রাশিয়ার রাত-দিন ০১
পোস্টটি ৮৩২৮ বার পঠিত হয়েছেঈদের পরের মৃতপ্রায় মনোরম ঢাকার ইস্টার্ন প্লাজার সামনে ঝুড়ি বিন্যাস্ত করে বসে থাকা মাঝারি উঁচু গাছটার গায়ে ছাপ্পড় মারা আকাশী-সাদা, আরেকটু এগিয়ে টং দোকানে চা খেতে চাই তো চারফুটের এক ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত গায়ে জার্সি ও মুখে উদ্বেগ নিয়ে হাঁটাহাঁটি করে। আর্জেন্টিনা দ্বিতীয় খেলায় জিততে পারবে তো? ঈদের বেড়ানো মাটি করে কাজে যোগ দেবার চিন্তায় ফিরে আসা কর্মব্যস্ত অফিস-বাবুটি পর্যন্ত ভাবিত, রোনালদো শালা ওদিকে চার গোল করে ফেললো, আগের ম্যাচে পেনাল্টি মিস করা মেসি এখন কী করবে?
কার্যত কাউকেই কিছু করতে হলো না। চিলিকে কনফেড কাপের শিরোপা এনে দেয়া মাস্টার ট্যাকটিশিয়ান সাম্পাওলি ফর্মেশন রাখলেন ৩-৪-৩। ব্যাপারটায় মেসির খুবই রাগ হলো, রাগের চোটে বলতে গেলে ফার্স্ট হাফে সে বলের আশেপাশেই গেলো না। টিভি কী লাইভ স্ট্রিমিং-এর সামনে বসে রাতজাগা ঢাকার তখন দুইটি ভাগ। টেন স্পোর্টসের সামনে বসা মূলত কুঁচুটে ব্রাজিল অথবা গুটিকয়েক পাকনা পর্তুগীজ সমর্থকেরা মুখ্য খোলবার চেষ্টায় আড়মোড়া ভাঙছে, আর সেকেন্ড কয়েক এগিয়ে থাকা মাছরাঙা টিভির সামনে তখন ঝিনুক হয়ে নীরবে সয়ে যায় আর্জেন্টিনা সমর্থকেরা।
এই সাম্যবস্থা দূর করতে এগিয়ে আসে আর্জেন্টিনার গোলরক্ষক উইলি কাবায়েরো। দূর থেকে হঠাৎ করে হুল ফোটায় লুকা মদ্রিচের ডান পা, অফসাইড অফসাইড ডাকের মিথ্যাবাদী রাখালের ভূমিকায় নেমে ইভান রাকিটিচকে শেষ গোলটি করতে দিয়ে মহানুভব আর্জেন্টিনা ডিফেন্স তাদের শেষ কাজটাও সেরে নেয়। যেমন ইচ্ছে লেখার সাম্পাওলি’র কবিতার খাতায় উদ্ভট সব বদলি নামানোতেও খেলায় কোনো ছাপ পড়ে না।
আকাশী-সাদার জার্সির এক কিশোরের কাঁদতে থাকা মুখকে যখন টিভি পর্দায় নিজের বুকে আশ্রয় দিচ্ছেন কোনো পিতা, সু ও স্বল্প- উভয় শিক্ষায় ভরপুর বাংলার অনলাইনের তখন উত্তেজনা আরেকটু বেশি। সমর্থকদের মাঝে কোপাকুপি না হলেও এখানে অসির চাইতে মসী বড়, কিন্তু মেসি বেশ ছোট। এগারোজনের বাইরে বেচারাকে এখন আরো দুজনের সামনে দাঁড়াতে হচ্ছে। একজন দিয়েগো ম্যারাডোনা, অন্যজন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। চিরকালের অন্তর্মুখী এবং ক্লাব চত্বর বার্সেলোনার বাইরে খেলা না পারা লিওনেল মেসির সামনে দাঁড়িয়ে প্রজ্ঞার দাপটে এবং ক্ষমাশীলতার ভারে জনতার কণ্ঠ রুদ্ধ। ‘যে পারে- সে একাই পারে!’ অথবা ‘অমুক হালায় গতবার যা বলেছিলো, ভুলি নাই...’
রাতটি কাটার পর অবশ্য সকালে ঢাকা বেশ শুনশান। লোকে বাড়ি ফিরবে ফিরবে করছে, এখনো ফেরে নাই। ব্রাজিলের পতাকা হালকা রোদে এখনো ঘোরাফেরা করলেও সমর্থকেরা বেশ তটস্থ হয়ে আছে। বড় দলগুলো যেভাবে মারা খেয়ে যাচ্ছে-আজ বিকালে কোস্টারিকার সাথে জেতার আগে আর্জেন্টিনাকে পচানোটা ঠিক হবে না। নাহ, জুমার নামাজে মোনাজাতটা আজ একটু লম্বা করা দরকার।
খেলা শুরু আগে তাই অনলাইনও বেশ শান্ত। মাঝে মাঝে দূর থেকে মিহি করে ‘জীবনে-মরণে আর্জেন্টিনা’ জাতীয় আত্নপ্রচার ভেসে আসলেও লোকে তাতে পাত্তা দেয় না। মেসির চেয়ে দৃষ্টি আজ নেইমারের ওপর বেশি। তবে নেইমারের ওপর চাপটা একটু কম। সেভেন-আপ কৌতুকের গ্যাস বেরিয়ে গেছে, ফুলটোক্কায় পড়ে যাওয়ায় নেইমার আজকাল ক্ষোভের নয়, হাসির পাত্র। বিস্ময় নয়, অনেকের কাছেই সে এখন বিরক্তি-বালক।
ঝিম ধরা দুপুরের পর তাই খেলা শুরু হয়ে যায়, টিভি সেটের সামনে তখন চিপস আর সেলেসাও সমর্থকদের উদ্বেগ। কিন্তু দলের আজ এ কী দশা! বড় ছেলে নেইমার আজও গতদিনের মতোই যখন ইচ্ছা মূর্ছা যাচ্ছে, উইলিয়ান মনে হয় ভোর রাতে সেহরির পরে আর কিছু খায়নি। ওদিকে কোস্টারিকার গুণ্ডাগুলোও খেলায় এক বিন্দু ছাড় দিচ্ছে না! এইভাবে খেলা দেখা যায়, অ্যাঁ?
হাফটাইমে সমর্থকেরা সিগারেট আর তিতে’র ব্রাজিল কড়া করে এককাপ চা খেয়ে আসার পর অবশ্য খেলায় একটু গতি এলো। উইলিয়ানকে কানে ধরে বসিয়ে দিয়ে ডগলাস কস্তাকে নামিয়ে দেয়ায় ব্রাজিলের আক্রমণের গতি বেড়েছে, তবে গোলটা আসছে না। শিল্প নগরীতে প্যারিসে গিয়ে নেইমার বেশ অভিনয় মারাচ্ছে, একবার পেনাল্টি দিয়েও ছোকরার অতি-অভিনয়ে বিরক্ত হয়ে রেফারি তা কেড়ে নিলো। ধ্বসে পড়া আর্জেন্টিনা দলের মনোবলের সমালোচনার সাথে ছুটিতে গিয়ে চিল করা মাউরো ইকার্দির ছবির পাশে যখন ‘আগেই জানতাম নেইমার একটা...’ জাতীয় পোস্ট দেখা দিচ্ছে অল্পস্বল্প, তখনই ব্রাজিলের শেষ রক্ষা হলো। নাভাসের পায়ের তলায় বল গলিয়ে দিলেন কুতিনহো, এবং শেষ দৃশ্যে ডগলাস কস্তার বাড়িয়ে দেয়া পা ছুইঁয়ে গোল করে শাবানার মতো কেঁদে দিলেন নেইমার।
চা খেতে নিচে নামলে এবার হিজাবের চাইতেও বেশি চোখে পড়ে হলুদ জার্সি। বেশ কয়েকজন আগেই জানতো যে ব্রাজিলকে আজকে আটকানো যাবে না। দ্বিতীয়ার্ধে সেলেসাও’রা যে পুরো সাম্বা নাচিয়েছে- এই রকম কথার পাশে ‘বড় দলের সাথে এভাবে খেললে হেরেও যেতে পারে’ মতবাদ এখন পাত্তা পায় না।
ব্রাজিল সমর্থকদের উত্তেজনা নিয়েই দিনটা শেষ হতে পারতো, কিন্তু বিষয়টা পূর্ণতা পায় না ভলগোগ্রাদের কথাটা না বললে। মুসলিম উম্মাহের প্রতিনিধি আহমেদ মুসার জোড়া গোলে নর্ডিক জলদস্যুদের জালে একাধিকবার বল ঢুকে গেলে আবহমান বাংলার জন স্নো’রা আরো একবার শ্বাস নেয়ার জন্য উঠে বসে। শেষ রাউন্ডে এই নাইজেরিয়াকে হারাতে পারলেই তো হয়, মেসির জন্য এটা আর এমন কী! আকাশী-সাদা জার্সির মোশাররফ করিমরা এখন বেশ আত্মবিশ্বাসী হয়ে পালটা আক্রমণে যাচ্ছে, আরে তোরা তো সাত গোল খেয়েছিলি, আমরা চেষ্টা করেও তিনটার বেশি নিতে পারি নাই!
সিনপ্লেক্সে চলছে পোড়ামন, কোথায় যেন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন হচ্ছে, গাছ কেটে সাফ করে ফেললো রোহিঙ্গারা। বাবর রোডের মুখে তখনো নির্বিঘ্নে শোভা পায় আর্জেন্টিনার পতাকা, জনৈক রনি আর আসাদের সৌজন্যে মৌচাকের সামনে ব্রাজিল ওড়ে বেঢপ আয়তনে। মানুষ নিকটে গেলে এসব পতাকা উড়ে যায়।
দৃষ্টিসীমায় অবশ্য কেবল পতাকাই স্পষ্ট। হায় হাসি, হায় দেবদারু- পেনাল্টি মিস করার পর গিলফি সিগুর্ডসনের কাঁধে উইলিয়াম ইকোং’এর সহানুভূতির হাতটা ঠিক নজরে পড়ে না।
- 0 মন্তব্য