বিশ্বকাপ ডায়েরী : বি-শ্ব-কা-প! কী বিশাল ব্যাপার!
পোস্টটি ৬৫০৭ বার পঠিত হয়েছে১.
ফুটবল, খেলাটা ভারী অদ্ভুত। কিছুতেই সুবোধ বালকটি হয়ে থাকতে দেবে না! ভদ্রতার এপিঠ-ওপিঠ ছ্যাড়াবেড়া করে দেবে একদম। হয়তো খুব বিনয়ী হয়ে সোফায় বসে খেলা দেখছেন, অথবা কেতাদুরস্ত ভঙিমায় বসে আছেন অফিসে, কিংবা বেড়াতে গেছেন কোথাও- চারপাশে অপরিচিতরা ঘিরে আছে, চাইলেও হুল্লোড় করার উপায় নেই। চেঁচামেচি, চিৎকার এসবে শালীনতার নিষেধাজ্ঞা আছে, তাই সীমা অতিক্রম করা যাবে না কিছুতেই। তারপরও ফুটবল আপনার এমন অবস্থা করে ছাড়বে যে, হঠাৎ আবিষ্কার করবেন অজান্তেই কখন যেন হট্টগোলের আসন অলংকৃত করছেন আপনি!
একটা গোল মিস হলো কি হলো না, মুখ-চোখ খিঁচিয়ে অশ্রাব্য কিছু শব্দ বা শব্দগুচ্ছ হড়হড় করে বেরিয়ে গেল আপনাতেই... আশেপাশে কে আছে কে নেই, সেই জ্ঞান লোপ পেয়েছে কবেই। মাঠে যারা খেলছেন তাঁরা তো ওই গোলকটি নিয়ে হুড়োহুড়ি করছেনই, যাঁরা দেখছেন তাদেরও হুশ-জ্ঞান সব কোথায় যেন বিলোপ হয়ে যায়। মুখ দিয়ে ছুটে কথার তুবড়ি আর মাঝে মাঝে পায়ের স্বয়ংক্রিয় নড়াচড়া তো আছেই। শান্ত, সুবোধ, পরিপাটি হয়ে যে ‘ভদ্দরনোক’ সেজে কেবল হাততালি আর বাহবা দেবেন, সে উপায় নেই এখানে।
এখানে শ্লীল-অশ্লীল, ভব্যতা-সভ্যতা, আদব-শিষ্টাচার বা শালীন-অশালীনের যে বালাই নেই তা নয় কিন্তু! এখানে সেসবও আছে। তবে খেলাটার মাত্রা, পরিধি আর ব্যাপকতা এমন যে, কিছুতেই সুস্থির হয়ে থাকার জো নেই। হৈ চৈ, হল্লাহাটি, চিল্লাফাল্লার সাথে উত্তেজনা আর উন্মাদনা মিলেমিশে এক অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতিতে উন্মাতাল করে তুলবেই।
২.
ফরহাজ, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু। ফুটবল নিয়ে অতিমাত্রায় ফ্যানাটিক। প্রিয় দলের খেলার দিন খানিক ঘোরে চলে যেত। এখনও যায়। জার্মানী নিয়ে যে পরিমাণ টেনশান হয় তার, অত টেনশান বোধহয় প্রেমিকার জন্যেও সে করে না। ওর জার্মানী আছে খাদের কিনারে, একটু এদিক-সেদিক হলেই তলিয়ে যাবে অতলে, উস্কুখুস্কু চুলগুলো নিশ্চয় আরো উস্কুখুস্কু হয়ে গেছে!
শওকতের সঙ্গে বন্ধুত্ব আরো আগের। এক সময় খুব যোগাযোগ ছিল, আজকাল হয় না তেমন একটা। বছর পাঁচেক আগে যখন দু’জনের পথ দুই দিকে বেঁকে গেল, তারপরও সপ্তাহান্তে প্যারেডে বসতাম, আড্ডা জমত। মাঝে মধ্যে ভাবি, মান্না দে’র মতো গাইলে মন্দ হয় না- ‘কোথায় হারিয়ে গেল সোনালী বিকেলগুলো, সেই... আজ আর নেই...’
ম্যারাডোনার জন্যেই সে যেভাবে আবেগে থরথর করে কেঁপে উঠে, স্বচক্ষে দৌঁড়ুতে দেখা মেসির জন্য তাহলে কত্ত আবেগ বুকে ধারণ করবে? আর্জেন্টিনার বিদায় নিশ্চিত হোক না-হোক, সে পরম আনন্দে টিভি সেটের সামনে বসবেই। আর্জেন্টিনার জন্য গলা ফাটাবেই। প্রতিপক্ষের পালটা খোঁচাগুলো নীরবে হজম না করে, পালটা আক্রমণ করবেই। শওকত বিয়ে করেনি। তবে যেদিন বিয়ে করবে সেদিন রাত জাগবে কি-না ঠিক জানি না, কিন্তু নিশ্চিত জানি, আর্জেন্টাইন ফুটবল ইতিহাসের জঘণ্যতম দলটির বীভৎস খেলা যদি থাকে, তাহলে সে রাত জাগবেই।
৩.
বিশ্বকাপ! কী বিশাল ব্যাপার! কত্ত আনন্দ-বেদনা, পাগলামির সাক্ষী হওয়ার সুযোগ করে দেয়। গুরুগম্ভীর ও প্রচন্ড ব্যক্তিত্ববান মানুষটিও নিজেকে হারিয়ে শিশুতোষ আনন্দে মেতে উঠেন। নীল নদ আর পিরামিডের দেশ মিশরের একজন মোহাম্মদ সালাহ আছেন, যিনি লিভারপুল জয় করে, জিতে নিয়েছেন সারা বিশ্বের ফুটবল হৃদয়গুলোও, সেই তাঁর খেলা দেখবেন বলে রাত জাগেন কোনো এক সন্তান-সম্ভবা বাংলাদেশী বধু! জার্মানীর বাঁচা-মরা লড়াই দেখবেন বলে সময়ের আগেই খানিক ঘুমিয়ে নেন প্রায় উনষাট-ছোঁয়া কোনো এক সরকারী চাকুরীজীবি! নিশ্চিন্তে খেলা দেখার জন্য কোথাও কেনা হয় ৩২ হাজার টাকায় প্রজেক্টর, নিরবচ্ছিন ফুটবল নিশ্চিতে ব্যবস্থা হয় জেনারেটরও। বিশ্বকাপ ব্যাপারটাই আসলে অন্যরকম।
হাতে গোণা ক’টি দলের কেবল লড়াই তো নয়, লাখো-কোটি মানুষের শত-হাজার কোটি আবেগ-অনুভূতিও যে মিশে থাকে এখানে!
৪.
একজন বাংলাদেশী ভদ্রলোক মস্কোর পথে ছুটছেন হন্য হয়ে। তা দেখে ছুটে এলেন আরেকজন পরিচিত। তিনিও বাংলাদেশী। ‘ভাই, এমন হন্তদন্ত হয়ে ছুটছেন কোথায়?’ কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করেন পরিচিত ভদ্রলোক। ছুটন্ত ভদ্রলোকের ক্ষণকাল তিষ্ঠানোর সময় নেই। ছুটতে ছুটতেই জবাব দিলেন, ‘লিও-কে দেখতে যাই ভাই।’
‘কি বললেন? লিও? কোথায় সে? চলুন, আমিও দেখবো!’ ছুটতে ছুটতে চলে আসেন পরিচিত ভদ্রলোক। এবার ছুটন্ত ভদ্রলোকের অবাক হওয়ার পালা। হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়েন তিনি। ‘আপনি সত্যিই লিও টলস্টয়ের স্ট্যাচুটা দেখতে যাবেন? আপনার না এই বিশ্বকাপের রুশ-উন্মাদনা নিয়ে একটা স্টোরি করার কথা!’
‘কি? ওহ! টলস্টয়! আচ্ছা, যান। আপনি দেখে আসুন। আমি হাতের কাজটা সেরে পরে যাবো খন!’ বলেই আর দাঁড়ান না পরিচিত ভদ্রলোক।
লিও মেসি। লিও টলস্টয়।
লিও-তে গুলিয়ে যায়। আকাঙ্খা জাগে, আকাঙ্খা হারায়। সবই এই বিশ্বকাপ উন্মাদনার ফল।
৫.
বি-শ্ব-কা-প!
এটা একটা জ্বর, ভয়াবহ জ্বর, আর ভীষণ ছোঁয়াচে।
রুশ-সাহিত্য কি আর কম সমৃদ্ধ করেছে বিশ্বসাহিত্যের সুবিশাল ভান্ডার! গোর্কি, টলস্টয়, দস্তয়ভস্কি, পুশকিন, চেখভ... কত কত নাম! অথচ কি আশ্চর্য্য দেখুন, সেই রাশিয়ায় গিয়ে গোঁড়া সাহিত্যিকেরও কোনো রুশ-লেখকের সন্ধান করার কথা বুঝি মনেই পড়ে না। তার চেয়ে রোনালদো, মেসি, সালাহ, চেরিশেভ, নেইমার, কেইন, লুকাকুদের তাড়া করার তাড়নাই বুঝি বেশী কাজ করে!
ওই যে বিশ্বকাপ জ্বর!
টলস্টয়রা কোথাও যাচ্ছেন না আর। তাঁরা যেখানে আছেন, থাকছেন সেখানে। তাদেরকে দু’দিন আগে আর পরে ধরা যাবে ঠিকই। যেমনটা ভেবেছেন আমাদের উপরের পরিচিত ভদ্রলোক। কিন্তু ফুটবল মাঠের শিল্পীরা যে ছুটছেন প্রতিনিয়ত। কেইন তো একছুটে পাঁচে পৌঁছে গেলেন, লুকাকুরা তার জবাব কী দেবেন সেটা যে মিস করা যাবে না কিছুতেই।
৬.
সুইডেনের তৃতীয় (প্রথম দুটো বিঁধেছে ইতালি ও নেদারল্যান্ডসকে) সুঁই-টা কি তবে জার্মানীকেই বিঁধবে? আর্জেন্টিনার স্বপ্নভঙ্গ কি নাইজেরিয়াতেই? ব্রাজিলের গোছানো সংসার তছনছ হবে না তো? জাপান-সেনেগালের মধ্যে কোন আনন্দদায়ী দলটা যাবে পরের পর্বে? বেলজিয়াম-ইংল্যান্ড কি সারপ্রাইজ নিয়ে অপেক্ষায়? স্পেন-পর্তুগাল ঠিকঠাক আছে কি?
কত প্রশ্ন, কত জিজ্ঞাসা, কত সংশয়, কত শংকা, নানান অশনি ডঙ্কাও বুঝি শোনেন কেউ কেউ। দোলাচলের দুলুনিতে দুলছে হাজারো স্বপ্ন, আশা-আকাঙ্খা আর প্রত্যাশা।
এটা যে বি-শ্ব-কা-প! আর বিশ্বকাপ মানেই বিশাল এক মহাযজ্ঞ, বিরাট ব্যাপার।
- 0 মন্তব্য