, নামে ধামে শৌর্য্যে গৌরবে যারা কোটিগুণ বিশাল। ভেন্যু পোর্ট অফ স্পেনে, বাংলাদেশ দল তাঁবু গাড়লো ত্রিনিদাদে। সেখানেই এলো দুঃসংবাদটা।
অধিনায়ক হাবিবুল বাশারের মোবাইলে দেশ থেকে ফোন এসেছিল একটা। রানা নেই, সেতু নেই- খুলনার চুকনগরে মোটরসাইকেল দূর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন জাতীয় দলের ক্রিকেটার রানা। ম্যাচের একদিন আগে সঙ্গীকে হারিয়ে শোকে মূহ্যমান ক্রিকেটারেরা। মানজারুল ইসলাম রানা, খুলনার সেই কালোমতন অলরাউন্ডার ছেলেটা, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিমানে ওঠার আগে বাশারকে বলেছিলেন, ভাই, একটা ম্যাচ জেতা লাগবে কিন্ত!
পোর্ট অব স্পেনে ডেভ হোয়াটমোরের ছেলেরা সেদিন মাঠে নেমেছিলেন শোকের চাদর গায়ে জড়িয়ে। বাংলাদেশের সাথে নর্থ আমেরিকার সময়ের বিস্তর ফারাক, ম্যাচ শুরুই হয়েছিল বোধহয় বাংলাদেশ সময় নয়টার পরে। মফস্বল শহরে রাত নামে সন্ধ্যের খানিক পরেই, ক্লাস এইটের একটা ছেলের জন্যে জেগে থেকে খেলা দেখাটা যথেষ্ট কষ্টসাধ্য ব্যপার, পরদিন ক্লাস-কোচিঙের যন্ত্রণা তো ছিলোই। মাঠে কিছু করে দেখানোর তাড়না নিয়ে নামা আত্মপ্রত্যয়ী মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে একটা রাতের জন্যে ভুলে যাওয়া বাবার বকুনী, মায়ের শাসন।
বল হাতে শুরুটা মাশরাফিই করেছিলেন, প্রাণের বন্ধুকে হারিয়ে ফেলার শোকটুকু শক্তিতে পরিণত করে নিজেকে মাঠে ঢেলে দেয়ার মিশনে নেমেছিলেন নড়াইল এক্সপ্রেস। নিজের দ্বিতীয় ওভারের ভাংলেন শেবাগের স্ট্যাম্প, কলার উঁচিয়ে দৌড়ে আসা ছেলেটার বুকের ভেতর লুকিয়ে থাকা আগুনটা তখন দেখতে পায়নি কেউ। ওপর থেকে রানা নিশ্চয়ই দেখেছিলেন, হয়তো মুচকি হেসেছিলেন বন্ধুর আগুনঝরা বোলিং দেখে। তাঁর জন্যেই তো সেদিনের সবটুকু নিবেদন!
উথাপ্পা-টেণ্ডুলকার-দ্রাবিড় ফিরলেন দ্রুতই, গলার কাঁটা হয়ে টিকে ছিলেন গাঙ্গুলী। যুবরাজ সিং সঙ্গ দিচ্ছিলেন তাঁকে। পরপর দুই ওভারে দুজনকে ফেরালেন রাজ্জাক-রফিক। নিশুতি রাতে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ছাপিয়ে 'আউট' চিৎকারে পাঁচতলা অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংটা তখন দিশেহারা! এতো রাতেও বাংলাদেশের খেলা দেখার লোকের অভাব নেই তাহলে! উত্তেজনায় টগবগ করে ফোটা এক কিশোর তখনও জানেনা, অদূরেই হাতছানি দিচ্ছে ইতিহাস গড়া জয়!
১৯১ তে থেমেছিল ভারত, তীব্র জ্বরের ঘোরে খেলতে নামা মাশরাফি নিলেন চার উইকেট। ইনিংস ব্রেকের সময়টা এর আগে এতো লম্বা ছিল বোধহয় না কখনও। ভরসা ছিল যার ওপর, সেই শাহরিয়ার নাফীস ফিরলেন দুই রানে। চট্টগ্রামের এক আনকোরা তরুণ, যার নামটাই কানে এসেছিল মাস কয়েক আগে, সেই তামিম ইকবাল শুরু করলেন তাণ্ডব। ক্যারিবিয়ান সাগরের জলরাশি ফুলে উঠলো বিপুল তাণ্ডবে, জহির খানের ছুঁড়ে দেয়া বলটা তামিমের ব্যাটের জলোচ্ছ্বাসে আছড়ে পড়লো গ্যালারীতে। ডাউন দ্যা উইকেটে এসে উড়িয়ে মারা তামিম ইকবাল সেদিন থেকেই বাংলাদেশের ক্রিকেটের পোস্টারবয়।
আরেক তরুণ মুশফিক ছিলেন ধৈর্য্যের প্রতিমূর্তি হয়ে। হাফসেঞ্চুরী করেই তামিম ফিরলেন, উইকেট বিলিয়ে এলেন আফতাবও। হাল ধরলেন সাকিব আল হাসান। দুই তরুণের অর্ধশতকে জয়ের বন্দরে টাইগারেরা। শেবাগ ফেরালেন সাকিবকে, বাশারও বিদায় নিলেন শেবাগের ঘূর্ণিতেই। জয়ের সঙ্গে ব্যবধান তখন আঙুলসমান। কাভার ড্রাইভে মুশফিকের চারে সেই ব্যবধানও ঘুচে গেল! এর পরের গল্পটা আনন্দের, উল্লাসের, কান্নার, চিৎকারের, গলা ভাঙার। নিরানব্বইয়ের লাকী আখন্দ যেন বছর আষ্টেক পর ফিরে এলেন আবার, পিয়ানোতে বাজিয়ে তুললেন সেই চেনা সূর। দূরের আকাশে উচ্ছাসে উড়তে থাকা কল্পিত লাল-সবুজের পতাকা দেখা যায়নি রাতের আঁধারে, চারিদিকে শুধু "বাংলাদেশ! বাংলাদেশ!" ধ্বনিটাই মধুবর্ষণ করে গিয়েছিল কানে।
ভারতের বিপক্ষে জয় এসেছিল আগেও, হারানো হয়েছিল অস্ট্রেলিয়াকেও। কিন্ত পোর্ট অব স্পেনের সেই জয়ের মহীমাটাই অন্যরকম। বিশ্বকাপের সেরা আটে ওঠা প্রথমবারের মতো, বাংলাদেশের ক্রিকেটের গতিপথটাই পাল্টে দিয়েছিল সেই জয়। প্যাভিলিয়নের খেলার লেখা, লেখার খেলা-৩ এ "বাংলাদেশের যে ম্যাচ কখনও ভুলবেন না" প্রশ্নে আমি বেছে নিয়েছি ২০০৭ বিশ্বকাপের গ্রুপপর্বের এই ম্যাচকেই। এই ম্যাচটা তো শুধু ভারতের বিপক্ষে জয়ের ম্যাচ নয়, নিজেদের বুকে চেপে বসা শোককে পরাভূত করার ম্যাচও।
- 0 মন্তব্য