• ফুটবল

সপ্তম ফুটবল বিশ্বকাপ নিয়ে সাতটি ইন্টারেস্টিং ফ্যাক্ট

পোস্টটি ৬৫৯৫ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

আজ ১৭ ই জুন, ১৯৬২ সালের এইদিনে চিলির সান্তিয়াগোর এস্তাদিও ন্যাসিওনাল স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ফাইনালে তৎকালীন চেকস্লোভিয়াকে ৩-১ গোলে হারিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ জয় করে ব্রাজিল। সেটি ছিল বিশ্বকাপের সপ্তম আসর, ওই আসরটি নানা কারণে আলোচিত, আজ ওই বিশ্বকাপ ফাইনালের ৫৫ বছর পূর্তিতে সপ্তম বিশ্বকাপ নিয়ে সাতটি ইন্টারেস্টিং ফ্যাক্ট আপনাদের সাথে শেয়ার করছি।

logo

১। এক বিশ্বকাপ আয়োজনে কত বাঁধা বিপত্তি?!!!!!!!

১৯৬২ বিশ্বকাপের আয়োজক হওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী ছিল তিনটি দেশ - তৎকালীন পশ্চিম জার্মানি,চিলি ও আর্জেন্টিনা। কিন্তু আয়োজক নির্বাচনের ভোটাভুটির আগেই জার্মানিকে সরে যেতে হয় কারণ ৫৪ ও ৫৮ বিশ্বকাপ ইউরোপে হয়েছিলো তাই কনমেবল চাইছিলো সেবারের  বিশ্বকাপ যেনো লাতিন আমেরিকাতেই হয়। লাতিনে না হলে বিশ্বকাপ বর্জনের হুমকিও দিয়ে রেখেছিলো কনমেবল তাই ফিফার অনুরোধে জার্মানি আয়োজক হওয়ার দৌড়ে নিজেদের সরিয়ে নেয়। এরপর আয়োজক হওয়ার দৌড়ে আর্জেন্টিনাই ছিল এগিয়ে কিন্তু চিলিয়ান ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি কার্লোস ডিটবর্নের বুদ্ধিমত্তার কাছে হার মানতে হয় আর্জেন্টিনাকে। তবে এত লড়াই করে আয়োজক হওয়ার পরেও চিলির লড়াই শেষ হয় নি, চিলির বিশ্বকাপ আয়োজক হওয়ার স্বপ্নে বড় ধাক্কা লাগে ১৯৬০ সালের প্রলয়ঙ্করী ভালদিভিয়া ভূমিকম্প, ওই ভূমিকম্পে চিলির স্টেডিয়ামগুলোতে ব্যাপক ক্ষতি হয়। সবাই ধরেই নিয়েছিলো যে চিলিতে বিশ্বকাপ আয়োজন করা আর সম্ভব না কিন্তু এক্ষেত্রেও চিলির ত্রাণকর্তা হয়ে হাজির হন কার্লোস ডিটবর্ন, তার নেতৃত্বে চিলি ওই ভয়াবহ ভূমিকম্পের ক্ষতি কাটিয়ে উঠে বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। সেসময়ে তার একটি ডায়ালগ বিশ্বকাপের আনঅফিসিয়াল স্লোগানে পরিণত হয়,ডায়ালগটি ছিল, "Because we have nothing,we will do everything" কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে যেই মানুষটা বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য এত্তকিছু করলো সে এই বিশ্বকাপ দেখে যেতে পারে নি, বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার মাত্র ১ মাস দুইদিন আগে পরপারে পাড়ি জমান কার্লোস। তার স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে বিশ্বকাপ স্টেডিয়ামের একটির নামকরণ তার নামে করা হয়।

dittborn

 

 

২। মাত্র চার স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপ!!!

ভাবা যায়,মাত্র চারটি স্টেডিয়াম দিয়েই পুরো বিশ্বকাপ সম্পন্ন হয়েছিলো!!! অবশ্য প্রাথমিক প্ল্যান অনুযায়ী আটটি ভেন্যুতে বিশ্বকাপ আয়োজনের কথা ছিল কিন্তু ওইযে আগেই বললাম ১৯৬০ সালের প্রলয়ঙ্করী ভালদিভিয়া ভূমিকম্প যেটিকে কিনা পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালি ভূমিকম্প বলেও অনেকে বর্ণনা করেন সেই ভূমিকম্পের আঘাতে বাকি চারটি স্টেডিয়াম এতটাই ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে যে ভেন্যুর তালিকা থেকে বাকি চারটি স্টেডিয়ামের নাম প্রত্যাহার করা হয়। অন্য চারটি স্টেডিয়ামে অভূতপূর্ব দ্রুত গতিতে কাজ চালিয়ে বিশ্বকাপ শুরুর আগেই তৈরী করে ফেলা হয়। স্টেডিয়াম চারটির নাম ছিল এস্তাদিও ন্যাসিওনাল, এস্তাদিও সাসুয়ালিত, এস্তাদিও বার্দেন কপার আর এস্তাদিও কার্লোস ডিটবর্ন।

Chile-5

 

৩। শেষবারের মতন ইউরোমেরিকা কাপ!!!

১৯৬২ বিশ্বকাপে যেই ১৬ টি দেশ অংশগ্রহণ করেছিলো তাদের মধ্যে ১০ টি দেশ ছিল ইউরোপ থেকে, ৫ টি কনমেবল থেকে আর একটি কনকাকাফ থেকে। অর্থাৎ এশিয়া,আফ্রিকা কিংবা অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের একটি দলও এই বিশ্বকাপে ছিল না!!!! তবে এটিই ছিল শেষ বিশ্বকাপ যেখানে এশিয়া অথবা আফ্রিকার কোনো দেশ কোয়ালিফাই করতে পারে নি, সেই হিসেবে বলা যায় এটিই ছিল শেষ ইউরোমেরিকা কাপ।

 

৪। 'ব্ল্যাক স্পাইডার'কে' টপকে চার গোল!!!!!!!

লেভ ইয়াসিনকে তো মোটামুটি সবাই চিনেন, এই রুশ গোলকিপার অনেকের মতেই সর্বকালের সেরা গোলকিপার। ব্ল্যাক স্পাইডার খ্যাত এই গোলকিপারই ১৯৬২ বিশ্বকাপের একম্যাচে খেয়েছিলো চারগোল!!!! গ্রুপ পর্বের ম্যাচে সেদিন তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মুখোমুখি হয়েছিলো কলম্বিয়া, মাত্র ১১ মিনিটেই তিনগোল খেয়ে ম্যাচ থেকে শুরুতেই অনেকখানি ছিটকে পড়ে কলম্বিয়া, ২১ মিনিটে একগোল শোধ দিলেও ৫৬ মিনিটে চতুর্থ গোল করে ম্যাচজয় অনেকটাই নিশ্চিত করে ফেলে সোভিয়েত কিন্তু এরপরই শুরু হয় নাটকের মূল অংশ। মাত্র ১৮  মিনিটের মধ্যে তিনগোল শোধ করে স্কোরলাইন ৪-৪ করে ফেলে কমম্বিয়া!!!! যেই গোলকিপারের নামে বর্তমানে বিশ্বকাপের সেরা গোলকিপারের পুরস্কার দেওয়া হয় সেই গোলকিপার মাত্র ১৮ মিনিটে খেয়েছিলো চার গোল,ভাবা যায়?!!! এরমধ্যে কলম্বিয়ার মার্কোস পোলের গোলটি হয়েছিলো ডিরেক্ট কর্ণার থেকে!!! বিশ্বকাপের ইতিহাসে সেটিই ছিল ডিরেক্ট কর্নার থেকে প্রথম গোল এবং এখন পর্যন্ত ওই গোলটিই বিশ্বকাপে ডিরেক্ট কর্নার থেকে একমাত্র গোল!!!

 

৫। বিখ্যাত 'কাতেনেচ্চিও' সিস্টেমের আবির্ভাব ও "ব্যাটল অফ সান্তিয়াগো'

কাতেনেচ্চিও সিস্টেমের সাথে আমরা অনেকেই আজ পরিচিত কিন্তু বিশ্ব ফুটবলে এই সিস্টেমের আবির্ভাব ঘটে ১৯৬২ বিশ্বকাপেই। কাতানেচ্চিও সিস্টেমের মূলমন্ত্র হচ্ছে আগে নিজের ঘর সামলাও তারপর আক্রমণে যাও অর্থাৎ কাউন্টার অ্যাটাক ছাড়া গোলের চেষ্টা এই সিস্টেমে করা হয় না। গ্রুপপর্বের পশ্চিম জার্মানি বনাম ইতালির ম্যাচে দুই দলই এই সিস্টেম ফলো করে যার ফলশ্রুতিতে ম্যাচটি গোলশূন্য ড্র তে শেষ হয়। শুধু এই ম্যাচ নয়,আরো অনেক ম্যাচেই অনেক দল এই 'কাতেনেচ্চিও' সিস্টেম ফলো করে যারফলে বিশ্বকাপে গড় গোলের সংখ্যা কমে যায়। একারণে এই বিশ্বকাপকে অনেকেই বোরিং বিশ্বকাপ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

এদিকে "ব্যাটল অফ সান্তিয়াগো"তে মুখোমুখি হয় স্বাগতিক চিলি ও ইতালি। এই ম্যাচটিকে অনেকেই বিশ্বকাপের ইতিহাসে নিকৃষ্টতম ম্যাচ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ম্যাচটিতে দুদলের খেলোয়াড়েরাই একে অপরের প্রতি আক্রমনাত্মক মনোভাব প্রদর্শন করেন, ম্যাচে চিলিয়ান ফরোয়ার্ড লিওনেল সানচেজ ইতালিয়ান ফরোয়ার্ড হামবার্তো মাসচিওর নাক রেফারির অগোচরে ভেঙ্গে দেন। এর কিছুক্ষণ পর ইতালির মারিও ডেভিড সানচেজের মাথা লক্ষ্য করে হাই কিক দেন!!!!  ম্যাচে ইতালির দুইজন খেলোয়াড় লালকার্ড দেখে যদিও রেফারি সতর্ক থাকলে এই লালকার্ডের সংখ্যা দুইদলের শিবিরেই বাড়তো। ২-০ তে ম্যাচটি জিতে নেয় চিলি কিন্তু খেলা শেষেও অবস্থা এতটাই বেগতিক থাকে যে দুই দলকেই পুলিশি পাহাড়ায় বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। ফুটবল ম্যাচ না বলে এই ম্যাচকে রেসলিং ম্যাচ বললে মোটেও অত্যুক্তি হবে না।

 

৬। সর্বোচ্চ গোলদাতা ৬ জন!!!!!

হ্যাঁ,ঠিকই দেখেছেন। সপ্তম বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ গোলদাতা ছিলেন ছয়জন!!! ব্রাজিলের গারিঞ্চা ও ভাভা, চিলির লিওনেল সানচেজ, যুগোস্লাভিয়ার দ্রাজান জার্কোভিচ, সোভিয়েত ইউনিয়নের ভ্যালেতিন ইভানভ, ও হাঙ্গেরির ফ্লোরাইন আলবার্ট - প্রত্যেকেই চারটি করে গোল করেছিলেন। একই বিশ্বকাপে ছয়জন সর্বোচ্চ গোলদাতা পাওয়ার ঘটনা সেটাই প্রথম আর এখন পর্যন্ত সেটাই একমাত্র।

 

৭। সেরা প্লেয়ারের ইনজুরি সত্ত্বেও ব্রাজিলের বিশ্বজয়

১৯৫৮ বিশ্বকাপের পরেই রাতারাতি ব্রাজিলের হিরো হয়ে যান পেলে, ১৯৬২ বিশ্বকাপ খেলতে এসেছিলেন আরো পরিণত হয়ে। বিশ্বকাপের শুরুটাও পেলে দারুণভাবে করেন, মেক্সিকোর বিরুদ্ধে প্রথম ম্যাচেই পান গোলের দেখা। কিন্তু পরের ম্যাচে চেকস্লোভিয়ার বিরুদ্ধে থাই মাসল ইনজুরিতে পড়ে টুর্নামেন্ট শেষ হয়ে যায় পেলের। পেলেকে ছাড়া ব্রাজিল কতটুকু করতে পারবে এব্যাপারে সবার মনেই দ্বিধা ছিল কিন্তু সবার মনের সংশয় কাটিয়ে দেন "ছোট্ট পাখি" খ্যাত গারিঞ্চা। টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ চারগোল তো করেছিলেনই সাথে প্রতি ম্যাচেই ড্রিবলিং স্কিল দিয়ে প্রতিপক্ষকে বলতে গেলে একাই তছনছ করেছেন। গারিঞ্চার চারটি গোলই এসেছিলো কোয়ার্টার ফাইনাল আর সেমিফাইনালের মতো মহাগুরুত্বপুর্ণ ম্যাচে।  পেলের বদলে সুযোগ পাওয়া আমারিল্ডোও অসাধারণ পারফর্ম করেন। শেষপর্যন্ত ভাভা,জিতো,আমারিল্ডোদের সাথে ব্রাজিলকে দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ এনে দেন গারিঞ্চা। আজকের এইদিনে আমারিল্ডো,জিতো ও ভাভার গোলে চেকস্লোভিয়াকে ৩-১ গোলে হারিয়ে ইতালি আর উরুগুয়ের পর দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ জিতে নেয় ব্রাজিল। আর এর সাথে সাথেই শেষ হয় ঘটনাবহুল সপ্তম বিশ্বকাপ। সেরা খেলোয়াড় হিসেবে "গোল্ডেন বল" জিতেন গারিঞ্চা।

1962

 

 

garrincha1

 

1962-final

 

ঘটনা রটনা অঘটন নানাকিছুর জন্য ১৯৬২ বিশ্বকাপ স্মরণীয়, ভয়াবহ ভূমিকম্পের বাঁধা অতিক্রম করে বিশ্বকাপ আয়োজন করে বিশ্ববাসীর বাহবা যেমন চিলি পেয়েছিলো তেমনি মাঠের খেলায়  "ব্যাটল অফ সান্তিয়াগো"র মত ঘটনার মত জন্ম দিয়ে সমালোচনার মুখেও পড়তে হয়েছিলো। কাতানেচ্চিওর প্রভাবে গড় গোল কমে যাওয়া, বিশ্বসেরা খেলোয়াড় পেলে ইনজুরিতে ছিটকে যাওয়া সবমিলিয়ে বিশ্বকাপের রঙ কিছুটা মলিন হওয়ার আশঙ্কা থাকলেও লিটল বার্ড গারিঞ্চার জাদুতে তা হয়নি। জিতো,ভাভা,আমারিল্ডোকে সাথে নিয়ে নান্দনিক ফুটবলের পসরা সাজিয়ে বিশ্ববাসির মন জয় করেই নিজ দেশকে বিশ্বকাপ জিতিয়েছিলো গারিঞ্চা। ব্রাজিলের দ্বিতীয় বিশ্বকাপ জয়ের ৫৫ বছর পূর্তিতে এই লেখার মাধ্যমে তাদের প্রতি সম্মান জানালাম আর লেখা শেষ করছি মহান আয়োজক কার্লোস ডিটবর্নের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি দিয়ে, কার্লোস নাই দেখুক কিন্তু পুরো বিশ্ব তো দেখেছে কিছু না থাকার দল সবকিছু করলে অসম্ভবকেও সম্ভব করা যায়,ভয়াবহ ভূমিকম্পের বাঁধাও অতিক্রম করা যায়।