• ক্রিকেট

অঝোরে ঝরে যাওয়া এক আশার ফুল

পোস্টটি ২৪৬৫২ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

 

ট্রেভর চ্যাপেল একবার তাঁকে নিয়ে বলেছিলেন, ‘তাঁর অধ্যবসায় ও মনোযোগ যেকোনো প্রতিষ্ঠিত ও ম্যাচিউরড ব্যাটসম্যানকে লজ্জায় ফেলে দেবে। যেভাবে সে তাঁর ব্যাটিংয়ে মনোযোগ দেয়, তা আমাকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করছে, এই ছেলেটির দীর্ঘ ক্রিকেট যাত্রা নিয়তি নির্ধারিত হয়ে আছে’।

এত বছর পরেও কি সেদিনের সেই ছোট্ট ছেলেটির সম্পর্কে এমনটাই ভাবতে পারেন ট্রেভর চ্যাপেল? শুধু চ্যাপেলই বা কেন, নিজের ব্যাটিংয়ের মায়াজালে পুরো ক্রিকেট বিশ্বকেই মজিয়ে ফেলেছিল যে ছেলেটি, সেই ছেলেটির এমন ভবিষ্যৎ কি কারোর দুঃস্বপ্নেও এসেছিল? আচ্ছা অন্য কারোর কথা নাহয় বাদই দিলাম, যাকে নিয়ে চ্যাপেলের এত উচ্ছ্বাস, সেই ছেলেটি নিজে কি ভাবতে পেরেছিল নিজের এমন করুণ পরিণতি?

 ৮ সেপ্টেম্বর, ২০০১। কলম্বোর সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাব গ্রাউন্ডে যখন ব্যাট উঁচিয়ে ধরেছে ছেলেটি, সে নিজেও কি তাঁর কীর্তির সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিল? থাকাটাই বরং অস্বাভাবিক। গা থেকে কৈশোরের গন্ধই যার যায়নি তখনো, তাঁর সাধ্য কোথায় নিজের এমন কীর্তির মহিমা বোঝার!

 কিন্তু যাদের বোঝার, তারা ঠিকই বুঝেছিল। বুঝেছিল বলেই ভেবে নিয়েছিল, বাংলাদেশ নামের সদ্য টেস্ট আঙ্গিনায় প্রবেশাধিকার পাওয়া এক দেশ থেকে বেরিয়ে এসেছে বিশ্ব ক্রিকেটের এক রত্ন। যে রত্ন মুরালি-ভাসদের পিটিয়ে মাত্র ১৭ বছর ৬১ দিনে টেস্ট সেঞ্চুরি করে হয়ে গেছে টেস্ট ক্রিকেটের সর্বকনিষ্ঠ টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান, পেছনে ফেলে দিয়েছেন ১৭ বছর ৭৮ দিনে সেঞ্চুরি করে এতদিন রেকর্ড আগলে রাখা মুশতাক মোহাম্মদকে। আমিনুল ইসলাম বুলবুলের পর মাত্র ২য় বাংলাদেশি ব্যাটসম্যান হিসেবে টেস্ট অভিষেকে সেঞ্চুরির দেখা পেয়েছেন, সেটাও হয়তো বুঝতে কিছুটা সময় লেগেছিল টিন-এজার ছেলেটির।

 

image_20130908140629

 

 বিশ্ব মিডিয়ার সেই প্রথম মোহাম্মদ আশরাফুল দর্শন, কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেটের সাথে সংশ্লিষ্টরা ততদিনে জেনে গেছেন, এই ছেলে বিশেষ কেউ। মাত্র ১৬ বছর বয়সে ঢাকা মেট্রোর হয়ে প্রথম শ্রেণী ক্যারিয়ার শুরু। হালচাল বুঝে উঠতেই তো গোটা কয়েক ম্যাচ কেটে যাওয়ার কথা। কিন্তু বাকি সবার মত হলে তাঁর চলবে কেন! দ্বিতীয় ম্যাচেই ঘোষণা দিয়ে দিলেন, তিনি বাকিদের চেয়ে আলাদা হতেই এসেছেন। খুলনার বিপক্ষে করে ফেললেন ১০১, নিজের দ্বিতীয় প্রথম শ্রেণির ম্যাচেই সেঞ্চুরি।

 মাস দুয়েক যেতে না যেতেই আবার শিরোনামে, এবার আরও বড় পরিসরে। সফররত অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট একাডেমী দলের বিপক্ষে করে বসলেন সেঞ্চুরি। একই মাসে জাতীয় ক্রিকেট লিগে চট্টগ্রামের বিপক্ষে ১৫৭ রানের ইনিংস। দেশের ক্রিকেট অঙ্গন তখন ভবিষ্যৎ এক ক্রিকেট তারকার আগমনী সুবাসে মৌ মৌ।

বাংলাদেশ তখন সবে হাঁটি হাঁটি পা পা করছে। এমন একজন ব্যাটসম্যান পেয়ে তাই আর দেরি করতে চাইলেন না সংশ্লিষ্টরা। ২০০১ এর এপ্রিলেই তাঁকে সাথে করে নিয়ে যাওয়া হল জিম্বাবুয়ে, বুলাওয়েতে অভিষেকও ঘটিয়ে দেয়া হল। ব্যাটে মাত্র ৯ রান এলেও অভিষেকে মনে রাখার মত উপলক্ষ অবশ্যই ছিল আশরাফুলের, আউট করেছিলেন তখনকার জিম্বাবুয়ে দলের সেরা ব্যাটসম্যান অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার কে।

 এরপরই সেপ্টেম্বরে লঙ্কার মাটিতে ওই রেকর্ড ইনিংস। এর মধ্যে টেস্টে সর্বোচ্চ রানের ইনিংসের মালিকানা বদল হয়েছে দুবার, ওয়ানডে ক্রিকেট দেখেছে দ্বিশতক, ফরম্যাটের বিবর্তনে জন্ম নিয়েছে ২০ ওভারের ক্রিকেট, কিন্তু মালিকানা বদল হয়নি আশরাফুলের ওই রেকর্ডের। কে জানে, এও হয়তো ক্রিকেট বিধাতারই আরেক আশ্চর্য খেলা। হারিয়ে যাওয়া এক আশার ফুলকে অন্তত এই এক জায়গা থেকে তো সুঘ্রাণ ছড়ানোর সুযোগ দেয়া হল এতে!

 অথচ হারিয়ে যাওয়ার কথা ছিল না তাঁর। বরং দেশের ক্রিকেট ইতিহাসে এতদিনে জ্বলজ্বল করে জ্বলার কথা ছিল মোহাম্মদ আশরাফুল শব্দ দুটি। এই যে আমাদের এত ক্রিকেট ক্রেজ, লাখ লাখ ছেলে ব্যাট হাতে দুনিয়া কাঁপানোর স্বপ্নে মশগুল, তাদের মধ্যে এই স্বপ্নের চারাগাছ পুঁতে দিয়েছিলেন তো এই আশরাফুলই! বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে জন্ম নেয়া প্রতিটি ক্রিকেট পাগল ছেলের স্মৃতিতে এখনো অমলিন কার্ডিফের ওই সেঞ্চুরি। নটিংহ্যামে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওই ৯৪ ই বা পিছিয়ে থাকে কিভাবে? ম্যাচ জিতলে হয়তো ওই ৯৪ ই এগিয়ে থাকত কার্ডিফের সেঞ্চুরির চেয়ে!

 

695175452

 

মনে রাখার মত ইনিংস তো কম খেলেননি তিনি। ২০০৭ টি-২০ বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ২৭ বলে ৬১, কিংবা ২০০৭ বিশ্বকাপে সাউথ আফ্রিকার বিপক্ষে ৮৩ বলে ৮৭ । মনে থাকবে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে চট্টগ্রামে ১৩৬ রানের ইনিংস, একই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে গলে ১৯০ রানের ইনিংসটি তো চাইলেও ভোলার উপায় নেই। চট্টগ্রামে ভারতের বিপক্ষে অপরাজিত ১৫৮ রানের ইনিংসটি তো আজও চোখে মায়াঞ্জন বুলায়। যুবরাজ সিং ভেঙ্গে দেয়ার আগে পর্যন্ত আন্তর্জাতিক টি-২০ তে দ্রুততম ফিফটির মালিকের ঘরেও লেখা ছিল আশরাফুল নামটিই।

 ২০০৬ সালে জাতীয় ক্রিকেট লিগে চট্টগ্রামের বিপক্ষে ২৬৩ রানের ইনিংসটিই বা ভুলে যাই কিভাবে! রকিবুল হাসান ভেঙ্গে দেয়ার আগ পর্যন্ত ওটাই ছিল দেশের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে সর্বোচ্চ রানের ইনিংস।

 স্বপ্নের মত ২০০৭ বিশ্বকাপ কাটিয়ে এসে রেকর্ড বইয়ে নাম তুললেন আবার। দেশের মাটিতে ভারতের বিপক্ষে ২য় টেস্টে মাত্র ২৭ মিনিটে হাফ সেঞ্চুরি করে মিনিটের হিসেবে সবচেয়ে কম সময়ে টেস্টে ফিফটির মালিক হলেন। বলের দিক থেকেও হলেন যৌথভাবে দ্বিতীয় দ্রুততম হাফ সেঞ্চুরিয়ান, পঞ্চাশ ছুঁয়েছিলেন কেবল ২৬ বলে। ওই সিরিজের পর অধিনায়কত্ব থেকে সরে দাঁড়ালেন হাবিবুল বাশার, সেই দায়িত্বও দেয়া হল আশরাফুলের কাঁধে। মাত্র ২২ বছর বয়সী আশরাফুল তখন ক্রিকেট বিশ্বের দ্বিতীয় কনিষ্ঠতম অধিনায়ক।

 কিন্তু অধিনায়কের প্রত্যাশা সেভাবে মেটাতে পারলেন না। সব ফরম্যাটে ৬২ ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশকে জিতিয়েছিলেন ১০ টি ম্যাচে। দলের এমন বিপর্যস্ত অবস্থা, নিজের পারফরম্যান্সও তথবৈচ, আশরাফুল তখন চাপের সাগরে নিমজ্জিত। সেই চাপের বহিঃপ্রকাশ হয়েই কিনা, অনুশীলনের সময় শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে এক ভক্তের সাথে জড়িয়ে পরলেন হাতাহাতিতে।

 ২০০৮ এ নিষিদ্ধ আইসিএল এর ধাক্কায় যখন এলোমেলো বাংলাদেশ ক্রিকেট, চাপ সামলাতে এগিয়ে এলেন নিজেই চাপে থাকা আশরাফুল। আইসিএল কাণ্ডের পর প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচে অপরাজিত ৬০ রানের ইনিংস খেলে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে দলকে এনে দিলেন স্বস্তির জয়। মাস দুয়েক পরেই ঢাকা টেস্টে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সেঞ্চুরি। আশরাফুলের ব্যাটে তখন দুঃসময়ের খরা কাটার আভাস।

 কিন্তু কে জানত, সামনে যেই দুঃসময় অপেক্ষা করে আছে তাঁর জন্য, তার তুলনায় এই দুঃসময় কিছুই না! বাকিদের থেকে আলাদা হতে এসেছিলেন, কিন্তু মাঠের পাশাপাশি মাঠের বাইরেও যে এভাবে আলাদা করে ফেলবেন নিজেকে, ভাবতে পারেনি কেউ। হঠাৎ এক শুক্রবারে ঘুম থেকে উঠে আড়মোড়া ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে সবাই আবিষ্কার করল, ব্যাট হাতে বরাবরের মতই আনপ্রেডিক্টেবল আশরাফুল আরও বড় আনপ্রেডিক্টেবল কাজ করে বসে আছেন! অর্থের বিনিময়ে বিকিয়ে দিয়েছেন নিজের ক্রিকেট চেতনা, নিজের পাশাপাশি কলঙ্কিত করেছেন দেশের ক্রিকেট ভাবমূর্তিকেও। যেই মানুষগুলোর হৃদয় মন্দিরে নিত্য পূজিত হতেন তিনি, সেই মানুষগুলোই ফুলের বদলে ছুঁড়ে দিলেন ঘৃণার কাঁটা। তিনিও তা মেনে নিলেন মাথা নত করে। মেনে নেয়া ছাড়া উপায়ই বা কোথায়, তিনি যে তখন খলনায়ক!

 

ashraful_afp

 

সাধারণ ভক্তদেরই বা দোষ কোথায়, যেই মানুষটির খারাপ সময়েও সকলের সাথে তার পক্ষ হয়ে নিত্য গলা ফাটিয়ে গেছে, সেই মানুষটিই কিনা সব ভালবাসা-সমর্থনের প্রতিদান দিলেন এভাবে! নায়ক থেকে খলনায়কের আসনে বসাতে তাই দ্বিতীয় বার ভাবতে হল না।

 কিন্তু ওই যে কথায় বলে না, প্রথম প্রেম নাকি চাইলেও ভোলা যায় না! আশরাফুলও এত মানুষের প্রথম প্রেম, চাইলেও তাই ভক্তরা তাঁকে এত সহজে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারেন না। আজও তাঁর ভক্তরা তাঁকে ভালবাসা বিলিয়ে যান অকাতরে, তাঁর জন্মদিনে দুহাত তুলে প্রার্থনা করেন সৃষ্টিকর্তার কাছে। আশরাফুলের সেই পাগলপারা ভক্তদের হয়েই তাই  শুভেচ্ছা জানাচ্ছি একসময়ের এই ক্রিকেট সেনসেশনকে। শুভ জন্মদিন মোহাম্মদ আশরাফুল!