• ক্রিকেট

'বিরাট'-স্তুতি

পোস্টটি ২০৫৫৩ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

তাঁকে নিয়ে স্তুতি-আলেখ্যের ভূমিকাংশটা সেরে নিই, কবি মহাদেব সাহার ‘তোমার বর্ণনা’ কবিতার এই কয়েক পংক্তিতে-

তোমাকে বিশদ ব্যখ্যা করবো কি বর্ণনায়ই বুঝেছি অক্ষম

নাই সে কিঞ্চিৎ ভাষাজ্ঞান, মাত্রাবোধ এমনকি শব্দেরও

                                                শৃংখলা

সে-বিদ্যা আয়ত্তে নাই অনায়াসে পাঠ করি তোমার চিবুক

কিংবা ধরো প্রসিদ্ধ নগর দেখে দেয় কেউ যে-রকম গাঢ়

                                                বিবরণ,

দর্শনীয় বস্তু আর সুপ্রাচীন স্থানের তালিকা; সে-রকম

তোমার বিশদ ব্যাখ্যা জানি আমি পারবো না কখনো।  

*****

খুব ফাঁকিবাজি হলো, না? ধার করা পদ্যে, কবির কাব্যে সেরে নেয়া হলো ভূমিকা! ক্ষমা করবেন, পাঠক। কি আর করবো বলুন, অপটু হাতে তুলি তুলে নিয়েছি যে! সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ক্রিকেট পুরুষটিকে চিত্রায়িত করবো বলে!

ঝোঁকের বশে তুলি হাতে তুলে নিলেও, পরক্ষণেই বুঝেছি এ আমার মতো অকর্মার কর্ম নয়। এই কাজের জন্য দরকার সুদক্ষ চিত্রকর, যিনি নিখুঁতভাবে রঙের খেলায় ঠিকঠাকভাবে তাঁকে চিত্রায়িত করতে সমর্থ হবেন। আমি তো এক নগণ্য চুনোপুঁটি, আমি আর কিভাবে তাঁকে সাজাই বলুন? তবুও বাসনাটা অদম্য বলে আর অবদমিত করতে ইচ্ছে হলো না। না-হয় একটু কাঁচা হাতে কাঁচা কাজ হলোই বা, তাতে তো আর তাঁর জৌলুস কোনো অংশে কমে যাচ্ছে না। তিনি যেমন আছেন তেমনই থাকবেন। মাঝখান থেকে অপটু হস্তখানা খানিকটা হস্তকর্ম না-হয় সেরেই নিল। ক্ষতি কি!

এই যাঃ! মূল প্রসঙ্গ থেকে কত দূরে সরে গেছি! দেখলেন তো, অনিপুণ হাতের কারুকাজ। কি বলতে চাইছিলাম, কোথায় চলে গেছি! যা হোক, প্রসঙ্গে ফিরছি।

বলছিলাম তাঁর কথা, যাঁর বর্ণনা আমার সাধ্যের অতীত। তার চেয়ে তাঁর স্তুতি-আলেখ্যই ভালো না?    

*****

তাঁর সাথে প্রথম পরিচয় নিশ্চয় সরাসরি সাক্ষাতে হয়নি, টিভি সেটের মাধ্যমেই হয়েছিল। তিনি ছিলেন আঠারো ইঞ্চির রঙিন বাক্সখানায়, আর আমি ব্যস্ত ছিলাম সোফায় উপবিষ্ট হয়ে ক্রিকেট দেখায়। স্টার ক্রিকেটে তাঁকে দেখছিলাম, মাত্রই কৈশোর পেরিয়েছেন। চটপটে এক তরুণ অধিনায়ক। খুব সপ্রতিভ, বেশ ছুটছেন। স্বল্প পুঁজিতেও তাঁর বোলারদের অসাধারণ বোলিংয়ে প্রতিপক্ষ দক্ষিন আফ্রিকার শিরোপা স্বপ্ন তখন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। দুই বল বাকী থাকতে তাঁর দলের জয়ও একপ্রকার নিশ্চিত হয়ে গেলো।

সেই মুহূর্তে তিনি করলেন তাঁর নেতৃত্বের সুনিপুণ প্রদর্শন। ঠোঁটে আঙুল রেখে শান্ত থাকার স্পষ্ট নির্দেশ দিয়ে, ছেলেদের যেন বলতে চাইলেন, ‘উঁহু, খেলা এখনও শেষ হয়নি। এখনই উল্লাস নয়।’ সেই মুহূর্তেই মনে হলো, এই ছোকরা আর দশজন সাধারণের মতো নন। তিনি অনন্য, তিনি অসাধারণ। তাঁর জন্মই যেন নেতা হওয়ার জন্য, নেতৃত্বের জন্য, পথ দেখানোর জন্য।

*****

খুব জহুরী বনে গেলাম, না? যেন সেই উনিশে’র বিরাটকে দেখেই আমি বুঝে গিয়েছিলাম, তিনি আজকের ‘বিরাট কোহলি’ হয়ে উঠবেন! তিনি একদিন শচীন টেন্ডুলকারকে ধাওয়া করবেন! তিনি ক্রিকেটের রেকর্ড বইকে পাকড়াও করবেন বারবার!

আরে নাহ, তেমন জহর চেনার গুণ থাকলে তো কথাই ছিল না। এই ফাঁকেতালে একটু জাতে উঠার চেষ্টা আর কি! বোঝেনই তো, অপটু হাতের কাজ। কোথাও একটু পটুতা না দেখালে কি হয়!

*****

ক্রিকেটের রঙিন আঙিনায় অভিষেক হলো তাঁর। খুব একটা রাঙাতে পারলেন না। দেখলাম, আবার ভুলেও গেলাম। ব্যর্থতার ইতিহাস কে মনে রাখে বলুন? তাঁর সেই উনিশের স্মৃতি রঙিন হয়ে স্মৃতিপটে জ্বলজ্বল করলেও, ভুলে গেলাম তাঁর পরের আন্তর্জাতিক স্মৃতি!

তখনও তাঁর শ্বেত পোষাক গায়ে চড়ানো হয়নি। গেলেন শ্রীলংকায়, যুবরাজ যেতে পারলেন না সেবার। পত্রিকা মারফত জানলাম, তিনি নাকি যুবরাজের জায়গা নেবেন। তিনি যুবরাজের মতো হয়ে উঠতে চান!

পড়েই ঠোঁটের কোণে খেলে গেল এক চিলতে অবজ্ঞার হাসি। কোথায় উনি, কোথায় ইনি! সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতির ক্যানভাসে যেন সম্প্রচারিত হয়ে গেলো, শর্ট বলে যুবরাজের পুল শট! আর কোহলি! হুঁহ! বাছা, হতে চাও তো আর কেউ হও। যুবরাজ নয়।

আমার আর কি দোষ? প্রভাতের দিবাকর যে মধ্যহ্নের আকাশ পুরোটা দখল করে রাখে, তেজে-ঔজ্জ্বল্যে যে সবাইকে ছাড়িয়ে যায়, সে জ্ঞান ছিল বটে, তবে প্রভাতে মেঘ ছিল যে! মেঘটা সরে গিয়ে যে এত উজ্জ্বলতা ছড়াবে, এত তেজস্বীতা থাকবে তার; ভবিতব্যের এই রঙ-বদল আমার মতো অধমের কিভাবে জানা হবে বলুন?   

তিনি ব্যাটসম্যানশীপে ছাড়িয়ে গেছেন যুবরাজকেও, আর হয়ে উঠেছেন ব্যাটসম্যান-রাজ্যের একজন যুবরাজও বটে! আর নেতৃত্বে? সে কথা না-হয় থাক। যুবরাজ সিং কোনোভাবে শুনতে পেলে, আমাকে পুল শটে উড়িয়ে দেয়ার জন্য তেড়ে আসবেন। নিজের নিরাপত্তার জন্যেই সে আলোচনায় যেতে চাই না।

*****

লক্ষন-দ্রাবিড়দের ভিড়ে পাঁচদিনের ক্রিকেটে সেভাবে নিয়মিত হতে না পারলেও, একদিনের ক্রিকেটে ঠিকই নিয়মিত হয়ে গেলেন তিনি। শচীন, শেওয়াগ, গম্ভীর, ধোনী, যুবরাজদের ভিড়েও নিজের জন্য আলাদা একটা জায়গা ঠিকই করে নিলেন। তবে তখনও তাঁর তাৎপর্য সেভাবে বোঝা হয়ে উঠেনি। ঢাকায় বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচে তাঁর অপরাজিত সেঞ্চুরীর পরও তাঁর মহিমা সেভাবে চোখে পড়েনি। পড়বে কিভাবে? ভারতীয় ব্যাটিং লাইন আপে কত বড় বড় নাম সব; সেখানে দু-চারটা সেঞ্চুরী দিয়ে একজন নিজের উপর সব আলো কেড়ে নিতে পারেন?

কিন্তু তিনি নিলেন, শুধু একটু সময় নিলেন, এই আর কি! সিবি সিরিজের এক ম্যাচে আমার সমস্ত মনোযোগ কেড়ে নিলেন তিনি। ব্যাটিং শিল্পের সমস্ত শিল্প তখন তাঁর ব্যাটে লুটোপুটি খেলছে, তিনি তা দিয়ে ইচ্ছেমতো সৃষ্টিসুখের উল্লাসে মেতেছেন। হোবার্টের সবুজ মাঠটাকে ক্যানভাস বানিয়ে, সুদক্ষ চিত্রকরের মতো আঁকছেন নিখুঁত এক ছবি। সেই ছবিতে যেন কত রঙের খেলা, কত প্রাণের বাহার, কত ঔজ্জ্বল্য!

৮৬ বলে ১৩৩ রানের মহাকাব্যিক এক ইনিংসে তিনি জানালেন, তিনি কত বড় ব্যাটিং-শিল্পী! আমরা মুগ্ধ হয়ে দেখি, একজন মহান শিল্পীর এক অনবদ্য সৃষ্টি!

কব্জীর সে কী মোচড়, দেখি আর আশ্চর্য্য হই! মনে হয় যেন কব্জীতে কেউ কোনো সুইচ বসিয়ে দিয়েছে, তিনি যেদিকে খুশী সেদিকে তাক করে সুইচটাকে অন করলেই হলো। ক’দিন পর আবারো খেললেন, আরো একটি ক্ল্যাসিক। ১৪৮ বলে ১৮৩। এবার ঢাকার মিরপুর হলো তাঁর বিশাল ক্যানভাস। তাঁর খেয়াল খুশীমতো তুলি চালান তিনি, তাতেই সৃষ্টি হয়ে যায় দৃষ্টিনন্দন সব শিল্প।

উইকেটের চারপাশে যেভাবে ব্যাট চালান, মনে হতে পারে তিনি বলটাকে মাঠের চারপাশ চেনানোর দায়িত্ব নিয়েছেন। কিংবা টর্চ হয়ে হয়তো বলটাকে পথ দেখাচ্ছেন, এবার ঠিক কোন পথে কোন গতিতে ছুটতে হবে!

আমরা দেখি, আর দেখি, ব্যাটিং হয় কতই না সুন্দর!

*****

ফুটবলের পাতা তখন ‘লিওনেল মেসি’ময়। বার্সার হয়ে যতটা উজ্জ্বল ততটা নন দেশের হয়ে, আর্জেন্টিনার আকাশী নীল জার্সিটায় কেমন ফ্যাকাশে হয়ে পড়েন তিনি! তাই নিয়ে সরগরম ফুটবল পাড়া। আর ক্রিকেট পাড়া? সেখানেও একই আলোচনা, তবে ভিন্ন আঙিকে। বিরাট যতটা ভালো রঙিন ক্রিকেটে, ততটা নন শ্বেত ক্রিকেটে। লাল বলের ক্রিকেটটায় কেমন ম্রিয়মান দেখায় তাঁকে, অথচ সাদা বলটাকে তো বেশ শাসনে রাখেন!

আলোচনাটা ধীরে ধীরে ডালপালা মেলে ছড়িয়ে পড়ল। কুড়ি টেস্ট খেলে ফেললেও, বিরাট তেমন ভালো করতে পারছেন কই? গোটা-চারেক শতক পেয়েছেন বটে, তবে তাঁর ব্যাটসম্যানশীপের সাথে কি তা আদৌ মানানসই? তাঁর শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে জানাবে, কিছুতেই নয়। তাঁর নামের পাশে ৩৫-৩৬ টেস্ট গড় বড্ড বেমানান, বড় বাজে দেখায়!

এই সময় শচীন টেন্ডুলকার গেলেন অবসরে, উত্তরাধিকার সূত্রে টেস্টের ‘নাম্বার চার’ হলেন তিনি। ব্যস! এরপর চিত্রপট বদলে গেল খুব দ্রুতই। সনাতনী ক্রিকেটেও তাঁর ব্যাট ঝলমলিয়ে হাসতে শুরু করল। ‘বেঁয়াড়া’ লাল বলটাও তাঁর ব্যাটে বশ মেনে, শুনতে লাগল তাঁর কথা।

সব ধরণের ক্রিকেটেই রানের পর রান করে যেতে লাগলেন তিনি। এবার আমাদের মনেই এক সংশয়ের খেলা, আচ্ছা, বিরাট সত্যি মানুষ তো? মানুষের পক্ষে কি এ-ও সম্ভব?

*****

নেতৃত্ব তাঁর সহজাত, তিনি বর্ন লিডার, তিনি স্বভাব নেতা। তাঁর জন্মই হয়েছে নেতা হওয়ার জন্য। সেই প্রমাণ দিতেই হয়তো এডিলেইডে অধিনায়কত্বের অভিষেকে দুই ইনিংসেই পেলেন সেঞ্চুরী। দ্বিতীয় ইনিংসেরটা তো ক্ল্যাসিকের মর্যাদা পেতে পেতেও পায়নি। ৩৬৪ তাড়া করতে গিয়ে করেছেন ১৭৫ বলে ১৪১, শুধুমাত্র বিজেতা না হয়ে বিজিত ছিলেন বলে, সেই ইনিংসের মহিমা চাপা পড়ে গেছে অনেকটা!

পৃথিবী যে কেবল বিজয়ীর কথা বলে!

*****

অগ্রজের প্রতি তাঁর অঢেল সম্মান, অনুজের প্রতি আছে স্নেহ। প্রাণের বন্ধুর উপর আছে ভরসা, বিশ্বাস। তিনি নির্ভর করেন অগ্রজে, ভরসা পান অনুজে। তিনি আস্থা রাখেন দলীয় সংহতিতে, বিশ্বাস করেন একতা ও ঐক্যে। দলও বিশ্বাস করে তাঁকে।

শচীনকে কাঁধে নিয়ে যিনি বলেন, “যে মানুষটা ২২ বছর ধরে পুরো দেশের ভার বইছে, আমরা তাঁর ভার বইতে পারব না?” নেতৃত্বের পট পরিবর্তন নিয়ে যিনি জানান, “ধোনী তো অনেকদিন দলকে টেনে নিল। একটা সময় মনে হলো, আমি যদি যোগ্য হয়ে থাকি, তাহলে এখনই সময় ওর দায়িত্বটা শিফট করার। এবার ও ওর খেলাটা উপভোগ করুক। একটা মানুষ এভাবে আর কত টানবে?” যে দলপতি এমন কথা বলেন, দল তাঁকে বিশ্বাস করবে না তো, করবে কাকে?

তিনি শুধু মাঠেই নেতৃত্ব দেন না, নেতৃত্ব দেন মাঠের বাইরেও।

তিনি কথা বলেন, ক্রিকেট নিয়ে, ক্রিকেটার নিয়ে, ক্রিকেট কালচার নিয়ে। আমরা তাঁকে দেখি, তাঁকে শুনি; আর স্বীকার করি, বিরাট কেবল অসাধারণ ব্যাটসম্যানই নন, অসাধারণ বক্তাও বটে!

*****

তাঁর স্তাবকের মতো অভাব নেই তাঁর নিন্দুকেরও। তাঁকে অনেকেই ঘৃণা করেন, তাঁর উত্তরোত্তর ঔজ্জ্বল্যে অনেকেই হন ঈর্ষাকাতর। তাদের জন্য চাইলে তিনি আউড়ে যেতে পারেন কবি মহাদেব সাহার ‘ঘৃণার উত্তরে চাই ক্ষমা’ কবিতার এই ক’লাইন-

হে মানুষ, দর্পিত মানুষ, তোমাদের কুৎসা আর ঘৃণার বদলে

আমি সহিষ্ণু বৃক্ষের মতো দেখো বুক চিরে এখনো ফোটাই ফুল,

আজো আরক্তিম ভালোবাসা তোমাদেরই সমর্পণ করি

তোমাদের ঘৃণার উত্তরে বলি প্রিয়, হাত জোড় করে চাই ক্ষমা।