• ক্রিকেট

জাতীয় দলের মিডল অর্ডারের ভবিষ্যত এবং দর্শকদের অসহিষ্ণুতা

পোস্টটি ১০৬৭৪ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।
হিন্দী মুভি "এম এস ধোনি"-তে দেখায় যে, সব খেলোয়ারদের এক ওভার নেটে ব্যাটিং দেখে প্রাথমিক ক্যাম্প দল নির্বাচন করে। তো সেখানে একটা ডায়লগ থাকে, "এ কেমন বিচারকের দল যে ছয় বলে খেলোয়ারের সম্ভাবনা বুঝে যায়?"
 
এসব ক্ষেত্রে সাধারণত যেটা হয় যে, বোলিং মেশিনে সেট করে ছয়টা বল ছয় রকমে করা হয়। কোনটা ড্রাইভ করার বল দেয়া হয়, কোনটা পুল করার বল, কোনটা সলিড ডিফেন্সের বল। দেখা হয় যে ব্যাটসম্যান কিভাবে ড্রাইভ করে, কেমন পুল করতে পারে ইত্যাদি। একটা শট খেলার সময় তাঁর পা কতটুকু চলে, ব্যাটের সাথে শরীরের ব্যালেন্স ঠিক থাকে কিনা, টাইমিং কতটুকু করতে পারে ইত্যাদি বিষয়ও দেখা হয়। এসব দেখে ওই ব্যাটারের সম্ভাবনা, প্রতিভা, টেকনিক বোঝা যায়!
 
নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখানো সফল ব্যাটসম্যান অনেক আছেন। টাইমিং আর হ্যান্ড আই কোঅর্ডিনেশন ঠিক ছিল বলে টেকনিকে অন্যান্য ঘাটতি থাকাতেও শেহওয়াগ, ধোনি সফল হয়েছেন। আবার স্বল্প প্রতিভা নিয়ে শুধুমাত্র অধ্যবসায়, পরিশ্রম আর টেম্পারমেন্টের জোরে সফল হয়েছেন এমন ব্যাটসম্যানও কম না। স্টিভ ওয়াহ মাত্র ৩টা শট খেলে টেস্টে ১০ হাজার+ রান করেছেন; চন্দরপল করেছেন ১১,৮৬৭।
 
পরিশ্রম, টেম্পারমেন্টের মাধ্যমে ধারাবাহিকতা অবশ্যই মূল ব্যাপার! তবে প্রতিভা, টেকনিক ভালো থাকলে কোন ব্যাটারকে লম্বা রেসের ঘোড়া ধরে তাঁর পিছনে বাজি ধরতে হয়। প্রথমদিকে খুব খারাপ করার পরেও ভারত রোহিত শর্মার পিছনে লেগে ছিল; অফ ফর্মের কারণে পাকিস্তানি নির্বাচকেরা বাদ দিলেও ইমরান খান একাই ইনজামামকে দলে ধরে রেখেছিলেন। ইনজি সেই বিশ্বাসের প্রতিদান দিয়েছিলেন। এরপরেও কোন ব্যাটার না পারলে সেটা সেই ব্যাটসম্যানের একান্তই নিজস্ব ব্যর্থতা! টেন্ডুলকার, বিনোদ কাম্বলি দুজনেই একইরকম ক্ষমতা নিয়ে ক্রিকেটে এসেছিলেন। একজন ব্যাটিং ঈশ্বর হয়েছেন, আরেকজন কম বয়সে ২টা ডাবল সেঞ্চুরি করে ডিসিপ্লিন্ড থাকতে পারেননি বলে পথ হারিয়েছেন। আমাদের নাফিস ইকবাল, আশরাফুল, আফতাব, অলক- চারজনেই সৃষ্টিকর্তাপ্রদত্ত প্রতিভা নিয়ে এসেছিলেন! আশরাফুল মাঝে মাঝে জ্বলে উঠে অন্ধকারের পথে পা দিয়েছেন; বাকীরা পারেননি কিছু করতে। এটা তাঁদের নিজস্ব গাফিলতি আর ব্যর্থতা!
 
পরবর্তীতে কী করতে পারবেন, কতটুকু নিজেকে ধরে রাখতে পারবেন সেটা ভবিষ্যতের ব্যাপার, নিজের পরিশ্রম আর কন্ট্রোলের ব্যাপার!
 
কিছুটা ব্র্যাগ মনে হতে পারে তবে লিটন দাসকে যখন প্রথম দেখি তাঁর কয়েকটা শট দেখেই তাঁর প্রতি মুগ্ধতা এসে পড়ে। একজন ব্যাটসম্যানের টাইমিং, কব্জির মোড়, আর স্টাইল দেখে 'এম এস ধোনি' সিনেমার ওই ডায়লগের মতো ব্যাটসম্যানের পটেনশিয়াল কিছুটা হলেও বুঝা যায়। ক্রিকেটের সবচেয়ে কঠিন শট হিসেবে ধরা হয় ফাস্ট বোলারের বিরূদ্ধে করা অন ড্রাইভকে। তিনি যেভাবে অবলীলায় ডেল স্টেইনকে অন ড্রাইভের চার মেরেছিলেন তাতে তাঁর প্রতিভা সম্পর্কে ধারণা পেয়েছিলাম। স্পিনারের বলে যেভাবে শুধুমাত্র কব্জির জোড়ে মিড উইকেট আর কাউ কর্নারে তিনি বল পাঠাতে পারেন, তাতে তার ক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। কব্জি আর টাইমিংয়ের জোরে যে সুন্দরতম ব্যাটিংয়ের জন্য মার্ক ওয়াহকে শৈল্পিক ব্যাটিংয়ের শেষ কথা মানা হয়, তাঁর কিছুটা ছোঁয়া দেখেছিলাম লিটনের ব্যাটিংয়ে! টাইমিং, ক্লাসের সব যোগ্যতা নিয়েই তিনি ক্রিকেটে এসেছেন। এমন না যে হুট করে চলে এসেছেন; ফার্স্ট ক্লাসে রানের বন্যা বইয়ে দিয়ে এসেছেন। আমাদের ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটের সাথে টেস্ট ক্রিকেটের পার্থক্যটা কয়েক ক্রোশ! সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। তবু একেবারে কোন কারণ ছাড়া তো তিনি জাতীয় দলে আসেননি।
 
আমরা সমালোচনা করার সময় খুব তাড়াতাড়ি অসহিষ্ণু হয়ে যাই। এই টেস্টের আগে লিটন মাত্র ৬ টেস্টে ৯ ইনিংস খেলেছেন!! এর মধ্যে ২টা হাফ সেঞ্চুরি। দুইটাই কঠিন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে; একটা ৪৪! বাংলাদেশের বিবেচনায় খুব কি খারাপ?? তাঁর অফ স্টাম্পের বাইরের বল জাজ করতে সমস্যা হয়, সত্যি। সেটা নিয়ে কাজ করতে হবে। ফার্স্ট ক্লাস থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ট্রান্সফর্মেশনের জন্য টেম্পারামেন্ট নিয়েও কাজ করতে হবে! ৯৪ এ থেকে ডাউন দ্যা উইকেটে এসে মাথা খারাপ করা তার পরিচয় দেয়। তবু মাত্র ১১ ইনিংসে ৩ ফিফটির পরেও "লিটনের প্রতিভা দেখার জন্য আর কত অপেক্ষা করব", অথবা তাঁকে "স্যার" বলাটা কিছুটা অজ্ঞতার পরিচায়ক। প্রথম ১৫ ইনিংসে মুশফিকের গড় ছিল ১১.৬, মাত্র ১টা ফিফটি! ইনিংসগুলোতে রানের লিস্ট দেখে তাঁকে একেবারেই লোয়ার অর্ডার ব্যাটসম্যান মনে হতো! কিন্তু মুশির টেকনিক, প্রতিভা, পরিশ্রম নিয়ে কারও মনে কোন সন্দেহ ছিল না! এজন্যে তাঁর পিছনে ইনভেস্ট করা গেছে। লিটন হয়তো সফল হবেন, হয়তো ব্যর্থ! কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি তাঁর জন্য সমালোচনার ঝাঁপি খুলে বসা অবিবেচকের কাজ।
 
প্রতিভা আর সম্ভাবনার কথা বলছিলাম। অনুর্ধ্ব১৯ দলে এবং পরবর্তীতে বেশ কিছু ইনিংসে মেহেদী হাসান মিরাজকে দেখে তা ব্যাটিংয়ের সম্ভাবনা বেশ ভালো বোঝা গেছে। কয়েকটা টেস্টে কয়েকজন কমেন্টেটরতো তাঁর একেকটা ড্রাইভ দেখে ইতিহাস শ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যানদের কথা মনে করেছেন!! তবে প্রতিভা থাকলেই হয় না, পরিশ্রম করতে হয়, সময় দিতে হয়। ব্যাটিং অল রাউন্ডার থেকে বোলিং অল রাউন্ডার হয়ে ওঠা মিরাজের ক্ষেত্রেও সম্ভবত তা-ই ঘটছে। তাঁকে হয়তো নেটে ব্যাটিংয়ে আরও মনোযোগ দিতে হবে। আবার টেম্পারামেন্ট, ম্যাচিউরিটির দিক থেকে মোসাদ্দেক প্রচণ্ড পরিণত।
 
পঞ্চপাণ্ডব অবসর নিলে দলের কী হবে সেটা নিয়ে আমরা অনেক শংকিত থাকি! ওপেনিং অথবা বোলিং ডিপার্টমেন্ট নিয়ে আসলে শংকার অনেক জায়গা আছে। সেটা অবশ্য এখনই আছে।
 
তবে নিজেদের মাথা ঠিক রেখে পরিশ্রম করলে, আর সঠিক গাইড পেলে বাংলাদেশ দলের ভবিষ্যত মিডল অর্ডারে মুমিনুল হক, লিটন দাস, মোসাদ্দেক হোসেন, মেহেদী হাসান মিরাজে আমি কোন শংকা দেখি না।das