মিলানের রাজপুত্রের গল্প
পোস্টটি ১২৫৩৬ বার পঠিত হয়েছে১.
২৪ এপ্রিল,২০০৭
উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লীগের সেমিফাইনালের প্রথম লেগে ঘরের মাঠ ওল্ড ট্রাফোর্ডে এসি মিলানের মুখোমুখি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। শক্তিমত্তার দিকে দুই দলই ছিল সমানে সমান তাই জমজমাট একটা ম্যাচই প্রত্যাশা করছিলো সবাই। ৫ মিনিটেই ইউনাইটেডকে এগিয়ে দেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, এই গোলের পর কোথায় মিলান গোল শোধ দেওয়ার চেষ্টা করবে তা না করে উল্টো ইউনাইটেডের আক্রমণ সামলাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছিলো মিলানকে! ম্যাচের এমন অবস্থা দেখে যখন ইউনাইটেডের দুই গোলের লিড নেওয়াটা সময়ের ব্যাপার মনে হচ্ছিলো তখুনি একটা ছোট্ট ম্যাজিক ঘটলো, খেলার আয়ু তখন ২২ মিনিট। মিলানের সিডর্ফ বেশ নিরীহগোছের একটা থ্রু পাস তার দলের ২২ নাম্বার জার্সি পরিহিত খেলোয়াড়ের দিকে বাড়িয়ে দিলেন, সেই প্লেয়ারকে কড়া মার্কিং এ রেখেছিলেন ইউনাইটেডের ক্যারিক আর সামনেই দাঁড়িয়ে হেইঞ্জ তাই বিপদ ঘটার সম্ভাবনাও ছিল না। কিন্তু এ কি! হুট করে ওই ২২ নাম্বার জার্সিধারীর ভিতরে যেনো বজ্রপাতের শক্তি এসে ভর করলো! আচমকা গতি বাড়িয়ে ওই দুইজনকেই ছিটকে দিয়ে গোল করলেন, মনে হলো আচমকা এক জাদুকরি শক্তি এসেই এই গোলটা করে দিয়ে গেলো। তবে এই গোলটাকে ছোট্ট ম্যাজিক বলেছিলাম কারণ এর ১৩ মিনিট পর বিশ্ব যা দেখেছে সেটা ওই গোলের চেয়েও কয়েকগুণ বেশী বিস্ময়কর। লেফট উইং এ ফ্লেচারের সাথে এরিয়াল ডুয়েলে হুট করে গতি বাড়িয়ে বল নিয়ে এগিয়ে যান ওই খেলোয়াড় তার সামনে তখন আগের হেইঞ্জ আর এভরা, হেইঞ্জের সামনে থেকে ডান পায়ে চমৎকারভাবে ফ্লিক করে হেইঞ্জের মাথার উপর দিয়ে বল নিয়ে কাট ইন করে ভিতরে ঢুকার চেষ্টা করেন সেই খেলোয়াড়, পিছন থেকে হেইঞ্জও তাড়া করছে আর সামনে দাঁড়িয়ে আছে এভরা। সবাই ভেবেছে সে বুঝি এখন বলটা নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করবে কিন্তু কিসের কি! ফ্লিক করার পর ওই চলন্ত বলকেই হেড করে সামনে এগিয়ে দেন আর এতেই বিভ্রান্ত হয়ে প্রতিপক্ষের হেইঞ্জ আর এভরা নিজেরাই একে অপরের সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যান আর ভ্যান ডার স্যারকে একা পেয়ে আস্তে করে ডানদিকে শট নিয়ে দলকে ২-১ এ এগিয়ে নেন ওই খেলোয়াড়। যদিও এমন দুইটা ম্যাজিকের পরেও ইউনাটেডের কাছে ৩-২ গোলে হেরেছিলো মিলান কিন্তু দুই দুইটি মহামূল্যবান অ্যাওয়ে গোল থেকে যথেষ্ট পরিমাণ আত্মবিশ্বাসই পেয়েছিলো মিলান যার প্রমাণ পরের লেগে সান সিরোতে ইউনাইটেডকে ৩-০ তে উড়িয়ে দেওয়া।
পাঠকরা সম্ভবত বুঝে গেছেন এতক্ষণ কোন খেলোয়াড়টির গল্প করছিলাম, হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন তিনি রিকার্ডো ইসকাজন ডস সান্তোস লেইটে যিনি আমাদের সবার কাছে কাকা নামেই সমধিক পরিচিত।
২.
ব্রাজিলের অধিকাংশ ফুটবল তারকাই কিছুটা অস্বচ্ছল পরিবার থেকেই উঠে আসে তবে রিকার্ডো কাকা এদিক থেকে ব্যতিক্রম, ১৯৮২ সালের ২২ শে এপ্রিল সিভিল ইঞ্জিনিয়ার বোস্কো ইস্কাজন পেরেইরা লেইটে ও শিক্ষিকা সিমোন ডস সান্তোসের ঘর আলো করে পৃথিবীতে আসেন রিকার্ডো কাকা। মজার ব্যাপার হচ্ছে সারা পৃথিবী তাকে কাকা নামে চিনলেও এই নামটি তার বাবা মায়ের দেওয়া নাম নয়, ছোটবেলায় তার বড়ভাই দিয়াগো রিকার্ডো নামটা উচ্চারণ করতে পারতো না বলে ‘কাকা’ নামেই রিকার্ডোকে ডাকতো আর একসময় ফুটবল সার্কিটে এই কাকা নামেই সে বেশি পরিচিত হয়ে যায়। পরিবারের আর্থিক স্বচ্ছলতার কারণে পড়ালেখার সাথে খেলাটা পুরোদমে চালিয়ে যেতে তার তেমন সমস্যা হয় নি। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে আজকের এই বিখ্যাত ফুটবলার প্রথমে চেয়েছিলো টেনিস খেলোয়াড় হতে কিন্তু পরবর্তীতে ফুটবলের দিকেই ঝুঁকে পড়েন। গামায় জন্ম নিলেও সাত বছর বয়সে পরিবারের সাথে সাও পাওলোতে চলে আসেন আর এখান থেকেই মূলত কাকা প্রফেশনাল ফুটবলের সাথে জড়িয়ে পড়েন।
সাও পাওলোর এক লোকাল ক্লাব আলফাভিলের হয়ে খেলার সময়ে বিখ্যাত ফুটবল ক্লাব সাও পাওলোর নজরে পড়েন তিনি এবং আট বছর বয়সেই সাও পাওলোর ইয়ুথ একাডেমিতে জয়েন করেন। একাডেমিতে নিজের প্লেয়িং স্টাইলের জন্য সহজেই ক্লাব কর্মকর্তাদের সুনজরে পড়ে যান। অবশ্য কাকার প্লেয়িং স্টাইলটাই এমন ছিল যে সেটা যেকোনো ব্যক্তির নজর কাড়তে বাধ্য, রোনালদিনহো কিংবা হালের নেইমারের মত স্কিল তার ছিল না কিন্তু প্লেমেকিং এবিলিটির সাথে একিউরেট পাসিং, আচমকা গতি বাড়িয়ে ডিফেন্ডারদের বোকা বানানো সাথে গোলবারের সামনে ঈগলের মত নিশানা – সবমিলিয়ে অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবে পারফেক্ট একটা প্যাকেজ। একারণেই মাত্র ১৫ বছর বয়সেই সাও পাওলোর সাথে অফিসিয়ালি চুক্তিবদ্ধ হন এরমাত্র চার বছর পরেই সাও পাওলোর সিনিয়র টিমের হয়ে অভিষেক ঘটে কাকার আর নিজের অভিষেক সিজনেই সাও পাওলোর হয়ে লীগে ২৭ ম্যাচে ১২ গোল করেন কাকা এবং দলকে লীগ শিরোপা জেতার ক্ষেত্রে বড় অবদান রাখেন। সাও পাওলোর হয়ে ভালো খেলার পুরস্কার হিসেবে কাকা ২০০১ সালে অনুষ্ঠেয় যুব বিশ্বকাপ দলে ডাক পেয়ে যান যদিও সেই টুর্নামেন্টে ব্রাজিল কোয়ার্টার ফাইনালের বেশি যেতে পারে নি। ২০০২ সালের ৩১ শে জানুয়ারি বলিভিয়ার বিপক্ষে ব্রাজিল সিনিয়র টিমের হয়ে অভিষেক হয় কাকার। কাকার প্লেয়িং পজিশন, স্টাইল সবকিছুতে রিভালদোর মিল দেখে তৎকালীন ব্রাজিল কোচ লুই ফিলিপ স্কলারি ২০০২ বিশ্বকাপ দলে কাকাকে রিভালদোর বদলি হিসেবে দলে নেন। তবে ওই বিশ্বকাপে রিভালদোর অসাধারণ পারফর্মেন্সের কারণে খুব বেশি প্লেয়িং টাইম পায় নি কাকা, গ্রুপপর্বের শেষম্যাচে কোস্টারিকার বিপক্ষে ৭২ মিনিটে রিভালদোর বদলি হিসেবে মাঠে নামেন কাকা। এরপর আর কোনোম্যাচে মাঠে নামার সুযোগ না পেলেও ব্রাজিল ওই বিশ্বকাপ জেতায় হয়ে যান বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য।
৩.
সাও পাওলোতে আরো দুইসিজন খেলার পর ২০০৩ সালে ৮.৫ মিলিয়ন ট্রান্সফার ফি তে ইতালিয়ান জায়ান্ট এসি মিলানে যোগ দেন কাকা আর এখানেই কাকা ক্যারিয়ারের সেরা সময় পার করেন। অ্যাঙ্কোনার বিপক্ষে মিলানের হয়ে প্রথমবারের মতন মাঠে নামেন কাকা, ম্যাচটা মিলান জিতে ২-০ গোলে। ভালো খেলার পুরস্কার হিসেবে মাত্র একমাসের মধ্যে লিজেন্ড রুই কস্তাকে টপকে স্টার্টিং লাইনআপে সুযোগ পেয়ে যান কাকা। সেই সিজনে কাকা ৩০ ম্যাচে ১০ গোল করার পাশাপাশি গুরুত্বপুর্ণ কিছু অ্যাসিস্টও করেন। মিলান সেই সিজনে ইতালিয়ান লীগ স্কুদেত্তো আর উয়েফা সুপার কাপের শিরোপা ঘরে তুলে মিলান, সবমিলিয়ে মিলানের হয়ে প্রথম সিজনে অসাধারণ সময় পার করেন কাকা যার পুরস্কারস্বরূপ সিরি আ তে নিজের প্রথম সিজনেই জিতেন নেন “সিরি আ ফুটবলার অফ দ্য ইয়ার”। ২০০৪ সালে ব্রাজিল কোপা আমেরিকার শিরোপা জিতলেও সেই দলের সদস্য ছিলেন না কাকা কারণ ওই টুর্নামেন্টে অপেক্ষাকৃত আনকোরাদেরই প্রাধাণ্য দিয়েছিলেন তৎকালীন সেলেসাও বস কার্লোস আলবার্তো পেরেইরা।
২০০৪-০৫ মৌসুমে মিলানের বিখ্যাত “ফাইভ ম্যান মিডফিল্ড” এর একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন কাকা, সেসময়ে মিলানের মূল স্ট্রাইকার আন্দ্রে শেভচেঙ্কোর ঠিক পিছনের পজিশনেই খেলতেন কাকা। মৌসুমের শুরুটাও দুর্দান্ত হয় মিলানের, ল্যাজিওকে হারিয়ে সুপারকোপা ইতালিয়ানার শিরোপা জিতে নেয় মিলান। কিন্তু এই সিজনের বাকি সময়টা ঠিক এমনভাবে যায় নি, কাকা লীগে সাত গোল করলেও জুভেন্টাসের কাছে স্কুদেত্তোর শিরোপা হারায় মিলান। সেবার ইউসিএলে বেশ দাপটের সাথে খেলে ফাইনালে চলে গিয়েছিলো মিলান যেখানে দুই গোল ও পাঁচ অ্যাসিস্ট করে দলকে ফাইনালে তুলতে বড় অবদান রেখেছিলো কাকা। ইস্তাম্বুলে ইউরোপ সেরা ক্লাব নির্ধারণী ম্যাচে মিলানের প্রতিপক্ষ ছিল ইংলিশ জায়ান্ট লিভারপুল, প্রথমার্ধেই ৩-০ গোলে এগিয়ে যায় মিলান আর তিনটা গোলেই কাকার পরোক্ষ অবদান ছিল। তবে দ্বিতীয়ার্ধে পাশার দান পুরোপুরি উলটে ফেলে লিভারপুল, মাত্র ছয় মিনিটের মধ্যে তিনগোল শোধ করে ফেলে লিভারপুল। শেষপর্যন্ত অতিরিক্ত সময়েও স্কোরলাইন ৩-৩ থাকলে খেলা গড়ায় টাইব্রেকারে যেখানে ৩-২ গোলে হেরে যায় কাকার মিলান। তবে কাকা “উয়েফা মিডফিল্ডার অফ দ্য ইয়ার” এর পুরস্কার জিতেন। স্কুদেত্তো আর চ্যাম্পিয়ন্স লীগ দুটোই অল্পের জন্য হাতছাড়া হওয়ায় সিজনটা কাকার জন্য কিছুটা হলেও আক্ষেপের ছিল তবে সেই আক্ষেপ কিছুটা কমে ব্রাজিলের হয়ে ২০০৫ এর কনফেডারেশন্স কাপ জয়ের পর। টুর্নামেন্টে ব্রাজিলের প্রতিটি ম্যাচেই মূলদলে ছিলেন কাকা। ফাইনালে আর্জেন্টিনাকে ৪-১ গোলে উড়িয়ে দিয়েছিলো ব্রাজিল, ব্রাজিলের হয়ে দ্বিতীয় গোলটি কাকার ছিল।
২০০৪-০৫ মৌসুমে লীগে সাত গোল করলেও ২০০৫-০৬ মৌসুমে কাকা সেটিকে নিয়ে যান ১৭ তে। তবে কাকার দল মিলান সেবারো সিরি আর শিরোপা জিততে ব্যর্থ। চ্যাম্পিন্স লীগ কিংবা কোপা ইতালিয়া কোনো টুর্নামেন্টেই সেবার ফাইনালে যেতে পারে নি মিলান। তবে নিজে ভালো খেলার পুরস্কারস্বরূপ ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতন কাকা জায়গা করে নেন ফিফপ্রো একাদশ এবগ্ন উয়েফা টিম অফ দ্য ইয়ারে। মিলানের হয়ে মৌসুম শেষ করে কাকা ব্রাজিলের হয়ে ২০০৬ বিশ্বকাপ খেলতে জার্মানি যায়। সেবার রোনালদিনহো, রোনালদো,কার্লোস,কাফু,দিদার সাথে কাকার মত খেলোয়াড় থাকা সত্ত্বেও টুর্নামেন্টের শুরু থেকে ধুঁকতে থাকে ব্রাজিল। প্রথম ম্যাচে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে কাকার দেওয়া একমাত্র গোলেই জয় পায় ব্রাজিল যেটি বিশ্বকাপে কাকার প্রথম গোল। এরপর ওই টুর্নামেন্টে কাকাকে আর সেভাবে খুঁজে পাওয়া যায় নি,সাথে অন্য খেলোয়াড়দের ব্যর্থতায় শেষপর্যন্ত ব্রাজিল বিদায় নেয় কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেই! ব্যর্থতার দায়ে চাকরি হারান পেরেইরা, নতুন কোচ হিসেবে দুঙ্গা এসেই ঘোষণা দিয়ে দেন যে তারকাখ্যাতি দিয়ে দলে জায়গা পাওয়ার দিন শেষ, এখন থেকে পারফর্মেন্স দিয়েই দলে জায়গা পেতে হবে। এতে রোনালদিনহো,রোনালদোর সাথে কাকারও দলে থাকাটা কিছুটা অনিশ্চিত হয়ে যায়।
৪.
বিশ্বকাপে ব্যর্থ মিশন শেষে মিলানের হয়ে ২০০৫-০৬ মৌসুমে খেলতে ফিরে আসেন কাকা। ওইদিকে দলের মূল স্ট্রাইকার শেভচেঙ্কো চেলসিতে চলে গেলে ইনজাঘির সাথে সেকেন্ড স্ট্রাইকার হিসেবে খেলা শুরু করেন কাকা। আগের দুই সিজনের মত এবারো লীগে ব্যর্থ মিলান, লীগ শেষ করে চতুর্থ পজিশনে থেকে। লীগে সেবার ৩১ ম্যাচে খেলে ৮ গোল করেন কাকা ওইদিকে কোপা ইতালিয়াতেও রোমার কাছে হেরে সেমিতেই বিদায় নেয় মিলান। তবে মিলান সেবার মূল খেলাটা দেখায় চ্যাম্পিয়ন্স লীগে যার নেপথ্য কারিগর ছিল কাকা নিজে। সেবার শুরু থেকে চ্যাম্পিয়ন্স লীগে অসাধারণ খেলছিলো কাকা, গ্রুপস্টেজে আন্ডারলেখটের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করে চ্যাম্পিয়ন্স লীগে নিজের প্রথম হ্যাটট্রিক পেয়ে যান কাকা। রাউন্ড অফ সিক্সটিনে দুই লেগ মিলিয়ে সেল্টিককে ১-০ গোলে হারায় মিলান আর সেই একমাত্র গোলটিও আসে কাকার পা থেকে। তবে কাকা তার সেরা খেলাটা দেখান ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে সেমিফাইনালের প্রথম লেগে যেটার বর্ণনা দিয়েই লেখাটা শুরু করেছিলাম। দ্বিতীয় লেগে মিলানের ৩-০ গোলের জয়ের ম্যাচে কাকা অসাধারণ এক দূরপাল্লার গোল করেছিলেন। ফাইনালে এথেন্সের অলিম্পিক স্টেডিয়ামে সেই লিভারপুলেরই মুখোমুখি হয় মিলান তবে এবার আর আগেরবারের ভুল মিলান করে নি। লিভারপুলকে ২-১ গোলে হারিয়ে মিলান জিতে নেয় চ্যাম্পিয়ন্স লীগের শিরোপা যেখানে ফাইনালের দুটি গোলেই ছিল কাকার পরোক্ষ অবদান। ১০ গোল করে আসরের সর্বোচ্চ গোলদাতার সাথে সাথেই জিতে নেন আসরের সেরা ফরোয়ার্ডের পুরস্কার। ঘরোয়া লীগে ব্যর্থ হলেও চ্যাম্পিয়ন্স লীগে এমন অতিমানবিয় পারফর্মেন্সের জন্য ২০০৬-০৭ সিজনটা কাকার জন্য ছিল ড্রিম সিজন। আর এই সিজনই কাকাকে মিলানের রাজপুত্রের আসনে পাকাপাকিভাবে বসিয়ে দেয়।
ওইদিকে আন্তর্জাতিক ফুটবলে ব্রাজিলের নতুন কোচ দুঙ্গার ছকে কাকা হয়ে যান দলের মূলতারকা, কিছুদিন পরেই পেয়ে যান ব্রাজিলের ঐতিহ্যবাহী “নাম্বার টেন” জার্সি! এসময়ে জাতীয় দলেও অসাধারণ খেলতে থাকেন কাকা, সেপ্টেম্বরে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে প্রীতিম্যাচে নিজেদের ডিবক্স থেকে অসাধারণভাবে তিনজন আর্জেন্টাইনকে বোকা বানিয়ে দুর্দান্ত এক সোলো গোল করেন কাকা যেটা সেলেসাওদের হয়ে কাকার সেরা গোল। তবে ক্যারিয়ারের সেরা ফর্মে থাকা সত্ত্বেও চ্যাম্পিয়ন্স লীগ ফাইনাল খেলার ধকল কাটিয়ে উঠতে না পারায় কোপা আমেরিকার দল থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করে নেয় কাকা। যদিও রবিনহোর নৈপুণ্যে ব্রাজিল ঠিকই সেবারের কোপা আমেরিকার শিরোপা জিতেছিলো কিন্তু টানা দ্বিতীয়বার দলের বাইরে থেকেই নিজ দেশের মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের আনন্দ উপভোগ করতে হয়েছিলো কাকাকে!
২০০৭-০৮ সিজনও দুর্দান্তভাবে শুরু করে কাকার মিলান, সেভিয়াকে ৩-১ গোলে হারিয়ে মিলান জিতে নেয় উয়েফা সুপার কাপের শিরোপা যেই ম্যাচে মিলানের তৃতীয় গোলটি করেছিলেন কাকা। ২০০৭ সালের ৫ অক্টোবর কাকা জিতে নেন “ফিফা প্লেয়ার অফ দ্য ইয়ারের” পুরস্কার আর ২ ডিসেম্বর পান “উয়েফা ব্যালন ডি অর”।
সেই মাসেই আর্জেন্টাইন ক্লাব বোকা জুনিয়র্সকে ৪-২ গোলে হারিয়ে মিলান জিতে নেয় ক্লাব বিশ্বকাপের শিরোপা আর সেই ফাইনালেও কাকা দলের হয়ে একটি গোল ও একটি অ্যাসিস্ট করেন। অসাধারণ পারফর্মেন্সের সুবাদে কাকা জিতে নেন সেই আসরের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার। নতুন বছরের শুরুতেই কাকা ক্যারিয়ারে দ্বিতীয়বারের মতন জিতে নেনে “সিরি আ ফুটবলার অফ দ্য ইয়ার” এর পুরস্কার। তবে সেই সিজনে কাকা নিজে লীগে ১৫ গোল করলেও তার দল মিলান টপ ফোরে জায়গা না পাওয়ায় ২০০৮-০৯ সিজনের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে খেলার সুযোগ পান নি কাকা। ২০০৭-০৮ চ্যাম্পিয়ন্স লীগেও মিলান ছিল ব্যর্থ, আর্সেনালের কাছে রাউন্ড অফ সিক্সটিনের ম্যাচে এগ্রিগেটে ২-০ গোলে হেরে বিদায় নেয় মিলান, সেই আসরে দুইটি গোল করেছিলেন কাকা। সেবার ব্রাজিলের কোনো আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট না থাকায় আন্তর্জাতিক ফুটবলের তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু হয় নি।
২০০৮-০৯ সিজন যত গড়িয়েছে কাকার মিলান ছাড়ার গুঞ্জন তত শক্তিশালি হয়েছে, জানুয়ারিতে ম্যানচেস্টার সিটির ১০৫ মিলিয়ন ইউরোর বিড সাথে মিলানের তৎকালীন অর্থনৈতিক দুর্দশা – দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে সবাই ধরেই নিয়েছিলো যে এবার কাকা মিলান ছাড়বেই। কিন্তু কাকা দৃঢ়কন্ঠে ঘোষণা দেন তিনি মিলানেই ক্যারিয়ার শেষ করতে চান এমনকি মিলান তাকে বিক্রি করতে চাইলেও সে ক্লাবের সাথে বসে সেই মত পরিবর্তন করার চেষ্টা করবেন। কাকার এই কথার পর ওই ট্রান্সফার উইন্ডোতে কাকার ক্লাব ছাড়ার গুঞ্জন থেমে যায়, মিলানের হয়ে সিজনটাও এর আগের সিজনের চেয়ে ভালোই কাটে কাকার। লীগে তৃতীয় হয়ে আবারো ফিরে পায় চ্যাম্পিয়ন্স লীগে খেলার যোগ্যতা,কাকা নিজেও করেন ১৬ গোল। কিন্তু সিজন শেষ হওয়ার সাথে সাথেই কাকার মিলান ছাড়ার গুঞ্জন আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠে তবে এবার আগ্রহী দলের নাম রিয়াল মাদ্রিদ। কাকা তখন ব্রাজিলের হয়ে কনফেডারেশন্স কাপ খেলতে দক্ষিণ আফ্রিকায় ওইদিকে কাকাকে মিলানেই রেখে দেওয়ার জন্য মিলানের ফ্যানরা প্রতিদিনই সান সিরোর বাইরে হট্টগোল করছে! ওইদিকে মিলানের আর্থিক অবস্থা তখন একদম নাজুক তাই মাদ্রিদের প্রায় ৭০ মিলিয়নের অফার মিলানের পক্ষে ফিরিয়ে দেওয়ার সম্ভাবনাও আস্তে আস্তে কমতে থাকে। শেষপর্যন্ত মিলানের সিইও আদ্রিয়ানো গ্যালিয়ানি জানিয়ে দেন যে মিলানের এমন দুঃসময়ে রিয়ালের এমন বড় প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়া আসলেই সম্ভব না, গ্যালিয়ানি নিজেই কাকাকে গিয়ে বুঝান যে মিলানের ভালোর জন্যই তাকে মিলান ছাড়তে হবে! শেষপর্যন্ত সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ৮ জুন ৬৭ মিলিয়ন ইউরোর বিনিয়ময়ে কাকাকে রিয়াল মাদ্রিদে ভেড়ানোর ঘোষণা দেন রিয়াল মাদ্রিদের প্রেসিদেন্ট ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ। যেই মিলানকে ভালোবেসে মাত্র ছয়মাস আগেই মিলানে ক্যারিয়ার শেষ করার কথা বলেছিলো সেই মিলানের স্বার্থেই শেষপর্যন্ত এক বর্ণিল অধ্যায়ের সমাপ্তি টানতে বাধ্য হন কাকা আর শেষপর্যন্ত এই একটা ট্রান্সফারই পরে কাকার পুরো ক্যারিয়ার উলটপালট করে দিয়েছিলো! ওইদিকে ব্রাজিলের হয়ে কনফেডারেশন্স কাপে কাকা ছিলেন দুর্দান্ত, মিশরের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে কাকার জোড়া গোলেই ব্রাজিল ৪-৩ গোলের জয় পায়। এরপর যুক্তরাষ্ট্র,ইতালি,দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে কাকা কোনো গোল না করলেও প্রায় প্রতিটি গোলেই ছিল কাকার পরোক্ষ অবদান। ২৮ জুন ফাইনালে যুক্তরাষ্ট্রের মুখোমুখি হয় ব্রাজিল, শক্তির দিক থেকে অনেক এগিয়ে থাকলেও প্রথমার্ধ ব্রাজিল শেষ করে ০-২ গোলে পিছিয়ে থেকে। দ্বিতীয়ার্ধে শুরু হয় কাকা ম্যাজিক, ৪৬ ও ৭৪ মিনিটে কাকার এসিস্টেই জোড়াগোল করেন লুইস ফ্যাবিয়ানো পরে ৮৪ মিনিটে এলানোর কর্ণারে মাথা ছুঁইয়ে দলের শিরোপা নিশ্চিত করেন অধিনায়ক লুসিও। ব্রাজিলের হয়ে টানা দুইবার কনফেডারেশন্স কাপের শিরোপা জিতেন ব্রাজিল আর পুরো টুর্নামেন্টজুড়ে অসাধারণ পারফর্মেন্সের পুরস্কার হিসেবে কাকা জিতে নেন গোল্ডেন বলের পুরস্কার।
৫.
ব্রাজিলকে কনফেডারেশন্স কাপ জেতানোর পরপরই কাকা চলে যান মাদ্রিদে, সেখানে ৩০ জুন তাকে অফিসিয়ালি রিয়াল মাদ্রিদের খেলোয়াড় উপস্থাপন করা হয়। মাদ্রিদের হয়ে কাকার অফিসিয়ালি ডেব্যু হয় লা লীগায় ডিপোর্টিভা লা করুনার বিপক্ষে আর মাদ্রিদের হয়ে কাকা প্রথম অফিসিয়াল গোল করেন ভিয়ারিয়ালের বিপক্ষে।
সেবার লীগে ২৫ ম্যাচে কাকা আট গোল ও ছয় অ্যাসিস্ট করেন কিন্তু ইনজুরির জন্য কাকা সেবার বেশকিছু ম্যাচ মিস করেন। ওদিকে লা লীগায় চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বার্সেলোনার চেয়ে তিন পয়েন্ট পিছিয়ে লীগ শিরোপা হাতছাড়া হয় রিয়ালের। তবে রিয়াল সেবার সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা খায় চ্যাম্পিয়ন্স লীগে, ফ্রেঞ্চ ক্লাব অলিম্পিক লিওর কাছে এগ্রিগেটে ২-১ গোলে হেরে রাউন্ড অফ সিক্সটিন থেকেই বিদায় নেয় রিয়াল মাদ্রিদ! কাকা,ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর মত বিগ সাইনিং সত্ত্বেও এমন ব্যর্থতায় সমর্থকরা বেশ ক্ষেপে যায়। শেষপর্যন্ত ব্যর্থতার জেরে কোচের পদ থেকে বরখাস্ত হন চিলিয়ান ম্যানুয়েল অ্যালেগ্রি। ওইদিকে বাম হাঁটুতে ইনজুরির জন্য চিকিৎসকরা সার্জারির পরামর্শ দিলেও বিশ্বকাপ মিস হতে পারে এজন্য সার্জারি না করেই কাকা চলে যান ব্রাজিলের হয়ে বিশ্বকাপ খেলতে আর এই সিদ্ধান্তই কাকার পুরো ক্যারিয়ার এলোমেলো করে দেয়।
২০১০ বিশ্বকাপে দুঙ্গার ব্রাজিলে কাকা ছাড়া আর তেমন বড় তারকা কেউই ছিল না, রবিনহো তখন ইতিমধ্যে নষ্টদের ভীড়ে হারিয়ে যাওয়া শুরু করেছে আর স্ট্রাইকার ফ্যাবিয়ানোও তেমন বড় কোনো নাম ছিল না। সব গড়পড়তা প্লেয়ারদের সাথে কাকাকে নিয়ে দুঙ্গা রক্ষণাত্মক কৌশলে বেশ স্থিতিশীল একটা দল দাঁড় করিয়ে ফেলেছিলো। সারাবিশ্বের কোটি কোটি ব্রাজিল ফ্যান সেবার কাকার পারফর্মেন্সে ভর করে বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্নে বিভর কিন্তু কিছুটা আনফিট কাকা সেবার নিজেকে পুরোপুরি মেলে ধরতে ব্যর্থ! প্রথম দুই ম্যাচে কাকা একটি করে অ্যাসিস্ট করেন ঠিকই কিন্তু সেই দুরন্ত গতির কাকাকে কোনো ম্যাচেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না! তদুপরি আইভরি কোস্টের বিপক্ষে রেফারির বিতর্কিত লাল কার্ডে পর্তুগালের বিপক্ষে গ্রুপের শেষম্যাচটি মিস করেন কাকা। রাউন্ড অফ সিক্সটিনে চিলির বিপক্ষে ব্রাজিলের ৩-০ গোলের সহজ জয়েও ছিল কাকার এক অ্যাসিস্ট। কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিল মুখোমুখি হয় সেবারের আসরের ডার্ক হর্স নেদারল্যান্ডসের, সেবার রোবেন,স্নাইডার,ভ্যান পার্সিকে নিয়ে নেদারল্যান্ডস দলটা বেশ ব্যালান্সড এক দল ছিল। তবে খেলার শুরুতেই রবিনহোর দেওয়া গোলে ব্রাজিল এগিয়ে গেলে মনে হচ্ছিলো ডাচ বাঁধাও অতিক্রম করে ফেলবে কাকার ব্রাজিল, এরপর ৩৫ মিনিটে কাকার এক অসাধারণ দূরপাল্লার শট ডাচ গোলকিপার স্টেকেলেনবার্গ অবিশ্বাস্যভাবে ফিরিয়ে দিলে নিশ্চিত গোল থেকে বঞ্চিত হয় ব্রাজিল। দ্বিতীয়ার্ধে পুরো ম্যাচের গতিপট ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে যায়, স্নাইডারের জোড়া গোলে ২-১ গোলের লিড নিয়ে নেয় নেদারল্যান্ডস এরপর মরার উপরে খাঁড়ার ঘা হিসেবে আসে ফিলিপ মেলোর পাগলাটে লালকার্ড! ১০ জনের দল নিয়েই কাকা আপ্রাণ চেষ্টা করে যায় সমতা ফেরাতে কিন্তু সেই চেষ্টা সফল হয় নি। ২-১ গোলে ডাচদের কাছে হেরে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেই বিদায় নেয় ব্রাজিল আর দলের মূলতারকা হয়ে এসেও গোলশূন্য এক টুর্নামেন্ট শেষ করতে হয় কাকার। সবচেয়ে বড় কষ্টের ব্যাপার হচ্ছে যেই দলের হয়ে খেলার জন্য নিজের ক্যারিয়ারের ঝুঁকি নিয়ে সার্জারি না করেই বিশ্বকাপ খেলতে এসেছিলো কাকা, সেই ব্রাজিলের হয়ে এটাই ছিল কাকার শেষ প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ! এরপর মাদ্রিদে ফিরেই কাকা হাঁটুর সার্জারি করেন যার জন্য আটমাস ফুটবল থেকে দূরে থাকতে হয়েছিলো কাকাকে।
কিন্তু এই আটমাসে অনেককিছুই পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিলো, মাদ্রিদ কোচের হটসিটে পেলেগ্রিনির জায়গায় তখন হোসে মরিনহো যার ইচ্ছাতে কাকার পজিশনে খেলার জন্য জার্মান প্লেমেকার মেসুত ওজিলকে দলে ভিড়িয়েছিলো রিয়াল মাদ্রিদ। ওজিল ক্লাবে এসেই ভালো ভালো খেলা শুরু করে ফলে ইনজুরি থেকেই ফিরেই সেরা একাদশে সুযোগ পাওয়াটা কাকার জন্য বেশ কঠিন হয়ে গিয়েছিলো। তবে সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটা হয়েছিলো কাকার নিজের মধ্যেই, যেই গতি ছিল কাকার মূল শক্তি ইনজুরি থেকে ফেরার পর সেই গতিটাই অনেকাংশে হারিয়ে ফেলে কাকা! ইনজুরির আগের কাকা আর ইনজুরির পরের কাকার ঠিক কতটা তফাৎ ছিল সেটা ওই ভিন্ন দুই সময়ের খেলা না দেখলে কেউ আন্দাজ করতে পারবে না। তবুও কাকা হাল ছাড়েন নি, যখুনি সুযোগ পেয়েছেন তখুনি শতভাগ উজাড় করে দিয়েছেন কিন্তু মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় পর্যাপ্ত সু্যোগের অভাব। কাকা হয়তো একম্যাচ বদলি হিসেবে নেমে ভালো করলো তাই পরের ম্যাচে মূল একাদশে খেলার সুযোগ পেয়েছে কিন্তু যখুনি একটা ম্যাচ কাকার খারাপ গিয়েছে তখুনি আবারো সাইডবেঞ্চে। সাইডবেঞ্চ-সাবস্টিটিউট-ভালো পারফর্মেন্স-মূল একাদশ-একম্যাচ খারাপ খেলা-আবার সাইডবেঞ্চ এই দুষ্টচক্রে চলে যায় কাকার পরবর্তী তিন সিজন। এদিকে মাদ্রিদ একাদশে অনিয়মিত হওয়ায় ব্রাজিল দলের দরজাও বন্ধ হয়ে যায় কাকার জন্য, ২০১০-২০১৩ এই তিনবছরে কাকা মাত্র তিনবার জাতীয় দলে ডাক পেয়েছিলো! ২০১২-১৩ সিজনের পরেই কাকা বুঝে যায় যে যদি সে ক্লাবের মূল একাদশের হয়ে নিয়মিত খেলার সুযোগ না পায় তাহলে ঘরের মাঠে ২০১৪ বিশ্বকাপে দলে জায়গা পাওয়াটা সম্ভব হবে না। তখন মরিনহোর বদলে মাদ্রিদের কোচ হয়েছেন কাকার পুরনো গুরু কার্লো আনচেলেত্তি, কার্লোর সাথে এব্যাপারে কথা বললে কার্লো জানিয়ে দেন যে মাদ্রিদে এত ইনফর্ম তারকার ভীড়ে কাকার মূল একাদশে জায়গা পাওয়া সম্ভব হবে না। বিশ্বকাপ মাথায় রেখে কাকা মাদ্রিদের কাছে ট্রান্সফারের আবেদন করে আর মাদ্রিদ সেই আবেদনে সাড়া দিয়ে ২০১৩ সামার ট্রান্সফারের একদম শেষদিনে ফ্রি ট্রান্সফারে কাকা ফিরে যান নিজের ঘর এসি মিলানে। চার বছরের মাদ্রিদ ক্যারিয়ারে দলের হয়ে চারটি শিরোপা জয় ছাড়াও ১২০ ম্যাচে কাকার ছিল ২৯ গোল ও ৩২ অ্যাসিস্ট।
৬.
কিন্তু এই চার বছরে সবকিছুই পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিলো, কাকা তার গতি ও স্কিলের অনেকটাই তখন হারিয়ে ফেলেছে ওদিকে মিলানও আর্থিকভাবে প্রায় পঙ্গু হয়ে গিয়েছে। কিন্তু একটা ব্যাপার ঠিক আগেরমতই ছিল আর সেটা হলো মিলানের ফ্যানবেস আর কাকার মধ্যে পারস্পরিক সেই ভালোবাসার সম্পর্ক, ফেরার পর দর্শকদের উষ্ণ ভালোবাসায় সিক্ত হন কাকা, আবার সেই পুরনো ২২ নাম্বার জার্সিতে খেলা শুরু করেন কাকা।
মিলানে ফিরেও আগের সেই কাকা আর ফিরে আসে নি তবে যতটুকুই ভালো খেলেছিলেন সেই পারফর্মেন্স সাথে অভিজ্ঞতা – সবমিলিয়ে ২০১৪ বিশ্বকাপে ব্রাজিল দলে তার অন্তর্ভুক্তির দাবি বেশ জোরালো হয়। কিন্তু তখনকার ব্রাজিল কোচ স্কলারি তার কনফেডারেশন্স কাপজয়ী দলটাকেই ধরে রাখতে চাইলে সেই দলে আর ঠাই হয় নি কাকার। বিশ্বকাপে সুযোগ না পাওয়ার পর কাকা অবসরের পরিকল্পনা করতে থাকেন, মিলানের সাথে দুই বছরের চুক্তি হলেও পারস্পরিক সমঝোতায় একবছর পরেই সেই চুক্তি শেষ করেন কাকা। এরপর কাকা চুক্তিবদ্ধ হন আমেরিকান ক্লাব অরল্যান্ডো সিটির সাথে, কিন্তু মেজর লীগ সকারে খেলার জন্য অরল্যান্ডো সিটিকে ২০১৫ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো। তাই কাকা লোনে খেলতে যান নিজের শৈশবের ক্লাব সাও পাওলোতে। এরপর ২০১৫-২০১৭ তিন সিজন খেলেন মেজর লীগ সকারে, এরমাঝে ২০১৬ কোপা আমেরিকায় ডগলাস কস্তার ইনজুরির সুবাদে ব্রাজিল দলে ডাকও পান তবে কাকা নিজেও ইনজুরিতে পড়লে কোনোম্যাচে খেলার সুযোগ আর পান নি। শেষপর্যন্ত ২০১৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর সবধরনের ফুটবল থেকে অবসরের ঘোষণা দেন কাকা আর এরই মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটে কাকার বর্ণাঢ্য ফুটবল ক্যারিয়ারের।
৭.
বর্তমান সময়ে অনেকেই প্রশ্ন করেন যে ক্যারিয়ারের মাঝপথে খেই হারানোর পরেও কেনো কাকার নাম ইতিহাসের সেরা মিডফিল্ডারদের সাথেই উচ্চারিত হবে? আসলে যারা কাকার পিকটাইমের খেলা দেখে নি তাদের যতই বুঝানো হউক তারা এই ব্যাপারটা বুঝবে না। পিরলো,ল্যাম্পার্ড,জেরার্ড,জাভি,ইনিয়েস্তারা লংটাইম সার্ভিস দিয়েছে এটা ঠিক কিন্তু এদের প্রত্যেকের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি কাকার মধ্যে এমন একটা গুণ ছিল যা এদের কারর মধ্যে ছিল না আর তা হলো মিডফিল্ডার হয়েও নিজের দিনে প্রতিপক্ষকে একদম দুমড়ে মুচড়ে ফেলা। কাকার সেরা ম্যাচগুলো দেখলেই দেখা যাবে যে নিজ দলের খেলোয়াড়দের তেমন সাহায্য ছাড়াও নিজের দিনে কাকা একাই প্রতিপক্ষকে উড়িয়ে দিতে পারতেন যেই কাজটা এখনকার যুগের মেসি ক্রিশ্চিয়ানো নেইমাররা করেন তবে কাকার সাথে এদের বড় তফাৎ হচ্ছে এরা সবাই ফরোয়ার্ড আর কাকা ছিল অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার। তাই লংটাইম সার্ভিস না দিতে পারলেও নিজের পিকটাইমে কাকা যেটা করতে পেরেছেন সেটাই কাকাকে সেরা মিডফিল্ডারদের কাতারে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
সমসাময়িক অনেক ভালো প্লেয়ারের চেয়েই ভক্তদের ভালোবাসা কাকা একটু বেশিই পেয়েছেন আর এর পিছনে বেশকিছু কারণও ছিল। প্রথমত, কাকার প্লেয়িং স্টাইল যেকোনো ফুটবল ফ্যানেরই ভালো লাগবে, অসাধারণ প্লেমেকিং স্কিলের সাথে দুর্দান্ত গতি দিয়ে কাকা তার পিকটাইমে যেকোনো ম্যাচের মোড় যেকোনো সময়ে ঘুরিয়ে ফেলতে পারতো। কাকার ব্যাপারে চেলসির লিজেন্ডারি মিডফিল্ডার ফ্রাঙ্ক ল্যাম্পার্ড বলেছিলেন “চেলসিতে আমি অসাধারণ সব খেলোয়াড়ের সাথে খেলি কিন্তু কাকা হচ্ছে একমাত্র খেলোয়াড় যার খেলা দেখার জন্য আমি টাকা খরচ করতেও রাজি আছি।” সর্বকালের অন্যতম সেরা লেফটব্যাক পাওলো মালদিনি বলেছিলেন “কাকা মিলানের জন্য যা করেছে তাতে সে সত্যিই মিলানের প্রতিক হয়ে গিয়েছে।” রোনালদিহো বলেছিলেন “মিলানে থাকাকালীন দুই থেকে তিন সিজন কাকা বিশ্বের সেরা খেলোয়াড় ছিল,তখন সে খেলার মাঠে যা খুশি করতে পারতো।” আন্দ্রে পিরলো বলেছিলেন “কাকার পিকটাইমে তাকে কিভাবে থামাতে হবে সেই কৌশল কোনো ডিফেন্ডারেরই জানা ছিল না।” তুমুল জনপ্রিয়তার আরেক কারন ছিল কাকা যখন পিকটাইমে ছিল তখন রোনালদো,রোনালদিনহো,আদ্রিয়ানোদের হারিয়ে ব্রাজিল দল ছিল তারকহীন। সেসময়ে কাকাই ছিল একমাত্র বলার মত ব্রাজিলিয়ান তারকা তাই সারা বিশ্বের সমস্ত ব্রাজিল ফ্যানদের সবচেয়ে প্রিয় খেলোয়াড় হয়ে যান কাকা।
তবে আরেকটা কারণ খুব বেশি ভূমিকা রেখেছে আর সেটা কাকার বিতর্কহীন ব্যক্তিগত জীবন। যেখানে অধিকাংশ ব্রাজিলের খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত জীবনের জন্য প্রায়ই তাদের পত্রিকার শিরোনাম হতে হয় সেখানে কাকা ছিলেন সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। ব্যক্তিগত জীবনে কাকা ভীষণ ধার্মিক একজন মানুষ, আঠারো বছর বয়সে সুইমিংপুলে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে কাকার ক্যারিয়ারটাই শেষ হতে বসেছিলো এমনকি ডাক্তার বলেছিলো কাকা কোনোদিন হয়তো হাঁটতেও পারবে না। কিন্তু অলৌকিকভাবে মাত্র কয়েক সপ্তাহ পরেই সুস্থ হয়ে মাঠে ফিরেন কাকা যেটাকে কাকা “ঈশ্বরের আশীর্বাদ” হিসেবে অভিহিত করেন। এরপর থেকেই ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মকে ভীষনভাবে অনুসরণ করতে থাকেন কাকা, প্রতিটি গোলের পর দুই হাত উপরের দিকে তুলে যেই সেলিব্রেশন করেন সেটা আসলে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন। বড় শিরোপা জেতার পর যেখানে দলের সবাই শ্যাম্পেন পার্টিতে ব্যস্ত সেখানে কাকা ব্যস্ত ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জ্ঞাপনে। এজন্য কাকা খুব সহজেই হয়ে গেছেন অনেক ভক্তের ড্রিম আইকন। অবশ্য কাকাও সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন ভক্তদের এই ভালোবাসা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য, ২০১০ এর পরে বহু ইনজুরি সত্ত্বেও কাকা হাল ছেড়ে দেন নি, দাঁতে দাঁতে চেপে লড়ে গেছেন। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও ২০১৪ বিশ্বকাপে ব্রাজিল দল থেকে বাদ পড়লেও কোচ কিংবা ম্যানেজমেন্টকে দায়ি করে কোনো কটুকথা বলেন নি উলটো নিজের কষ্ট ভুলে উদ্বোধনী ম্যাচে ব্রাজিলকে সাপোর্ট দিতে উপস্থিত ছিলেন স্টেডিয়ামে। আজ যখন প্রতিভা নষ্টকারিদের লিস্টে রোনালদিনহো,আদ্রিয়ানো,রবিনহোদের পাশে অনেকে কাকার নাম নেন তখন সত্যিই খুব খারাপ লাগে, কাকার প্রতিভা পূর্ন বিকশিত না হওয়ার জন্য কাকার কোনো দায় নেই দায় থাকলে সেটা কাকার ভাগ্য আর ইনজুরির। ক্যারিয়ারজুড়ে কাকা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে গেছেন ভক্তদের ভালোবাসার পূর্ণ প্রতিদান নিতে। মিলানের দর্শক যেভাবে ভালোবেসে তাকে রাজপুত্রের আসনে বসিয়েছে সেই ভালোবাসার প্র্তিদান দেওয়ার জন্য কাকা ম্যানচেস্টার সিটির লোভনীয় অফারও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। আবার সেই মিলানের ভালোর জন্য নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও মাদ্রিদে ট্রান্সফারের ডিসিশন নিয়েছিলেন। তাই কাকার বিদায়বেলায় আজ জেমসের ওই গানটাই বারবার মনে পড়ে “মনে রেখো কেবল একজন ছিল..... যে ভালোবাসতো শুধুই তোমাদের.....”
- 0 মন্তব্য