ভিরাটের বিরাটত্ব
পোস্টটি ৬৬৬৭ বার পঠিত হয়েছে“আমরা অবশ্যই বিশ্বাস করি যে, ২-০ থেকে নিশ্চয় ৩-২ সম্ভব। যদি আমরা তা বিশ্বাস না করতাম, তাহলে ২-০ থেকে ২-১ করাটাই তো সম্ভব হতো না।”
এই ‘বিশ্বাস’ শব্দটাই তাঁর মূল শক্তি। পৃথিবী যা-ই বলুক, অবস্থা যেমনই হোক, প্রতিপক্ষ কিংবা পরিবেশ পরিস্থিতি যত কঠিনতরই হোক না কেন, তাঁর বিশ্বাসটাই তাঁর মূল চালিকাশক্তি। তিনি বিশ্বাস করেন নিজেকে, বিশ্বাস রাখেন স্ব-সক্ষমতায়, আস্থা রাখেন সতীর্থ ও বন্ধুত্বে- এবং সবশেষে তাঁর বদ্বমূল বিশ্বাস যে, ফলাফল তাঁর পক্ষেই আসবে। আসতেই হবে। কারণ, তিনি জানেন- পরিশ্রম ও নিবেদনে তিনি ঘাটতি রাখেননি। সর্বস্ব উজার করে দিয়েছেন, সতীর্থদের থেকে সবটা নিংড়ে নিয়েছেন, তারপরও যদি ফলাফল তাঁর হয়ে না-হাসে, তাহলেও তিনি বিশ্বাস হারান না। এবার হয়নি তো কি হয়েছে, পরেরবার হবে নিশ্চয়!
তাঁর ঐ ‘বিরাট’ উচ্চতায় আরোহণের মূলে তো এই বিশ্বাসই।
****
ইদানীং স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের সঙ্গে খুব তুলনা হচ্ছে তাঁর। সেই একই রকম নিবেদন, সেই একই রকম রান-ক্ষুধা, সেই একই রকম একাগ্রতা, ঠিক যেনো স্যার ডনের মতো করে ক্লান্তিহীন গতিতে রান করে যাওয়া আর ক্রিকেটানন্দের মহা-উচ্ছ্বাসে উচ্ছ্বসিত হওয়া। বিগত দুই বছর ধরেই সহস্রাধিক টেস্ট রান করেছেন তিনি, টানা তৃতীয়বার হওয়ার পথে ইতিমধ্যেই রান-সংখ্যা সাত’শ পেরিয়ে গেছে তাঁর। এ বছরের সবচেয়ে বেশী রান ও সেঞ্চুরীও তাঁর। তবে টানা চার বছর সহস্রাধিক টেস্ট রানের এই কীর্তি আগেই করে রেখেছেন তাঁর সমসায়িক ব্যাটিং-প্রতিদ্বন্ধি স্টীভ স্মিথ। নিষেধাজ্ঞা না পেলে যে স্মিথ, তাঁর অজি-অগ্রজ ম্যাথু হেইডেনকে ধাওয়া করতেন না, তা কে বলতে পারে! হেইডেন যে ২০০১ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত এই কীর্তি টানা করে গেছেন!
সে যাই হোক, আমরা ফিরি স্যার ডন ব্র্যাডম্যান ও ভিরাট কোহলির আলোচনায়।
যে বিশ্বাসটা নিজে লালন করছেন, যে বিশ্বাস সতীর্থদের শিরায়-উপশিরায় ছড়িয়ে দিচ্ছেন, যে বিশ্বাস সকাল-সন্ধ্যে জপে যাচ্ছেন কান থেকে কানে, বলে যাচ্ছেন মাইক্রোফোনে... সেই ২-০ থেকে ৩-২ করার প্রথম ও এখন পর্যন্ত একমাত্র কীর্তির নেতৃত্বে ছিলেন স্যার ডন ব্র্যাডম্যানই।
মেলবোর্ন টেস্টের সেই অভিনব ব্যাটিং লাইন আপের কথা ক্রিকেটের শিষ্য মাত্রই জানেন। যে টেস্টে শুধু ব্যাটিং দক্ষতা নয়, স্যার ডন রেখেছিলেন তাঁর সুনিপুণ নেতৃত্বের উৎকৃষ্ট প্রদর্শনও। পরের এডিলেইড টেস্টেও দ্বিশতক পেয়েছিলেন ব্র্যাডম্যান। সিরিজ নির্ধারণী শেষ টেস্টেও সেঞ্চুরী ছিল তাঁর। পুরো সিরিজে ৯০ গড়ে ৮১০ রান ছিল তাঁর।
জয়ী দল | রান মার্জিন | সিরিজ ও সময় |
অস্ট্রেলিয়া | ৩৮২ | অ্যাশেজ, ১৮৯৪-৯৫ |
অস্ট্রেলিয়া | ৩৬৫ | অ্যাশেজ, ১৯৩৬-৩৭ |
ভারত | ২২২ | ভারত বনাম অস্ট্রেলিয়া, ১৯৭৭-৭৮ |
অস্ট্রেলিয়া | ২১৬ | অ্যাশেজ, ১৯০৩-০৪ |
ভারত | ২০৩ | ভারত বনাম ইংল্যান্ড, ২০১৮ |
*রানের ব্যবধানে সবচেয়ে বড় জয়, সিরিজে ২-০ তে পিছিয়ে থেকে তৃতীয় টেস্টের প্রতিদ্বন্ধিতায়। চার বা ততোধিক টেস্ট ম্যাচের সিরিজ।
ভিরাট কোহলি এখন পর্যন্ত ৭৩ গড়ে ৪৪০ রান করেছেন। সাউদাম্পটন ও লন্ডন বেড়িয়ে সপ্তাহ-দুয়েক বাদেই জানা যাবে, ‘ভিরাটের ভারত’ স্যার ডনের অস্ট্রেলিয়ার মতো কোনো ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারলো কি না! অবশ্য ২-০ তে পিছিয়ে থেকে তৃতীয় টেস্টের ২০৩ রানের জয়ে, একটা ইতিহাস হয়েছে ইতিমধ্যেই। ২-০ তে পিছিয়ে থাকা অবস্থা থেকে তৃতীয় টেস্টে ঘুরে দাঁড়ানোর তালিকায় এটি পঞ্চম স্থানে। এই তালিকার দ্বিতীয় স্থানে আছে স্যার ডনের ঐ অস্ট্রেলিয়াও।
****
এন্ডারসন-কোহলি চিত্তাকর্ষক এক লড়াই, এই আধুনিক ক্রিকেটে। বহুদিন পর ক্রিকেটে সেই ‘সময়ের সেরা ব্যাটসম্যান বনাম সময়ের সেরা বোলার’ প্রতিদ্বন্ধিতাটা ফিরে এসেছে। গত বিলেত সফরে কোহলি নিদারুণ ব্যর্থ হলেও, এবার চমৎকার জবাব দিচ্ছেন। গত তিন টেস্টে ছয়বার সুযোগ পেয়েও এন্ডারসন তাঁকে একবারও আউট করতে পারেননি। বহুবার সুযোগ সৃষ্টি করলেও, ভিরাট বরাবরই বেঁচে গেছেন।
এজবাস্টনে ভিরাটের সেই অসাধারণ ১৪৯ রানের মহাকাব্যেও ছিল ভাগ্যের ছোঁয়া। যেই ইনিংসের পর ইয়ান চ্যাপেল ১৯৩৮ সালের ট্রেন্ট ব্রিজ টেস্টে স্ট্যানলি ম্যাককেবের মহাকাব্যিক সেই দ্বিশতকের কথা তুলে এনেছিলেন। ম্যাককেবের ইনিংসটি চলাকালীন সময়ে হঠাৎ স্যার ডন ব্র্যাডম্যান সকল সতীর্থদের ডেকে ব্যলকনিতে এনে বলেছিলেন- “দেখো, মন ভরে দেখে নাও। আর কখনো এমন মহাকাব্য দেখার সুযোগ পাবে না!”
হ্যাঁ, সৌভাগ্যের সুবাস থাকলেও, সেই ইনিংসে কালিমা নেই এতটুকু। ঐ যে বিশ্বাসের কথা বলেছিলাম- নিজের সামর্থ্যে অগাধ বিশ্বাস, লক্ষ্যের দিকে একাগ্রতা আর খেলাটার প্রতি নিবেদন থাকলে একজন ক্রিকেটার কী হতে পারেন বা করতে পারেন, জানতে চাইলে- ভিরাট কোহলিকে দেখতে পারেন। তাঁর দলে আরো দশজন ক্রিকেটার ছিলেন, ব্যাটসম্যানও ছিলেন বেশ ক’জন, তাঁরাও সেই সৌভাগ্যের সুবাস পেয়েছিলেন, কিন্তু সেই সুবাসকে নিজের পক্ষে আনতে পারেননি। যা ভিরাট পেরেছেন। তাঁর ‘বিরাটত্ব’ এখানেই। তিনি প্রতিকূল পরিবেশে ভাগ্যকে বশে এনে নিজের হয়ে কথা বলাতে জানেন। জানেন, সময়কে পক্ষে আনার মন্ত্রও।
****
সময়টা খুব কঠিন। বছরের শুরুর দিকে দক্ষিন আফ্রিকা সফর করেছেন, ২-১ এ হেরেছেন। বিলেতি গ্রীষ্মে এসে পিছিয়ে পড়েছিলেন ২-০ তেই। সম্ভাবনার নিক্তিতে তাঁর দিকে পাল্লা না ঝুঁকলেও, ঐ যে বদ্ধমূল বিশ্বাস, সেই বিশ্বাসটার জোরেই লড়াই করছেন, হয়তো করবেন সাউদাম্পটন হয়ে লন্ডন পর্যন্ত!
আবার বছরান্তে যাবেন অস্ট্রেলিয়ান-গ্রীষ্ম উপভোগ করতে। অবশ্য বিলেতি গ্রীষ্মও উপভোগ করার কথা বলে দেশ ছেড়েছিলেন, কিন্তু তিনি উপভোগ করলেও সতীর্থদের যে উপভোগ্য হয়ে উঠছে না সময়টা! অস্ট্রেলিয়ার সময়টা কেমন যাবে কে জানে!
ভারত অস্ট্রেলিয়ার মাটি থেকে কখনোই সিরিজ জিতে ফেরেনি, ফেরেনি দক্ষিন আফ্রিকা থেকেও। দক্ষিন আফ্রিকা তাঁরও অজেয় থেকে গেছে, ব্যাটে ইংলিশ-কন্ডিশন আপাত-জয় হলেও, নেতৃত্বের জয় এখনও দূরের বাতিঘর। তবুও বিশ্বাসের দেয়ালটাতে হতাশার আঁচড় কাটতে না দিয়ে, আশা-টা এখনো জিঁইয়ে রেখেছেন তিনিই। দেখা যাক, শেষ পর্যন্ত ভিরাট তাঁর ‘বিরাটত্ব’ আরো দেখাতে পারেন কি না!
****
এন্ডারসন-কোহলি প্রতিদ্বন্ধিতার ফলে আরো কিছু ব্যাটসম্যান-বোলার দ্বৈত লড়াই উঠে আসে আলোচনায়। ব্র্যাডম্যান-লারউড, ভিভ রিচার্ডস-ডেনিস লিলি আর টেন্ডুলকার-ওয়ার্ন লড়াইয়ের পর ক্রিকেট মাঠে সবচেয়ে আনন্দদায়ী দ্বৈত লড়াই বলা হচ্ছে এটাকে। দুরন্ত ফর্মের বোলার আর উড়ন্ত ফর্মের ব্যাটসম্যান, দুজন দুজনকে ঘায়েলের সর্বাত্মক চেষ্টা করছেন- ২২ গজে এর চেয়ে চিত্তানন্দের আর কি হতে পারে?
অস্ট্রেলিয়ান গ্রেট ইয়ান চ্যাপেল তাঁর কলামে, অন্য তিন লড়াইয়ের সাথে এটার একটা পার্থক্য টেনেছেন। ব্র্যাডম্যান যে দলে খেলেছেন, সেই সময় অস্ট্রেলিয়ার টপ অর্ডার ছিল অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা। ভিভ রিচার্ডসের ব্যাটিং লাইন আপও ছিল দুর্দান্ত ব্যাটসম্যান দিয়ে ঘেরা, শচীন টেন্ডুলকারও ভরসা করার মতো ব্যাটসম্যান পেয়েছিলেন। কিন্তু এই ক্ষেত্রে ভিরাট তা পাচ্ছেন না। তাঁকে লড়তে হচ্ছে অনেকটা একাই।
ইয়ান চ্যাপেলের কথাটা হুবহু তুলে দিলেই হয়তো পাঠকের বুঝতে সুবিধে হবে।
The difference between Kohli and the three aforementioned batsmen is the supporting cast. Bradman - not that he required it - was surrounded by one of Australia's best ever top-order line-ups. Richards was the star in a glittering West Indies batting order, and Tendulkar for much of his career had a similar pride of place in a strong Indian line-up.
Currently Kohli is fighting a lone hand against a suddenly rampant England attack, and that allows the bowlers the luxury of expending the bulk of their energy in seeking his wicket.
এমন নিঃসঙ্গ অবস্থাতেও ভিরাটের অতিমানবীয় কীর্তির পেছনের মূলমন্ত্র হচ্ছে- বিশ্বাস। তিনি বিশ্বাস করেন, বিশ্বাস রাখেন।
****
চমৎকার একটা পেস বোলিং ইউনিট গড়ে উঠেছে তাঁর নেতৃত্বে। এজবাস্টনে প্রথম টেস্টে সবাই যখন কূলদীপ যাদবের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে কথা বলছিল, সেখানে তিনি নামলেন চার পেসার নিয়ে। পরের টেস্টে কূলদীপ খেললেও, তৃতীয় টেস্টে আবার চার পেসারে ফিরে এসেছেন। ফাস্ট বোলারদের প্রতি তাঁর যে অগাধ বিশ্বাস তা আর লুকোছাপা কিছু নেই। সেজন্যেই হয়তো ফাস্ট বোলাররা তাঁকে দিচ্ছেনও দু’হাত ভরে। গত টেস্টেই যেমন বুমরাহ ও হার্দিক পান্ডিয়া অর্ধেকেরও বেশী ছেঁটে দিলেন। দক্ষিন আফ্রিকা সফরে একমাত্র টেস্ট জয়ও এসেছিল তাঁর পেসারদের কল্যাণে। পেসারদের উপর তাঁর ভরসা ও বিশ্বাস, অনেকটাই উন্মুক্ত একটা ব্যাপার।
৩৭ টেস্টে ২২ জয়। সৌরভ গাঙ্গুলিকে ডিঙিয়ে দ্বিতীয় সফল ভারতীয় অধিনায়ক তিনি। ধোনীকেও টপকে যাওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। তবে তাঁর ৩৭ টেস্টের কোনো একাদশই টানা দ্বিতীয় ম্যাচ খেলেনি। প্রতিপক্ষ নিয়েও কথা হবে। দক্ষিন আফ্রিকা ও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তাদেরই মাঠে একটা করে জয় বাদে, ভিনদেশে অন্য সবগুলো জয়ই তাঁর দলের তুলনায় অনেকাংশেই দূর্বল দলের বিপক্ষে। তাঁর নেতৃত্ব নিয়েও কথা হতে পারে, কিন্তু তাঁর নিবেদন নিয়ে কোনো কথা হবে না। কথা হবে না তাঁর বিশ্বাস ও সামর্থ্য নিয়েও।
দলপতিকে সাহসী ও আত্মবিশ্বাসী হতে হয়। স্বপ্নদ্রষ্টা ও নিবেদিত হতে হয়। ভিরাট কোহলি সাহসীও, আত্মবিশ্বাসীও, স্বপ্নদ্রষ্টাও, নিবেদিতও। এই ভারত দলটা ‘ভিরাটের ভারত’ হয়ে উঠেছে বহু আগেই। দলপতির বিশ্বাস যদি পুরো দল পুরোদমে আত্মস্থ করতে পারে, তাহলে যে কোনো কিছুই হতে পারে।
হ্যাঁ, ভিরাটের বিরাটত্বের বিরাট-স্বরুপ দেখার বিরল সৌভাগ্যও জুটে যেতে পারে আমাদের!
- 0 মন্তব্য